হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদের জটিল সমীকরণ

পুলক ঘটক

প্রশ্ন: সেপারেশনের পর একজন হিন্দু নারীর স্ব-উপার্জিত সম্পত্তিতে তার পূর্বের স্বামীর অধিকার আছে কিনা?
 
একটি বাস্তব ঘটনা বলছি। একজন নারীর বিবাহের অল্পদিন পরই স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সেটা ২২ বছর আগের ঘটনা। মেয়েটি তখন গর্ভবতী ছিল, কিন্তু পিশাচ প্রকৃতির লোকটার সঙ্গে তিনি থাকতে পারেননি। বিচ্ছেদের অল্পদিন পর তার একটি কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। সেই বাচ্চাটাকে নিয়েই তিনি বাকি জীবন পার করে দিচ্ছেন। ঐ নারী একজন স্বনামখ্যাত ডাক্তার। ফলে তিনি প্রচুর আয় করেছেন; মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন এবং তার নিজের সবকিছু তার মেয়ের জন্যই তিনি রেখে যেতে চান। এখন প্রশ্ন হল, ঐ নারী সারাজীবন যে সম্পত্তি অর্জন করেছেন বা করবেন, সেই সম্পত্তিতে তার আগের সেই স্বামীর অধিকার আছে কিনা? তার সেই স্বামী আবার বিয়ে করেছেন এবং পরের স্ত্রীর গর্ভে ছেলে সন্তান জন্ম নিয়েছে। হিন্দু আইনে মেয়েদের সম্পত্তিতে অধিকার নেই; ছেলেরা সম্পত্তি পায়। এখন ঐ ডাক্তার ভদ্রমহিলার সম্পত্তি তার নিজের পেটের মেয়েটি পাবে, নাকি তার সতীনের ছেলে (আগের স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীর পেটে জন্ম নেওয়া ছেলে) পাবে? আমার পোস্টের সঙ্গে সংযুক্ত স্ট্যাটাসের স্ক্রীণশটটি এমনই এক নারীর। তার এই প্রশ্নের সমাধান কি?
আসলে, বিদ্যমান হিন্দু আইনে ডিভোর্স বা বিবাহ বিচ্ছেদ নেই। একজন বিবাহিত হিন্দু নারী তার স্বামীর কাছ থেকে আলাদা বসবাসের সুযোগ পেলেও সে স্বাধীন হয় না। সেপারেশনের পর স্বামী তার সঙ্গে না থাকলেও ঐ পুরুষকেই নিজের পতি মনে করে নিজেকে সতী প্রমাণ করে চলা নারীর জন্য বাধ্যতামূলক। তবে পুরুষদের সৎ হওয়ার দরকার নেই। পুরুষ যতগুলো ইচ্ছা বিয়ে করতে পারে; চাইলে ঘরে নটি, দাসী, রক্ষিতা রাখতে পারে; যত্রতত্র গমন করতে পারে; চরম লাম্পট্য করতে পারে। হিন্দু আইনে পুরুষের ক্ষেত্রে কোন বাধা নেই। স্ত্রীর প্রতি তার কোনো প্রকার বিশ্বাসযোগ্যতার দরকার নেই। কিন্তু স্ত্রীকে তার স্বামীর প্রতি বিশ্বাসভাজন ও পতিনিষ্ঠ হয়ে সারা জীবন কাটাতে হবে। এটাই হল হিন্দু আইন।
 
১৯৪৬ সালে পাস হওয়া ইংরেজদের সর্বশেষ হিন্দু আইনটি (The Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act, 1946) অনুযায়ী একজন নারীর স্বামী খারাপ বা অক্ষম প্রমাণিত হলে তিনি সেই স্বামীর কাছ থেকে আলাদা হয়ে বসবাস করতে পারেন। তবে তিনি স্বাধীন হন না। তিনি চাইলে অন্য কাউকে বিয়ে করে সুস্থ-স্বাভাবিক সংসার জীবন যাপন করতে পারেন না। সেপারেট হয়ে যাওয়া স্বামীর পরিচয়েই তাকে বাঁচতে হবে। তিনি পরাধীন; তার দেহ মন সবকিছুর উপর তার পৃথক হওয়া স্বামীরই অধিকার বহাল থাকে। এক কথায় নারী হলো অধীনস্থ দাসী। এর ভিত্তিতেই নারীর অন্যান্য সকল অধিকার নির্ধারিত হচ্ছে।
 
একারণে উক্ত নারীর নিজের যোগ্যতায় ও পরিশ্রমে অর্জিত সম্পত্তিতেও তার নিজের পরিপূর্ণ অধিকার থাকে না। বিদ্যমান হিন্দু আইনে ১১ প্রকার ”স্ত্রীধন” আছে যার মধ্যে শুধু ”সৌদায়িক,” ”শুল্ক”এবং ”যৌতুক” নামক স্ত্রীধনের উপর নারীর পূর্ণাঙ্গ কর্তৃত্ব থাকে। ”স্বোপার্জিত”অর্থাৎ নিজের অর্জিত সম্পত্তিতেও বিবাহিত নারীর পূর্ণাঙ্গ কর্তৃত্ব নেই। স্বামীর অনুমতি ছাড়া তিনি তার নিজের শ্রমে অর্জিত সম্পত্তি দান, বিক্রয় বা হস্তান্তর করতে পারেন না।
 
যেহেতু বাংলাদেশের বিদ্যমান হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ নেই, তাই ঐ ডাক্তার ভদ্রমহিলার অর্জিত সম্পত্তির উপর তার পৃথক হয়ে যাওয়া সেই স্বামীর কর্তৃত্ব থাকবে। ওনার অর্জিত সম্পত্তি ওনার মেয়ে পূর্ণস্বত্বে পাবে না, জীবনস্বত্ব হিসেবে পাবে। মেয়েটি যদি পুত্র সন্তানের জননী হতে না পারে তবে তার মৃত্যুর পর আইনত সম্পত্তির রিভার্সন হবে; অর্থাৎ ঐ সম্পত্তি ডাক্তার ভদ্রমহিলার পূর্বের স্বামী অথবা তার পরের বউয়ের ছেলে পূর্ণস্বত্বে পাবে। এমন কি সেই লোক যদি কোনো ছেলে সন্তান দত্তক নেয়, তবে এই ডাক্তার মহিলার সম্পত্তি তার স্বামীর দত্তক নেওয়া ছেলের অধিকারে চলে যাবে। অনেকের ধারণা, হিন্দু আইনে মায়ের সম্পত্তিতে মেয়ের অধিকার। এটাও পুরোপুরি সত্য নয়; সামান্য অংশে সত্য। এগারো প্রকার স্ত্রী-ধনের মধ্যে শুধু “যৌতুক”ও ”পিতৃদত্ত” নামক স্ত্রীধন মেয়েরা পাবে।
 
এরকম বাস্তবতায় আইনজীবীদের পরামর্শ অনুযায়ী ঐ ভদ্রমহিলা তার নিজের নামে কোনো সম্পত্তিই কিনছেন না। তিনি তার সকল সম্পত্তি কিনেছেন মেয়ের নামে। তিনটি কারণে তিনি কন্যার নামে সম্পত্তি কিনেছেন।
১. তার ভয়, তার পূর্বের স্বামী বা তার সন্তানরা তার অবর্তমানে সম্পত্তিগুলোর দখল নিতে পারবে;
২. সেপারেট হওয়া সেই স্বামীর অনুমতি ছাড়া তিনি সম্পত্তি দানপত্র করতে পারবেন না;
এবং
৩. নাতী জন্ম না হলে তার কন্যা পূর্ণাঙ্গ উত্তরাধিকার পাবে না।
 
কন্যার নামে কিনতে গিয়ে তাকে বারবার ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের মুখোমুখী হতে হয়েছে এবং তাদের কাছে ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে, এত ছোট মানুষের এত টাকার উত্স কি? এবার বলুন, নিজের নামে সম্পত্তি না করে একটা বাচ্চা মেয়ের নামে সম্পত্তি কেনা কতটুকু নিরাপদ?
 
আসলে হিন্দু নারীর নিজের উপরই তার নিজের অধিকার নেই। তার দেহ এবং মনের উপর তার স্বামীর অধিকার। আইনের এই বাস্তবতায় বিপন্ন হিন্দু নারীদের জন্য মুক্তি পাওয়ার দু’টি মাত্র পথ খোলা আছে। এক. সতীত্ব বিসর্জন দেওয়া, দুই. ধর্মান্তরিত হওয়া। এই দুটি পথ ছাড়া অসৎ, অক্ষম, লম্পট কিংবা দুর্বৃত্ত স্বামীর কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় প্রচলিত হিন্দু আইনে রাখা হয়নি।
 
আপনি হয়তো মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার আগে জানতেন না, আপনার জামাইয়ের নানারকম বদঅভ্যাস আছে। সে হয়তো নেশাখোর, বদমাস; চুরি-ডাকাতির মতো অপরাধে জড়িত। বিয়ের পর জানলেন; কিন্তু আপনার মেয়ের আর মুক্তি নেই। একজন হিন্দু পুরুষ যদি জাত-বদমাস হয়; যদি আপনার মেয়েকে সকাল-বিকাল মার দেয়, গালাগালি করে শশুর বংশকে উদ্ধার করে; যদি ধর্ষণ, ডাকাতি, নারী পাচার, চোরাকারবারি বা খুনের মতো অপকর্মের দায়ে আদালতে প্রমাণিত অপরাধী হয় এবং যদি জেলে থাকে, তবুও আপনার মেয়ের মুক্তি নেই। ঐ পুরুষকেই পতিধন মেনে তারই “সতী স্ত্রী” হিসেবে আপনার মেয়েকে জীবনভর বাঁচতে হবে। বিদ্যমান আইন হিন্দু নারীকে বেশ্যাবৃত্তিতে যাওয়ার অথবা ধর্মান্তরিত হওয়ার সুযোগ দেয়। অথচ ডিভোর্সের মাধ্যমে মুক্ত হয়ে নতুন করে বিয়ে করে সুস্থ-সুন্দর জীবন যাপনের অধিকার দেয় না।
 
বলতে পারেন, যেহেতু হিন্দু নারীর স্বামী বেঁচে থাকতে দ্বিতীয় বিবাহ অবৈধ, সেক্ষেত্রে কি দ্বিতীয় বিবাহ করে নিজেকে অসতী প্রমাণ করে নারী তার স্বউপার্জিত সম্পত্তির উপর সম্পুর্ন নিজের অধিকার আনতে পারবে?
 
সেক্ষেত্রে বলব, এটা হয়তো সম্ভব। কিন্তু তাতে মেয়েটির দ্বিতীয় বিয়ে হিন্দু আইন অনুসারে বৈধতা পাচ্ছে না। পুরুষদের যতগুলো ইচ্ছে বিয়ে করার সুযোগ থাকলেও মেয়েদের দ্বিতীয় বিয়ের সুযোগই নেই। ফলে মেয়েটির দ্বিতীয় বিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত সন্তানরাও বৈধ সন্তান হয় না এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকারসহ সকল ক্ষেত্রে সেই সন্তানের অধিকারও টলমলে অবস্থায় থাকে।
তাছাড়া, বাংলাদেশে ফৌজদারি আইন হিসেবে Adultery Act বা ব্যভিচার আইন চালু আছে। দন্ডবিধিতে অবৈধ বিবাহের মাধ্যমে বসবাসের জন্যেও সাজা নির্ধারণ করা আছে। পেনাল কোডের ৪৯৪ ধারায় বলা হয়েছে, “Whoever, having a husband or wife living, marries in any case in which such marriage is void by reason of its taking place during the life of such husband or wife, shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to seven years, and shall also be liable to fine.” 
দণ্ডবিধির ৪৯৩, ৪৯৪, ৪৯৫, ৪৯৬ এবং ৪৯৭ ধারায় অবৈধ বিবাহ এবং অবৈধ যৌনতার বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে বিভিন্ন মেয়াদের সাজার বিধান করা আছে। ফলে মেয়েটির পুরাতন স্বামী পেনাল কোড অনুযায়ী মেয়েটিকে এবং তার নতুন স্বামীকে অভিযুক্ত করে ৫ বছর থেকে ১০ বছর পর্যন্ত সাজা দাবি করতে পারবে।
উল্লেখ্য ব্যাভিচার আনের ক্ষেত্রে পরকীয়ার অভিযোগে স্ত্রীকে আসামী করার সুযোগ নেই; কিন্তু তার প্রেমিককে আসামী করা যাবে। অন্যদিকে হিন্দু পারিবারিক আইনে পুরুষের বহুবিবাহে বাধা না থাকায় পেনাল কোডের ধারা থেকে বহুবিবাহকারী ‍পুরুষ নিস্কৃতি পেতে পারেন; কিন্তু বিবাহিত নারী অবৈধভাবে দ্বিতীয় বিয়ের দায় থেকে নিস্কৃতি পাবেন না।
 
আইনে না থাকলেও ইদানিং অনেকে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে সেপারেশনের চুক্তি করে। অনেক ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদ অনিবার্য প্রয়াজন হওয়ায় হিন্দুরা এটা করতে বাধ্য হচ্ছে। তারা নোটারি পাবলিকের সামনে স্বাক্ষর দিয়ে ঘোষণা দেয়, নতুন করে মেয়ের বিয়ে দিলে তার স্বামী আপত্তি করতে পারবে না। এরকম ঘোষণার আসলে কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। কারণ বাংলাদেশে প্রচলিত হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং নারীর পুনরায় বিয়ের সুযোগই নেই।
 
অথচ ধর্মশাস্ত্রে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নারীকে অন্য পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। পরাশর সংহিতায় বলা হয়েছে,
“নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরণ্যো বিধিয়তে।”
শ্লোকটির অর্থ হল, “স্বামী যদি নিরুদ্দেশ হয়, মারা যায়, প্রব্রজ্যা অবলম্বন করে (অর্থাৎ সন্ন্যাসী হয়ে যায়), ক্লীব (পুরুষত্বহীন) হয় অথবা পতিত(ধর্ম বা সমাজ থেকে বিচ্যুত) হয় – এই পাঁচ প্রকার বিপদ উপস্থিত হয়, তবে নারীকে অন্য পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া বিধেয়।”
 
আমি বেদ, সংহিতা, রামায়ণ ও পুরাণ থেকে নারীর পুন:বিবাহের পক্ষে এরকম অনেকগুলো সুস্পষ্ট বিধান ও ঘটনার দৃষ্টান্ত দেখাতে পারব। বলুন দেখি, শাস্ত্রে থাকা সত্ত্বেও বিবাহ বিচ্ছেদ এবং নারীর পুন:বিবাহ কিভাবে ধর্মের পরিপন্থী হয়? বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের অর্থ এই নয়, আইন হলে আপনার মা-বাবার বিয়েটাও ভেঙে যাবে কিংবা আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার নিজের বিয়েটাও ভেঙে যাবে। যার ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদ দরকার, তারা করবে। আপনি তার অধিকারে কেন বাধা দেবেন?
 
ধর্মে বিধান আছে এবং সমাজে প্রয়োজন আছে বোঝার পরেও যারা বিবাহ বিচ্ছেদ আইন প্রণয়নের বিরোধিতা করছে তারা আসলে ধার্মিক, নাকি বাটপার? তারা কি হিন্দু সমাজের ভাল চায়? তারা বলছে, হিন্দু বিবাহ চুক্তি নয় এবং এই বিয়ে অবিভাজ্য। অথচ সনাতন ধর্মে শুধু এক প্রকার বিয়ের কথা নেই। বহু প্রকার বিয়ের কথা শাস্ত্রে আছে। তার মধ্যে বর্ণ বিভাগ অনুযায়ী তিন প্রকার এবং বিয়ের পদ্ধতি ভেদে আট প্রকার বিয়ের কথা আছে।
 
বিবাহ বিচ্ছেদ শুধু নারীর জন্য প্রয়োজন, তা কিন্তু নয়। পুরুষের জন্যেও অনেক সময় দায় থেকে মুক্ত হওয়া অত্যাবশ্যক হতে পারে। কয়েক বছর আগে (২৯.০৩.২০১৮) রংপুরে হিন্দুু সমাজের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা খুন হয়েছিলেন। হত্যায় তার স্ত্রী সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা ছিল না। স্ত্রীর অন্য ব্যক্তির সঙ্গে পরকীয়া ছিল। পরকীয়া প্রেমিকের সঙ্গে মিলিত হয়ে নিজের স্বামীকে হত্যা করেছিলেন ঐ মহিলা। স্বামীকে হত্যার দায়ে তার ফাঁসির রায় হয়েছে।
এখন বলুন দেখি, ঐ স্ত্রীর সঙ্গে ঘর করতে কি স্বামীটা বাধ্য? যার সঙ্গে মনের মিল নেই, স্ত্রী পরকীয়া করে তা জানেন কিন্তু সেই স্ত্রীকে ডিভোর্স দেওয়া যাবে না – এটা কি হয়? বৈধভাবে তারা আলাদা হয়ে গেলে ঐ মানুষটাকে জীবন দিতে হতো না।
আবার বিপরীত ক্ষেত্রে যেখানে পুরুষ লোকটা খারাপ, অন্যের সঙ্গে পরকীয়া করে এবং স্ত্রীর উপর নির্যাতন চালায়, সেই স্বামীর সঙ্গে ঘর করতে কি ঐ নারীকে বাধ্য করবেন? বৈধভাবে বিয়ে বিচ্ছেদের আইন থাকলে আপনার সংসার বা আপনার বাবা-মায়ের সংসার তো ভাঙছে না। যার ক্ষেত্রে বিচ্ছেদ অত্যাবশ্যক তার প্রয়োজনে আপনি কেন বাধা দিবেন?
আইন শুধুমাত্র ভাল মানুষদের জন্য হয় না; খারাপ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে আইন বেশি প্রয়োজন। শুধু পুরুষ খারাপ হতে পারে, নারী খারাপ হতে পারে না – এটা ঠিক নয়। একজন ভদ্রলোকের স্ত্রী যদি হিংস্র বা মারাত্মক বিপদজনক হয়, তাহলে সেই পুরুষেরও নিস্তার নেই। বনিবনা না থাকলেও এমনকি স্বতন্ত্র বসবাস করলেও ঐ নারীকে আজীবন ভরণপোষন দিতে আপনি বাধ্য। আপনি তাকে ভালবাসেন না, তার সঙ্গে বাস্তবে কোনো সম্পর্ক নেই, একসাথে থাকেনও না, তার কারণে হয়তো নানাভাবে সমাজে অপদস্ত হচ্ছেন – তারপরও “হিন্দু বিবাহিত নারীদের পৃথক বাসস্থান এবং রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার আইন, ১৯৪৬” অনুযায়ী তাকে প্রতিমাসে ভরণপোষণ দিতে হবে। স্ত্রী মামলা করলে আদালত ভরণপোষনের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেবে। এটা নিয়ে আপনার মনে আক্ষেপ থাকতেই পারে; কিন্তু বিদ্যমান আইনের কারণে আপনার কিছুই করার নেই।
সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিত্ব, সরকারি চাকরিজীবী এবং নিয়মিত বাহিনীতে চাকুরিরত পুরুষদের জন্য এই সমস্যাটা বেশি মারাত্মক। আপনার স্ত্রী পৃথক থাকা অবস্থায় তার যদি কোনো অঘটন ঘটে তাতেও আপনি ফেঁসে যেতে পারেন। আইনটি এমন : আপনি যদি ভদ্রলোক হন কিন্তু আপনার স্ত্রী যদি ভদ্রমহিলা না হন – তাহলে আপনি বিপদে আছেন। আর আপনি যদি খারাপ বা অত্যাচারী লোক হন আর আপনার স্ত্রী যদি নেহায়েত ভালমানুষ হয়, তাহলে ঐ ভদ্রমহিলা বিপদে আছেন। আইন ভালর জন্য সহায়ক ও খারাপের নিয়ন্ত্রক হওয়ার কথা। হয়েছে উল্টো। ডিভোর্স সবার জন্য নয়, কিন্তু যাদের জন্য প্রয়োজন, তাদেরকে অধিকার দেয়া জরুরি।
 
মনে রাখবেন বিয়ের আইনের উপর নির্ভর করে আপনার সন্তানের সম্পত্তির অধিকার। মানুষ এখন ঘরে বসে গোটা পৃথিবীর খবর রাখে। এই ২০২৩ সালের পৃথিবীর মানুষ হিসেবে আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে – কোনটা হিন্দু সমাজের জন্য হিতকর? সময়ের প্রয়োজনে যেখানে পরিবর্তনের চাহিদা রয়েছে এবং যেসব আইন বিশ্ববাসীর কাছে আপনার-আমার মর্যাদাকে লঘু করে সেসব আইন বদলাতেই হবে। 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ