‘বৈষম্যমূলক’ হিন্দু আইনের সংস্কার দাবি

ডেইলি স্টার: বাংলাদেশে প্রচলিত হিন্দু আইন প্রথাগত এবং অবিচারমূলক, বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য আখ্যা দিয়ে এর সংস্কারের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ।

আজ শুক্রবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির একটি মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের পক্ষ থেকে এ দাবি জানানো হয়।

হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ সংবাদ সম্মেলন থেকে পাঁচটি দাবি জানায়। এগুলো হলো— হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ; হিন্দু অভিভাবকত্ব আইনে বাবা-মায়ের সমান অভিভাবকত্ব; হিন্দু দত্তক আইন সংস্কার; বিবাহবিচ্ছেদ আইন প্রণয়ন এবং বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করণ।

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক পুলক ঘটক জানিয়েছেন, গত ১ সেপ্টেম্বর তাদের সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করেছে, যেখানে ১০১ সদস্যের একটি নির্বাহী পরিষদ থাকবে। তারা হিন্দু আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কারের দাবিতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করবেন।

তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ কায়েমি স্বার্থ রক্ষার জন্য হিন্দু আইন সংশোধনের দাবির বিরোধিতা করছেন। কিন্তু বৈষম্য নিরসনের জন্য এবং অধিকারবঞ্চিতদের অধিকার পুনরুদ্ধারে আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাব। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ, এই সম্প্রদায়ের অর্ধেক নারী জনগোষ্ঠীর সবাই এবং মানবতাবাদী মানুষদের সবাই এই আইনের সংস্কার চায়।’

লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ময়না তালুকদার বলেন, বাংলাদেশে প্রচলিত প্রথানির্ভর হিন্দু আইনে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী এবং তৃতীয়লিঙ্গের মানুষ সুদীর্ঘকাল যাবত নানাভাবে বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছেন। আইনগুলো প্রায় শতাব্দিকাল যাবত অসংশোধিত রয়ে যাওয়ায় এবং কোডিফাইড না হওয়ায় আদালতে মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠায় ব্যাঘাত ঘটছে।

তিনি বলেন, এই আইন ব্রিটিশ আমলে গৃহীত এবং সনাতন হিন্দুধর্মের সঙ্গে অসঙ্গতিপূণ। ধর্মের নামে এই আইন প্রচলিত হলেও বাস্তবিক অর্থে এর সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক নামমাত্র। বৌদ্ধ, জৈন এবং বিভিন্ন গোত্রের মানুষ আলাদা ধর্মের অনুসারী হলেও তাদের সবাইকে একই হিন্দু আইনের আওতাভুক্ত করা হয়েছে।

ড. ময়না তালুকদার আইনের বৈষম্য ও অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরেন। তাদের মতে, বিদ্যমান হিন্দু আইন বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। কেননা, বাংলদেশের সংবিধান নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে এবং বলেছে, রাষ্ট্র এমন কোনো আইন প্রণয়ন করবে না যা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। অথচ প্রচলিত হিন্দু আইন অনুযায়ী পিতা-মাতার সম্পত্তিতে পুত্র সন্তানের উপস্থিতিতে কন্যা সন্তানের অধিকার নেই। তৃতীয় লিঙ্গ, অন্ধ, বোবা, কালা এবং দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরাও এ অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এ রকম বিধান অমানবিক।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, হিন্দু আইনে দত্তক নেওয়ার বিধান থাকলেও সে অধিকার শুধু পুরুষের। স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষে স্ত্রী দত্তক নিতে পারে। অপুত্রক বিধবা মৃত্যুর আগে স্বামীর ‘পূর্ব নির্দেশ ছিল’ প্রমাণ করতে না পারলে দত্তক নিতে পারে না। শুধু তাই নয়, দত্তক নিতে হবে শুধু পুত্র অর্থাৎ পুরুষ শিশুকে। কন্যা শিশু দত্তক নেওয়ার বিধান নেই। ভিন্নগোত্রের বা ভিন্ন বর্ণের শিশুকে দত্তক নেওয়া যাবে না। প্রতিবন্ধী বা রুগ্ন শিশুকে দত্তক নেওয়া যাবে না। এ ধরনের বিধান অমানবিক, শিশুর প্রতি অসংবেদশীল এবং বৈষম্যমূলক।

এতে বলা হয়, ‘হিন্দু শাস্ত্রে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং নারীর পুনঃবিবাহের সুস্পষ্ট বিধান থাকলেও বিদ্যমান হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদের কারও কোনো অধিকার নেই। তবে স্ত্রীর বর্তমানে স্বামী যতগুলো ইচ্ছে বিয়ে করতে পারে। নারী বিবাহ বিচ্ছেদও চাইতে পারবে না, দ্বিতীয়বার বিয়েও করতে পারবে না। সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রয়োজন এবং চাহিদা আছে কিন্তু আইন নেই।’

ময়না তালুকদার বলেন, কাউকে মানুষ হিসেবে প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা অন্যায়। বিদ্যমান আইন পুরুষকে একচেটিয়া কর্তৃত্ব দিয়েছে। তাই সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা, নারীর সমঅধিকার নিশ্চিতকরণ ও মর্যাদা বৃদ্ধি, নারী শক্তির বিকাশ, ধর্মের মূল চেতনা প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কারণে বিদ্যমান হিন্দু আইনের সংস্কার দরকার।

তিনি বলেন, আইনটি সংবিধিবদ্ধ না হওয়ায় প্রাচীন আইনসমূহে অস্পষ্টতা, দ্ব্যর্থকতা, স্ববিরোধ ও অসঙ্গতি আছে। বিভিন্ন আদালতের বিভিন্ন রকম রায় এবং আধুনিক রাষ্ট্রীয় আইন ও বিধিবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণেও আদালতে মামলা পরিচালনায় অসুবিধা হয়। তাই হিন্দু আইনের সংশোধন, সুস্পষ্টিকরণ, আধুনিকায়ন ও সংবিধিবদ্ধকরণ জরুরি।

ভারত, নেপাল এবং মরিশাসে ইতোমধ্যেই হিন্দু আইন সংশোধন করে সবার সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়। বলা হয়, ব্রিটিশ সরকার বিদায় নেওয়ার পর স্বাধীন ভারতে এই আইন অনেকবার সংশোধিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশ প্রথমে পাকিস্তানের অন্তর্গত এবং পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে স্বাধীন হলেও এ পর্যন্ত কোনো সরকার হিন্দু আইন সংশোধনের কাজে হাত দেয়নি।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকারকর্মী রীনা রায়, লক্ষ্মী রানী বাড়ৈ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি অ্যান্ড বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নিরু বড়ুয়া।

স্যেজন্যে: ডেইলি স্টার

ফেসবুক গ্রুপ লিংক: হিন্দু আইন সংস্কার চাই

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ