পুলক ঘটক
আমাকে একজন প্রশ্ন করেছেন, “আমার বাবা, মায়ের মৃত্যুর পর ৫ বিঘা জমি দিয়ে গেছে। জমিই আমার সম্বল। তিন বোনের বিয়ে হয়েছে অনেক বড়লোক ঘরে। এখন আপনারা যদি এই আইন পাশ করেন তখন বোনেরা ভাগ চাইতে আসলে কি করবো?”
এই ব্যক্তির যে উদ্বেগ তা অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখে। প্রথমত, উনি বোনদের জমির ভাগ দেওয়ার বিষয়ে মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রস্তুত নন। এটা ওনার ব্যক্তিগত দোষ নয়, এটি লালিত জনমনস্তত্ত্ব। ওনার যদি আরও তিনজন ভাই থাকত তাহলে ওনার একার ভাগে থাকা ৫ বিঘা পৈত্রিক জমি চার ভাইয়ের মধ্যে বন্টন হবে – এ বিষয়টি তিনি জন্মের পর থেকেই মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে যেতেন। মানসিকভাবে তিনি আগে থেকেই প্রস্তুত থাকতেন। আজ হঠাৎ করে হিন্দু আইন পরিবর্তন করার পর তিনি প্রায় ভূমিহীন হয়ে যাবেন –এ বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই তাকে চিন্তাগ্রস্ত করবে। সুতরাং তিনি নারী-পুরুষ সমান অধিকার দিয়ে আইন প্রণয়নে তার সাধ্য অনুযায়ী বাধা দিয়ে যাবেন। মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কায়েমী স্বার্থ কেউ সহজে ছাড়তে চায় না। তার উদ্বেগ নিরসন না করে স্বেচ্ছাচারীভাবে এগোনো যাবে না, এটা উচিতও নয়।
এবার আসি সমাধানের কথায়। ঐ ভদ্রলোকের উদ্বেগ কি আসলেই যৌক্তিক? নতুন আইন হলে তার বোনেরা কি তার ৫ বিঘা জমির উপর ভাগ বসাতে পারবে? না, তারা এটা করতে পারবে না। তার ৫ বিঘা জমি তারই থাকবে।
আপনারা ভাবছেন নতুন আইন পাস হলে আপনাদের সম্পত্তি নতুন করে বাটোয়ারা করতে হবে? এই ধারণা ঠিক নয়। আইনের কার্যকরতা তিন প্রকার হয়।
এক. আইন পাস হওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে তা কার্যকর হওয়া(Immediate effect),
দুই. ভূতাপেক্ষ কার্যকরতা (Retrospective effect), অর্থাৎ আইন পাসের সময়ের পূর্বকাল থেকে কার্যকরতা।
এবং
তিন. ভবিষ্যৎ কার্যকরতা (Prospective effect) । অর্থাৎ আইনটি পাস হওয়ার দুই/তিন বছর পর নির্ধারিত দিন থেকে এর প্রয়োগ শুরু হওয়া।
জমিজমা ও সম্পদের বন্টন সম্পর্কিত বিধানাবলির retrospective effect বা পূর্বকাল থেকে কার্যকরতা হয় না। ভূতাপেক্ষ আইন সবক্ষেত্রেই বিরল। সেটা করতে গেলে ঐ বিশেষ ক্ষেত্রের জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হয়। সুতরাং আইন পাস হলে অতীত কাল থেকে তা কার্যকর হবে– এই চিন্তা অবান্তর। আইন সংসদে পাস হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি যেদিন স্বাক্ষর করবেন এবং সরকারি গেজেটে যেদিন থেকে তা কার্যকর হবে বলে আদেশ জারি হবে, তখন থেকে বলবৎ হবে।
ভারতে সমঅধিকার দিয়ে নতুন হিন্দু আইন প্রণীত হওয়ার পর পূর্বেই বাটোয়ারার ভিত্তিতে নিস্পন্ন হওয়া সম্পত্তিতে নতুন আইনের কোনো প্রভাব পড়েনি। এতে মামলা মোকদ্দমার জটিলতা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি কিছুই হয়নি। আমাদের এখানেও বাটোয়ারা সম্পন্ন হওয়া সম্পত্তিতে নতুন আইন হাত দেবে না। জমি বাটোয়ারা হওয়ার পর অনেকে তাদের সম্পত্তি হয়তো বিক্রিও করে দিয়েছে। সেই জমি হিন্দু বা মুসলমান যে কেউ কিনে থাকতে পারে। এখন আগেই যে জমির বাটোয়ারা নিস্পন্ন হয়ে গেছে নতুন আইনের প্রভাব তার উপর পড়বে কেন? তাহলে তো যারা হিন্দুদের জমি কিনেছে তারাও বিপদে পড়বে।
এগুলো ভুল চিন্তা। নতুন আইন রাষ্ট্রে বলবৎ হওয়ার পর কেউ মারা গেলে তখন তার সম্পত্তির বন্টন নতুন আইনের ভিত্তিতে হবে। নতুন আইন হওয়ার পরেও কেউ যদি মৃত্যুর আগে তার ছেলেদের নামে সম্পত্তি লিখে দিয়ে যেতে চান, তাতেও কিছু করার নেই। কারণ সে অধিকার তার থাকবে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে আইন পাস হওয়ার পর তা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করার পক্ষে নই। আমি প্রসপেক্টিভ আইনের পক্ষে। কারণ জনগণকে বিদ্যমান আইনের ভিত্তিতে বাটোয়ারা সম্পন্ন করার সুযোগ দিয়ে ভবিষ্যতের একটি নিদিষ্ট তারিখ থেকে কার্যকর হলে জটিলতা হবে না। নইলে অনেক ক্ষেত্রে মামলা-মোকদ্দমা তৈরি হতে পারে। এটা করা যাবে না। আমরা সমাজের মঙ্গলের জন্য লড়ছি, জটিলতা সৃষ্টির জন্য নয়। আইন প্রসপেক্টিভ হওয়ায় আমাদের প্রজন্মের অনেকেই হয়তো নতুন আইনের সুফল পাবে না। কিন্তু আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বৈষম্যমূলক কালাকানুনের দায় থেকে মুক্ত করে যেতে পারব।
অতএব কারও বাটোয়ারাকৃত জমিজমা নিয়ে ভেজাল তৈরি হবে, এমন শঙ্কা নেই। সবার প্রতি আমার পরামর্শ, আপনারা বাটোয়ারাগুলো যেন সময় থাকতে আইনগতভাবে করে নেন, যাতে আইন সংশোধন হলেও ভবিষ্যতে জটিলতায় পড়তে না হয়। জমির খাজনা, খারিজ, নামজারি সবকিছু ঠিকটাক করে নিন। আইন কিন্তু সংশোধন হবে, সেটা আজ হোক বা কাল হোক।
হিন্দু আইন সংশোধনের দাবিতে আমাদের আন্দোলনে যারা সহযাত্রী হয়েছেন, তাদের প্রতিও আমার আহ্বান, আপনারা সবটা জেনে বুঝে আন্দোলনে শামিল হন। আইন পরিবর্তন হলেই ভাইয়ের জমির ভাগ পাব – এরকম বাসনা কেউ মনের মধ্যে রাখবেন না। যাদের বাবা মারা গেছে এবং বাবার সম্পত্তি ইতিমধ্যে ভাইদের মধ্যে বন্টন হয়ে গেছে, নতুন আইন হলে বোনেরা কেউ ঐ সম্পত্তির ভাগ পাবে না। যাদের বাবা মারা যায়নি, নতুন আইন কার্যকর হওয়ার পর পিতৃবিয়োগ হলে শুধূ তারাই পৈত্রিক সম্পত্তির সম-মালিকানা পাবেন। মায়ের, স্বামীর, স্ত্রীর, ভাইয়ের বা বোনের সম্পত্তির ক্ষেত্রেও সমতার নীতি প্রতিষ্ঠিত হবে। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
কাজেই আমাদের সহযোদ্ধারা কেউ কোনো প্রকার লোভের বশবর্তী হয়ে নয়; উন্নত আদর্শ, সমতা ও মানবিক মর্যাদার দাবিতে আন্দোলনে আসছেন, আসবেন। আইন সংশোধন হলে একজন নারী হিসেবে আপনার সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, আপনি মানুষ হিসেবে পুরুষের চেয়ে কম পাওয়ার যোগ্য নন, সমান পাওয়ার যোগ্য – এই স্বীকৃতি। রাষ্ট্রকে এবং সমাজকে এটা স্বীকার করতে হবে। সন্তান হিসেবে আপনি আপনার মা-বাবার কাছে সমান – এই স্বীকৃতি হলো বড় অর্জন। দ্বিতীয় বড় অর্জন হল, এরপর থেকে নারীরা অসহায় ও নির্ভরশীল থাকবে না। কোনো নারীকে বিধবা হওয়ার পর ভাইয়ের বাড়িতে বা স্বামীর বাড়িতে বা অন্য আত্মীয়দের কাছে আশ্রিত বা গলগ্রহ হয়ে বাঁচতে হবে না।
আমরা যদি এই দাবি আদায় করতে পারি তাহলে মানুষ হিসেবেও আমরা সফল। একজন বাবা হিসেবে আমি আমার কন্যা সন্তানকে তথা সকলের কন্যা সন্তানকে সমঅধিকারে ও সমমর্যাদায় পরিবারে, সমাজে এবং রাষ্ট্রের কাছে প্রতিষ্ঠিত করে যেতে পেরেছি, তাদের শতবর্ষের দুর্দশা অসহায়ত্ব ও গ্লানি মোচন করতে পেরেছি– এক জীবনে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে? একটি মহৎ আন্দোলনে ব্রতী হওয়া এবং ন্যায্যতার পক্ষে থাকাই আপনার-আমার জীবনের বড় কর্ম হয়ে জীবনের ইতিহাসে গাঁথা থাকবে। ন্যায় ও সত্যের জয় হবে। আমি বিশ্বাস করি ধীরে ধীরে সকল মানুষ মহত্ত্বের মিছিলে শামিল হবে। জয় মানুষ।