ভানুলাল দাস
হিন্দু মেয়েরা বড্ড ডরে ডরে থাকে। তারা পিতার সম্পত্তির অধিকারের বিষয়ে মুখ ফুটে হ্যাঁ বলে না, আবার ‘না’ বলে না। মৌন থাকে – পিনপতন নিরবতা পালন করে। কেন এমন হয়, কেন মেয়েরা কথা বলে না?
আসলে, নিজের অধিকারের কথা বলতে হলেও অনুকুল পরিবেশ লাগে, কিছু কিছু অধিকার থাকা লাগে। কিছুটা গনতান্ত্রিক পরিবেশ লাগে। হিন্দু মেয়েদের জন্য এমন পরিবেশ নাই। হিন্দু পরিবারগুলো পিতৃতান্ত্রিক স্বৈরাচারের চারণভূমি। পিতা, ভ্রাতা ও পুরুষ সদস্যরা এর শাসক শ্রেণি। সমস্ত ক্ষমতা পুরুষের কুক্ষিগত। মিনস অব প্রোডাকশান বা সম্পত্তির পুরোটা পুরুষের হাতে থাকায় নারীরা ক্ষমতাহীন, বাক স্বাধীনতাহীন। পরিবার থেকে বের করে দিলে তাদের যাওয়ার মত জায়গা নেই।
হিন্দু মেয়েরা পরিবারে আগাছার মত। শেকড় মেলার মত যথেষ্ট জায়গা দেয়া হয় না। তারা কৈশোর থেকে জানে, তাদের বাপের বাড়িতে কিছু নাই, স্বামীর বাড়িতেও নাই। অন্য পুরুষের দয়া, অনুগ্রহ, বদান্যতায় বেঁচে থাকতে হবে আজীবন। ফলে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসাবে হিন্দু নারীর ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে না। তারা ভীতু হয়, অবলা হয়। নিজ অধিকার নিয়ে সোচ্ছার হতেও সাহস করে না। কোথায় দাঁড়িয়ে সে প্রতিবাদ করবে? কোথাও তার দাঁড়ানোর জায়গা নেই। সম্পত্তির স্থায়ী অধিকার সেই জায়গা যেখান থেকে নারী নিজের মনের কথা জোর গলায় বলতে পারে।
নিজের কথা পাগলেও কয়, তো হিন্দু নারীরা কয় না কেন? তারা জানে, কইয়া ভয়ানক বিপদে পড়বে, পাত্তা পাবে না। মারধর করা হবে পরিবারে। কলেজ বিববিদ্যালয়ে পড়া বন্ধ করে দেবে। বিয়ের খরচা দেবে না। এই বাস্তব হুমকিতে বসবাস করে বলেই তারা নিরব। কিন্তু এই নিরবতা পুরুষদের অন্যায়ের প্রতি সম্মতির লক্ষণ নয় মোটেই ( যে রকম নারী বিদ্বেষীরা ভাবে!)। বরং এই নিরবতা অসহায় হিন্দু নারীর যুগ যুগান্তের মৌন কান্না; যাদের শুনার মত কান আছে তারা শুনতে পায় সেই মর্মস্পর্শী কান্না, আর যারা কান থাকতেও বধির তারা কেমন করে শুনবে!
আইন করে একবার মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার দেন, তখন দেখবেন, কয়জনে বলে, আমরা নেব না। আমাদের জমির দরকার নাই! আমরা ভ্রাতাভগ্নির প্রেমে অন্তরায় হতে চাই না।
পুরুষরা ভাল করে জানে, আইনে অধিকার দিলে নিজ নিজ অধিকার মেয়েরা ঠিকই বুঝে নেবে। ভ্রাতৃপ্রেমের দোহাই দিলে তখন লোকে হাসবে। তাই তারা সর্বশক্তিতে নারীর সম্পত্তির অধিকারের দাবিকে প্রতিরোধ করতে চায়। মেয়েদের নামে কুৎসা রটায়, কলংক লেপন করে। হিন্দু মেয়েদের দমিয়ে রাখার সবচে’ বড় অস্ত্র এই কথা বলা, “তোরা ধর্মান্তরের মতলবে বাপের সম্পত্তি চাস!” তারা ভুলে যায় যে, তারা মাতৃজটরে লালিত হয়েছে এবং তার মা একজন জটরধারী নারী।
হিন্দুমেয়েরা সংসারে পেটেভাতের কামলা, যাদের ক্রীতদাসীর মত জীবনযাপন করতে হয়। ক্রীতদাস বা ক্রীতদাসীদের কস্মিনকালেও বাকস্বাধীনতা থাকে না। মালিকের ইচ্ছার বিরুদ্ধাচারণ দুঃসাহসের কাজ।
আমার কন্যা বাপের সম্পত্তি চায়, অথচ আপনার কন্যা সম্পত্তি চায় না, এর কারণ কী? ভেবে দেখেছেন কখনও? কন্যাকে স্বাধীন মতামত রাখার সুযোগ দিয়ে একান্তে তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তা হলে সঠিক উত্তরটা পাবেন।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত উপমহাপুলিশ পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ
* লেখাটি ফেসবুকে প্রকাশিত