সরকারি জরিপ অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯১.০৪% মুসলমান। হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিস্টান ও আদিবাসী সকল ধর্মের অনুসারী সম্মিলিতভাবে এখন ৯ শতাংশের কম। কিন্তু শিশু একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, ছায়ানট, বুলবুল ললিতকলা একাডেমিসহ সরকারি অথবা বেসরকারি যেকোনো নাচ, গান বা আর্টের স্কুলে একবার স্বচক্ষে দেখে আসুন। সেখানে মুসলিম ও অমুসলিম ছাত্র-ছাত্রী প্রায় সমান। এটা কিভাবে সম্ভব? স্বাধীনতার ৫৩ বছরে দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী কমতে কমতে ৯ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। কিন্তু সংস্কৃতি অঙ্গনে সেই অনুপাত অন্যরকম কেন? অমুসলিমরা কি কোনো কারণে বেশি সংস্কৃতিমুখী হচ্ছে? নাকি মুসলিমরা বিশেষ কোনো কারণে সংস্কৃতিবিমুখ হচ্ছে? কোনো জনগোষ্ঠী সংস্কৃতি বিমুখ হলে তারা সমাজে পিছিয়ে পরে, নাকি এগিয়ে যায়? বিজ্ঞানকে আপনার বিশ্বাসের প্রতিকুল ভেবে যদি প্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানবিমুখ হয়ে যান তাহলে কে ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
১৯৪৭এ দেশ বিভাগের পর তৎকালীন পূর্ববঙ্গের উচ্চবর্ণীয় হিন্দু, জমিদার, জোতদার এবং অগ্রসরবর্তী হিন্দুদের একটি বড় অংশ ভারতে চলে যাওয়ায় এদেশে সংস্কৃতি অঙ্গনে ঘাটতি তৈরি হয়েছিল সন্দেহ নেই। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও এদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠী ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারছে না। দেশান্তরি হওয়া অব্যাহত আছে –কখনো কম, কখনো বেশি। সংস্কৃতিতে এর প্রভাব অনিবার্য। হিন্দু কমার সাথে স্বাভাবিক নিয়মে সংস্কৃতি অঙ্গনে হিন্দু জনগোষ্ঠীর পদচারণা কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু দেখছি উল্টোটা।
এই বিষয়ে আরেকটি জিনিস লক্ষণীয়। হিন্দু ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতরা সঙ্গীত, চিত্রকলা, যাত্রা, নাটক, সিনেমাসহ সংস্কৃতি জগতের সর্বক্ষেত্রে সরাসরি অংশ নেন। কিন্তু মুসলমানদের ক্ষেত্রে আলেম, মওলানা ও মসজিদের ইমামদের প্রায় কাউকেই সংগীত চর্চা করতে অথবা সিনেমা ও নাটকে অভিনয় করতে দেখা যায় না। এর কারণ কি? মুসলিম তরুণরা নাটক, সিনেমা ও যাত্রাপালা দেখলেও বয়স হওয়ার পর অনেকেই বাদ দেন। কেন? প্রবীণদের কি সিনেমা, নাটক, যাত্রা, গান, নাচ – এসব দেখতে ভাল লাগেনা? খারাপ লাগার তো কথা নয়! তবে বাদ দেবে কেন? এতে কি ধর্মে কোনো বাধা আছে?
ইসলাম বিশ্বাসী অনেকে বলেন বাধা আছে, আবার অনেকেই বলেন বাধা নেই। কার কথা ঠিক? নাটক দেখতে বা গান শুনতে যদি ধর্মে বাধা না থাকে, তাহলে আমি আমার কমনসেন্স থেকে বলতে পারি; গাইতে ও অভিনয় করতেও বাধা থাকার কথা নয়। আর গাইতে বা অভিনয় করতে যদি ধর্মে নিষেধ থাকে তাহলে সে জিনিস দেখা বা শোনাটাও পাপ। সবরকম ভাবেই চর্চা করা নাজায়েজ বা নিষিদ্ধ হবে। নিষিদ্ধ না হয়ে থাকলে তা চর্চা করাটা নিশ্চয় বৈধ। শুধু তরুণদের জন্য নয়, প্রবীণ, মওলানা, পীর, মুর্শীদ – সবার জন্যই বৈধ। দুটোর একটা –হয় বৈধ, নতুবা অবৈধ।
প্রবীণরা অনেকেই টিভি দেখেন এবং টেলিভিশনের প্রোগ্রামে অংশ নেন। টিভিতে নাটক দেখেন এরকম মওলানা দেখেছি। তবে নাটকে অভিনয় করতে আমি কোনো মওলানাকে দেখিনি। আলেম ওলামারা পেশাদার অভিনয়েও নেই, সৌখিন অভিনয়েও নেই। শুধু অভিনয় নয়; সঙ্গীত চর্চা, ছবি আঁকা –কোনোটিতেই মওলানা সাহেবদের দেখতে পাইনা।
ছবি আঁকা অবৈধ হলে আপনার ছবি তোলাও অবৈধ। ছবি না তুললে আপনি পাসপোর্ট করতে পারবেন না। এমনকি পবিত্র হজ্জ পালনের জন্যেও ভিসা পাবেন না। এটি সৌদি আরবের ইসলামী সরকারের অনেকদিন আগে চালু করা বিধান। আজকাল ছবি যহেতু সবাই তোলে, সুতরাং ছবি তোলা হয়তো বৈধ। নিজের ছবি তোলা অবৈধ না হলে, ছবি আঁকাও অবৈধ হওয়ার কথা নয়। আমার সাধারণ জ্ঞানে এমনই মনে হয়।
বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীসমূহ যদি বিশেষ কোনো কারণে সংস্কৃতি চর্চায় অধিকতর মনোযোগী হয়ে ওঠে, এবং সংখ্যায় কম হয়েও যদি তারা এক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে পেছনে ফেলতে পারে, তবে সাধুবাদ। সংস্কৃতি চর্চার ফলে মানবসম্পদের উন্নয়ন ও বিকাশ সহজ হবে। এতে সংখ্যালঘুদের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে এবং উন্নত ও সমৃদ্ধ মানবগোষ্ঠী হিসেবে উচ্চ আসন পাবে। তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের ক্ষতি হবে না। কারণ সমাজের যেকোনো একটি ছোট অংশের অগ্রগতি হলেও তা রাষ্ট্র ও সমাজের সমষ্টিগত উন্নয়নে অবদান রাখে। কিন্তু যদি এর বিপরীত হয়? হিসাবটা সংখ্যালঘুর সাংস্কৃতিক উন্নয়নের না হয়ে, যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর পশ্চাদপসরণের হয়? তবে মারাত্মক! যদি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বিশেষ কোনো কারণে সংস্কৃতিবিমুখ হয়ে পড়ে, এবং তার ফলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকেই অগ্রবর্তী দৃশ্যমান হয় তবে গোটা জাতির জন্য অশনি সংকেত!
বিদ্যমান ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সম্ভাবনাটিই প্রকট। এমন বৈগুণ্য ঘটলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে জীবনের মূলধারায় ফেরানো জরুরি। নতুবা বাঙালি জাতি বাঁচবেনা; দেশ বাঁচবেনা।
দেশের মুসলমান জনগোষ্ঠী বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবন থেকে পিছিয়ে পড়লে জ্ঞানী, গুনী, আলেম ও মওলানা সাহেবদেরই এগিয়ে আসতে বলব। সংস্কৃতি ও সুকুমার বৃত্তির চর্চা; সুর সাধনা; সত্য ও সুন্দরের অভিযাত্রা ও নির্মল আনন্দকে যদি অধর্ম, অন্যায় বা পাপ বলে মনে না করেন, তবে আপনারা এগিয়ে আসুন; অন্যরা উদ্বুদ্ধ হবে। আপনি আচরি ধর্ম লোকেরে শেখান। অভিনয়ে, গানে, চিত্রকলায়, নৃত্যে আমাদের বিদগ্ধ আলেমদের দেখতে চাই। নবপ্রাণে জেগে উঠুক বাঙালি। সবাইকে পহেলা বৈশাখের শুভেচ্ছা। শুভ হোক নতুন বছর।
লেখক: সাংবাদিক; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ