পুলক ঘটক: ক্ষতস্থানে পচন ধরেছে, নিদারুণ কষ্ট ভোগ করে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হচ্ছে একজন মানুষ। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ঈশ্বরের অভিশাপ। আসল কারণ তখনো মানুষের অজানা। তাই নিরুপায় মানুষ নিরাময়ের সন্ধানে ঝাড়ফুঁক তুকতাকের আশ্রয় নিয়েছে; রক্ষা পেতে অদৃশ্য ঈশ্বরের সাহায্য খুঁজেছে। আজ থেকে কয়েক শো বছর আগে এটাই ছিল মানুষের জীবন বাস্তবতা।
ক্রমবিকশিত জ্ঞান থেকে মানুষ জেনেছে, শরীরে ঘা সৃষ্টি বা পচনের কারণ হল, খালিচোখে দেখা যায় না এমন অসংখ্য অণুজীব –ব্যাকটেরিয়া। লক্ষ কোটি অণুজীব মানুষ বা অন্য প্রাণীর দেহের মধ্যে আশ্রয় করে তাদের নিজেদের জীবনচক্র তৈরি করে নেয়ে। তাদের রুখতে না পারলে মানব দেহের নিজ কার্যচক্র বিঘ্নিত হয়। শরীরে দৃশ্যমান বা অদৃশ্য ঘা তৈরি হয়।
১৬৬৫ সালে রবার্ট হুকের গবেষণায় প্রথম ব্যাক্টেরিয়ার অস্তিত্ব ঘোষণা এবং এর ১১ বছর পর ১৬৭৬ সালে এন্টনি ভ্যান লিউয়েনহুকের গবেষণায় আবারও প্রকৃতিতে অনুজীবের সন্ধান লাভ নতুন সত্য সামনে এনেছে। তার প্রায় ২০০ বছর পর ১৮৬০ সালে বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর প্রাণীদেহে ব্যাক্টেরিয়ার জীবনচক্র আবিস্কার করে যখন ঘোষণা দিলেন “সকল রোগের কারণ এই ব্যাক্টেরিয়া” তখন থেকে পৃথিবী জুড়ে চিকিৎসা শাস্ত্র নতুন পথে অগ্রসর হতে লাগল।
তার ৬৮ বছর পরে ১৯২৮ সালে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং আবিস্কার করেন প্রথম এন্টিবায়োটিক, ‘পেনিসিলিন’ –যা মানবদেহে ব্যাক্টেরিয়ার জীবনচক্র নষ্টের ক্ষমতা তৈরি করে। আধুনিক চিকিৎসার প্রাণদায়ী ওষুধ সেই এন্টিবায়োটিক এখন অনেক রকমের।
শুধু এন্টিবায়োটিক আবিস্কারের মাধ্যমে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ব্যাধি, বেদনা ও মৃত্যু দ্বারা আক্রান্ত বিশ্বমানবের যে উপকার করেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে বড় হিসেবে স্থান করে নেওয়া কয়জন মানুষ তা করতে পেরেছে? আশ্চর্য! লুই পাস্তুর বা ফ্লেমিংয়ের মতো মানুষদেরকে আমরা শ্রেষ্ঠ ‘মহামানব’ ঘোষণা করিনি!
আপনারা যে যাই বলুন, আমরা আসলে মহামানবের সঠিক মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি। ‘মহাপুরুষ’ হিসেবে মানছি কিছু চালাক মানুষকে, যারা বহুমাত্রিক মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সমাজে ভাইরাসের মতো সংক্রমণশীল বহু বিচিত্র বিশ্বাস ছড়িয়ে দিয়েছে –যেগুলো সবই আজ “ঈশ্বরের বাণী” হিসেবে স্বীকৃত।
সত্যবাদী ঈশ্বর বিভিন্ন মহাপুরুষের কানে বিভিন্ন রকম কথা কিভাবে বলতে পারেন তা আমার বোধগম্য হয় না।
আপনি এক মহাপুরুষ; আপনি ইহজগতে বাস করে অজ্ঞাত পরকালও দেখতে পেয়েছেন! অথচ আপনি আপনার চোখের সামনে বিরাজ করা জীবাণুগুলোকে দেখতে পাননি! রোগের কারণ হিসেবে জীবাণুর অস্তিত্বের কথা বলে যেতে পারেননি! কি আশ্চর্য! এ কারণে আপনার ব্যাপারে আমার মনে সংশয় তৈরি হলে তা কি আমার অপরাধ?
আপনারা সব মহামানব (কিংবা অতিমানব) ঈশ্বরের কাছ থেকে শুনে বা দেখে এসে একমত হয়ে আমাদেরকে বলেননি, “মানুষের বার বার জন্ম ও বার বার মৃত্যু হবে।” আপনারা কেউ কেউ পরকালে স্বর্গ-নরক দেখেছেন। কেউ কেউ একটি সুনির্দিষ্ট শেষ বিচারের দিনের কথা বলেছেন, যেদিন নাকি সবাইকে এক মাঠে দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে বিচার করা হবে। অন্যদিকে কেউ কেউ নিত্যদিনের কর্মফলে নিত্যকালের বিচারের কথা বলে গেছেন।
আপনারা সবাই নিজেকে সত্যবাদী দাবি করেছেন; মানে অন্যেরটা মিথ্যা! আপনাদের বিভিন্ন জনের বিভিন্ন কথার কারণে আমরা সাধারণ মানুষ আজ বিভক্ত। আপনারা কাছের অদৃশ্য জীবাণুগুলো দেখতে পাননি; অথচ অতি দূরের, ইহকালের বাইরের ও কালান্তরের গল্প ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন।
আপনারা ঈশ্বর, দেবতা, জ্বীন, পরী, অ্যাঞ্জেল, ফেরেস্তা, ভুত, পেত্নী –এমন অনেক রকম অদৃশ্য সত্তা দেখেছেন। অথচ আপনার নিজের দেহে বাস করা জীবাণুদের দেখতে পাননি! ওষুধ হলে ভূত-পেত্নী-জ্বীন তাড়াতে বলেছেন; শরীরে এন্টিবায়োটিক প্রয়োগের পরামর্শ দিতে পারেননি।
আপনাদের সবার কীর্তি ও কথা শুনে আমার মতো একজন সাধারণ বুদ্ধির মানুষের মনে যদি প্রশ্নের উদয় হয়, এ কি আমার অপরাধ হবে? যদি প্রকৃত সত্যের অন্বেষায় বুদ্ধিবৃত্তিকে নিয়োজিত করি তবে কি অপরাধ হবে? যদি নতুন কোনো সত্য আমার সামনে প্রতিভাত হয়, তবে পুরাতনকে মিথ্যা ঘোষণা করা কি অপরাধ হবে?
আমার ভাবনাগুলো অনেক মানুষের বিশ্বাসের প্রতিকূল হতে পারে। আমার বিশ্বাসই হয়তো ভিন্নরকম। কিন্তু এ যে আমার বিশ্বাস! হয়তো ভঙ্গুর বিশ্বাস। এগুলো বলার অধিকার আমার কেন থাকবে না? আমার উপলব্ধির কথা বললে আপনি কেন ক্ষিপ্ত হবেন?
মানুষ যা ভাবে, তা বলার অধিকার থাকা উচিত। বহু মানুষের উদ্ভট বিশ্বাস রক্ষার প্রয়োজনে একজন মানুষেরও সত্য বলার অধিকার এবং প্রশ্ন করার অধিকার কেড়ে নেয়া যায় না। অধিকার কেড়ে নিলে ধর্ম হয় না।
নিছক কিছু বিশ্বাস ধর্ম হতে পারে না। মিথ্যা বিশ্বাসের ঝুরি রক্ষা করাও ধর্ম নয়। ঈশ্বর সত্য স্বরূপ ও প্রেম স্বরূপ। সত্য ও প্রেম থেকে বিচ্যুত হলে ধর্ম থাকে না; তাতে বরং হৃদয় থেকে ঈশ্বরের মৃত্যু হয়।
ধর্মের ধারণা বিভিন্ন মানুষের কাছে বিভিন্ন রকম। বহু শাস্ত্র পাঠ করে আমি বুঝেছি, বিশ্বাসগুলো ধর্ম নয়; বরং বিভেদ ও বিদ্বেষের কারণ। বিভেদ ও বিদ্বেষ মানুষের হৃদয় থেকে প্রেমকে ছুড়ে ফেলে দেয়; হত্যা করে। প্রেম নিহত হলে ধর্ম নিহত হয়।
বহু শাস্ত্র পাঠ করে আমি বুঝেছি, ভালবাসাই ধর্ম। পরম কল্যাণ ও পরমার্থের সন্ধানই ধর্ম। গবেষণাই ধর্ম। সত্য সন্ধানই ধর্ম। প্রশ্ন করতে না পারলে সত্য সন্ধান হয় না। প্রেম ও সত্যের প্রতিকূল সকল অন্ধ বিশ্বাস তিরোহিত হোক। জয় মানুষ।
[পুলক ঘটক; সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ]
⇒ ফেসবুক পেজ, ফেসবুক প্রোফাইল, টুইটার অ্যাকাউন্ট
⇒বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের ফেসবুক গ্রুপ