শিতাংশু গুহ: বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ চীনকে পছন্দ করে? কথাটা রূঢ় সত্য। চীন বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই কৃতিত্ব চীনপন্থী কমুনিস্টদের নয়, বরং ইসলামপন্থী মৌলবাদীদের। চীনপন্থী কম্যুনিস্টরা প্রায় সবাই সাম্প্রদায়িক, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ কথা বেশ জোর দিয়েই বলা যায়? এভাবেও বলা যায়, চীনপন্থী কমিউনিষ্ট এবং ইসলামপন্থী মৌলবাদ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ! একটা সময়ে আমরা শুনেছি, ‘চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান’। যাঁরা এ তত্ত্বে বিশ্বাস করেন, জানিনা, তাঁরা কি এখন বলবেন, ‘চীনের ভাইরাস (করোনা) আমাদের ভাইরাস’?
চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে বিরোধিতা করেছে। যদিও আন্তর্জাতিক কূটনীতির কারণে ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করেনি, বা সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি। চীন অযথা পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে জড়াবেই বা কেন? বন্ধু’র জন্যে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইতিহাস চীনের কই? আর পাকিস্তান তো বন্ধু নয়, ‘খয়ের খা’, ভৃত্যের জন্যে কেউ মরে নাকি? পৃথিবীতে ‘প্রভুভক্ত’ কুকুরের অনেক গল্প আছে; কিন্তু ‘ভৃত্যভক্ত’ প্রভুর আত্ম্যত্যাগের কাহিনী তেমন নেই? বাংলাদেশের জাতিসংঘ সদস্য প্রাপ্তি ইস্যুতে চীন ‘ভেটো’ দিয়েছে। স্বীকৃতি দিয়েছে ৩১শে আগষ্ট ১৯৭৫, বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর।
রাজনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নেই, একথা সবার জানা। চীন তাই বাংলাদেশের বন্ধু হতেই পারে? কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের চীনপ্রীতির কারণ রাজনীতি নয়, বরং ‘ভারত-বিদ্বেষ’। যেহেতু চীন ভারতের শত্রু, তাই বাংলাদেশের বন্ধু। ভারত বিদ্বেষই বাংলাদেশে দেশপ্রেম! পাক-ভারত ক্রিকেট ম্যাচের কথা আনছি না, চীনপ্রীতির ঘটনা থেকে বাংলাদেশে ভারত-বিরোধিতার তীব্রতা বোঝা উচিত। ভারতের অনেক দোষ, তন্মধ্যে মুখ্য দু’টি হচ্ছে, ‘ভারত হিন্দু অথবা হিন্দু ভারত’ এবং ভারত ‘সাঁধের পাকিস্তান’ ভেঙ্গেছে। এ অমার্জনীয় অপরাধের কোন ক্ষমা নেই?
ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, ৯৩হাজার বন্দী পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী ছেড়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে এনেছে; বঙ্গবন্ধু’র এক কথায় সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে, বা এমনি কত কি যতই বলুন না কেন, কিচ্ছু লাভ নেই, ভারত ‘কাপড় খুলে’ দিলেও বাংলাদেশের মানুষের মন পাবেনা? বাংলাদেশে একটি ডায়লগ আছে, ‘দেহ পাবি মন পাবি না’- বাংলাদেশ সরকার (দেহ) ভারতের বন্ধু হতে পারে, কিন্তু জনগণ (মন) বিপক্ষে। এন্টি-ইন্ডিয়ান জনগণের সংখ্যাটা একশ’ শতাংশ হয়তো নয়, তা ঠিক, কিন্তু অংকটি বিশাল! ভারত যতই গরু, পেঁয়াজ সাপ্লাই করুক না কেন, কাজ হবেনা!
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, মানুষগুলো বাঙ্গালী হয়নি, পাকিস্তানীই রয়ে গেছে? তাই পাকিস্তান ভাতৃপ্রতীম দেশ, ভারত বন্ধুপ্রতিম। ভাতৃপ্রতিম হচ্ছে ভাইয়ের মত; ভাই বেশি প্রিয় না বন্ধু? ক’দিন আগে ভারত ও চীনের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য একটি সুন্দর কথা বলেছেন, সেটি হচ্ছে, ‘ভারত আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু, আর চীন বন্ধু’। এটি তো রাষ্ট্র পর্যায়ের কথা, দুই দেশ তাঁদের প্রয়োজনমত কূটনৈতিক ভাষায় কথা বলবে, সেটাই স্বাভাবিক, আমি বলছিলাম ‘আম-জনতার’ কথা! বাংলাদেশিদের ভারত-বিদ্বেষ ধর্মীয় চেতনা থেকে উদ্ভুত।
ঠিক একই কারণে বাংলাদেশের মানুষ কতটা বাঙ্গালী তা বলা মুশকিল, পুরোপুরি বাঙ্গালী নয়, হয়তো, ‘বাঙ্গালী মুসলমান’! ধর্ম সংস্কৃতির একটি অংশ। কিন্তু ধর্ম যেখানে সংস্কৃতি থেকে বড় হয়ে যায়, অথবা ‘পরকাল’ ইহকাল থেকে মোক্ষ হয়ে যায়, সেখানে আরবীয় সংস্কৃতি ঢুকতে বাধ্য অথবা মরু সংস্কৃতি ঢুকলে এমনি হয়? বাংলাদেশে এখন বাংলা থেকে আরবীর কদর বেশি। ষাটের দশকে আরবি হরফে বাংলা লেখার একটি উদ্যোগ ছিলো, সেটি যাঁরা ভণ্ডুল করেছেন, তাদের উত্তরসূরিরা এখন দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর ওয়াজ শুনে ঘুমাতে যায়! কথাবার্তা, চলন-বলন, বইপুস্তক সর্বত্র একই অবস্থা।
বাহাত্তরে বাংলাদেশে রব উঠেছিলো, ‘ঢাকা হবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির’ কেন্দ্রবিন্দু। এখন আর একথা কেউ বলেনা। ছবি বিশ্বাসের সেই বিখ্যাত ডায়লগ, ‘অভাব জানালা দিয়ে প্রবেশ করলে ভালোবাসা দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়’ মনে আছে নিশ্চয়? তেমনি মরু সংস্কৃতি দরজা দিয়ে ঢুকলে বঙ্গ সংস্কৃতি জানালা দিয়ে পালাবে বটে। বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক দৈন্যতা প্রকট, ভাস্কর্য ভাঙ্গা এর প্রমান। চীনে কিন্তু ভাস্কর্য আছে! চীন মুসলমানদের চরম অত্যাচার করছে, শুয়োর খাওয়াচ্ছে, মসজিদ ভেঙ্গে দিচ্ছে, মুমিন মুসলমান টু-শব্দ করছেন না? এর ছিটেফোঁটা ভারতে হলে টের পেতেন তাদের দেশপ্রেম! এজন্যেই বলছিলাম, ভারত বিদ্বেষই বাংলাদেশে দেশপ্রেম!
লেখক: আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক, ইমেইল: guhasb@gmail.com