সাম্প্রদায়িক শক্তির কারণেই নারী অধিকার ও দেশের অগ্রগতিবাধাগ্রস্ত হচ্ছে

দীপক চৌধুরী: বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, খবরদারিত্ব যাই বলি না কেন-সবকিছুর চেয়েও জটিল বিষয় হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। এই সাম্প্রদায়িকতা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে মানুষকে ভালোবাসা। কে হিন্দু, কে মুসলিম, কে মুচি, কে দলিত, কে শিক্ষক, কে বিজ্ঞানী- এই ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠতে না পারলে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হবে না। আর এটা সৃষ্টি না হলে সাম্প্রদায়িকতা নিশ্চিহ্ন হবে না। দীর্ঘদিন থেকেই চলে আসা এ প্র্যাকটিস বন্ধ করার জন্য যে হিম্মত দরকার এর ঘাটতি রয়েছে। জাতীয় পার্টি, বিএনপি, জামায়াত ও সমমনা শক্তিগুলো চিরকালই আওয়ামী লীগ বিরোধী। ইতিহাসে এর অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করে। সংবিধান থেকে বাতিল করা হয় রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক স্তম্ভ ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। একদিকে জাতির পিতার খুনীদের দায়মুক্তি দিয়ে জারি করা হয়েছিল কুখ্যাত ইনডেমেনিটি অধ্যাদেশ, অন্যদিকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে ধর্মভিত্তিক ও যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতির সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। পঁচাত্তর পরবর্তী দীর্ঘ সময়ের সেনাশাসনে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অসাম্প্রদায়িক চরিত্রকে ছিন্নভিন্ন করা হয়।

সেটি এক দীর্ঘ ইতিহাস, অতীত ও দুঃসময়। জিয়াউর রহমান, এইচ এম এরশাদ, খালেদা জিয়ার রাজনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ছিল। বলা চলে, এটা ছিল একমাত্র দর্শন ও শক্তি। জিয়ার দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরেই এরশাদের যাত্রা ও ক্ষমতারোহন। এবার বিজয় দিবসে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে নতুন করে শপথ উচ্চারিত হয়েছে। অবশ্য এটি প্রতিবছরই হয়ে থাকে। আমরা শপথ নিই আবার ভুলে যাই। ভাস্কর্য বিরোধিতার নামে সাম্প্রদায়িক শক্তি নতুন করে ফণা তোলার কারণেই এক ধরনের প্রতিবাদী মনোভাব বিজয় দিবস উদযাপনকে ঘিরে দেখা গেছে। যদি ভুল না করি তাহলে দেখতে পাই, আমরা ১৯৭১-এ সাম্প্রদায়িকতাকে ‘কবর’ দিয়েছি।

বিস্ময়কর ঘটনা এটি যে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনাও এবার বিজয়ের মাসে ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিজয় দিবসের আলোচনা সভায় বলেছেন, “আমি একটা কথাই বলব, এই মাটিতে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সকল ধর্মের মানুষের বসবাস থাকবে অর্থাৎ আমরা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে অন্য ধর্মকে অবহেলার চোখে দেখবো না।” তিনি আরো বলেন, “মনে রাখতে হবে, সকলে এক হয়ে মুক্তিযুদ্ধে রক্ত ঢেলে দিয়ে এদেশ স্বাধীন করেছি। যার যা ধর্ম তা পালনের স্বাধীনতা সকলেরই থাকবে। আমরা সেই চেতনায় বিশ্বাস করি এবং ইসলাম আমাদের সে শিক্ষাই দেয়।”

এটা তো প্রমাণিত যে, পাকিস্তান ছিল ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি এ জন্যে যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না। রাষ্ট্রীয়ধর্ম থাকবে না। ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার হবে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে। রাষ্ট্র হবে সবার, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব মানুষের। রাষ্ট্রটি হবে অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চরিত্রের। কারণ, বিশেষ কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিল না মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধ ছিল আমাদের সকল বাঙালির।

লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি, সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ