ভয়েস অব আমেরিকা: নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসার পর গত দশ বছরে ভারতের রাজনৈতিক পটভূমি পাল্টে দিয়েছেন। তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা দলকে ছাড়িয়ে গেছে। সংসদীয় নির্বাচনের চেহারা বদলে ক্রমশ প্রেসিডেন্সিয়াল ধাঁচের নির্বাচনে পরিণত হয়েছে।
এর ফলে, বিজেপি ক্ষমতায় থাকার জন্য ক্রমশ মোদী ব্র্যান্ডের উপর নির্ভর করছে। এমনকি রাজ্য বিধান সভা নির্বাচনেও স্থানীয় নেতারা পেছনের সাড়িতে চলে যাচ্ছেন।
“মোদী শুধু প্রধান প্রচারকারী ছিলেন না, এই নির্বাচনে তিনি ছিলেন একমাত্র প্রচারকারী,” বলছেন ইয়ামিনি আইয়ার, একজন জননীতি বিষয়ক গবেষক।
মোদীর সমর্থকরা তাঁকে দেখেন একজন স্বনির্ভর, শক্তিশালী নেতা হিসেবে, যিনি বিশ্বে ভারতের অবস্থান উন্নত করেছেন। তারা মোদীর ব্যবসা-বান্ধব নীতিকে দেশের অর্থনীতি বিশ্বের পঞ্চম-বৃহত্তম হওয়ার কারণ হিসেবে দেখেন।
কিন্তু একই সাথে, তাঁর এক দশকের শাসন ভারতকে গভীর ভাবে বিভক্ত করেছে। তাঁর সমালোচকরা বলছেন, মোদীর হিন্দু-ভিত্তিক রাজনীতি দেশে অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণা ছড়িয়েছে এবং সংখ্যালঘুদের উপর, বিশেষ করে মুসলিমদের উপর নির্লজ্জ আক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ মুসলিম।
মোদীর অধীনে ভারতের অর্থনীতিতে বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এক দিকে স্টক মার্কেট রেকর্ড সৃষ্টি করছে এবং কোটিপতির সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে; অন্যদিকে তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব ব্যাপকহারে বাড়ছে। ভারতের অল্প সংখ্যক মানুষ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থেকে লাভবান হচ্ছেন।
মোদীর সমালোচকরা বলছেন, তাঁর সরকারের অধীনে দেশের গণতন্ত্র নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক বিরোধীদের দমিয়ে রাখার জন্য সরকার ক্রমশ শক্তি ব্যবহার করছে, স্বাধীন মিডিয়ার জায়গা সীমিত করে দিচ্ছে এবং ভিন্নমত দমন করছে। সরকার সমালোচকদের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, দেশ গণতন্ত্র বিকশিত হচ্ছে।
এপ্রিলের মাঝা-মাঝি সময়ে যখন ভোট গ্রহণ শুরু হয়, তখন বিজেপি তাদের প্রচারণায় “মোদীর গ্যারান্টির” উপর জোর দেয়, এবং অর্থনীতি, দারিদ্র বিমোচন ও সমাজসেবায় তাঁর দলের সাফল্যের কথা প্রচার করে। মোদী একের পর এক জনসভায় বার বার বলেন যে দেশের হাল তাঁর হাতে থাকলে, “ভারত ২০৪৭ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত হবে।”
মুসলিমদের নিশানা
তবে প্রচারণা এক পর্যায়ে ক্রমশ হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠে, এবং মোদীর মেরুকরণকারী বক্তৃতাবাজী সংখ্যালঘু মুসলিমদের নিশানা করে। এই কৌশল তাঁর মূল হিন্দু ভোটারদের মাঝে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে বলে মনে করা হয়।
তাঁর বিরোধীপক্ষ, কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন ‘ইন্ডিয়া’ জোট, মোদীর হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সমালোচনা করেছে। তারা অর্থনীতি নিয়ে অসন্তোষ থেকে লাভবান হবার আশা করছে, এবং বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি আর বৈষম্য ঘিরে তাদের প্রচারণা চালিয়েছে।
কিন্তু এক ডজনেরও বেশি বিরোধী দলের এই জোটের কাজ আদর্শগত পার্থক্যর জন্য ব্যাহত হয়েছে এবং বেশ কিছু নেতা দলত্যাগও করেছেন। এর ফলে, জোটের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
বিরোধীদের জোট আরও দাবী করছে যে, তাদেরকে অন্যায় ভাবে নিশানা করা হয়েছে। তাঁরা বলছেন, তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলো তল্লাশি, গ্রেফতার এবং দুর্নীতি সংক্রান্ত তদন্ত চালিয়েছে, যেগুলো তাঁরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে মনে করেন। সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
আরেকটি বিজয় দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের অন্যতম হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর অবস্থান পাকাপোক্ত করবে। এর আগের নির্বাচনে ২০১৯ সালে বিজেপি ৫৪৩ সংসদীয় আসনের মধ্যে ৩০৩টী জয় করেছিল।
নাঈমুল ইসলাম খান তার পত্রিকায় তারেক রহমানের উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি ছাপিয়েছিলেন। সেটা উল্লেখ করে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, খান সাহেব তারেকের লোক, বা তিনি তারেকের সঙ্গে লাইন দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই খোলাচিঠি তিনি কবে ছাপিয়েছিলেন, সেখানে কি লেখা হয়েছিল, কি ভুল আছে তার কোনো উদ্ধৃতি কেউ দিচ্ছে না। ঢালাও মন্তব্য, “তিনি তারেক রহমানকে খোলা চিঠি দিয়েছিলেন,” “তারেকের সাথে লাইন দিয়েছিলেন” ইত্যাদি ইত্যাদি। এধরনের প্রচারণা অসততা এবং উদ্দেশ্যমূলক।
আচ্ছা ভাইয়েরা, মিথ্যা কথা কেন বলেন? তিনি কি সেই খোলাচিঠি তারেক রহমান ক্ষমতাধর থাকা অবস্থায় লিখে তার কাছ থেকে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন? চিঠিটি তিনি লিখেছিলেন ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনে ক্ষমতায় আসা সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে – যখন তারেক রহমান কারাগারে।
বিচার ও শাস্তি থেকে এক রকম রেহাই দিয়ে তারেককে চিকিৎসার নামে বিদেশে পাঠানো সঠিক হয়েছে কিনা, তাকে কারাগারে রেখে বিচার প্রক্রিয়া চালালে পরবর্তী রাজনীতিটা কেমন হতো ইত্যাদি প্রশ্নে মতান্তর থাকতে পারে। ভবিষ্যতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এসব নিয়ে অনেক আলোচনা করবেন। তবে এটুকু জেনে রাখুন, তারেককে বিদেশে পাঠানো, নির্বাচন আয়োজন এবং সামরিক বাহিনীর কুক্ষিগত রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে একজন সাংবাদিকের ঐ খোলা চিঠির অবদান আছে।
সাংবাদিকের নিজের কন্ঠ থেকে সুর বেরোয় না, অথচ সবচেয়ে বড় সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদের সুরের সমালোচনা লেখে। নিজেরা বোলিং, ব্যাটিং, ফিল্ডিং কিছুই না পারলেও দক্ষ ক্রিকেটারের ভুল ধরে। নিজেরা খেলতে না জেনে দক্ষ খেলোয়ারদের খেলা শেখায়। আর নিজেরা রাজনৈতিক না হয়েও রাজনীতি শেখায় ঝানু রাজনীতিবিদকে। সাংবাদিকতা পেশার চরিত্রটাই এমন। নাঈমুল ইসলাম খান আওয়ামীলীগ বা বিএনপি করেন না। তিনি সাংবাদিক। তিনি তারেক রহমানকে খোলা চিঠি লিখে সাংবাদিকতায় কোনো পাপ করেননি।
২০০৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর দৈনিক আমাদের সময়ের প্রথম পাতায় ছাপা হওয়া ঐ খোলা চিঠিতে তারেক রহমানকে নাঈমূল ইসলাম খান যেসব পরামর্শ দিয়েছেন সেগুলো যদি তিনি মানতেন তাহলে জিয়াপুত্র ব্যক্তিগতভাবে উপকৃত হতেন এবং রাজনীতিরও উপকার হতো।
কারাগার থেকে বেরিয়ে দেশের বাইরে গিয়ে যাতে চিকিৎসা নেন এবং স্বাস্থ্যের যত্ন নেন, তৎকালীন সময়ে বন্দী এক ‘নষ্ট রাজপুত্রকে’ সেই পরামর্শ দিয়েছেন সাংবাদিক। “জুবায়দা ও জায়মার প্রতি ভালবাসা থেকে দেশের সকল মানুষের প্রতি ভালবাসা” শিখতে পরামর্শ দিয়েছেন।
তাকে পড়াশোনা করতে বলেছেন এবং ইউরোপ ও আমেরিকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষ কোর্সে অংশ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি, এমনকি আটককৃত অবস্থায় তারেক যাদের দ্বারা নিগৃহিত হয়েছেন তাদের প্রতিও, প্রতিহিংসাপরায়ন না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
বলেছেন, “দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গিতে ভ্রান্তি ছিল নিশ্চয়ই। … বাংলাদেশের খেটে খাওয়া পরিশ্রমী কৃষক-মজুর আরো অনেক ভালো জীবন যাপনের অধিকার রাখে। তাদের কথা একটু বেশি করে ভাবুন….”
তারেককে ভুল স্বীকার করার পরামর্শ দিয়ে তিনি লিখেছেন, “আমাদের রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় যে কোন ভুল স্বীকারকে অত্যন্ত অসম্মানজনক ও ক্ষতিকারক বিবেচনা করা হয়। আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিতে পারি এই ধারণা ভিত্তিহীন ও মারাত্মক বিপর্যয়কর।”
এ লেখায় অপরাধ কোথায়? ওনার লেখাটি বেশ বড়, যাদের ইচ্ছা হয়, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে লেখাটির সমালোচনা লিখুন; গণতন্ত্রে সমালোচনা ও পাল্টা সমালোচনা আত্মোপলব্ধিতে ও সমাজ-মানস গঠনে ভূমিকা রাখে।
আমি কেন নাঈমুল ইসলামের পক্ষে লিখছি? তার সঙ্গে নিশ্চয় আমার আন্তরিক সুসম্পর্ক আছে। কিন্তু ভাল সম্পর্ক থাকলেও সবার সম্পর্কে সবসময় লেখি না। আমি তার পক্ষে লিখছি, কারণ তিনি ”রাজাকার পুত্র”। একজন রাজাকার পুত্র পত্রিকার সম্পাদক হয়ে সেখানে “তুই রাজাকার” কলাম চালু করার দুঃসাহসী বীরত্ব প্রদর্শন করায় আজ আমি তার পক্ষে কলম ধরেছি।
একটি প্রতিকূল সময়ে সাংবাদিকতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নতুন ধারা সৃষ্টির কারিগর হওয়ায় তার প্রতি স্বাধীন বাংলাদেশের দায় আছে।
“মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নির্ভীক কণ্ঠস্বর” স্লোগানে ‘আজকের কাগজ’ পত্রিকা আবির্ভাবের সেই সময়টা ভাবুন – ১৯৯১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়া ও এরশাদ হয়ে খালেদা পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাবিরোধী রাজনীতির পুরো সময়টা বিবেচনা করুন। তখনকার প্রভাবশালী বাংলা পত্রিকা ‘ইত্তেফাক’ ও ‘ইনকিলাব’। ইনকিলাব ও তার মালিকের অবস্থান সবাই জানেন। আর ইত্তেফাক সেসময় মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে না হলেও এই চেতনার পক্ষে বিপ্লবী অবস্থানে ছিল না। পত্রিকাটির মালিকরা প্রায় সবসময় ছিলেন ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে; তারা মন্ত্রিত্বও নিয়েছেন – রাজনীতির এপক্ষে, ওপক্ষে; সব পক্ষেই। তাদের সুবিধাবাদী ক্ষমতারোহন নিয়ে আমাদের কথা নেই, বরং সাথে আছি নীতিতেই আমরাও আছি।
এরশাদ ও খালেদা সরকারের প্রিষ্ঠপোষকতায় ইনকিলাবের চেয়েও চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও উগ্র অবস্থান থেকে প্রকাশিত হতো বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের দল ফ্রিডম পার্টির পত্রিকা দৈনিক মিল্লাত। ঐ পত্রিকায় শেখ হাসিনার নামটাও বিকৃত করে করে লেখা হতো; হিন্দুয়ানী ভাষা থেকে জাতিকে উদ্ধারের জন্য ‘জলপ্রপাত’কে লেখা হতো ‘পানিপ্রপাত’। এগুলো ‘জলপাই’কে ‘পানিপাই’ বানানো পত্রিকা। সেনাশাসক এইচ এম এরশাদের ‘দৈনিক জনতা’ পত্রিকাও ছিল প্রায় একই লাইনের।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সবসময় সুস্পষ্ট অবস্থানে সবেধন নীলমণি ছিল ‘সংবাদ’ ও ‘বাংলার বাণী’। কিন্তু বুদ্ধিজীবী মহলের বাইরে সাধারণ মানুষের কাছে তার প্রবেশ কতটুকু ছিল?
তবে বলুন, খালেদার আমলে শানিত কলমে “তুই রাজাকার” কলাম চালু করা কোন পক্ষের দালালী ছিল? নাঈমুল ইসলাম কি তখন ক্ষমতাসীন দলের তুষ্টিসাধন করে লাভবান হওয়ার সাংবাদিকতা করেছিলেন? অনেকের মতোই সাংবাদিকতায় ও চরিত্রে আপোষকামিতা তথা বিচ্যুতির রেকর্ড খান সাহেবের নেই, একথা কখনোই বলব না। কিন্তু সেকাল থেকে আজ পর্যন্ত তার কর্মকাণ্ডে তাকে কি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের বুদ্ধিজীবী হিসেবে চেনেন?
অধিক কথা কি বলব, জাতীয় প্রেস ক্লাবের নির্বাচনের সময় নাঈমুল ইসলাম খানের ভোট কোন পক্ষ প্রত্যাশা করে? ইসলামপন্থী, এরশাদপন্থী, খালেদাপন্থী, নিজামীপন্থী, ফ্রিডমপার্টিপন্থীরা? নাকি তার ভোটটা আমরা প্রত্যাশা করি? আপনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একজন হয়ে “রাজাকার পুত্রের” ভোট পাবেন – এমনটা কেন প্রত্যাশা করেন ভাই?
আপনিও অন্তরে জানেন নাঈমুল ইসলাম খান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একজন; তার পিতার রাজনৈতিক অবস্থান মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে হলেও। আপনি আরও জানেন, নাঈমুল খান একদম অসাম্প্রদায়িক। আপনি জানেন, তিনি সাম্প্রদায়িক বৈষম্য, জাতিগত বৈষম্য, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ইত্যাদির বিপক্ষের মানুষ। তিনি পরিপূর্ণভাবে আধুনিক চিন্তাচেতনা সম্পন্ন বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ।
ছেলে বয়সে ছাত্রশিবির করেছে, এখনো গোপনে জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে টাচে আছে, বাবা-কাকাও ছিল রাজাকার – এমন মানুষও পরিচয় গোপন করে আপনার-আমার সাথে থাকে; মিথ্যা কথা বলে এবং সুবিধা নেয়। আর যে মানুষটা অকপটে তার সত্য পরিচয় দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লড়াই করে যাচ্ছে তাকে কোনঠাসা করার জন্য তার পিতার অপরাধ দেখিয়ে দেওয়ার মূল মতলব কি?
আওয়ামী লীগ করে, কিন্তু সেক্যুলারিজম কি জিনিস বোঝে না – আন্তরিকভাবে সাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী; রাজনীতি নিয়ে পুরাই ব্যবসা করে –এমন মানুষকে সালাম দিয়ে চলার চেয়ে অকপটে “রাজাকার পুত্র” হিসেবে নিজেকে স্বীকার করে অনুশোচনা প্রকাশকারী নাঈমুল ইসলাম খানকে সালাম জানানো নৈতিক দায়িত্ব মনে করি। রাজাকারের পরিবারে জন্ম নিলে রাজাকার হওয়াই তার নিয়তি, মানুষ হওয়ার অধিকার তার নেই – এমন বিশ্বাস নিয়ে কখনো চলিনি, এমন কথা কখনো বলিনি, ভবিষ্যতেও বলব না। যাদের ভাগে টান পরে তারা এসব বলুক।
গতকাল আমাদের এক রিপোর্টার ভাই একটি দৈনিক পত্রিকায় জয়েন্ট এডিটর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। ফেসবুকে পোস্ট দেখে ওনাকে আমি অভিনন্দন জানিয়েছি। আমাদের বহু সহকর্মী তাকে অভিন্দন জানিয়েছেন। আচ্ছা, ওনাকে অভিনন্দন জানানোর সময় তিনি কোন মতাবলম্বী, কতটা সৎ, কত ইঞ্চি লম্বা, তিনি নিরামিষ খান না আমিষ খান – এসব কি আমরা বিবেচনা করেছি? তিনি তার পেশাগত জায়গায় একটি বড় সফলতা অর্জন করেছেন বিধায় আমরা অকুন্ঠে বন্ধু হিসেবে তাকে অভিনন্দিত করেছি। নাঈমুল ইসলাম খান তার পেশাগত জায়গায় যদি কোনও বড় অর্জন করেন, আমরা কি তাকে অভিনন্দন জানাব না? সাংবাদিকতা পেশাটি কি আমলাদের পদের তুলনায় তুচ্ছ? একজন পত্রিকা সম্পাদক কি সরকারের একজন সচিবের তুলনায় অত্যন্ত নগন্য? তাহলে প্রধানমন্ত্রী তাকে সচিব পদমর্যাদার একটি দায়িত্বে নিয়োজিত করলে কষ্ট কোথায়?
বলুন দেখি নাঈমুল ইসলাম খান বড় কোনও বিনিয়োগ হাতে নিয়ে যদি আবার বৃহৎ একটি পত্রিকা বের করার উদ্যোগ নেন, তার কাছে চাকরির জন্য যাবেন না – কে কে আছেন? রাজাকার পুত্রের অধীনে চাকরিতে যাবেন – এটা একটা কথা হল?
নাঈমুল খান দুর্নীতিবাজ ও অসৎ হলে পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তার দায়িত্ব পালন কি কাঙ্খিত? সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত থাকা কি শুধু আমলাদের বিষয়? একজন অসৎ ও দুর্নীতিবাজ সাংবাদিক কি সমাজের অনেক বেশি ক্ষতি করতে পারে না? তার পত্রিকার সম্পাদক হওয়া নিয়ে টেনশন নেই, তাকে অভিনন্দন জানাতেও রাজি আছেন, শুধু তার প্রধানমন্ত্রীর প্রেস-সেক্রেটারি হওয়া নিয়ে টেনশন – এরকম কেন? অসৎ ও দুর্নীতিবাজ হলে নাঈমুল খানের সম্পাদক থাকা উচিত নয়, তার জেলে থাকা উচিত। সব পেশার জন্য এটাই সত্য হওয়া উচিত।
“তুই রাজাকার” কলামের জন্য নাঈম খানের ব্যাপারে বহু মানুষের জ্বলুনি আছে। তারা প্রত্যাশা করে একজন রাজাকার পুত্র তাদের পক্ষে থাকবে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকরা রাজাকারের বিরুদ্ধে তার কলমকে নেবে, কিন্তু ভয়ে থাকবে তার ভাগটা যেন তিনি নিতে না পারেন।
নাঈমুল খান দক্ষতা ও বাকপটুতা দ্বারা তার অবস্থান অর্জন করেছেন একথা সত্য। জামাত-বিএনপির লোকজনের ভাষায় তিনি, “চাটুকারিতা” করে হাসিনার আস্থা অর্জন করেছেন। আচ্ছা, ঐ পদে কি সরকারের বিরোধী কাউকে নিয়োগ দেওয়া আশা করেন? অনেকে আছে, যারা আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে কোনো অবদান ছাড়াই অনেক বড় বড় পদ হাতিয়ে নিয়েছেন। তাদেরও সমালোচনা হয়। আবার যে দক্ষতার সাথে সরকারের পারপাস সার্ভ করে তারও সমালোচনা হয়। যদি তিনি সরকারের চাটুকারিতা করে থাকেন এবং যদি তিনি যোগ্য হন, তাহলে তো সরকারের রাজনৈতিক নিয়োগে ভুল নেই। একদিন নয়, দু’দিন নয়, বছরের পর বছর নাঈমুল খান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে মানুষের মত প্রকাশ ও জানার অধিকারের পক্ষে কাজ করেছেন। তাতে ভুল-ভ্রান্তি ও বিচ্যুতিও থাকতে পারে। কিন্তু তার অবদান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে; অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পক্ষে। এতে আওয়ামীলীগের কতটুকু উপকার বা ক্ষতি হয়েছে তারা বুঝবে।
আগেও বলেছি, আবার বলছি, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব পদের জন্য সম্ভাব্য যেসব নাম শুরু থেকে আলোচনায় ছিল তারা সবাই দক্ষ, যোগ্য ও উত্তম মানুষ। তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত এবং আরও বড় জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা তাদের আছে। যারা যেখানে কাজ করেন তারা সেখানেই অর্জন প্রত্যাশা করেন এবং লেগে থাকলে প্রাপ্তিও থাকে। তাদের কারও নিয়োগে আমার আপত্তি নেই, বরং অর্জনে অভিনন্দন জানাব।
বিভিন্ন মহল থেকে বিরোধিতার ফলশ্রুতিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব পদে নাঈমুল ইসলাম খানের নিয়োগ কিছুটা ঝুলে গেছে, এ আমি জানি। শেখ হাসিনা কোন সাংবাদিককে অথবা কোন আমলাকে তার প্রেস সচিব নিয়োজিত করবেন, এ সিদ্ধান্ত ও এক্তিয়ার সম্পূর্ণ তাঁর। কিন্তু একজন মানুষকে অহেতুক হেনস্তা করা বা অপদস্ত করা অনুচিত কাজ মনে করি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠায় এক রাজাকার পুত্রের অবদানকে মানুষ যেন শ্রদ্ধায় স্মরণে রাখে।
শকুন্তলা থেকে রাধারাণী –সনাতন ধর্মের ভিন্ন দিগদর্শন
পুলক ঘটক ও অরুণাভ সেন
মুখবন্ধ
ঘটনাটি ঘটেছিল সেই ১৯৩১ সালে। সাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ দেবের ‘কাব্য-দিপালী’ পত্রিকা সম্পাদনায় সাহায্য করছিলেন এক বিধবা নারী। কারও চোখে তিনি হয়তো “সামান্যা রমণী।” বাস্তবে তিনি তখন “অপরাজিতা” ছদ্মনামে খ্যাত বাংলার এক বিশিষ্ট কবি। প্রকৃত নাম রাধারাণী দেবী; ভারতবর্ষে নারী বিকাশের পথে অনুপ্রেরণার এক নাম। এই কবির সাথে হৃদয়ের গাঁটছড়া তৈরি হয়ে যায় নরেন্দ্রনাথের। তাঁদের হার্দিক সম্পর্ক বিয়ের সম্পর্কে গড়ায়। দু’জনের বয়সে পনেরো বছরের ব্যবধান। তার উপর প্রতিকূল আবহ। সে-সব শুধু উপেক্ষিতই হল না, কন্যাসম্প্রদানেও নজির তৈরি হল। নিজেই নিজেকে সম্প্রদান করলেন রাধারানি দেবী। ১৯৩১-এর ৩১মে সেই বিয়ের পরের দিন সংবাদপত্রে শিরোনাম হয় ‘রাধারানি-নরেন্দ্র দেব বিবাহ: কন্যার আত্মসম্প্রদান’।
রাধারাণীর জীবন বিপ্লব
রাধার স্বামী সত্যেন্দ্রনাথের জীবন কেড়েছিল এশিয়াটিক ফ্লু নামের মারণব্যাধি। তখন বয়স মাত্র তেরো বছর আট মাস। এয়োতির চিহ্ন মুছে গিয়েছে। খাওয়া দাওয়া থেকে পোশাকে – সবকিছুতে বদলে গেছে অভ্যস্ত জীবনের ছন্দ। খাদ্য হিসেবে বরাদ্দ হয়েছিল হবিষ্যান্ন, একাদশীতে নির্জলা উপবাস। এরপরের ইতিহাস মরা গাছে ফুল ফোটানোর।
শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় পরিজন বিশেষত শাশুড়ি মায়ের স্নেহছায়া বাস্তবের রুক্ষতা থেকে অনেকখানি আড়াল করেছিল অকাল বিধবাকে। শাশুড়ি সুশীলা বালা ঠিক করলেন, ফের বৌমার বিয়ে দেবেন। কিন্তু বাধাটা এল বিধবা কন্যার নিজের বাপের বাড়ি থেকেই। রাধারাণীর মা নারায়ণী দেবী সেকেলে মানুষ। তিনি ছেলে ও এক জামাইকে পাঠালেন শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়েকে ফিরিয়ে আনার জন্য। বললেন তাঁর মেয়ের দ্বিতীয় বিয়ে হতে পারে না; তাহলে তারা সমাজের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না।
সুশীলা বালা প্রতিবাদ করলেও পরিস্থিতির চাপে পুত্রবধূকে ফিরিয়ে দিলেন। মাথাভাঙায় বাপের বাড়ি এসে কন্যা বুঝল বৈধব্যের শুদ্ধাচার, নিয়মনিষ্ঠা কাকে বলে। থান পরানো হল, খুলে দেওয়া হল গায়ের গয়না, ছেঁটে দেওয়া হল মাথার কালো চুল। খাদ্য হিসেবে বরাদ্দ হল হবিষ্যান্ন, একাদশীতে নির্জলা উপবাস।
কিছু দিন পরে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে এলেও মা প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছেন, রঙিন শাড়ি আর আমিষ আহার চলবে না। সে কথা জেনে কষ্ট পেলেন শাশুড়ি সুশীলা বালা। কিন্তু হাল ছাড়লেন না তিনি। আদরের বৌমার গায়ে ফের উঠল ইঞ্চিপাড় কাপড়, হাতে দু’গাছি চুড়ি, গলায় কানে সোনা। রাধারাণীকে তিনি দিলেন বড় ছেলের সম্মান!
মরা গাছে ফুল ফোটানোর চ্যালেঞ্জ রাধারানী নিয়েছিলেন। তাঁর গোটা জীবন যেন নাটক আর গল্পে মোড়া। তিনি তখন অন্তঃপুরিকা। সাহিত্য চর্চা আর নিয়মিত পড়াশোনা করে দিন কাটে। খাতার পর খাতা ভরিয়ে তোলেন। তাঁর লেখা প্রকাশের নেপথ্যের কাহিনী বেশ ইন্টারেস্টিং। আশুতোষ দত্ত ততদিনে কোচবিহার ছেড়ে কলকাতায় এসেছেন; বাড়িতে ফিরেছে সাহিত্য মনস্কতার পরিবেশ।
এই সময় রাধারাণীর ছোট পিসিমা চমৎকারিণী দেবী দেবরপুত্র নরেন্দ্র দেবকে দিয়ে তাঁর ভাইঝির কবিতা প্রতিভা যাচাই করতে চাইলেন। সেই কবিতা পড়ে সাহিত্য জগতের প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবশালী নরেন্দ্র হতবাক। নিজের জবানিতে লিখেছেন “আমি কবিতা পড়ে অবাক হয়ে গেলুম”। নরেন্দ্রর উদ্যোগে রাধুর কবিতা প্রকাশ হতে লাগলো।
রাধারাণী কেন অপরাজিতা হলেন, কেন অপরাজিতাকে বারো বছর অজ্ঞাতবাসে রাখলেন সে কথা জানা যায় তাঁর লেখা একটি চিঠি থেকে। অপরাজিতার কবিতায় যারা তাঁকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছিলেন তাদের মধ্যে প্রধান স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। কবি রাধারানীকে ডেকে পাঠিয়েছেন, প্রশ্ন করেছেন। তখন রাধু বলেছেন, “আপনার কাছে সত্য কথাই বলছি, এই কবিতা পুরুষের রচনা নয়। মেয়েরই হাতের রচনা…… অপরাজিতা তাঁর আসল নাম নয়, ছদ্ম নাম। সময় হলেই সে আপনার সামনে এসে পরিচয় দিয়ে আপনাকে প্রণাম করে ধন্য হবে। এখন তাঁর আসার উপায় নেই।”
সাহিত্য জগতের কিছু অবিচারের বিরুদ্ধে রাধারানীর মনে যে প্রতিবাদ শানিত হচ্ছিল তার নান্দনিক প্রকাশ সম্ভব হয় ‘অপরাজিতা’ নামের দ্বিতীয় সত্তার সযত্ননির্মানে। সেই নির্মাণ এতটাই কুশলী যে ভাষাপ্রয়োগ, রচনাশৈলী, বিষয় নির্বাচনের পাশাপাশি সম্পূর্ণ ভিন্ন ছাঁদের হাতের লেখা আয়ত্ত করেছিলেন রাধারানী।
কবি নরেন্দ্র দেবের সাথে রাধারাণীর কবে প্রথম চাক্ষুস পরিচয় হয়েছিল তার দিনক্ষণ জানা নেই। তবে কাব্য-দীপালির প্রথম সংস্করণ সম্পাদনার সময় রাধারাণী দত্ত নরেন্দ্র দেবকে সাহায্য করেছিলেন। এটি প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। এর চার বছর পরে দৈনিক বঙ্গবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হল চাঞ্চল্যকর সংবাদ। শিরোনাম “রাধারাণী-নরেন্দ্র বিবাহ, কন্যার অত্মসম্প্রদান”। সাহিত্য জগত শুধু নয় সেদিন আলোড়ন উঠেছিল সমাজে। বিংশ শতকের তিনের দশকে বাল্যবিধবার পুনর্বিবাহ যথেষ্ট চর্চার বিষয়। আর যার সঙ্গে বিয়ে হল তিনি বিপত্নীক নন।
রাধারাণী বিয়ের দিন লিলুয়ায় এসেছিলেন তাঁর প্রথম শ্বশুর বাড়ি থেকে। কাউকে কিছু বলেননি। এই না বলে আসার অপরাধবোধে দীর্ণ হয়েছেন আমৃত্যু। মনে মনে তাকে কষ্ট পেতে দেখে কন্যা নবনীতা মাকে প্রশ্ন করেছেন, “কেন তিনি এই কাজ করেছিলেন? যারা তাঁকে এত স্বাধীনতা দিয়েছে, এমন কি নিজেরাই আবার তাঁর বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ….“। রাধারাণী মেয়েকে বলেছিলেন আমার ওপর গোটা পরিবারের নির্ভরতা বেড়েছিল। এই সময়ে বিয়ের কথা জানালে যদি ওদের খারাপ লাগত! হয়ত তিনি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। তাই না জানিয়ে চলে এসেছিলেন।
১৯৩৪, বিয়ের তিন বছর পরে নরেন্দ্রর মা মৃণালিনী আছেন তাদের দক্ষিন কলকাতার বাড়িতে। রাধারাণী তখন সন্তানসম্ভবা। হঠাৎ একদিন দুপুরবেলা সেই বাড়িতে হাজির সুশীলা বালা। ঘোর লজ্জায় রাধারাণী। সুশীলা বালাই তাঁকে বুকে টেনে পরিস্থিতি সহজ করে দিলেন। ছেলে হয়েছিল, তবে রইল না বেশি দিন। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সে চলে গেল মায়ের কোল শূন্য করে।
তবে কী মা হওয়া তাঁর ভাগ্যে নেই! স্বামী নরেন্দ্র রাধারাণীর শরীরের অবস্থায় চিন্তিত। দূর্বল শরীরে হাঁপানির প্রকোপ বেড়েছে। শেষ পর্যন্ত ধন্বন্তরী চিকিৎসক শ্যামাদাস বাচস্পতি তাঁকে সুস্থ করলেন। পরামর্শ দিলেন হাওয়া -বাতাস খেলে এমন বাড়িতে থাকার। এরপর সম্পূর্ণ নিজের তৈরি নকশায় রাধারাণীর জন্য তৈরি হল বাড়ি; নাম ‘ভালো-বাসা’। সত্যিই সুস্থ হয়ে উঠলেন রাধারাণী, মনের মত করে সাজিয়ে তুললেন তাদের স্বপ্ননীড় ‘ভালো-বাসা’। ততদিনে সাহিত্য ও ব্যক্তিগত জীবনে সে সুপ্রতিষ্ঠিত। আত্মীয় পরিজনরা সবাই তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন। তারা আর দূরে থাকতে পারলেন না। রাধারাণীর প্রথম শ্বশুর বাড়ির লোকেরা যাতায়াত শুরু করলেন ‘ভালো-বাসা’য়।
১৯৩৭সালে আবার সন্তানসম্ভবা হলেন, ১৯৩৮এর ১৩ জানুয়ারি ওই বাড়িতে এল নতুন এক প্রাণ, রবীন্দ্রনাথ নামকরণ করলেন ‘নবনীতা’। সেই মেয়েও পরবর্তী কালে হয়ে উঠলেন বাংলা সাহিত্যের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব যাকে মানুষ চেনে নবনীতা দেবসেন নামে।
শাস্ত্রবিচার
রাধারাণীর জীবনের উপরোক্ত বর্ণনা আমি ”ধ্রুবতারাদের খোঁজে” ফেসবুক পেজ থেকে (তথ্য যাচাইয়ের পর) নিয়েছি। এ পর্বে আরেক জোড়া নরনারীর প্রণয়কাহিনী বলব, যাদের নিয়ে মহাকবি কালীদাস অমর কাব্যনাট্য লিখে গেছেন। তারও আগে লিখেছেন মহাকবি ব্যাসদেব। সে কাহিনী বর্ণনার আগে সামান্য শাস্ত্র বিচারের চেষ্টা করব। সনাতন শাস্ত্রগ্রন্থে সুপ্রাচীনকালের প্রথা অনুযায়ী আট (৮) রকমের বিয়ে নির্দেশিত আছে। এগুলো হল ১. ব্রাহ্ম, ২. দৈব, ৩. আর্য, ৪. প্রাজাপত্য, ৫. আসুর, ৬. গান্ধর্ব, ৭. রাক্ষস ও ৮. পৈশাচ।
পাত্র-পাত্রী নির্বাচন বা সংযোগ ঘটানোর প্রক্রিয়াভেদে বিয়ের এই আট রকমের প্রকারভেদ। অর্থাৎ আপনি যদি নিজে উপযাচক হয়ে আপনার মেয়েকে কারও কাছে নিঃস্বার্থে দান করে দেন, তাহলে সেটা এক প্রকার বিয়ে। শাস্ত্র অনুযায়ী এটি সর্বোৎকৃষ্ট, যার নাম ব্রাহ্ম বিবাহ।
যদি পূণ্যলাভের আশায় যজ্ঞের পুরোহিতকে দক্ষিণা হিসেবে নিজের কন্যারত্ন দান করে দেন, তা হবে অরেক প্রকার বিয়ে। এর নাম দৈব বিয়ে যা, দ্বিতীয় সর্বোত্তম। বলাবাহুল্য, আমাদের শাস্ত্রভক্ত দাদারা বর্তমানকালে পুরোহিতকে কন্যা দান করে পূণ্য অর্জনে রাজি নন।
ধর্মীয় উদ্দেশ্যে এক জোড়া বা দুই জোড়া গো-মিথুন গ্রহণের বিনিময়ে যদি কন্যা দান করেন তা আরেক রকম বিয়ে (আর্য বিবাহ)। ছেলে-মেয়ে সুখে সংসার করবে –এরকম চুক্তিতে যদি কন্যাদান করেন তাহলে হবে আরেক রকম বিয়ে। এর নাম প্রাজাপত্য বিবাহ, যা বর্তমানে আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত রয়েছে। আট প্রকার বিয়ের তালিকায় এটি চতুর্থ; অর্থাৎ এটি মধ্যম প্রকারের বিয়ে।
শুল্ক বা পণের বিনিময়ে আপনি যদি আপনার মেয়েকে (বিক্রি করে) দেন তবে তা আরেক রকম বিয়ে। এর নাম আসুর বিয়ে, ভাল’র ক্রমে যার অবস্থান ৫ নম্বরে। দান করা কিংবা বিক্রি করা নয়; যদি পাত্র-পা্ত্রী নিজেরা পরস্পরকে পছন্দ করে বিয়ে করে, তাহলে সেটি আরেক প্রকারের। একে বলে গান্ধর্ব্য বিয়ে। তালিকায় এটি ৬ নম্বরে। শাস্ত্রে এর বিধান আছে।
যদি ক্ষমতার জোরে কারও মেয়েকে বলপূর্বক তুলে এনে বিয়ে করেন সেটা হবে আরেক রকম বিয়ে। একে বলে রাক্ষস বিয়ে যার অবস্থান ৭ নম্বরে। তবে শাস্ত্র অনুযায়ী ক্ষমতাধর ক্ষত্রিয়দের জন্য এ উত্তম বিয়ে, পুরাণ ও মহাভারতে যার অনেক দৃষ্টান্ত আছে। তবে এখনকার যুগে এটাকে ক্রাইম হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এরকম বীরত্ব কেউ দেখালে বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ অনুসারে অপহরণ মামলায় ফাসবেন এবং দন্ডনীয় হবেন।
আর যদি কোনো মেয়েকে ঘুমন্ত, উন্মত্ত বা নেশাগ্রস্ত করে তাকে প্রতারণাপূর্বক সম্ভোগ করেন সেটি হবে সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রকারের বিয়ে –যার নাম পৈশাচ বিয়ে। এধরনের কর্মকে সে যুগেও প্রশংসা করা হয়নি এবং এখনকার আইনেও ধর্ষণ দণ্ডনীয় অপরাধ।
পূর্ববোক্ত আট প্রকার বিয়ের আবার বর্ণভেদে বিয়ের অধিকার ভেদ আছে। অর্থাৎ ব্রাহ্মণের জন্য যা বৈধ, শূদ্রের জন্য তা বৈধ নয়। এছাড়াও বর্ণ ভেদে তিন প্রকার বিয়ে আছে – সমলোম, অনুলোম ও প্রতিলোম। বিয়ের কোয়ালিটি অনুযায়ী সন্তানদের বর্ণ পরিচয় শাস্ত্রে নির্ধারণ করা আছে। সেই অনুযায়ী বিদ্যমান হিন্দু আইনেও অধিকার নির্ধারণ করা আছে।
আমি এই যে বিবরণ দিলাম. এজন্য আমাকে কেউ গালি দেবেন না আশা করি। কারণ এগুলো শাস্ত্র এবং আইনের কথা, আমার কথা নয়। গালি দিলে তা শাস্ত্রপ্রণেতা মুনি ঋষিদের উপরে গিয়ে পড়বে। যেহেতু বিবাহই পারিবারিক আইন রচনার ভিত্তি, তাই আমি বিষয়গুলো আলোচনা করছি। শাস্ত্র এবং আইন জানলে আশা করি আপনারও ক্ষতি হবে না।
এই শাস্ত্র কথায় একটি বিষয় পরিস্কার। নারী দানের বস্তু, বিক্রয়ের বস্তু, জোর করে ছিনিয়ে নেয়ার বস্তু এবং অন্যায় পন্থায় উপভোগের বস্তু –এ সবই শাস্ত্র নির্ধারিত। এর সঙ্গে এটিও শাস্ত্র নির্ধারিত, তারা মানুষ। তারা চাইলে কারও দান বা বিক্রয়ের বস্তু না হয়ে নিজেদের পছন্দে সঙ্গী নির্বাচন করতে পারে।
শাস্ত্রের এই নির্দেশনায় গান্ধর্ব্য বিবাহ থাকলেও স্বয়ংবর সভায় পাত্র বাছাই করার ব্যবস্থা দেখা যায় না। কিন্তু মহাভারতে তার অনেক প্রমাণ আছে। অর্থাৎ কিছু বিষয় স্মৃতি শাস্ত্রে না থাকলেও প্রথা বলবৎ।
কলিযুগের ব্যতিক্রম হল, ইতিহাসে অপরাজিতা কবি রাধা রানী দেবী ১৯৩১ সালে নিজেই বিয়েতে নিজেকে সম্প্রদান করেছিলেন। বাবা-জ্যাঠারা সম্প্রদান করেননি। আপনি বলতেই পারেন, “কলিযুগে আরও কত কি দেখব!” মনে রাখবেন, মানবীয় সাল/বর্ষ গণনার ইতিহাসে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর বা কলি যুগ নামক কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই। কলি যুগের এই বিয়ে অতীতের বিভিন্ন প্রকারের বিয়ের চেয়ে উত্তম না অধম সে বিচারও মনুষ্যত্বের। এযুগের নারী-পুরুষ আসলে নিজেরাই নিজেদের সম্প্রদান করে, কারণ কালটা কলিযুগ- যা অতীতের চেয়ে উন্নত যুগ।
প্রিয় পাঠক, কলিযুগ আপনার অপছন্দ তাই না? আপনি প্রাচীনপন্থী, তাই প্রাচীনের প্রতি আপনার ভালবাসা থাকলে আপনাকে জোর করে আধুনিক বানাতে চাই না। কিন্তু সেই প্রাচীনকালেও যদি আত্মসম্প্রদান ঘটে থাকে তবে মানবেন তো? যদি পুরাণে বর্ণিত দ্বাপর যুগেও নারীর নিজেই নিজেকে সম্প্রদানে বিয়ে হয়, তবে মানবেন তো?
পুরাণে আত্মসম্প্রদানের বিভিন্নরকম একাধিক নিদর্শন আছে, তার একটি বলব। সে ছোটখাটো লোকের বিয়ে নয়, কৌরব বংশের আদি পুরুষ স্বয়ং রাজা দুষ্মন্ত’র বিয়ে হয়েছিল বনে জন্ম নেয়া নারী শকুন্তলার আত্মসম্প্রদানে। শকুন্তলা বিয়েতে নিজেই নিজেকে দুষ্মন্ত’র কাছে সম্প্রদান করেছিলেন। ঐ যুগলের প্রণয়কাহিনী শুনুন। মহাভারতের আদিপর্বের ৮৮ অধ্যায় থেকে তুলে ধরছি।
বনের মধ্যে পথ হারানো তৃষ্ণার্ত রাজা দুষ্মন্ত হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলেন কন্ব মুনির আশ্রমে। সে নির্জন শান্তির নিলয়ে দেখা পেলেন অপূর্ব সুন্দরী শকুন্তলার। অচেনা সে তরুণী তাকে পানাহার করালেন, শান্তি দিলেন। কিন্তু তাকে দেখে রাজার অন্তর উথাল পাতাল।
শকুন্তলা মেনকা নামে এক বেশ্যার সন্তান; স্বর্গ-বেশ্যা! মর্ত্যের বেশ্যারা উপভোগ্য হলেও তাদের সন্মান নেই। তবে স্বর্গের বেশ্যাদের সম্মান-মর্যাদা অনেক। বেশ্যার মেয়ে জানলে আমরা কেউ বিয়ে করতে চাই না। কিন্তু আমাদের প্রাচীন মুনি-ঋষি-মহাপুরুষদের অনেকেই বেশ্যার সন্তান।
বেশ্যা দেখলে ঋষিদের কাপড় ভিজে যাওয়ার ঘটনা অনেক আছে। মেনকাকে দেখেও বিশ্বামিত্র ঋষির সেই অবস্থা হয়েছিল। দু’জনের কৃতকর্মে জঙ্গলের মধ্যে শকুন্তলার জন্ম দিয়ে সেখানেই শিশুটিকে ফেলে দিয়ে গিয়েছিলেন সে মহান জন্মদাতারা। কণ্ব মুনি শিশুটিকে কুড়িয়ে পেয়ে সন্তানস্নেহে বড় করেছিলেন।
সেই শকুন্তলা এখন তরুণী কিংবা যুবতী। বনের মাঝে নির্জন কুটিরে নারীরত্ন শকুন্তলাকে দেখে একাধারে প্রেমার্ত ও কামার্ত হলেন রাজা দুষ্মন্ত। নানাবিধ উপহার দিয়ে মুগ্ধ করার চেষ্টায় তিনি শকুন্তলাকে বললেন, “আজ হইতে আমার সমস্ত রাজ্য তোমার হউক; তুমি আমার ভার্যা হও”।।৩।।
এরপর তিনি বিয়ে সংক্রান্ত শাস্ত্রবাক্যের রেফারেন্স দিয়ে বলছেন,
“সুন্দরি, তুমি গান্ধর্ব্ব বিবাহ অনুসারে আমাকে গ্রহণ কর। কেন না ক্ষতিয়ের পক্ষে গান্ধর্ব্ব বিবাহই আট প্রকার বিবাহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।”।।৪।।
গান্ধর্ব্বেণ চ মাং ভীরু! বিবাহেনৈহি সুন্দরি!।
বিবাহানাং হি রম্ভোরু! গান্ধর্ব্বঃ শ্রেষ্ঠ উচ্যতে।।৪।।
শকুন্তলাও রাজার প্রতি অনুরোক্ত হয়েছেন। কিন্তু তিনি রাজার এরকম প্রস্তাবে তাৎক্ষণিকভাবে রাজি হলেন না। তিনি বললেন, “আমার বাবা (কন্ব মুনি) আসুক। তিনি আমাকে আপনার কাছে সম্প্রদান করবেন।”
আমার বাবা রাগ করতে পারে, তিনি একজন মুনি, আমি বাবার ইচ্ছার বাইরে যেতে পারব না, “তিনি যাঁহার হস্তে আমাকে দান করিবেন, তিনিই আমার ভর্ত্তা হইবেন।।৬।।” – শকুন্তলা এসব কথা বলে রাজাকে ধৈর্য ধরতে বলেন। আর দুষ্মন্ত, “কিচ্ছু হবে না, তুমি চিন্তা কইরো না” এ ধরনের কিছু কথা বলে শকুন্তলাকে পটানোর চেষ্টা করেন আর কি!
যা হোক, এ পর্যায়ে বিবাহবিধি এবং উচিত-অনুচিত নিয়ে তাদের দু’জনের মধ্যে কিছু শাস্ত্রীয় বাহাস হয়। মহাভারতের রচয়িতা ঋষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস সেখানে শকুন্তলার মুখ দিয়ে মনু সংহিতার সেই বহুলালোচিত বক্তব্যটিও উপস্থাপন করেছেন, যেখানে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, “নারীর কোনো স্বাধীনতা নেই।”
“পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে।
পুত্রস্তু স্থাবিরে ভাবে ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি”।।৭।।
পন্ডিতপ্রবর মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের পদ্যে এর বাংলা হল,
“জনক করিবে রক্ষণ শৈশব যখন,
যৌবনে রক্ষিবে পতি করিয়া যতন ;
বৃদ্ধকালে রক্ষা তারে করিবে তনয়,
স্বাধীনতা অবলারে দেওয়া ভাল নয়।”
এই যুক্তি খণ্ডন করে রাজা দুষ্মন্ত কি বলছেন শুনুন,
“আত্মনো বন্ধুরাত্মৈব গতিরাত্মৈব চাত্মনঃ।
আত্মনৈবাত্মনো দানং কর্ত্তুমর্হসি ধর্ম্মতঃ”।।১৩।।
“দেখ – নিজেই নিজের বন্ধু এবং নিজেই নিজের গতি; সুতরাং তুমি ধর্ম্ম অনুসারে নিজেই নিজকে দান করিতে পার”।।১৩।।
এই যে “নিজেই নিজকে দান করিতে পার” বা “আত্মনৈবাত্মনো দানং কর্ত্তুমর্হসি ধর্ম্মতঃ” কথাটা বেদব্যাস সুস্পষ্টভাবে সেখানে লিখলেন এবং সেটারই বাস্তবায়ন দেখালেন।
এখানে তিনি আট প্রকার বিয়ে, তার মধ্যে কোনটা উত্তম, কোনটা অধম; ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র বর্ণভেদে কার কোনটাতে অধিকার বা অগ্রাধিকার ইত্যাদি আবার বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। কথাগুলো স্মৃতিশাস্ত্র তথা মনুসংহিতার রেফারেন্সেই বলা হয়েছে।
শাস্ত্রবাণী দিয়ে বিষয়টি “ধর্ম্মসঙ্গত” বোঝানোর পর শকুন্তলা গান্ধর্ব্য মতে বিয়েতে রাজি হলেন। তারপর বলছেন,
যদি ধর্ম্মপথস্ত্বেষ যদি চাত্মা প্রভর্মম।
প্রদানে পৌরবশ্রেষ্ঠ! শৃণু মে সময়ং প্রভো।।।২১।।
“পৌরবশ্রেষ্ঠ, যদি ইহা ধর্ম্মসঙ্গত হয় এবং আমি যদি আমাকে দান করিতে সমর্থ হই, তবে আমার প্রার্থনা শুনুন”।।২১।।
এখানে তাদের মিলনে যে সন্তান জন্ম নেবে তাকে রাজা করতে হবে এই শর্ত দেন শকুন্তলা।
এই শাস্ত্র আলোচনাগুলো পরস্পরের প্রতি বিশেষভাবে অনুরোক্ত এক জোড়া নরনারীর মধ্যে শুধু ঐ মুহুর্তের কথোপকথন ভাবলে ভুল করবেন। নরনারীর পরস্পরের প্রতি এরকম আত্মদানকে কণ্ব মুনি শাস্ত্রসন্মত হিসেবেই সেখানে স্বীকৃতি দিয়েছেন। মহর্ষি বেদব্যাস ও তার শিষ্য পরম্পরায় বৈশ্যাস্পায়নরা একে পরিপূর্ণ শ্রদ্ধায় পেশ করেছেন। মনে রাখতে হবে, হিন্দুদের সবচেয়ে প্রিয় শাস্ত্র গীতা মহাভারতেরই অংশ।
এখানে প্রচলিত শাস্ত্রীয় নির্দেশের আরেকটি লঙ্ঘন অনুমোদন করার বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, কণ্ব মুনির পালিত সন্তান হিসেবে বিবেচনা করলে শকুন্তলা ব্রাহ্মণ কন্যা। আবার বিশ্বামিত্র ঋষির ঔরসজাত সন্তান হিসেবে বিবেচনা করলেও তিনি ব্রাহ্মণ কন্যা। কিন্তু রাজা দুষ্মন্ত ছিলেন ক্ষত্রিয়। শাস্ত্রে উচ্চ বর্ণের পুরুষের সঙ্গে নিম্নবর্ণের কন্যার বিয়ের বৈধতা আছে, যাকে অনুলোম বিবাহ বলে। কিন্তু নিম্নবর্ণের পুরুষের জন্য উচ্চ বর্ণের কন্যার পাণীগ্রহণ বা প্রতিলোম বিবাহ নিষেধ করা আছে। তাহলে দুষ্মন্ত ক্ষত্রিয় হয়ে কিভাবে ব্রাহ্মণ কন্যাকে বিয়ে করে?
এর ব্যাখ্যায় মহাভারতের ঐ পর্বে বলা হয়েছে, যেহেতু রাজা বিশ্বামিত্র জন্মসূত্রে ক্ষত্রিয় ছিলেন এবং পরে তপস্যা দ্বারা ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করেছিলেন, তাই তিনি জন্ম পরিচয় অনুসারে ক্ষত্রিয়ই। তাই তার ঔরষজাত কন্যা শকুন্তলা রাজা দুষ্মন্তের জন্য সমবর্ণের এবং বৈধ। এই ব্যাখ্যার পর যার যা ইচ্ছা বুঝুন।
শকুন্তলাকে বনের মধ্যে রেখে দুষ্মন্তের পলায়ন, শকুন্তলার গর্ভে ভরতের জন্ম, নিজ সন্তানকে রাজা দুষ্মন্তের অস্বীকার ও প্রতারণামুলক আচরণ, পরবর্তিতে দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার পুনরায় মিলন ইত্যাদি আছে। বিভিন্ন পুরাণে এই বর্ণনায় কিছু তারতম্য থাকলেও মৌলিক ভিন্নতা নেই। এর বিস্তৃত পাঠ ভাল পাঠকের জন্য। তাই আমার লেখায় সবটা নয়, মূল গ্রন্থ পড়ুন এবং অন্ধত্ব দিয়ে নয়, বিবেক দিয়ে উপলব্ধি করুন। জ্ঞানমনস্কতা বৈষম্যমুক্তির পথ দেখাক। রাধারাণী ও শকুন্তলাদের জীবন সহজ হোক; মানব মর্যাদাপূর্ণ হোক। শুভমস্তু।
গত ৯ মে ২০২৪ দ্য ডেইলি স্টারে পার্টিশন বিষয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা করলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মননকুমার মন্ডল। বক্তৃতায় তিনি দেশভাগ নয়, পার্টিশন শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কেনো তিনি পার্টিশন শব্দটি ব্যবহার করলেন সে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তার ভাষায় পার্টিশন একটি আয়োজিত বিষয়। ব্রিটিশেরা সেই আয়োজন করেছিল দক্ষতা সঙ্গে। দেশভাগ শব্দের ভেতর পার্টশনের পুরো বিষয়টি আসে না।
অধ্যাপক মননকুমার মনে করেন, পার্টিশন শব্দটি বহু ব্যবহারে বাংলা হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষ যখন এই বিষয়ে কথা বলেন তখন সহসাই পার্টিশন শব্দটি ব্যবহার করেন। শব্দ চয়ন ও তার ব্যবহার নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, শব্দের ভেতর থাকে মনোভঙ্গি, রাজনীতি ও আগামীর নিশানা। ধর্মের ভিত্তিতে করা পার্টিশনের ব্যাপ্তি সাগরঅবধি।
অধ্যাপক মননকুমার মণ্ডলসহ সংশ্লিষ্ট গবেষকদল পার্টিশনের টেক্সট উন্মুক্ত করতে কাজ করছেন। পশ্চিম বাংলায় মুদ্রিত ফর্মে পার্টিশনের রিপ্রেজেটেশন মূলত ট্রমা, স্মৃতিকারতা, হাহাকার ও শূন্যতার বয়ান- যা মূলত ট্রমায় ঠাসা। এ ট্রমা মূলত পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম বাংলায় যাওয়া শিক্ষিত ও উচ্চবিত্তের অভিজ্ঞতা। বৈচিত্র্যতার দিক থেকে দেখলে এ টেক্সটের ভেতর খুব বেশি ভিন্নতা নেয়। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম বাংলায় যাওয়া হিন্দুরা শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর ছিলেন বলে তাঁরা অভিজ্ঞতা সহজে তুলে ধরতে পেরেছেন।
অন্যদিকে, পশ্চিম বাংলা থেকে পূর্ব বাংলায় আসা মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা মূলত ছিলেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির যারা শিক্ষা-দীক্ষায় ততটা অগ্রসর ছিলেন না। পার্টিশন বিষয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা লিখতে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি। একইভাবে আর্থ-সামাজিক সূচকে অনগ্রসর হিন্দু জনগোষ্ঠী পূর্ব বাংলা থেকে যারা পশ্চিম বাংলায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতাও মুদ্রিত আকারে অধরা থেকে গেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, যারা পার্টিশনের অভিজ্ঞতা লিখতে পারেননি তাদের বয়ান কী অজানা থেকে যাবে? কিংবা কেউ যদি লিখিত ইতিহাসের বাইরে পার্টিশনের ইতিহাস জানতে চান তাহলে কোথায় তা অনুসন্ধান করবেন?
ইতিহাসকে যদি সামগ্রিকতার আলোকে দেখতে হয় তবে এ অনুসন্ধান জরুরি। কারণ, মুখে মুখে থাকা টেক্সটের মূল্য মুদ্রিত টেক্সটের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। লিখিত টেক্সট কেবল মান উত্তীর্ন, অলিখিত টেক্সটও গুরুত্বপূর্ণ বটে। কারণ, বাঙালির যাপিতজীবনের বড় অংশ চলে কথকতায়, মুদ্রিতজীবনের ব্যাপ্তি সেখানে খুব বিস্তৃত নয়। কথার জগৎ অনেকবড়। এ কথার পড়তে থাকে সামগ্রিকতা। সুতরাং পার্টিশনের কথার যে ভাণ্ডার তা মুদ্রিত আকারে আনতে পারলে পার্টিশন ইতিহাসের পরিকাঠামো আরও সমৃদ্ধ হবে।
অন্যভাবে দেখলে, মুদ্রণের প্রতি এদেশের সাধারণ মানুষের এক ধরনের নির্লিপ্ততা রয়েছে। তারা মূলত কথাশ্রয়ী। কথার ভেতর বাঁচতে চায়। পূর্ব বাংলার বাউল সাধক শাহ্ আবদুল করিমের বক্তব্য তা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে-“কালির কলমে হয় না কালাম।” অর্থাৎ লিখে ফেললেই জ্ঞান হয়ে যায় না। এমনকি বর্ণের শরীরে সবসময় সত্য থাকে না। কথা অমূল্য।
তাই এপার বাংলা ওপার বাংলার মানুষের মুখেমুখে থাকে পার্টিশনের কথা শুনতে হবে। কথার ভেতর ঢুকতে হবে। এ অ্যাপ্রাচ পার্টিশনের বহুমাত্রিকতার সন্ধান দিবে। মানুষের মুখে বেঁচে থাকা, স্মৃতিকথা ও অভিজ্ঞতা পার্টিশনের টেক্সট উদারীকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অধ্যাপক মননকুমার মণ্ডলেরা সেই পথে হাঁটছেন। পার্টিশনের টেক্সটকে সংকীর্ণ বাইনারি ভালো বা মন্দ, ট্রমা না স্মৃতিকারতা সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার দিন শেষ হয়ে আসছে। পার্টিশন একটি বিস্তৃত প্রপঞ্চ যাকে সংকীর্ণ ফ্রেমে বাধা যায় না। পার্টশনের জনভাষ্য যথাযথভাবে তুলে আনতে পারলে নিশ্চিত ইতিহাসের স্বাস্থ্য আরও সমৃদ্ধ হবে।
এলেক্স হেলি তার রুটস্ উপন্যাসে উল্লেখ করেছেন, কেবল বিজয়ীদের নয় যথাযথভাবে মূল্যায়িত হলে বিজিতদের ইতিহাসও মহত্তর হতে বাধ্য। সমাজের নিচুস্তরে বাস করা প্রান্তিক মানুষদের পার্টিশনের গল্প অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। এ উদ্যোগের ভেতর নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার ঘ্রাণও পাওয়া যাচ্ছে। পার্টিশনের ঝড় কীভাবে সমাজের নিচুস্তরের মানুষদের ওপর দিয়ে বয়ে গেলো? কী নির্যাস সঞ্চিত হলো তাদের মানসপটে? তা জানার আবশ্যকতা অস্বীকার করার উপায় নেই।
এখন প্রশ্ন তো উঠতে পারে পার্টিশনের ৭৫ বছর পর কতোজন প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যাবে? কতটুকু রয়েছে তাদের শারীরিক বা মানসিক স্থিতি? বা স্মৃতি থেকে তারা অভিজ্ঞতা কতোটুকু পুনরুৎপাদন করতে পারবেন? গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক তার বিখ্যাত প্রবন্ধ ক্যান সাবঅলটার্ন স্পিক?-এ এমন প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি মন্তব্য করেছেন টেক্সট আরোপিত না হয়ে সার্বভৌম হলে সেখান থেকে নতুন নতুন বিষয়ের জন্ম হতে পারে। পার্টিশনের টেক্সট সীমাবদ্ধ গন্ডির মধ্যে না রেখে উদার করা গেলে সেই শার্সি দিয়ে নতুন আলো আসবেই।
উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিক মিশেল ফুকোকে উদ্বৃত্ত করে গায়ত্রী স্পিভাক আরও বলেছেন- অদেখা বিষয়কে যদি দেখানো যায় তাহলে তা এক ধরনের পরিবর্তন আসে অর্থাৎ পার্টিশন নিয়ে প্রান্তীয় মানুষদের যে অজানা অভিজ্ঞতা তা যদি তুলে আনা যায় তবে এই ধারার ইতিহাস চর্চায় প্যারাডাইমগত পরিবর্তন আসবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অধ্যাপক মননকুমার মণ্ডলদের এ অনুসন্ধানের দার্শনিক ও অ্যাকাডেমিক পাটাতন শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। তারা কয়েকবছর ধরে পার্টিশনের এ বহুমাত্রিক বয়ান অনুসন্ধান করছেন।
ইতিমধ্যে সংগ্রহ করেছেন প্রায় সাড়ে এগারশো ঘণ্টা জনভাষ্য-যা রেকর্ডবদ্ধ করা হয়েছে। এ অ্যাপ্রাচকে বলা হচ্ছে, রিপোজিটরি বা তথ্যভাণ্ডার। আর্কাইভ নয়। কারণ, আর্কাইভের রাজনীতি আছে, আর্কাইভ সবসময় নৈর্ব্যক্তিক নয়। আর্কাইভের মালমসলা যোগাড়ে রাষ্ট্রের বিশেষ পক্ষপাত থাকে। রাষ্ট্র স্বস্তিদায়ক ও প্রচারসর্বস্ব তথ্য জমাতে চায়। রিপোজিটরি বা তথ্যভাণ্ডার উন্মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি। যেখানে থরে থরে থাকবে, তরতাজা ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত ও বয়ান। নিঃসন্দেহে বস্তুনিষ্ঠ ও প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে রিপোজিটরি অভিনব ও উদ্ভাবনী উদ্যোগ।
পার্টিশন বিষয়ে ইতিহাস চর্চার নতুন ধারা ট্রমানির্ভর ন্যারেটিভির সীমানা ভাঙছে। উঠে আসছে নানাধরনের অভিজ্ঞতা নির্ভর গল্প, যেসব গল্প লেখার সার্মথ্য অভিঘাতীদের নেই। ইতিমধ্যে উত্তর প্রজন্মের খোঁজে শিরোনামে এ গবেষণা প্রকল্পের কয়েকটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে-যা পাঠকপ্রিয়তাও পেয়েছে।
পার্টিশন নিয়ে চোখ খোলা এ উদ্যোগের অগ্রনায়ক অধ্যাপক মননকুমার মণ্ডলসহ তার গবেষণা দলের সদস্যদের অভিবাদন। পার্টশন বিষয়ে উন্মোচিত টেক্সট পাঠককে আরও গভীরে নিয়ে যাচ্ছে। এ টেক্সট কেবল শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত ও ধনিক শ্রেণির অভিজ্ঞতার সীমিত গন্ডির বিষয় নয়। এর পরিধি অনেক বিস্তৃত যার কেন্দ্রে রয়েছে মূলত আমজনতা। আমজনতার অভিজ্ঞতানির্ভর পার্টিশনের টেক্সট লিবারেটেড বা উন্মুক্ত হচ্ছে-যা খুব জরুরি ছিল।
“আমি তোমার মতের সঙ্গে দ্বিমত করতে পারি; কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকারের জন্য আমি আমার জীবন দিতে পারি।”- ভলতেয়ার
ভলতেয়ারের যে উক্তি আজকের এই ঘুনে ধরা পঁচা-গলা সমাজেও সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। কিংবদন্তি ফরাসী সাহিত্যিক ও মহান দার্শনিক ভলতেয়ারের ২৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল বৃহস্পতিবার (৩০ মে)।
পুরো নাম ফ্রঁসোয়া-মারি আরুয়ে। যিনি ভলতেয়ার নামেই বেশি পরিচিত। তাকে বলা হয়,ফরাসি আলোকময় যুগের একজন মহাকবি ও লেখক, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক ও পথ প্রদর্শক। খ্রিস্টান ধর্মের (বিশেষ করে রোমান ক্যাথোলিক চার্চের) বিভিন্ন বিষয়ের কঠোর সমালোচনা করায় সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি। দার্শনিক মতবাদ, সৃজনশীল সাহিত্যিক কাজের মাধ্যমে তিনি ধর্মীয় স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা এবং ধর্ম ও রাষ্ট্রকে পৃথক রাখার পক্ষে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।
১৬৯৪ সালের ২১ নভেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ভলতেয়ারের জন্ম। চতুর্দশ লুইয়ের রাজত্বকালে তার পরিবার রাজনৈতিকভাবে অনেক সুবিধা পেয়েছিল।
দুর্ভাগ্যক্রমে তার বয়স যখন মাত্র সাত বছর, তখনই তার মা মারা যান। এই ঘটনাটি বাবা ও বড় ভাই-বোনদের প্রতি তাকে বিদ্রোহী করে তোলে। পরিণামে বিদ্রোহী এই বালকটি আশ্রয় পায় ধর্মপিতা অ্যাবের কাছে, যিনি নিজেও একজন মুক্ত-চিন্তাবিদ হিসেবে পরিচিত।
লেখাপড়া শেষ করার পর তিনি সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। স্বপ্ন ছিল একজন নাট্যকার হবেন, কিন্তু তার ধর্মপিতা বিরোধিতা করেন এবং একজন সরকারী কর্মকর্তা হতে চাপ দেন। তাই ধর্মপিতার ইচ্ছে অনুযায়ী প্যারিসে নোটারি অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু, তিনি তার অধিকাংশ সময়ই বিদ্রূপাত্মক কবিতা লিখে ব্যয় করেছেন। পরে ফরাসি রাষ্ট্রদূতের সচিব হিসেবে নেদারল্যান্ডে চলে যান।
প্যারিসে ফিরে আসার পর ১৭১৭ সালে তিনি ফরাসি সরকারকে নিয়ে বিদ্রূপাত্মক লেখা প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি ডিউক অব অর্লিন্সকে নিয়ে উপহাস করেছেন। ফলস্বরূপ তিনি কেবল প্যারি থেকেই বিতাড়িত হননি, সেইসঙ্গে তাকে ১১ মাস জেল খাটতে হয়েছে। কারাগারে থাকার সময় ‘হেনরিয়ের্ডে’ নামে একটা মহাকাব্য রচনা করেন তিনি।
অভিজাত ব্যক্তিদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে পরের বার ১৭২৬ সালে বিনা বিচারে তাকে ইংল্যান্ডে নির্বাসন দেয়া হয়। সেখানে তিন বছর নির্বাসনে থাকাকালে তিনি জন লোক, নিউটন ও ব্রিটিশ সরকার ব্যবস্থা নিয়ে অধ্যয়ন করেন।
প্যারিসে ফিরে আসার পর ১৭৩৪ সালে তিনি ‘ফিলোসফিক্যাল লেটার্স অন ইংলিশ’ নামে একটি প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই প্রবন্ধগুলোতে তিনি ব্রিটিশ সমাজ ব্যবস্থার পক্ষে কথা বলেন, যা ছিল ফরাসি সমাজ ব্যবস্থার বিপরীত। ফলে তার বইগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং জনরোষানলে পড়ে আবারও তিনি শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
১৭৩৪ থেকে ১৭৪৯ সময়ে নির্বাসনে থাকাকালে তিনি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নিয়ে অধ্যয়ন করেন। একই সঙ্গে তিনি লেখালেখি চালিয়ে যেতে থাকেন। বিভিন্ন ধরণের দার্শনিক এবং তাত্ত্বিক বিষয়বস্তু তিনি তার লেখায় তুলে ধরেছেন।
১৭৪৯ সালে তিনি পটসড্যাম চলে যান। সেখানে তিনি বার্লিন অ্যাকাডেমি অব সাইন্সের সভাপতিকে আক্রমণ করে লেখা প্রকাশ করেন। ফলে আবারও তিনি জনরোষানলে পড়েন। গ্রেফতার এড়াতে তিনি সেই শহর ছেড়ে চলে যান। এদিকে ফ্রান্সের শাসক পঞ্চদশ লুই তাকে প্যারিসে নিষিদ্ধ করে দেন। এমতাবস্থায় তিনি এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরতে থাকেন এবং একপর্যায়ে সুইজারল্যান্ডে গিয়ে আশ্রয় নেন।
বিভিন্ন সময়ে নির্বাসনে থাকাকালে তিনি প্রায় ২১ হাজার বই সংগ্রহ করেছেন এবং অধ্যয়ন করেছেন। অতঃপর তিনি রাষ্ট্র থেকে চার্চকে পৃথক রাখার জন্য আহবান জানান। অর্থাৎ তিনি ধর্মকে রাজনীতি থেকে পৃথক রাখার পক্ষে ছিলেন।
নির্ভুলভাবে বলতে গেলে তিনি তার ব্যতিক্রমধর্মী লেখনীর মাধ্যমে নতুন ধারণা ও চিন্তাসমূহকে ফলপ্রসূভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি তার বিখ্যাত ‘CANDIDE’ (১৭৫৯) গ্রন্থে গটফ্রিড উইলহ্যাম লিবনিজ এর অতি আশাবাদী দর্শনের স্পষ্ট সমালোচনা করেছেন। অন্যদিকে ব্লেইস প্যাসক্যাল কর্তৃক মানব অমঙ্গলতা নিয়ে অতি নৈরাশ্যবাদী দর্শনেরও বিরোধিতা করেছেন তিনি।
একজন দার্শনিক হিসেবে ১৭৬৪ সালে তিনি বিখ্যাত ‘Philosophical Dictionary’ গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এছাড়া ১৭৫১-১৭৭২ সালে লেখা তার প্রবন্ধগুলো তিনি ‘Encyclopedia’ শিরোনামে প্রকাশ করেন। এসব লেখায় তিনি অত্যন্ত খোলামেলাভাবে ফরাসি সমাজ, ধর্ম ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমালোচনা করেছেন।
ইতিহাসে ভলতেয়ারের অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। কেননা কিভাবে ইতিহাসকে সংরক্ষণ করতে হবে, তার এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির ধারণা দিয়েছিলেন তিনি। তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে ধারাবাহিকভাবে ইতিহাসের ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করেছিলেন।
তিনি খ্রিস্টান, ইসলামসহ প্রায় সব ধর্মেরই সমালোচনা করেছিলেন। তাই অনেকের কাছেই তিনি একজন নাস্তিক হিসেবে পরিচিত। মূলত তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন একেশ্বরবাদী। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে যারা একেশ্বরবাদ নিয়ে কাজ করেছেন, তাদের অন্যতম একজন ছিলেন ভলতেয়ার।
তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন, তবে অন্ধ বিশ্বাসের পরিবর্তে পর্যবেক্ষণ ও যৌক্তিক বিচারের মাধ্যমে তিনি ঈশ্বরকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন। ‘Treatise on Toleration’ (১৭৬৩) গ্রন্থে তিনি সব মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন। তার মতে, সব মানুষেরই ঈশ্বর একজন। সুতরাং ধর্মকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে বিভেদ ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা উচিত নয়।
তার কনফুসিয়াসের রাজনৈতিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাই তিনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিভিন্ন দুর্বলতার সমালোচনা করেছেন। বরং একটি সচেতন, দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক রাজতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন তিনি। তার মতে, জনগণকে শিক্ষিত করলে কেবল জনগণেরই উপকার হবে তা নয়, রাজার জন্যও এটা প্রয়োজন। এভাবেই তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে অভিজাত বর্গের সমালোচনা করেছেন এবং সাধারণ মানুষের ধর্মীয় ও বাক স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছেন।
২৫ বছর পর প্রথমবারের মতো ১৭৭৮ সালে তিনি তার প্রিয় জন্মভূমি প্যারিসে ফিরে আসেন। এক সময় যাকে বার বার প্যারিসবাসী তাড়িয়ে দিয়েছিল, আজ তারা তাকে বুকে আলিঙ্গন করে গ্রহণ করেন। ওই সময় বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের সঙ্গে দেখা হলে তিনি ভলতেয়ারকে একজন মুক্ত স্থপতি হিসেবে ঘোষণা করেন।
অবশেষে ১৭৭৮ সালের ৩০ মে এই মহান দার্শনিক মারা যান।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন সাহিত্যিক, যার অসাধারণ লেখনী শক্তি তার সময়ে তুমুল বিতর্কের ঝড় তুলে দিত। এমনও হয়েছে, সেই ঝড়ের আঘাতে কখনো কখনো অনেক প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত দার্শনিক মতবাদ কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাসের ভীত নড়ে যেত। তার অধিকাংশ কর্মই ছিল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমালোচনাকে কেন্দ্র করে। ফলস্বরূপ তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে, জেল খাটতে হয়েছে, এমনকি নির্বাসনেও যেতে হয়েছে।
তার লেখনি সাধারণ মানুষকে এতটাই প্রভাবিত করত যে, কখনো কখনো শহরের পর শহর লোকজন উত্তপ্ত হয়ে যেত এবং তার রচিত গ্রন্থগুলো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিত। সমাজ ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করার সুবাদে তার শত্রুর সংখ্যা ছিল অগণিত। তিনি সরকারের অকার্যকারিতা, সাধারণ মানুষের মূর্খতা, চার্চের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা এবং দুর্নীতিবাজ ও পরজীবী স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করেছেন।
তাই আঠারো শতকের ওই সময়ে রোমান ক্যাথোলিক চার্চ, ফরাসি সরকার, এমনকি সাধারণ মানুষের কাছেও তিনি শত্রুতে পরিণত হয়ে পড়েন। এতদসত্ত্বেও তিনি ছিলেন নাগরিক অধিকার আন্দোলনের এক অন্যতম অগ্রসেনানী। যিনি উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা, নাটক, ইতিহাসসহ সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই কাজ করেছেন। যেখানে কেবল চিঠির সংখ্যাই ছিল ২১ হাজার এবং বই-পুস্তকের সংখ্যা ছিল প্রায় ২ হাজারেরও বেশি।
পুরো একটি জীবন বিতর্কে জর্জরিত থাকা সত্ত্বেও, আজ তাকে ইতিহাসের একজন সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক এবং দার্শনিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ভলতেয়ারের কিছু বিখ্যাত উক্তি-
“পড় এবং নাচ কর, এই দুটি কর্ম কখনো বিশ্বের কোনো ক্ষতি করবে না।”
“জবাব দিয়ে নয়, একজন মানুষকে বিচার কর তার প্রশ্ন দিয়ে।”
“জীবন হচ্ছে একটি ডুবন্ত জাহাজ, তাই বলে নৌকায় থাকার সময় গান গাইতে ভুলে যাওয়া উচিত নয়।”
“যদি ঈশ্বর নাই বা থাকেন, আমাদের কর্তব্য হবে ঈশ্বরকে আবিষ্কার করা।”
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি বলেছেন, মানুষের মধ্যে যারা অনিত্য জীবন ধারণ করে নিত্যজীবন ধারণ করেছেন এবং যারা মানুষের কল্যাণে কাজ করেন তারাই প্রকৃত মহৎ। গতকাল বিকালে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের কমলছড়ি গ্রামে ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন (পিবিএম) অনাথালয়’ পুনরায় চালুর লক্ষ্যে আয়োজিত এক সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি এসব কথা বলেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, জ্ঞানদীপ্ত, বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের উপস্থিতিতে আজ পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন (পিবিএম) অনাথালয় পুনরায় চালুকরণ হলো। তিনি বলেন, অনাথালয় হলো যেখানে অসহায় বা দ্বীন-দুঃখীদের লালনপালন করা হয়। অনাথালয়ে অনাথদের আশ্রয় দান একটি মহৎ কাজ।
তিনি বলেন, আমরা মানুষ। মানুষের অনিত্য জীবনের মধ্যে যারা নিত্য জীবন ধারণ করেছেন তারাই মহৎ ও মহান। মহান ও মহৎ মানুষ পৃথিবীতে এসেছেন আবার চলেও গেছেন। তারা মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, নবী করীম (সা.), যীশুখ্রিষ্ট, গৌতম বুদ্ধ এরা ছিলেন মানুষরুপী দেবতা।
প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি আরো বলেন, জীবনে বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যের প্রয়োজন রয়েছে। ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য অনৈক্য দূর করে সকলকে একে-অপরের কাছে আসতে হবে। বৃহত্তর ও দূরদর্শী চিন্তা ছিল বলেই সত্তরের দশকে শ্রদ্ধেয় জ্ঞানশ্রী ভান্তে দীঘিনালায় পার্বত্য চট্টল অনাথাশ্রম এবং আশির দশকে খাগড়াছড়ির কমলছড়ি শ্রদ্ধেয় সুমনালংকার ভান্তে পিবিএম’র মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। এইসব মহীয়সী মানুষদের সৃষ্টিকে লালন এবং এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব সবাই মিলেই পালন করতে হবে।
প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার দেশের মানুষের কথা ভাবে, দেশের শান্তির কথা ভাবে বলেই পার্বত্য অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সংঘাত বহুলাংশে বন্ধ হয়েছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের মনে শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের স্রোতধারা বহমান রয়েছে। আগামীতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
আমরা নারীরা ছোট বেলা থেকে ছেলেদের মতই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি, ছোট বেলা থেকে ছেলেদের মতই মেয়েদের অভিভাবক, শিক্ষকগণ উপদেশ দেন ভালো করে লেখাপড়া করতে হবে, ভালো রেজাল্ট করতে হবে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বি সি এস ক্যাডার হতে হবে, ভালো চাকরি পেতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু অভিভাবক থেকে শিক্ষক কেউই বলেন না মেয়েদের জীবনের কঠিন বাস্তবতা সম্পর্কে, যেটা ছেলেদের থেকে মেয়েদের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন, সেটা বিয়ের পর সংসার জীবনে প্রবেশ করার পর, একটা মেয়ে সে যতই শিক্ষিত, মেধাবী হোক না কেন ঠিকই দিনের পর দিন তাকে সংসারের ঘানি টানতেই হয়, সেই তিনবেলা রান্না, ঘরের কাজকর্ম সবই করতে হয়, কিন্তু পুরুষদের কিন্তু এসব করতে হয় না।
একটা মেয়ে বাইরে কাজ করলেও তাকে বাসায় এসে ঠিকই রান্না করতেই হবে। এখানে অনেকে অনেক কথা বলতে পারেন, যে সব শ্বশুরবাড়ি খারাপ নয়, সব স্বামীরা খারাপ নয়, তাদের বলছি, পুরুষ মানুষ হল, আকাশের মত রং বদলায়, একসময় মনে হবে সে খুব ভালো, আরেকসময় সে তার উগ্র রূপটি দেখাবে, স্বার্থে আঘাত না লাগা পর্যন্ত সবাই ভালো সেজেই থাকে।
হ্যা তবে কিছু পুরুষ অবশ্যই ভালো আছেন কিন্তু সেটা কয় পার্সেন্ট? আমার তো মনে হয় ২০% ও হবে না। নারীদের বিয়ের পরই হয় ক্যারিয়ার স্যাক্রিফাইস করতে হয় না হয় দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয়, অনেকেই বলতে পারেন, টাকা বেশি থাকলে কাজের লোক রেখে কাজ করাবে, সেটাই বা কয়জনে পারে বলেন তো, হিন্দু দের ক্ষেত্রে তো হিন্দু কাজের লোক পাওয়া ই যায় না। ৯০% স্বামীরা স্ত্রী দের দিয়ে রান্না করাতে চান, সন্তান লালন পালন করাতে চান, কাজের লোকের হাতে চান না এবং নিজেরাও কিচ্ছু করতে চান না। আর তা যদি বউ করতে না চায় তাহলে সেই বউ বাদ, অন্য বউ আনো, সমাজ, পরিবার সবার এই মেন্টালিটি। আর হিন্দু নারীদের তো ডিভোর্স, খোরপোশ কিচ্ছু নেই, তাই হিন্দু পুরুষদের আরও সুবিধা।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থায় নারীরা শিক্ষিত স্বাবলম্বি হয়েও খুব একটা লাভ হচ্ছে না, সংসারের জাতাকলে পিষ্ঠ হয়ে তার জীবনের দুর্দশাগুলো কাটছে না। সারাজীবন সংসারের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে শেষ বয়সে সন্তান রাও মুখ ফিরিয়ে নেয়, এটাই আমাদের সমাজে নারীর জীবনের বাস্তবতা।
প্রয়োজন শক্ত আইন, আর পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন। তা না হলে, পরিবার তন্ত্র ভেঙে পড়বে চীন, জাপান, কোরিয়ার মত, ওরা তো অনেক উন্নত, সেখানকার নারীরা সবাই স্বাবলম্বী। সেখানে নেই ধর্মীয় গোড়ামি, ধর্মের দোহাই দিয়ে কেউ নারীদের দাবিয়ে রাখতে পারে না। সেখানকার নারীরা নাকি বিয়ে করতে চায় না, সেসব দেশের জনসংখ্যা ও ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। তাও ভালো নারীরা অন্তত স্বাধীন ভাবে বাঁচতে তো পারছে।
মিথ্যা এই পরিবার তন্ত্র, সামাজিক অবকাঠামো যার ছায়াতলে নারী সহ অন্যান্য দুর্বল মানুষদের নিপীড়ন করা হয় প্রতিনিয়ত। যেখানে সম অধিকার উপেক্ষিত, মানবাধিকার উপেক্ষিত, লাঞ্চিত হয় নারী সহ দুর্বল জনগোষ্ঠী সেই সামাজিক পরিকাঠামো এবং পরিবারতন্ত্র নিপাত যাক। গড়ে উঠুক স্বাধীন, সম অধিকার, মানবাধিকার এ পূর্ণ একটি সমাজ ব্যাবস্থা।
বিচ্ছেদ তিক্ত ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া হলেও অনেকের কাছে ডিভোর্স একমাত্র সমাধানের পথ। নানা কারণে দাম্পত্য জীবনে কলহ দেখা দিতে পারে। ফলে সংসার টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না অনেক সময়। আর এজন্য দেশে দেশে রয়েছে বিবাহ বিচ্ছেদ আইন। তবে ব্যতিক্রম ফিলিপিন্স ও ভ্যাটিকান সিটি। দেশ দুটিতে আইন অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদ অবৈধ।
ভ্যাটিকান ধর্মীয় রাষ্ট্র হওয়ায় বিষয়টি স্বাভাবিক ধরে নেওয়া হলেও এশিয়ার দেশ ফিলিপিন্সের এমন আইন অবাক করার। এমনকি দেশটির দম্পতিদের একটা বড় অংশের প্রতিবাদের পর আইনে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে ফিলিপিন্সের সরকার।
ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ ‘বংবং’ মার্কোস জুনিয়র মনে করেন, কিছু ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং এর বিকল্পও থাকা উচিত। প্রেসিডেন্টের এই ভাবনা থেকে ফিলিপিন্সে বিবাহ বিচ্ছেদের আইন পাস হতে যাচ্ছে।
ফিলিপিন্সের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ দেশটিতে বিবাহ বিচ্ছেদের আইন করতে একটি বিল পাস করেছে। আগামী আগস্টে বিলটি উচ্চকক্ষ সিনেটে উত্থাপন করা হবে। এরপর প্রেসিডেন্টের সম্মতিসূচক সইয়ের শেষে আইনে পরিণত হতে।
নতুন এই বিলের লেখক ও পার্লামেন্টের প্রতিনিধি এডসেল ল্যাগম্যান বলেন, ভ্যাটিকান ছাড়া বিশ্বের একমাত্র দেশ ফিলিপিন্স, যেখানে বিবাহ বিচ্ছেদ এখনো বেআইনি। এটি এই দেশের ঐতিহ্য। তবে যেসব ফিলিপিনো নারীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, যারা পারিবারিক সহিংসতার শিকার, যাদের বিয়ের কার্যত মৃত্যু হয়েছে, তাদের মুক্তির জন্য নতুন আইন তৈরি হচ্ছে। এই আইন বিয়ে এবং সামাজিক সম্পর্ক সম্বন্ধে ফিলিপিন্সে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরবে বলে মনে করেন ল্যাগম্যান।
বিবাহ বিচ্ছেদের এই আইন তৈরির চেষ্টা ফিলিপিন্সে নতুন নয়। ২০১৮ সালে এমন একটি বিল নিম্নকক্ষে পাস হলেও উচ্চকক্ষে পাস করা সম্ভব হয়নি। ২০২০ সালের আদমশুমারি অনুসারে, ফিলিপিন্সের রোমান ক্যাথলিকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মোট জনসংখ্যার ৭৮.৮%। দেশটির জনসংখ্যার একটি বড় অংশের ধর্মীয় ভাবনা এই আইন পাস বাধাগ্রস্ত করছে। সূত্র- ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
শিব নারায়ন দাশ কেবল দেশের পতাকার সঙ্গেই নয় বরং স্বাধীনতার ধারাবাহিক সংগ্রামের একজন অন্যতম কারিগর। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার সঙ্গে অনেকেই যুক্ত থাকলেও যতদিন দেশের পতাকা থাকবে ততদিন শিব নারায়ন দাশ ইতিহাস হয়ে থাকবেন। তিনি কখনোই তার দায়িত্বের প্রতি অবহেলা করেননি। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত দেশ ও দেশের মানুষের কথা ভেবেছেন।
বৃহস্পতিবার (৩০ মে) জাতীয় প্রেস ক্লাবের আব্দুস সালাম হলে মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশের প্রথম পতাকা আঁকা শিল্পী শিব নারায়ন দাশের স্মরণে আয়োজিত স্মরণসভায় এসব কথা বলেন বক্তারা। শিব নারায়ন দাশের পরিবার সভাটির আয়োজন করে।
সভায় বিশিষ্ট আইনজীবী ও শিব নারায়ন দাশের বন্ধু অ্যাড. জেড আই খান পান্না বলেন, ‘তাকে নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। এতো মানুষ তখন ছিল তাহলে পতাকা আঁকার জন্য তাকে ডাকার কি দরকার ছিল? তাদের দিয়ে করাতেন। তার মানে এখানে একটা ঘাটতি ছিল। এই ঘাটতি পূরণ করার জন্য তখন একমাত্র বিশ্বস্ত লোক ছিল শিব নারায়ন দাশ। তাকে খোঁজা হয় নাই কুমিল্লায় এমন কোনও হিন্দু বাড়ি ছিল না। সব বাড়িতে হানা দিয়ে তাকে খোঁজা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ষাটের দশকে একটা পোস্টার লাগানোও ছিল তীব্র সাহসের ব্যাপার। শিবু দাকে শুধু আমরা না, পুরো জাতি হারিয়েছে।’
বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, ‘শিব নারায়ন দাশ ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন। তা আর কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, দেশের পতাকার সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে থাকবে। তিনি একজন স্বপ্নবান মানুষ ছিলেন।’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমাদের দেশ এখন পুতিনের রাশিয়া, উত্তর কোরিয়ার দুঃশাসনের সঙ্গে তুলনা হচ্ছে। লোকেরা বলছে, কলকাতায় গিয়ে আওয়ামী লীগের এমপি বটি কাবাব হয়ে গেছে। যারা পতাকা, দেশ, স্বাধীনতা, স্বাধীনতার চেতনাকে পিষ্ট করেছে তাদের আজ এই অবস্থা।’
বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলনের সভাপতি শুভ্রাংশু চক্রবর্তী বলেন, ‘শিবুদা অনেক ছোট বয়স থেকেই সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ছাত্রলীগের দুই ধারার মধ্যে যারা প্রগতির পক্ষে ছিলেন, তাদের পক্ষে ছিলেন শিব নারায়ন দাশ। তিনি যা বলতেন সেটা মনে প্রাণে ধারণ করতেন।’
শিব নারায়ন দাশের ছেলে অর্ণব আদিত্য দাশ বলেন, ‘আমার বাবা জীবনের শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে গেছেন। বাবার পতাকা তৈরির ঘটনা, সেই সময়ের রাজনীতি, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, কারা ছিলেন তার সব কিছুই লিখে গিয়েছেন। বাবা সব সময় বলেছেন, আমাকে একটা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, আমি তা পালন করেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্য সবাই যেমন তাদের পরিবার-পরিজন ফেলে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনিও তাই করেছেন।’
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন শিব নারায়ন দাশের স্ত্রী গীতশ্রী চৌধুরী, শ্রমিক নেতা আব্দুল ওয়াহেদ, শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি জহিরুল ইসলাম, বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান প্রমুখ।
দক্ষিণ কোরিয়ার ধনকুবের চে তায়ে-ওনকে বিবাহবিচ্ছেদের পর সাবেক স্ত্রীর খোরপোশ বাবদ ১ লাখ ৩৮ হাজার কোটি ওন বা ১০০ কোটি ডলার দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। জানা গেছে, এটি দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে দামি ডিভোর্স। খবর বিবিসির।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন চে তায়ে-ওন। এ কারণে স্ত্রী রোহ সো-ইয়ংয়ের সঙ্গে ৩৫ বছরের বিবাহিত সম্পর্কের ইতি ঘটে। বিচ্ছেদের প্রায় এক দশক পরে গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ মে) খোরপোশ বাবদ এ অর্থ প্রদান করার নির্দেশ দেন সিউল হাইকোর্ট।
জানা গেছে, চে তায়ে-ওন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রভাবশালী বহুজাতিক কোম্পানি এসকে গ্রুপের চেয়ারম্যান। খোরপোশের অর্থের পাশাপাশি চে’র কোম্পানির শেয়ারও তার সাবেক স্ত্রী পাবেন বলে রায় দিয়েছেন সিউল হাইকোর্ট।
এর আগে ২০২২ সালে পারিবারিক আদালত চেতায়ে-ওনকে ৬ হাজার ৬৫০ কোটি ওন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। এসকে গ্রুপের শেয়ার দেওয়ার জন্য রোহ সো-ইয়ংয়ের অনুরোধ নাকচ করেছিল পারিবারিক আদালত।
দক্ষিণ কোরীয় মুদ্রায় চে তায়ে-ওনের সম্পদের আর্থিক মূল্য প্রায় ৪ লাখ কোটি ওন ধরেছে আদালত। বিচ্ছেদ হওয়ায় চে’র সাবেক স্ত্রী এই সম্পদের আনুমানিক ৩৫ শতাংশ পাবেন। রায়ে বলা হয়েছে, রোহ সো-ইয়ং রাজনৈতিক পরিবারের হওয়ায় চে তায়ে-ওনের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড এবং এসকে গ্রুপের সম্পদ বাড়াতে ভূমিকা রেখেছিলেন।
এদিকে চে তায়ে-ওনের আইনজীবীরা বলেছেন, আদালতের এই আদেশ একতরফা। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলেও জানিয়েছেন আইনজীবীরা।