সনাতন ধর্মে ট্রান্সজেন্ডার

সনাতন ধর্মে ট্রান্সজেন্ডার বা লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী সম্পর্কে কি বলা আছে, গত দু’দিন যাবত তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমার বিস্ময়ের অবধি নেই। কি নেই প্রাচীনকালের গ্রন্থাবলিতে! প্রাচীনতম ঋকবেদ থেকে শুরু করে রামায়ণ, মহাভারত এবং সর্বশেষ পুরাণগুলি পর্যন্ত সবখানে লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর এত ব্যাপক উপস্থিতি আছে, আগে ভাবিনি। কবি, মুনিঋষি বা প্রাচীন ধর্ম-সাহিত্যিকরা প্রকৃতি ও মানবজীবনকে একদম উল্টেপাল্টে দেখেছেন; মানুষকেও দেখিয়েছেন। সেসব দেখে লাখ লাখ মানুষ আরো বেশি অন্ধ হয়েছে!

অর্ধনারীশ্বর

বলতে দ্বিধা নেই, আধুনিক দৃষ্টিতে অলৌকিকতা ও প্রাচীন যুগের জীবনধারা নিয়ে সমালোচনার বহু অবকাশ থাকা সত্ত্বেও, সেই সুপ্রাচীন মেধাবীদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে গেছে। শ্রদ্ধা কমেছে প্রতিদিনের নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় আগের চেয়ে সমৃদ্ধ হওয়া বর্তমান পৃথিবীর অন্ধ মানুষদের প্রতি।
সনাতন শাস্ত্র যত পড়ছি, তত বিস্মিত হচ্ছি। আগে থেকেই জানতাম সনাতন ধর্ম সবচেয়ে প্রাচীন এবং সবচেয়ে আধুনিক। এতে প্রাচীন ভৌতবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, বহুমাত্রিক আধ্যাত্ম্য দর্শন, প্রেমধর্মের সর্বোত্তম বিকশিত রূপ, যুদ্ধবিদ্যা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আইন, সংগীত, নৃত্যকলা, ছন্দ, ব্যাকরণ, কামশাস্ত্র, চিকিৎসাবিদ্যা সব আছে। সেই সময় পর্যন্ত মানুষ যতটা আবিষ্কার করতে পেরেছিল ততটা আছে। তারমধ্যে মানুষ ও জীবজগতের নানাবিধ লিঙ্গবৈশিষ্ট্য ও যৌন প্রবণতা এত বিশদভাবে উপস্থাপন করা আছে আগে খেয়াল করিনি। কিছু ক্ষেত্রে সে উপস্থাপনা উত্তর-আধুনিক জ্ঞানকেও অতিক্রম করে গেছে মনে হয়।

চিত্রে এক দেহে নারী-পুরুষ (রাধা-কৃষ্ণ) দ্বৈত সত্তার প্রতীকী উপস্থাপন।

যেমন ধরুন আমরা যারা বিষয়গুলো নিয়ে কমবেশি পড়াশোনা করছি তারা প্রায় সবাই ‘নারী’, ‘পুরুষ’, ‘উভলিঙ্গ’, ‘হিজড়া’, ‘গে’, ‘লেসবিয়ান’, ‘লিঙ্গান্তরিত’ ইত্যাদি নানারকম লিঙ্গ পরিচয়ধারী মানুষ ও জীব সম্পর্কে জানছি। যৌন প্রবণতার দিক থেকে ‘সমকামী’, ‘অসমকামী’, ‘উভকামী’, ‘বহুকামী’, ‘নির্লিপ্ত’ ইত্যাদি নানা বৈশিষ্ট্যের কথা গবেষকদের লেখায় পড়ছি। কিন্তু পুরাণ অনুসন্ধানে পেলাম ‘কিমপুরুষ’ নামে আরেক ধরনের মানুষ –যারা প্রতি একমাস পর লিঙ্গান্তরিত হতেন। এভাবে পর্যায়ক্রমে পুরুষ ও নারী হয়ে বিহার করেছেন। এ ধরনের লিঙ্গ বৈশিষ্ট্যের মানুষ আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণায় উদঘাটিত হয়েছে কিনা আমি জানি না। এ যদি নিছক অলৌকিক কল্পনা হয়, তবে মানুষের কল্পনাশক্তির তারিফ করতে হবে। আর যদি বিজ্ঞানসম্মত বাস্তবতা হয় তবে তো কথাই নেই! আমি ‘কিম্পুরুষ’ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ পাইনি; কারো জানা থাকলে সহযোগিতা করবেন।

পড়ুন: সনাতন শাস্ত্রে ট্রান্সজেন্ডার ও লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর অধিকার

সম্প্রতি লিঙ্গ পরিবর্তনের নৈতিকতা, গ্রহণযোগ্যতা ও বৈধতা নিয়ে বেশ বিতর্ক হচ্ছে। অথচ সেই রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের যুগেই লিঙ্গ পরিবর্তনের অনেক কাহিনী আছে। গত বুধবার (২৫ জানুয়ারী, ২০২৪) শুধুমাত্র মহাভারত ও মনুসংহিতার রেফারেন্সে লিঙ্গান্তরিত ‘শিখণ্ডী’র কাহিনী উপস্থাপন করে সনাতন শাস্ত্রে ট্রান্সজেন্ডারের স্বীকৃতি ও অধিকার প্রসঙ্গে সামান্য আলোকপাত করেছিলাম। আমি শাস্ত্রীয় কোন বিষয়ে উদ্ধৃতি দিলে, নিশ্চিত না হয়ে বলি না। তারপরও আমার বোঝার বা উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ভুলভ্রান্তি হতে পারে। কারণ আমি একজন মানুষ; ভুল ভ্রান্তির উর্ধ্বে ওটা মহাপুরুষ নই। তবে আমি যখনই আমার ভুল বুঝতে পারি, তখনই তা স্বীকার করি এবং শোধরানোর চেষ্টা করি। বন্ধু ও অনুসারীরা আমার লেখার অবশ্যই সমালোচনা করবেন, ভুল ধরিয়ে দেবেন –আমি সমৃদ্ধ হব, কৃতজ্ঞ থাকব। কিন্তু দয়া করে সদলবলে বহুমূর্খতার প্রদর্শনী করতে আসবেন না। সমাজে বিতর্কের চেয়ে মুর্খদের গালাগালির আধিক্য দেখা দিলে তাতে উন্নত সমাজের লক্ষণ প্রকাশ পায় না।

মহাভারতের কাহিনীতে বৃহন্নলা রূপে ট্রান্সজেন্ডার অর্জুন।

আগের লেখায় শিখণ্ডীর কাহিনী মহাভারত থেকে যেভাবে উদ্ধৃত করেছি তাতে ভুল নেই। অথচ কেউ কেউ যে শাস্ত্রগ্রন্থ জীবনে চোখেও দেখেননি, সেই শাস্ত্র নিয়ে আমাকে চ্যালেঞ্জ করতে এসেছেন; গালাগালি করেছেন। এ বড়ই কৌতুক!

জ্ঞানের পাহাড় (বই পুস্তকের বোঝা) গাধার পিঠে শোভা পেলেও প্রাণীটির মস্তিষ্কে তার কিছুই ঢোকে না। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে তেমন হওয়া উচিত নয়। মানুষকে নিজ মস্তিষ্কে জ্ঞান সঞ্চয় করতে হয়। মানুষ যদি জ্ঞানের পরিবর্তে মুর্খতার পাহাড় মস্তকে ধারণ করে তবে তা বিসদৃশ হয়। ফেসবুকে অনেকের মন্তব্যে তাদের উদ্ভট অম্তঃদৃশ্য প্রকাশ পায়।

হর-গৌরী

আমার আগের লেখাটির প্রায় পুরোটাই ছিল রেফারেন্স। এলজিবিটিকিউ (LGBTQ+) আন্দোলন নিয়ে দেশে বিদেশে বিতর্কের প্রসঙ্গ আলোচনা ছাড়া আমার নিজের কথা সেখানে তেমন একটা নেই। শুধু নিজের ভাষায় মহাভারতের কাহিনী তুলে ধরেছি। যারা বেদব্যাসের সংস্কৃত মহাভারত বা তার আনুপূর্বিক অনুবাদ না পড়ে প্রবন্ধটির বস্তুনিষ্ঠতা চ্যালেঞ্জ করতে এসেছিলেন তাদের হাতে বিদ্যা দেবীর দুর্দশা দেখে কষ্ট পেয়েছি। প্রিয় বন্ধুরা, টিভিতে ‘মহাভারত’ সিরিয়াল দেখে শাস্ত্র নিয়ে বিতর্ক করতে আসলে শুধু দারিদ্র্যই প্রকাশ পাবে।

শাস্ত্রের কথা থাক। স্বঘোষিত ধর্মবীরদের মূল উত্তাপ ‘ট্রান্সজেন্ডার’ নিয়ে। আফসোসের বিষয় হলো, অধিকাংশ তার্কিক (অথবা গালিবাজ) ট্রান্সজেন্ডার শব্দের অর্থই জানেন না। অথচ তা নিয়ে তর্ক করছেন! ট্রান্সজেন্ডার বৃহত্তর অর্থবোধক একটি বিষয়। গতদিনের লেখায় আমি শুধু লিঙ্গান্তরিত ট্রান্সজেন্ডারদের বিষয়ে বলেছি। Transgender শব্দের (Trans+gender) অর্থ বোঝার জন্য Transnational শব্দের মধ্যে Trans+national শব্দ দুটি সন্ধিবদ্ধ হয়ে কিভাবে কিরকম অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে মিলিয়ে দেখুন। কারো লেখার সমালোচনা করতে চাইলে ইংরেজি ‘অ্যাসেক্সুয়াল’, ‘স্ট্রেইট’, ‘হোমোসেক্সুয়াল’, ‘গে’, ‘লেসবিয়ান’, ‘প্যানসেক্সুয়াল’, ‘বাইসেক্সুয়াল’ ইত্যাদি শব্দের অর্থ আগে ভালো করে বুঝে নেবেন। সর্বোপরি ‘জেন্ডার’ এবং ‘সেক্স’ শব্দের সম্পর্ক ও পার্থক্য দয়া করে জেনে নেবেন। পড়লে জানা যায়। এসব বিষয়ে আমার নিজেরই জানার অনেক ঘাটতি আছে। বিষয়গুলি জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, যৌনবিজ্ঞান, মানববিদ্যা, জেন্ডার স্টাডিজ ও ডাক্তারি শাস্ত্র সংক্রান্ত। এর অনেককিছুই আমাদের সাধারণ জীবনধারার বাইরের বিষয়; যথেষ্ট কঠিন। দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি আপনাদের শেখাচ্ছি এমন নয়; নিজেও শিখছি। শেখার চেষ্টা করছি।

লেখক: সাংবাদিক; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ