পুলক ঘটক
ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভা। সেখানে চুলের মুঠি ধরে টেনে-হিঁচড়ে আনা হল একজন নারীকে। নাম তার দ্রৌপদী। দুর্যোধনের পার্ষদরা সবার সামনে এক নারীকে নিয়ে উল্লাস করছেন। দুর্যোধন আদেশ দিলেন, তাঁকে বিবস্ত্র কর। নারীকে বিবস্ত্র করার মহা-পৌরুষ কর্মে এগিয়ে গেলেন দুঃশাসন। তাদের সব অনুসারীর জন্য নারী নিপীড়ন এক নারকীয় উৎসব।
বিপন্ন দ্রৌপদী আশ্রয় চায় তাঁর পাঁচ-পাঁচজন স্বামীর কাছে। স্বামীরা প্রত্যেকে মহাবীর; অনেক ক্ষমতা। কিন্তু সেই ক্ষমতা এখন দুর্যোধনের দাস হয়ে গেছে। তারা পাঁচজনই খুব ধার্মিক, কিন্তু আজ অপরাধের দাসত্ব করা তাদের ধর্ম; বিপন্ন নারীর পাশে দাঁড়ানো ধর্ম নয়!
দুর্যোধনের সামর্থ্যের মূল উৎস পিতামহ ভীস্ম। তিনি মহাধার্মিক, কিন্তু পাপ-রাজত্বের দাস। তিনি চোখের সামনে নারীর উপর অন্যায় হতে দেখছেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঠেকাবেন না। তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতির দাসত্ব করছেন। নারী ধর্ষণ প্রতিহত করা তাঁর ধর্ম নয়; তাঁর ধর্ম ধর্ষকদের পক্ষে থাকা!
গুরু দ্রোণাচার্যের এমনই সামর্থ্য, তিনি চাইলে একাই সকল দুর্বৃত্তকে নিধন করতে পারেন। কিন্তু তিনি ধর্মপরায়ণ রাজ-কর্মচারী মাত্র। ভালো-মন্দ সবই বোঝেন, কিন্তু রাজ আজ্ঞার বাইরে যাবেন না। তাই চোখের সামনে গৃহবধূর বস্ত্রহরণ দেখছেন, প্রতিকারে রুখে দাঁড়াচ্ছেন না৷
ধার্মিকরা সবাই নারীর প্রতি অবিচারের প্রশ্নে নিরব। ফলাফল কুরুক্ষেত্র; সবংশে ধ্বংস! প্রলয় দেখার পর বলেছেন “একি হলো জনার্দন!”
এক পাষণ্ড প্রামাণিক বর্তমানে হিন্দু নারীদের বিরুদ্ধে দুর্যোধনের ভুমিকায় নেমেছেন। এক ‘দুষ্ট বিশ্বাস’ বসেছেন অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের আসনে। তিনি পুরাতন এক সমাজ সংস্কার পরিষদের চেয়ার দখলে নিয়ে সংস্কারের বিরুদ্ধে সভা বসিয়েছেন; এক প্রাচীন মন্দিরভবন দখল করে সেখানে বসে হিন্দু নারীদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছেন, মেয়েদের বিরুদ্ধে আপত্তিকর পোস্টার তৈরি করছেন। সেখানে বসে ফেসবুকে ঘোষণা দিয়েছেন, “কৌশলে যদি ধর্ম রক্ষা হয়, তবে কৌশলকেই হাতিয়ার হিসেবে নিলাম।” কৌশল শকুনির ধর্ম। ‘হরিদাস পাল’ হয়েছেন অন্ধ রাজার আইন উপদেষ্টা; পাপিষ্ঠ শকুনি। বিভিন্ন জায়গায় চেয়ার পেতে বসে বুড়ো ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্যের দল দুর্বৃত্ত দুর্যোধন – দুঃশাসনদের সহযোগীর ভূমিকায় আছেন। এরা শুধু নারীর অধিকারের বিরুদ্ধে তালেবানি হিন্দুর ভূমিকায় নেমেছে বললে ভুল হবে। এরা দ্রৌপদীদের বস্ত্রহরণের ভূমিকায় অবতীর্ণ। এদের সঙ্গী সাথীরা ইন্টারনেটে নারীদের বিরুদ্ধে যা করছে, মহাভারতের দুর্যোধন ততো করতে পারেনি। তারা বুঝতে পারছে না, তাদের দখলকৃত জয়কালী মন্দিরের দেবী তাদের অপকর্মে রুষ্ঠ।
অন্যদিকে নারীর প্রতি নগ্ন অবিচার দেখেও “আমি কি করতে পারি, আমার হাত পা বাঁধা,” বলছেন রাজা যুধিষ্ঠির দাশগুপ্ত। আপনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা; জীবনে অনেক লড়েছেন, অনেক সন্মান পেয়েছেন। কি হারানোর ভয় করেন দাশগুপ্ত বাবু? সগর্বে নিজেকে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের দৌহিত্র পরিচয় দেন। এ পরিচয় আপনাকে মানায়; শকুনিদের বিপক্ষে “অপারগ যুধিষ্ঠির” হওয়া আপনার মানায় না। হিন্দু নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ও দুর্বৃত্তদের মোকাবেলায় প্রয়োজনে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আপনার নেতৃত্ব কাম্য।
নারীর প্রতি ক্রমাগত অন্যায়ের ফলশ্রুতিতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ও শেষে মহাপতন দেখার পর কেউ যেন বলবেন না, “একি হলো জনার্দন!”
আমরা ভাল-মন্দ বুঝি। তাই ন্যায়ের জন্য লড়ছি; লড়ব। ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে। নারী নির্যাতকরা জয়ী হয় না। ধর্ম সেখানে থাকে না। যথা ধর্ম তথা জয়।
লেখক: সাংবাদিক; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ