কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীকে উৎপাদনমুখী করতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে। কিন্তু যেভাবে তিনি সেটা করতে চেয়েছিলেন, তা ছিল হঠকারিতা। তাহের ছিলেন একজন বিভ্রান্ত ও রোমান্টিক বিপ্লবী। বিচারের নামে জিয়ার প্রহসনে তাহেরের মর্মান্তিক পরিণতি আমাকেও বেদনার্ত করে। কিন্তু ৭ নভেম্বর তিনি যা করেছেন বা করতে চেয়েছেন, সেটা সমর্থন করার কোনো সুযোগ নেই।
প্রভাষ আমিন: বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনটি তারিখ রাজনীতির বাঁকবদল করে দিয়েছিল। এর দুটি আগস্টে, একটি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, আরেকটি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। অপর তারিখটি হলো ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর। তবে মূল টার্নিং পয়েন্ট অবশ্যই ১৫ আগস্ট। বাকিগুলো তার পরম্পরা। ১৫ আগস্ট খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল, যাতে রাজনীতিতে তার কোনো উত্তরাধিকার না থাকে। এমনকি শিশু রাসেলও তাদের এই নিষ্ঠুর পরিকল্পনা থেকে রেহাই পায়নি। তবে দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা। ১৫ আগস্টের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল।
৭ নভেম্বর বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুবই আলোচিত, বিতর্কিত, গুরুত্বপূর্ণ, বেদনাদায়ক এবং জট লাগানো দিন। দিনটি একেকজন একেকভাবে পালন করে। আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাই কার বিপ্লব, কে পালন করে? বিএনপি দিনটি পালন করে বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে। কিন্তু ৭৫-এর ৭ নভেম্বর তো বিএনপির জন্মই হয়নি। আর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তখন ক্যান্টনমেন্টে গৃহবন্দী। এমনকি জিয়াউর রহমান তখন কাগজে কলমে কেউই ছিলেন না। ২৪ আগস্ট মোশতাক জিয়াকে সেনাপ্রধান বানালেও ৩ নভেম্বর ক্যু করে সেনাপ্রধান হন জেনারেল খালেদ মোশাররফ। নিজ বাসায় বন্দী হন জিয়া। এমনকি জান বাঁচাতে জিয়া তখন পদত্যাগ করে পূর্ণ পেনশন দেওয়ার আবেদন করেছিলেন। তার মানে ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান আসলে সেনাবাহিনীর পদত্যাগী সাবেক প্রধান।
খালেদ মোশাররফ জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করে বাসার টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেও, তার বেডরুমের ফোন লাইনটি সচল ছিল। সেই ফোনেই তিনি কর্নেল তাহেরকে বলেছিলেন, ‘সেভ মাই লাইফ’। ডাক পেয়ে তাহের তার ‘সৈনিক সংস্থা’ নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন। তাহের যে জিয়াকে ভালবেসে তার জীবন বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তা নয়। বিপ্লবের গোপন আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের সুযোগ ভেবেই মাঠে নেমেছিলেন তিনি। জাসদের মধ্যেই তখন অনেক বিভ্রান্তি। কর্নেল তাহেরের বিপ্লবের কথা জানতেনই না জাসদের অনেকে। ৭ নভেম্বর বিপ্লব হোক, প্রতিবিপ্লব হোক, ব্যর্থ বিপ্লব হোক, হঠকারিতা হোক–করেছে জাসদ। ৭ নভেম্বর তো বিএনপির সাফল্যের দিন নয়, জাসদের ব্যর্থতার দিন, অথচ সেটাই ঘটা করে পালন করে বিএনপি। পদচ্যুত, গৃহবন্দী সেনাপ্রধান ক্যু করতে পারেন, বিপ্লব নয়।
যে সৈনিকেরা জিয়াকে নিয়ে উল্লাস করেছে তারা তো ছিল কর্নেল তাহেরের অনুগত। রাস্তায় যে জনগণ সৈনিকদের সঙ্গে মিলে ট্যাংকের ওপর উঠে উল্লাস করেছে, তারা তো জাসদের কর্মী। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, যদি সেদিন জাসদের বিপ্লব সফল হতো; যদি জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরের সাথে বেইমানি না করতেন, যদি জিয়া তাহেরের স্ক্রিপ্ট ফলো করে শহীদ মিনারে গিয়ে বিপ্লবের ঘোষণা দিতেন; তাহলে আজ বাংলাদেশের রাজনীতির চিত্রটা কেমন হতো? আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকতো জাসদ, যেমনটা ছিল ৭৫-এর আগে, বিএনপির হয়তো জন্মই হতো না। সত্যি রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।
জাসদের বিপ্লব সফল হলে ভালো হতো, আমি এমনটা মনে করি না। জাসদের বিপ্লব সফল হলে কী হতো আসলে তা বলা মুশকিল। যারা বিপ্লবটি করতে চেয়েছিলেন, তারাও এর পরিণতি সম্পর্কে আদৌ জানতেন কিনা, আমার সন্দেহ। জাসদ আগে কী অপকর্ম করেছে, পরে কী করতে পারতো, সে আলাদা তর্ক। তবে অফিসারদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিপ্লব ভালো কিছু বয়ে না আনারই কথা। আর সিরাজুল আলম খান যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আফিম খাইয়ে ধ্বংস করেছেন একটি মেধাবী প্রজন্মকে, ৭ নভেম্বর কি তার চূড়ান্ত পরিণতি? জাসদের লোকজন কি তা বিশ্বাস করেন? সিরাজুল আলম খানের কি সায় ছিল ৭ নভেম্বরের তথাকথিত বিপ্লবে? মাত্র তিন বছর বয়সী একটা রাজনৈতিক দল কিছু ‘খ্যাপাটে সৈনিক’-এর ওপর ভর করে মধ্যরাতে গুলি ফুটিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করে ফেলবে? বিপ্লব কি এতই সহজ? ৭ নভেম্বর কি জাসদের বিপ্লব, নাকি স্বপ্নবান কর্নেল তাহেরের ইউটোপিয়ান বিপ্লব বিলাস? প্রশ্নগুলো সহজ, কিন্তু উত্তর পাওয়া দায়।
৩ নভেম্বর ১৫ আগস্টের খুনি চক্রের বিরুদ্ধে ক্যু করেছিলেন খালেদ মোশাররফ। কিন্তু তিনি আর্মি ক্যু করতে চেয়েছিলেন সিভিলিয়ান স্টাইলে। আলাপ-আলোচনা-সমঝোতার সুযোগে কালক্ষেপণ হয়। বিভ্রান্তি ছড়ায়, গুজব ছড়ায়, ক্যুর শুরুতেই পলায়নপর খুনিচক্র কারাগারে হত্যা করে জাতীয় চার নেতাকে। এই ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে নামে জাসদ, আরও স্পষ্ট করে বললে কর্নেল তাহের। তিনি জিয়াউর রহমানের মাথায় লবণ রেখে বরই খেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কর্নেল তাহের সৈনিকদের উস্কানি দিতে যতটা পটু ছিলেন, জনসমাগম করতে ততটা নয়। জনগণ জাসদের পক্ষে ছিল না বলেই তাহেরের চেয়ে বেশি চালাক জিয়া বরইটি নিয়ে নিজেই খেয়ে ফেলেন। কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দিয়ে জিয়া ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন অবশ্যই। কারণ তাহের তাকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। কিন্তু কর্নেল তাহের বিপ্লবী ‘সৈনিক সংস্থা’ করে ক্যান্টনমেন্টে গোপন রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। তার বিপ্লবের মূল স্লোগান ছিল ‘সৈনিক সৈনিক ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই’। এ ধরনের হঠকারী তৎপরতা সবসময়ই অপরাধ। তবে ৭ নভেম্বরই জাসদের প্রথম হঠকারিতা নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও, এমপি হত্যা, থানা লুট, ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরণ চেষ্টার চূড়ান্ত পরিণতি ৭ নভেম্বর। আর এই ৭ নভেম্বরেই জাসদের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকেছিলেন কর্নেল তাহের।
কর্নেল তাহেরের ব্যাপারে আমার মধ্যে একটা মিশ্র অনুভূতি আছে। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার। তবে যুদ্ধ করে স্বাধীন করেই নিজের দায়িত্ব শেষ করেননি তিনি। দেশ গঠন নিয়ে তার নানা পরিকল্পনা ছিল। তিনি সেনাবাহিনীকে উৎপাদনমুখী করতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে। তার চাওয়ার সাথে আমি ষোলআনা একমত। কিন্তু যেভাবে তিনি সেটা করতে চেয়েছিলেন, তা ছিল ভুল, হঠকারিতা। কর্নেল তাহের ছিলেন একজন বিভ্রান্ত কিন্তু রোমান্টিক বিপ্লবী। বিচারের নামে জিয়ার প্রহসনে কর্নেল তাহেরের মর্মান্তিক পরিণতি আরো অনেকের মতো আমাকেও বেদনার্ত করে। কিন্তু ৭ নভেম্বর তিনি যা করেছেন বা করতে চেয়েছেন, সেটাও সমর্থন করার কোনো সুযোগ নেই।
৭ নভেম্বর আরেকটা বিষয় প্রমাণিত হয়েছে, আপনি ভালো-মন্দ যাই করতে চান, তাতে জনগণের সমর্থন থাকতে হবে। জনগণের সমর্থন ছাড়া আপনি কিছুই অর্জন হরতে পারবেন না। জাসদের ব্লুপ্রিন্টে ছিল ৭ নভেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশ ঘটানো এবং জিয়াউর রহমানকে সেখানে এনে তাদের দাবির পক্ষে ঘোষণা দেওয়ানো। কিন্তু সবই জাসদের পরিকল্পনামতো হলেও জনতার ঢল নামেনি বলেই নিয়ন্ত্রণটা নিজের হাতে রাখতে পারেননি তাহের।
৭ নভেম্বর নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু সবচেয়ে কম আলোচনা হয় সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায়টি নিয়েই। ৭ নভেম্বর তিনটি পক্ষ, তিনপক্ষের নেতৃত্বেই তিনজন সেক্টর কমান্ডার, তিন বীর উত্তম। খালেদ মোশাররফ আর তাহের হেরেছেন; জিয়াউর রহমান জিতেছেন। ৭ নভেম্বর এক মর্মান্তিক ভ্রাতৃঘাতী দিন। ৭ নভেম্বর আমরা হারিয়েছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের তিন শ্রেষ্ঠ বীরকে। খালেদ মোশাররফ তো ছিলেন বীরদের বীর। কর্নেল হুদা আর কর্নেল হায়দারের বীরত্বও মুক্তিযুদ্ধের বীরগাথার অংশ। তিনজনই বীরউত্তম। খুনিচক্রের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়ে প্রাণ দেওয়া খালেদ মোশাররফ আজ যেন ভুলে যাওয়া নাম। শেখ হাসিনা ইতিহাসের অনেক দায় মিটিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন, জেলহত্যা মামলার বিচার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন। এখন সময় খালেদ-হুদা-হায়দার হত্যার বিচার করার। ইতিহাসের দায় মেটাতে হবে সবাইকেই।
বাংলাদেশের রাজনীতির দুটি পক্ষ- আওয়ামী লীগ আর এন্টি আওয়ামী লীগ। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশে এন্টি আওয়ামী লীগ শক্তির নবজন্ম ঘটে, পরে যেটা বিএনপি হিসেবে পরিচিতি পায়।
ইতিহাস আমরা বদলাতে পারব না। কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়াটা জরুরি, যাতে কোনো ভুলের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। ৭ নভেম্বরের শিক্ষা হলো, আর কখনও যেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্র, রক্তপাত, নিষ্ঠুরতা না ঘটে।
লেখক: প্রভাষ আমিন, সাংবাদিক, বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ