প্রচলিত হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কার করে নারীদের সমঅধিকার নিশ্চিত করতে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের প্রতি কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ। গত শুক্রবার (২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩) পরিষদের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে নতুন করে এই দাবি উপস্থাপন করা হয়।
সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কার সময়ের দাবি এবং সংস্কার প্রাসঙ্গিক। হিন্দু পরিবারে দেখা যায়, বর্তমানে বিয়েবিচ্ছেদের মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে ভগবানের হাতে, তাই এখানে বিচ্ছেদের বিষয়টি দেখার কোনো সুযোগ নেই। পুরুষের বিয়ের ক্ষেত্রে কোনো আইনি বাধা বা সীমা নেই। একজন পুরুষ চাইলেই একাধিক বিয়ে করতে পারেন, একই সঙ্গে একাধিক স্ত্রী রাখতে পারেন। কিন্তু নারী কোনোভাবেই স্বামীর জীবদ্দশায় আরেকটি বিয়ে করতে পারেন না।
নারী কেবল সীমিত ক্ষেত্রে জীবনস্বত্বে সম্পত্তির অধিকারী হতে পারেন। হাজার নিগ্রহ সত্ত্বেও স্ত্রী বিয়েবিচ্ছেদ পাবেন না। হিন্দু নারীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার, বিয়ে নিবন্ধন, সন্তানের অভিভাবকত্ব ইত্যাদি বিষয়ে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা অবসানের লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে গত ৩ মে উচ্চ আদালতে একটি রিট করা হয়।
অন্যদিকে সংস্কারে বাধা দিয়ে আরেকটি পক্ষ তৎপর রয়েছে। তাদের মতে, হিন্দু আইন সংস্কারে বিরুদ্ধ পক্ষের যুক্তি শাস্ত্রীয় আইন অপরিবর্তনীয়। কিন্তু উভয় পক্ষের এই বিপরীত মেরুতে অবস্থান কখনো কখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবল তিক্ততায় পর্যবসিত হয়। কেউ কেউ পরস্পরকে অশ্লীল শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে আক্রমণ করে ব্যক্তিগতভাবে হেনস্তা করারও চেষ্টা করেন, যা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ-১৯৭৯-এ বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে স্বাক্ষর করেছে, যেখানে নারীর অধিকার ভোগ ও চর্চার প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার কথা বলা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে লিঙ্গ সমতার বিষয়টিও সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। একদিকে সংবিধানের কথা বলে সমঅধিকার, সমমর্যাদার লড়াই; অন্যদিকে নারীকে অধিকারবঞ্চিত রেখে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে কি?
তাই সময় হয়েছে উভয় পক্ষের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করার। হাজার বছর ধরে হিন্দু ধর্ম অনেক ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে সময়ের প্রয়োজনে সংস্কারের মাধ্যমে টিকে আছে। ভবিষ্যতেও টিকে থাকবে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ১৯৫৬ সালে ‘হিন্দু সাকসেশন অ্যাক্ট’ পাস করেছে এবং এই আইনের মাধ্যমে হিন্দু নারী ও পুরুষের উত্তরাধিকার সম্পত্তির সমান অংশ নিশ্চিত করেছে। পরে দেশটি দুই দফা আইনটি সংশোধন করে যুগোপযোগী করেছে। এটি আমাদের জন্য উদাহরণ হতে পারে। নেপাল ও মরিশাসে হিন্দু আইনে লিঙ্গবৈষম্য না থাকলেও বাংলাদেশের হিন্দু পারিবারিক আইনে এই বৈষম্য মেনে নেয়া যায় না। সংবিধানে লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে কারো প্রতি বৈষম্য না করার অঙ্গীকার রয়েছে। রাষ্ট্রকে এ অঙ্গীকার পালন করতে হবে। প্রচলিত হিন্দু আইন সংশোধন সময়ের প্রয়োজন। এই দৈনদশার পরিবর্তন আনতে হিন্দু নারী সমাজকে অগ্রণী ভূমিকায় নামতে হবে।
ফেসবুক গ্রুপ লিংক: হিন্দু আইন সংস্কার চাই