পুলক ঘটক
মহাভারতে বেশ কয়েকটি ট্রান্সজেন্ডার (লিঙ্গান্তরিত) চরিত্র পাওয়া যায়, যেমন শিখণ্ডী, স্থুনাকর্ণ ও বৃহন্নলারূপী অর্জুন। এদের মধ্যে মধ্যে রাজা দ্রুপদের জ্যেষ্ঠ সন্তান শিখণ্ডী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তাঁর হাতেই মহাবীর ভীস্মের পতন ঘটেছিল। প্রচলিত ধারণায় শিখণ্ডী নারীও নন, পুরুষও নন – তিনি ‘হিজড়া’ ছিলেন। অনেকে তাঁকে নপুংসক হিসেবে বর্ণনা করেন। কিন্তু মহাভারতের বর্ণনায় বাস্তবে তিনি ছিলেন নারী থেকে পুরুষ রূপ পরিগ্রহকারী ব্যক্তি। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের পুরাণে বা প্রগৈতিহাসিক লোকগাথায় লিঙ্গান্তরিত ব্যক্তির উপস্থিতি আছে কিনা আমি জানি না। তবে ব্যাসদেব লিখিত সংস্কৃত মহাভারতে লিঙ্গান্তরিত হওয়ার কাহিনী আছে। অন্যলিঙ্গে রূপান্তরের সে কাহিনী অলৌকিক; আধুনিক জীববিজ্ঞান বিশ্লেষণে যা পাওয়া যাচ্ছে অথবা চিকিৎসা বিজ্ঞানে যা ঘটছে তেমন নয়। কিন্তু লিঙ্গান্তরিত ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান, মর্যাদা, অধিকার ও তাদের নিয়ে সামাজিক-রাজনৈতিক টানাপোড়েনের একটি চিত্র তাতে পাওয়া যায়।
শিখণ্ডী আমজনতার কেউ ছিলেন না। তিনি রাজসন্তান। বড় ঘরে ব্যতিক্রমী মনো-দৈহিক বৈশিষ্ট্যের কোনো সন্তান জন্ম নিলে তার লিঙ্গপরিচয় গোপন রাখার চেষ্টা যেমন ঘটে, শিখণ্ডীর ক্ষেত্রেও তা ঘটেছিল। তাঁকে ছেলের পোশাকে লালন পালন করে যুদ্ধবিদ্যাসহ উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে বড় করেছিলেন রাজা দ্রুপদ। এমনকি তাকে পুরুষ পরিচয়ে দর্শানার রাজা হিরণ্যবর্ম্মার কন্যার সঙ্গে বিয়েও দিয়েছিলেন। বিয়ের পর গোল বাধে। স্ত্রী বুঝতে পারলেন তার স্বামী পুরুষ নয়। এভাবে প্রতারণাপূর্বক বিয়ে দিয়ে কন্যার জীবন নষ্ট করায় রাজা দ্রুপদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন রাজা হিরণ্যবর্ম্মা। পরে রাজকন্যা শিখণ্ডী নিজে তপস্যার মাধ্যমে নারী থেকে পুরুষ রূপ পরিগ্রহ করে সমস্যা মিটিয়েছিলেন। তাঁর নারীঅঙ্গ গ্রহণ করেছিলেন স্থুনাকর্ণ নামে এক যক্ষ। আর স্থুনাকর্ণের পুরুষাঙ্গ নিয়েছিলেন শিখণ্ডী। এভাবে পরস্পর লিঙ্গ পরিবর্তনের ইউনিক বর্ণনা মহাভারতে আছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, পুরুষ হওয়ার পরও সেযুগে তিনি আর দশজন মানুষের মতো সামাজিক মর্যাদা, বিশেষত “পুরুষের মর্যাদা” পাননি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দেখা যাচ্ছে, শিখণ্ডী বীর হওয়া সত্ত্বেও ট্রান্সজেন্ডার হওয়ায় তাঁর সাথে যুদ্ধ করতে দুর্যোধনের প্রধান সেনাপতি ভীস্মদেব রাজী হননি। তিনি নারী ও ভিন্নলিঙ্গের ব্যক্তির সাথে যুদ্ধ করা অনুপযুক্ত মনে করে যুদ্ধের মাঠে শেষপর্যন্ত নিরস্ত্র থেকে স্বেচ্ছামৃত্যু বেঁছে নিয়েছেন।
পড়ুন: সনাতন ধর্মে ট্রান্সজেন্ডার
নারী ও লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর প্রতি এরকম দৃষ্টিভঙ্গী আধুনিক যুগেও বিদ্যমান আছে। বর্তমান যুগে লৈঙ্গিক সংখ্যালঘুদের অধিকার ও মানুষ হিসেবে প্রাপ্য মর্যাদার আন্দোলন বিশ্বব্যাপী আলোচিত বিষয়। যৌন বৈশিষ্ট্যে শুধু নারী এবং পুরুষ নয় – প্রাকৃতিকভাবেই লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি এখন জীববিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত সত্য। কিন্তু পুরাতন ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে তা মিলছে না বিধায় বিজ্ঞানের নবতর উদ্ভাবনকে অনেকে মানতে রাজি নয়। ঠিক ‘পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে’ আবিস্কারের ঘোষণা শুনে তৎকালীন ধর্মবিজ্ঞানীরা মহাকাশ গবেষকদের সঙ্গে যেরূপ আচরণ করেছিলেন, এখনো তাই হচ্ছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞান এখন নারীকে পুরুষ এবং পুরুষকে নারী বানিয়ে দিতে পারে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক শল্য চিকিৎসার সুযোগ নিয়ে কেউ লিঙ্গান্তরিত হতে চাইলে তাঁকে সে অধিকার দেয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে মানুষ মারমুখী বিতর্ক করছে। বিভিন্ন দেশে এর অনুকূল আইন প্রণয়নে আপত্তি আসছে।
বিজ্ঞান বলছে, যৌন বৈশিষ্টে কিছু মানুষ আছে, যারা জন্মগতভাবে অ্যাসেক্সুয়াল। অর্থাৎ যৌনপ্রবৃত্তিহীন। বাহ্যিক অঙ্গে তাদেরকে নারী বা পুরুষ হিসেবে দেখা গেলেও বিপরীত লিঙ্গের প্রতি তাদের কোনো আকর্ষণ নেই। কেউ আছে দৈহিক বৈশিষ্ট্যেই একাধারে নারী এবং পুরুষ –উভয় লিঙ্গের। কেউ আবার শারীরিক গঠনে পুরুষের মতো দেখতে হলেও তার আভ্যন্তরীন শারীরিক ও মানসিক গঠন নারীর মতো। এরকম বিচিত্র লিঙ্গবৈশিষ্টের মানুষ শরীর বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন। আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে তা হয়তো মেলে না বিধায় আমরা বিরূপ আচরণ করছি। কিন্তু অন্যের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, শারীরিক-মানসিক বৈশিষ্ট্য বা ব্যক্তিগত ব্যপারে আমাদের গায়ের জোর দেখানোর অধিকার আছে কি?
সাধারণভাবে হিজড়াদের বিষয়ে নির্মম না হওয়ার জন্য সচেতনতাবোধ বাংলাদেশের সমাজে তৈরি হয়েছে মনে হয়। কিন্তু লৈঙ্গিক সংখালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যেও লিঙ্গ পরিচয়ের ক্ষেত্রে এবং যৌন মনো-দৈহিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে অনেক প্রকার স্বাতন্ত্র্য আছে –এই জ্ঞান এখনো অধিকাংশ মানুষের নেই। তাই হিজড়াদের পুর্নবাসনের বিষয়ে অনেক মানুষ সহানুভূতিশীল হলেও লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর (LGBTQ+) যৌন আচরণ এবং বৈশিষ্ট্যগতভাবে সেরকম আচরণ করার অধিকারের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষ এখনো সংখ্যায় কম। মূলতঃ ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রচলিত ধারণা ও নির্বোধের সহিংসবৃত্তি এর জন্য দায়ী।
বাংলাদেশে মাদ্রাসায় ছেলে শিশুদের উপর পায়ুকামীতা প্রয়োগের বা অসংখ্য ছেলে ধর্ষণের ঘটনার বিরুদ্ধে ধর্মবীরদের কোনো আন্দোলন নেই। কিন্তু লিঙ্গসংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে প্রবলের রক্তচক্ষু ভয়ঙ্কর! এজন্য শুধু ইসলাম বিশ্বাসীদের প্রতি কটাক্ষ করে লাভ নেই। হিন্দু শাস্ত্রও লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর প্রতি সুবিচার করেনি। হিজড়াদের সাধারণভাবে শাস্ত্রে নপুংসক/ক্লীব (যৌন-প্রতিবন্ধী) হিসেবে দেখা হয়েছে। তাদেরকে পিতার শ্রাদ্ধ করার অধিকার দেওয়া হয়নি এবং সেই সুবাদে তাদের সম্পত্তিতেও অধিকার হরণ করা হয়েছে। মনু সংহিতা বলছে,
“অনংশৌ ক্লীবপতিতৌ জাত্যন্ধবধিরৌ তথা।
উন্মত্তজড়মূকাশ্চ যে চ কেচিন্নিরিন্দ্রিয়াঃ।।” (৯/২০১)
অর্থ: ক্লীব (পুরুষত্বহীণ), পতিত (বর্ণভ্রষ্ঠ), জন্মান্ধ, বধির, উন্মত্ত, জড়, চেতনহীন, মূক (বোবা), কালা (শ্রবণশক্তিহীন) প্রভৃতি বিকলেন্দ্রিয় ব্যক্তিরা কেউই পৈত্রিক ধনসম্পত্তির অংশিদার হবে না। (৯/২০১)।
মনুসংহিতার এই উদ্ধৃতি ব্যবহার করে দায়ভাগ আইনে শুধু যৌন প্রতিবন্ধীর অধিকার হরণ নয়, প্রায় সকল প্রকার শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধীর অধিকার হরণ করা হয়েছে। প্রতিবন্ধীদের জন্য বাড়তি অধিকার ও বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দরকার। কিন্তু হিন্দু আইনে করা হয়েছে তার উল্টোটা। মানুষের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।
সনাতন ধর্ম আইন ও বিধিবিধানের ক্রমবিবর্তন এবং যুগধর্ম স্বীকার করে। এটি শুধুমাত্র এক শাস্ত্রনির্ভর বা এক ব্যক্তি প্রবর্তিত ধর্ম নয়। এখানে যেহেতু অনেক বিকল্প মত দেওয়া আছে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিবেকের বাণী অনুসরণের নির্দেশ দেওয়া আছে সুতরাং বিবেকের জয়গান গেয়ে যেতে চাই।
“কেবলং শাস্ত্রমাশ্রিত ন কর্তব্য বিনির্ণয়।
যুক্তিহীন বিচারেণ ধর্মহানি প্রজায়তে।।”
–ভগবান বৃহস্পতি
অর্থ: শুধু শাস্ত্রের উপর নির্ভর করে কর্তব্য ও অকর্তব্য নির্ধারণ করা উচিত নয়। যুক্তিহীন বিচারের দ্বারা ধর্মহানি ঘটে থাকে।