উত্তরাধিকার আইন সংস্কার ও হিন্দুসম্প্রদায়ের আশঙ্কা

নির্তেশ সি দত্ত: হিন্দু নারীর অধিকার সুরক্ষা নিয়ে গত ১৪ মে ২০২৩ তারিখে বাংলাদেশ হাইকোর্ট রুল জারি করলে হিন্দু সম্পত্তি উত্তরাধিকার আইন সংস্কারের বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। হাইকোর্টের রুলে হিন্দু নারীর বিবাহ নিবন্ধন, বিচ্ছেদ, ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব, দত্তক ও সম্পত্তির সমান উত্তরাধিকার সুরক্ষায় নীতিমালা বা নির্দেশনা গ্রহণে রুল জারি করলেও আলোচনা হচ্ছে মূলত সম্পত্তির সমান উত্তরাধিকার আইন নিয়ে। সম্পত্তির সমান উত্তরাধিকার আইনের পক্ষে বিপক্ষে অনেক আলোচনায়ই সোশাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। অনেকে উজ্জীবিত হচ্ছেন, অনেকে আশঙ্কায় আছেন, অনেকে হাসি তামাসাও করছেন। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্পত্তি আইন সংস্কারের বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়ার কিছু নেই। কারণ ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বিভাগের পর থেকে পাকিস্তান হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের বিশাল পরিমাণ ব্যক্তিসম্পত্তি বেদখল হওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস আছে।

নির্তেশ সি দত্ত

হিন্দু নারীর বিবাহ নিবন্ধন, বিচ্ছেদ, ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব, দত্তক ও সম্পত্তির সমান উত্তরাধিকার সবক্ষেত্রেই নারী-পুরুষে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, সব ক্ষেত্রেই নীতিমালা প্রণয়ন জরুরী। সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিষয়ে হিন্দু নারী-পুরুষে জঘন্যতম বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। বর্তমান হিন্দু পারিবারিক আইনে উত্তরাধিকার হিসেবে হিন্দু নারী সম্পত্তির মালিকই হতে পারে না, হিন্দু পুরুষেরা সকল উত্তরাধিকার সম্পত্তির মালিক হয়। এটা হতে পারে না। এই আইন স্পষ্টভাবে হিন্দু নারীদের শত শত বছর বঞ্চিত করেছে। কাজেই নারী,পুরুষ ও অন্যান্য লিঙ্গনির্বিশেষে সমান উত্তরাধিকার আইনের দাবী অত্যন্ত যৌক্তিক দাবী। ফলে হিন্দু সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন সংস্কার জরুরী হয়ে পড়েছে। এই আইন হতে হবে শুদ্ধ স্বচ্ছ নিরপেক্ষ এবং ফাঁকফোকড়, অসঙ্গতি ও জটিলতাবর্জিত। দুরভিসন্ধিমূলকভাবে অসঙ্গতি, আইনের মারপ্যাচ ও ফাঁকফোকড় রেখ এই আইন সংস্কার হলে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় নতুন করে বিপাকে পড়বে। বিগত বছরে প্রস্তাবিত হিন্দু উত্তরাধিকার খসড়া আইনে বেশ কিছু অসঙ্গতি ও মারপ্যাঁচ রয়ে গেছিল। এমনিতেই শক্রসম্পত্তি নামক কালো আইনে, ভূমি কর্মকর্তাদের অসততা, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ অধ্যাদেশের আইনি জটিলতা, প্রণীত আইনের ফাঁকফোকড়ে, আইন আদালত সংখ্যালঘু বান্ধব না হওয়া ইত্যাদি বহু কারণে লক্ষ লক্ষ একর সংখ্যালঘু হিন্দু সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের প্রায় ২৬ লাখ একর জমি দখল হয়ে গেছে বা ২৬ লক্ষ একর জমি থেকে সংখ্যালঘুরা উচ্ছেদ হয়ে গেছে। এই জমির পরিমাণ ইজরাইল রাষ্ট্রের অর্ধেক! অর্থাৎ, ইজরাইল ফিলিস্তিনিদের যে পরিমাণ জমি দখল করেছে তার অর্ধেক বাংলাদেশের হিন্দুরা হারিয়েছে। কাজেই, সম্পত্তির আইন সংস্কার বিষয়ে হিন্দুদের আশঙ্কা হওয়া মোটেই অমূলক নয়। তাই সংখ্যালঘু হিন্দু সম্পত্তি আইন সংস্কারে এসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে। পুনঃপুন যাচাই বাছাই করে বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে খসড়া প্রণয়ন করতে হবে।

হিন্দু ভাই, বোন, বাবা, মা যারা বলছেন- হিন্দু মেয়েরা উত্তরাধিকারে সমান সম্পত্তি পেলে ধর্মান্তরিত হয়ে চলে যাবে তারা ভুল বলছেন। হিন্দু ছেলেরাও ধর্মান্তরিত হয়, উত্তরাধিকারে প্রাপ্য মেয়েদের সম্পত্তি না দিয়ে সেই অংশসহ নিজের সম্পত্তি নিয়েই ধর্মান্তরিত হচ্ছে। সম্ভবত সেই জন্যই বিগত বছরের প্রস্তাবিত হিন্দু উত্তরাধিকার খসড়া আইনে ধর্মান্তরিত উত্তরাধিকার বিষয়ে একটি ধারা রাখা হয়েছিল।

প্রস্তাবিত সেই হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের খসড়ায় বলা হয়েছিল-

“গ. ধর্মান্তরিত ব্যক্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণ

কোন হিন্দু নারী, পুরুষ বা হিজরা (তৃতীয় লিঙ্গ) যদি উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি গ্রহণ করার পূর্বে অন্য ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা ধর্মান্তরিত না হয় তাহলে উক্ত ব্যক্তির সম্পত্তির অংশটি তার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা সমান অংশ পাবেন। কিন্তু কোন হিন্দু নারী, পুরুষ বা হিজরা (তৃতীয় লিঙ্গ) যদি উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি গ্রহণ করার পর অন্য ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা ধর্মান্তরিত না হয় তাহলে উক্ত ব্যক্তির সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন।”

অর্থাৎ হিন্দু নারী বা পুরুষ উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির মালিক হওয়ার পরে ধর্মান্তরিত হলে আর তার স্ত্রী পুত্রকন্যারা ধর্মান্তরিত না হলে সেসব নিরপরাধ হিন্দু স্ত্রী পুত্রকন্যারা উক্ত উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। ধর্মান্তরিত ওই ব্যক্তি পরবর্তীতে অহিন্দু বিয়ে করলে সেই ঘরের অহিন্দু স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা তার উত্তরাধিকার পাবে। আর তার ধর্মান্তরিতপূর্ব হিন্দু স্ত্রী পুত্রকন্যারা উত্তরাধিকারের সম্পত্তি পেতে হলে হিন্দু স্ত্রী পুত্রকন্যাদের তার মত ধর্মান্তরিত হতে হবে। সাবাস! এই খসড়া নিশ্চিতভাবেই কি সংখ্যালঘু হিন্দুদের ধর্মান্তরিত হওয়াকে উৎসাহিত করে না?? বা স্ত্রী পুত্রকন্যারা ধর্মান্তরিত না হওয়ার কারণে সম্পত্তি বঞ্চিত হওয়া কি হিন্দুদের সম্পত্তি অন্যধর্মের হস্তগত হওয়ার সহজ পথ বাৎলে দেয় না??

প্রস্তাবিত সেই হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের খসড়ায় আরো অনেক অসঙ্গতি ও মারপ্যাচ ছিল- যেমন, এখানে ‘স্ত্রী’র পাশাপাশি ‘স্বামী’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়নি। প্রশ্ন হলো, নারী ধর্মান্তরিত হলে তার স্বামীর ক্ষেত্রে কী হবে তা ওই খসড়ায় বলা হয়নি। অর্থাৎ শুধুমাত্র ধর্মান্তরিত পুরুষকে টার্গেট করে ধারাটি লেখা হয়েছিল। ধর্মান্তরিত নারীর জন্য এই আইন প্রযোজ্য হবে, নাকি হবেনা- সেই ধোঁয়াশা থেকেই গেছে। সুতরাং হিন্দু নারী ধর্মান্তরিত হলে তাদের জন্য প্রচ্ছন্ন আনুকূল্য রাখার চেষ্টা করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে। যে হিন্দু নারীদের বৈষম্য দূর করার জন্য আইন করা হচ্ছে, সেই হিন্দু নারীরা যদি আইনের মারপ্যাচে বঞ্চিতই হয় তবে বিষয়টি অধিক বিড়ম্বনার হবে। এইসব অসঙ্গতিপূর্ণ আইন প্রণয়ন হয়ে গেলে সেটা সংশোধন করার আন্দোলন আরো কঠিন হবে। তাই সার্বিক বিবেচনায় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অভিন্ন সমান উত্তরাধিকার আইন প্রণয়ন করা হউক। একই সাথে বাংলাদেশ সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইনটিও প্রণয়ন করা হউক।

লেখক- নির্তেশ সি দত্ত 

 

সকৃতজ্ঞ স্বীকৃতি⇒ লেখাটি গ্রামনগর বার্তা থেকে সংগৃহিত

ওয়েবসাইট⇒ বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ

ফেসবুক গ্রুপ লিংক⇒ হিন্দু আইন সংস্কার চাই

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ