পশু হত্যার ধর্ম

পুলক ঘটক: সনাতন ধর্মে আমিষ ভোজন এবং নিরামিষ ভোজন দুটোই আছে। তবে নিরামিষ আহারকে বেশি উৎসাহিত করা হয়েছে। যারা তপস্যি বা আধ্যাত্ম পথের পথিক, তাদের জন্য আহারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানারকম সংযম সাধনার পরামর্শ আছে। আর যারা সংসারের কঠিন কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত, তাদের জন্য আহার সংযম ও সাধনার বিষয়গুলি ততোটা কঠোর নয়।

যেমন ধরুন, ব্রহ্মচর্য ব্রতধারী ব্যক্তির জন্য প্রাণীহিংসা, মাংস ও মধু ভক্ষণ এবং স্ত্রীসংসর্গ সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়েছে – যে পরামর্শ সংসারি বা গৃহীর জন্য নয়।

“বর্জ্জয়েন্মধু মাংসঞ্চ গন্ধং মাল্যং রসান্ স্ত্রিয়ঃ।
শুক্তানি যানি সর্ব্বাণি প্রাণিনাঞ্চৈব হিংসনম।।” ২/১৭৭।।
-মনু সংহিতা

অর্থ: ব্রহ্মচারী মধু, মাংস, সুগন্ধী, মালা, মিষ্টি, ও স্ত্রী বর্জন করবে। যে খাদ্য অম্ল হয়ে যেতে পারে তা ভক্ষণ করবে না এবং প্রাণিহিংসাও করবে না।

পশুহত্যা করা হয় মূলত ভোজনের জন্য। যারা আমিষ ভোজন করে তাদের জন্য পশু হত্যা সনাতন ধর্মে পুরোপুরি নিষিদ্ধ নয়। তবে এসব নৃশংস কর্ম যতটা কম করা যায়, তত মঙ্গল। যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, অহিংস ও নিরামিষাশী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। পশুপ্রাণীর প্রতি নির্মমতা বা অকারণে পশুহত্যা নিষিদ্ধ। অকারণে বা সামান্যবোধে কীটপতঙ্গ হত্যাও শাস্ত্রে নিষিদ্ধ। প্রতিদিনের পথচলায়, জ্ঞানে বা অজ্ঞানে যেসব ক্ষুদ্র পোকামাকড় বা প্রাণী হত্যা হয়, শাস্ত্রে তাকে পঞ্চসূনা পাপের অন্তর্গত করা হয়েছে।

পঞ্চসূনা গৃহস্থস্য চুল্লীপেষণ্যুপস্করঃ।
কণ্ডনীচোদকুম্ভশ্চ বধ্যতে যাস্তু বাহয়ন্॥ (মনুস্মৃতি ৩/৬৮)

অর্থ: চুল্লী, পেষণী (শিললোড়া), সমার্জ্জনী, উদুখল, মুষল ও জলকলস এই পাঁচটির নাম সূনা। এসবের দ্বারা যে ক্ষুদ্র পোকামাকড় বা জীবহিংসা হয় গৃহস্থ সেই পাপে লিপ্ত হয়।

এসব পাপ থেকে মুক্তির জন্য প্রতিদিন দান ও অধ্যয়ন ইত্যাদি পঞ্চ মহাযজ্ঞ করার নির্দেশ স্মৃতিশাস্ত্রে আছে। অর্থাৎ শাস্ত্রে প্রাণীহিংসা পাপ হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে। আবার শাস্ত্রে হিংসার বৈধতাও দেওয়া হয়েছে। এমনকি মানুষ হত্যারও বৈধতা আছে- যদিও সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী নরহত্যা পাপ।

রাজা, ক্ষত্রিয় বা সৈনিকের জন্য যুদ্ধকে কর্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করা আছে। জাতিয়তাবাদী চেতনায় যুদ্ধকে “স্বাধীনতা যুদ্ধ” ”মুক্তিযুদ্ধ” এবং ধর্মে ”ধর্মযুদ্ধ” হিসেবে মহিমান্বিত করা হয়। অথচ যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা ও ভয়াবহতা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হয় না। তার মানে সাধারণভাবে যা পাপ, বিশেষ ক্ষেত্রে তা কর্তব্য।

কিন্তু নিরীহ তৃণভোজী নির্বৈরী প্রাণীকে হত্যা করা তো আত্মরক্ষার যুদ্ধ নয়! এই হত্যায় ঈশ্বরের সন্তোষ্টি কিভাবে হয়? আসলে হত্যার মূল উদ্যেশ্য খাদ্য হিসেবে ব্যবহার; ঈশ্বরের সন্তোষ্টির জন্য পশুহত্যা করা প্রয়োজনীয় নয়। সনাতন ধর্মে পশুবলিকে প্রত্যেকের কর্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। ধর্মের উদ্দ্যেশ্যে পশুবলির গণপ্রচলনও নেই। বরং নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।

খাদ্য নিয়ন্ত্রণের একটি পথ হল, তুমি যা কিছু খাও তা ঈশ্বরকে অর্পন করে খেতে হবে। যা ঈশ্বরের কাছে অর্পণযোগ্য নয়, বা যা প্রসাদ নয়, তা খাদ্য হবে না। গীতায় সকল কর্মের সঙ্গে ভক্তির সংযোগ ঘটানো হয়েছে।

যৎকরোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যৎ।
যত্তপস্যসি কৌন্তেয় তৎকুরুষ্ব মদর্পণম্ ॥২৭/৯॥

অর্থ: তুমি যা অনুষ্ঠান কর, যা আহার কর, যা হোম কর, যা দান কর এবং যে তপস্যা কর, সেই সমস্তই আমাকে সমর্পণ কর।

খাদ্য গ্রহণ একটি দৈনন্দিন জীবনকর্ম। ভক্তির পথে চললে এই জীবনকর্মও ঈশ্বরে অর্পিত হওয়া দরকার। কিন্তু সব ধরনের খাদ্য সব দেবতাকে অর্পন করা যায় না। যে দেবতার যে ফুল প্রিয়, তাকে সেই ফুল দিয়ে পূজা করতে হয়। বিভিন্ন দেবতার পূজা বিভিন্ন রকম বস্তুতে হয়। এখানে বহুদেবতা পূজার সাথে একেশ্বরবাদের তাত্ত্বিক সন্নিবেশ।

একেশ্বরবাদ সনাতন ধর্মের মৌলিক মতবাদ হলেও এখানে একের মধ্যে বহুর উপস্থিতি। ছান্দোগ্য উপনিষদের ”একমেবাদ্বিতীয়ম” (৬/২/১) ঘোষণায় ঈশ্বরকে শুধু ‘এক’ বলা হয়নি। তাকে “অদ্বিতীয়” বলা হয়েছে। শুধু “এক” বললেই কথাটা ফুরিয়ে যায়। কিন্তু বলা হল, “অদ্বিতীয়”। তিনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো সত্ত্বার অস্তিত্বই নেই। দৃশ্যমান বা অদৃশ্য সকল কিছুই ঈশ্বরের একেকটি রূপ বা বিভূতি। ঈশ্বর এক হলেও তার রূপ এক রকম নয় –বহুরূপ; অনন্তরূপ। এক আগুন যেমন অসংখ্য প্রদীপে জ্বললে অসংখ্য রূপে প্রতিভাত হয়, অনেকটা তেমনই। সে আগুন শুধু প্রেমের উষ্ণতা দেয় না; ধ্বংসাত্মক ও কালাত্মক হতে পারে।

প্রেমময় স্রষ্টার ধ্বংসাত্মক রূপটিও নিত্যদিনের। ঐরূপে তিনি “করাল বদনাং ঘোরাং” মহাকাল বা মহাকালী প্রকৃতি –প্রলয়রূপী বা রূপিনী– ঈশ্বর যেন স্বাক্ষাৎ মৃত্যুসরূপ। সকল প্রাণীর মৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যুরূপী, সর্বগ্রাসী, সর্বনাশী যে ঈশ্বর, তার পূজায় জীবনকে আহুতি দিতে হয়; সেখানে পশুবলি হয়। নিষ্ঠুর মৃত্যুদেবতার পূজায় বলি হয়। ঈশ্বরকে আহুতি দেয়ার ছলে মানুষ নিজেই সে পশুমাংস আহার করে।

সকল প্রাণীর মৃত্যু অনিবার্য। এটা মেনে নিয়েই বোধকরি মৃত্যুরূপী দেবতার কাছে নিরীহ প্রাণীকে বলি দিয়ে নিজের উদরপূর্তিকে মানুষ জায়েজ করে নেয়। ঈশ্বরের যে সকল শান্ত সৌম্য প্রেমরুপী দেবরূপ আছে, সে রূপের পূজায় বলি নেই। কালরূপের পূজায় বলি আছে।

কিন্তু প্রতিদিন কালীপূজা করা বা মহাকালের পূজা করা এবং বলি প্রদান করে প্রসাদ হিসেবে মাংস ভক্ষণ সহজ হয় না। ফলে ভক্তিবাদী ধর্মীয় ব্যবস্থা নিত্যদিন পশুহত্যার নির্মমতা পক্ষান্তরে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে ইদানিং পূজায় পাঁঠাবলির জন্য হিন্দুরা আর অপেক্ষা করে না; বাজার থেকে খাসির মাংস কিনে এনে তৃপ্তি মেটায়।

সনাতন ধর্ম বিবর্তনবাদী ও ক্রমোন্নতির ধর্ম। এই ধর্মের আদি বৈশিষ্টে পশুহত্যার প্রচলন ছিল এবং ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়েছে। আদিম মানুষের জীবন-জীবীকার মূলে ছিল পশু শিকার। বৈদিক যাগযজ্ঞে ও তন্ত্র সাধনায় পশুবলি এবং পৌরাণিক রাজাদের মৃগয়া বা শিকারের নেশায় সে যুগের জীবন-বাস্তবতার প্রতিফলন রয়েছে। একদিকে জীবন রক্ষার জন্য শিকারের অনিবার্যতা, অন্যদিকে বিকশিত মানবতাবোধ, তথা প্রাণীর প্রতি দরদ –এই দুইয়ের টানাপোড়েন সেই প্রাচীন কালেই মানুষকে তত্ত্বের দ্বন্দ্বে নিয়োজিত করেছিল।

ভক্তিবাদী সনাতন ধর্ম বা প্রেমধর্ম বিকশিত হওয়ার পূর্বযুগে পশুবলি ও আমিষ আহারের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। বুদ্ধের “অহিংসা পরম ধর্ম“ ঘোষণাকে সে হিংসার বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহ বলে মনে হয়। সনাতন ধর্মে অহিংস বৈষ্ণবীয় ধারার বিস্তার পশুহত্যাকে প্রবলভাবে নিরুৎসাহিত করেছে। প্রাচীন বেদে এবং সাংখ্য দর্শনে সাধারণভাবে জীবহিংসা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সম্ভবত স্বামী বিবেকানন্দের একটি লেখায় পড়েছিলাম, নিয়মিত নিরামিষ খেলে মানু্ষের হিংসাবৃত্তি হ্রাস পায়। এতে শরীর অপুষ্ট হয় না। গরু, মহিষ ও হাতির মতো তৃণভোজী প্রাণীরা মাংসভোজী মানুষের চেয়ে দুর্বল নয়। মানুষের দাঁত ও শারীরিক গঠন মাংসাশী প্রাণীদের মতো নয়; বরং তৃণভোজী প্রাণীদের সাথে মিল বেশি। বিজ্ঞানের আধুনিক আবিস্কার অনুযায়ী এই ধারণা কতটা সত্য জানি না। তবে আমার মানবিক বোধে মনে হয়, প্রাণী হত্যা করে বাঁচার চেয়ে যারা অহিংস পন্থায় বাঁচতে চায় তারা উত্তম।

আমি মাছ-মাংস ভোজন করি। কিন্তু অহিংসার আদর্শে যারা নিরামিষ আহার করে, তাদেরকে আমার চেয়ে উন্নত মনে করি। ধর্মীয় গ্রন্থগুলো পাঠ করে অহিংসার দর্শনে আমি যতটা প্রভাবিত হয়েছি, আমার মনোজগতকে তার চেয়ে বেশি আলোরিত করেছে মহাত্মা গান্ধীর আত্মজীবনী “The Story of My Experiments with Truth”। আমিষ আহার না করেও মানুষ ভালভাবে বাঁচতে পারে –গান্ধীজিসহ আমার চারদিকের বহু মানুষকে দেখেছি। আমি মাছ-মাংস আহার করি বটে, কিন্তু আত্মগ্লানিতে ভুগি; নিজেকে অপরাধী মনে হয়। নিজেকে তখন বন্য প্রাণীর চেয়ে উন্নত মনে হয় না।

জঙ্গলবাসী আদিম মানুষের যে জীবনধারা তার সঙ্গে সহিংস পশুর জীবনধারার সাদৃশ্য বেশি। সেই বুনো মানুষ সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে উন্নত মানুষ হয়ে ওঠার সাধনায় লিপ্ত আছে। সে সাধনায় অহিংসার দর্শন নিশ্চয় উন্নততর। মানবিকতার মহোৎকর্ষই ধর্ম। পশুহত্যাকে ত্যাগ বা মহত্ত্ব বলার সুযোগ নেই। ক্ষেত্রবিশেষে বড়জোর প্রয়োজন বলতে পারি। মানুষ পশুর চেয়ে বেশি হিংস্র – এই বদনাম দূর হোক।

”মা হিংস্যাৎ সর্ব্বা ভুতানি” –কোনো প্রাণীরই হিংসা করবে না।

 

[পুলক ঘটক; সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ]

 ফেসবুক পেজফেসবুক প্রোফাইলটুইটার অ্যাকাউন্ট

বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের ফেসবুক গ্রুপ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ