হিন্দু আইন সংস্কারে বাধা এলেও এগিয়ে যেতে হবে: শ্যামল দত্ত

ভোরের কাগজ: সরকারি ব্রজমোহন কলেজের ছাত্রী মুক্তা শেড়ফার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে একই কলেজের এক ছাত্রের। প্রেম থেকে বিয়ে। কিন্তু বিয়ের পর মুক্তার ওপর চলে নির্যাতন। মুক্তার ভাষায়, স্বামী আমাকে দরজা বন্ধ করে নির্যাতন করত। লজ্জায় কাউকে বলতে পারতাম না। নির্যাতন সহ্য করেছি। এক সময় সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস সাতকাহনের দীপাবলি চরিত্র থেকে আমি সাহস পাই। আত্মহত্যার পথ থেকে বেঁচে যাই। এক পর্যায়ে ‘আলাদা’ হয়ে যাই। কিন্তু দেশের হিন্দু আইনে স্বামীকে ডিভোর্স দেয়ার নিয়ম নেই। আমার বয়স এখন বত্রিশ। হিন্দু নারীদের আরেকটা বিয়ে করারও আইন নেই।

একই চিত্র ফুটে ওঠে ডা. মায়া হোড়ের বয়ানে। তিনি বলেন, দেশের বর্তমান হিন্দু আইনে ক্ষতিগ্রস্ত বেশি নারীরা। আমার স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিল। আমার একটি কন্যাসন্তান আছে। পারিবারিক সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার পর স্বামী একাধিক বিয়ে করে। কিন্তু আমি বিয়ে করতে পারিনি। কারণ হিন্দু আইনে আমার বিয়ে করা অবৈধ। ফলে সন্তান অবৈধ হবে। তখন সবকিছু অবৈধ হবে। আমি এ দেশের ছেলেদের সঙ্গে আমার মেয়েকে বিয়ে দিতে ভয় পাচ্ছি। আমি যেন একটা জেলের মধ্যে আটকা পড়ে আছি। বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের প্রথম দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে এভাবেই নিজেদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। হিন্দু আইন সংস্কার আন্দোলনের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০৩তম জন্মজয়ন্তির যুগপৎ আয়োজন হিসেবে এ সম্মেলনের স্লোগান ছিল ‘বিদ্যাসাগরের পথ ধরে’। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভোরের কাগজ সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত। মুক্তা শেড়ফা, মায়া হোড়সহ হাজারো হিন্দু নারীর ‘আটকা পড়া জেল’ থেকে মুক্তির বার্তা ছিল শ্যামল দত্তের প্রবন্ধে। তিনি বলেন, পিতার

সম্পত্তিতে নারীর অধিকার, বিবাহ-বিচ্ছেদের পর নারীকে পুনরায় বিয়ের সুযোগসহ নানা দাবি নিয়ে হিন্দু আইন সংস্কারে নেয়া উদ্যোগে বাধা আসবে। তবে বাধা অতিক্রম করে তিনি এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।

মূল প্রবন্ধে শ্যামল দত্ত বলেন, শুধু বিধবার জন্য নয়, বিভিন্ন কারণে নারীকে দ্বিতীয়বার বিয়ের নির্দেশনা আছে বিভিন্ন শাস্ত্রে। বিদ্যাসাগরের দেখানো পথে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নারীকে নিজের মতো বাঁচতে দেয়া বা পুনরায় বিয়ের সুযোগ সৃষ্টির জন্য আইন প্রণয়নের যখন কথা বলছি, তখন একটি মহল শাস্ত্র মানতে রাজি নয়। তাদের সেই পুরনো কথা, ‘হিন্দু বিয়ে জন্মজন্মান্তরের বন্ধন।’ কিন্তু তাদের যুক্তিমতে বন্ধনটা শুধুই নারীর জন্য। পুরুষের কোনো বন্ধন নেই- তারা চাইলে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও যত ইচ্ছে বিয়ে করতে পারে, এমনকী রক্ষিতাও রাখতে পারে।

তিনি বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে সত্য নির্ণয় হয় না। বিধবা বিবাহের পক্ষে বিদ্যাসাগরের আবেদনে সহ-স্বাক্ষর করেছিলেন মাত্র ৯৮৭ জন। আর এ আবেদনের বিরোধিতাকারী পাল্টা আবেদনে স্বাক্ষর করেছিলেন প্রায় ৩৬ হাজার ব্যক্তি। আইনটি পাস হওয়ার ২০০ বছর পরে কেউ বলছে না, বিধবা বিবাহের অধিকার দেয়া অন্যায় হয়েছিল। সতীদাহ প্রথা সম্পর্কে কী বলব? সতীদাহ বলতে অতীতে আদৌ কিছু ছিল, তা এখন অনেকেই পুরোপুরি অস্বীকার করতে চান। তিনি বলেন, ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ভারতে নতুন করে হিন্দু আইন প্রণয়ন করা হয় এবং বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দু আইন এখনো সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।

আশাবাদ ব্যক্ত করে শ্যামল দত্ত বলেন, বিশ্বাস করি হিন্দু আইনের আওতাধীন নারীদের সমঅধিকারের জন্য আমরা যেসব সংস্কার দাবি করছি তা বাস্তবায়িত হবে। জনগণ তা গ্রহণ করবে এবং উপকার পাবে। একদিন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও অবাক হয়ে ভাববে, এমনও একটি সময় ছিল যখন নারী হয়ে জন্মানোর কারণে সমাজের অর্ধেক মানুষের পিতার সম্পত্তি লাভের অধিকার ছিল না! তারা ভেবে আশ্চর্য হবে, তাদের পূর্বপুরুষদের অনেকে এ পরিবর্তনের বিরোধিতা করেছিল।

হিন্দু আইন সংস্কার আন্দোলনের কর্মীদের উদ্দেশে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি মিলন কান্তি দত্ত বলেন, সাহস হারাবেন না। যারা বিরোধিতা করছে, তারা সময়ের শিকার। তাদের অনেকই হিন্দু বিবাহ রেজিস্ট্রেশনের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু এখন তারাই বিবাহ রেজিস্ট্রেশনের জন্য মন্দিরের (ঢাকেশ্বরী) সামনে ঘুরেন।

বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ড. ময়না তালুকদারের সভাপতিত্বে সম্মেলনে আরো বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পুলক ঘটক, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুন নূর দুলাল, বাংলাদেশ মহিলা ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দীপালি চক্রবর্তী প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক সাংবাদিক সুভাষ সাহা।

সকৃতজ্ঞ স্বীকৃতি: ভোরের কাগজ

বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ

⇒ফেসবুক গ্রুপ লিংক: হিন্দু আইন সংস্কার চাই

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ