মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে কী বোঝায়

মেহেরুন্নেছা: মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ক্যানভাসটা আসলে কী! মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ক্যানভাসটা হল সর্বাগ্রে দেশপ্রেম। দেশের মঙ্গলার্থে নিবেদিতপ্রাণ এবং প্রগতিশীল একটা জাতিই হবে সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ একটা জাতি। এ দেশের আকাশ-বাতাস-সবুজকে যারা ভালোবাসে; এ দেশের জনসাধারণকে যারা ভালোবাসে; এ দেশের উন্নয়নে যারা সুখী হয় তারাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালনকারী। তারাই ভালোবেসে লাল-সবুজের পতাকাটা হৃদয়ে ধারণকারী। তারাই ’৭১ সালে পাকিস্তানের শোষণকে মনেপ্রাণে ঘৃণাকারী।

এ চেতনাধারীরাই ’৭১-এর লড়াইকে জাতির মুক্তির লড়াই বলে মনে করে। এসবই হল একজন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিয়ামক। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এবং এ বাংলার মানুষের অন্যায়ের কাছে কভু মাথা নত না করা।

জাতির পিতা আমাদের মুক্তি চেয়েছিলেন। তিনি সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে এক জঘন্য লুকোচুরি। কী হয়েছিল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সেই রাতে?

সেই রাতে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বুলেটের বৃষ্টি ঝরেছিল; বাংলার আকাশে মর্মছেঁড়া কান্নার রোল উঠেছিল; সুবহে সাদিকের বেলায় আগস্ট আর শ্রাবণের মাতমে প্রকৃতি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ঘাতকরা ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে। বাংলার লাল-সবুজের পতাকায় অঙ্কিত হয়েছিল এক কালো অধ্যায়।

বাংলার ইতিহাসে আগস্ট এখন কেবলই রক্তঝরার ইতিহাস। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়ানক গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং অন্তত ৫০০ নেতাকর্মী আহত হন। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট মাত্র আধা ঘণ্টার ব্যবধানে সারা দেশের ৬৩ জেলার ৩০০ স্থানে ৫০০টিরও বেশি সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ভয়ানক ঘটনাগুলো মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্রেরই কর্ম।

সবচেয়ে ভয়ংকর ও ন্যক্কারজনক বিষয় হল, ১৫ আগস্টের পর ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ আবার কী জিনিস টাইপ প্রশ্নের উত্থাপন শুরু করল একটি গোষ্ঠী। এতে করে ঘাতকের সন্তানদের রাজত্বের তোড়ে শহীদের সন্তানরা মুখ লুকাতে বাধ্য হয়। একটা সময় বঙ্গবন্ধুকে আড়ালে রেখে ঘাতকদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মেরে রক্তাক্ত করা হয়। সেই যে শুরু হল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বেইমানি, আজ অবধি তা চলছে। একটা পক্ষ স্বাধীনতার ভুল ইতিহাস, ভুল বার্তা, বিতর্কিত ইতিহাস- এসব হঠকারিতার আলোকে গোপন ষড়যন্ত্রের বিন্যাসে মত্ত হয়। বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিভিন্ন রকম ন্যক্কারজনক ঘটনার।

এই যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, তাকে আমরা কী বলব! এটি আসলে একটা জাতির নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। নিজের শেকড়ের সঙ্গে লড়াই।

এ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। মুক্তিযুদ্ধকে উপলক্ষ করে এ দুটি দিবসেও অনেকের আপত্তি। তারা একটি দিনকেই স্বাধীনতা দিবস হিসেবে রাখতে চান। হায়রে কপটেরা! চোখ বন্ধ করলেই কি সত্যকে ধামাচাপা দেয়া যায়! ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর- দুটি দিবসের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য ভিন্ন হলেও তা বাঙালির কাছে চিরকাল ভাস্বর হয়েই থাকবে। কেবল তাই নয়, স্বাধীনতার পক্ষশক্তির কাছে ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরের মতো ৭ মার্চও সমান তাৎপর্যপূর্ণ।

এ জাতিকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয়েছিল সেই ১৯৫২ সালে। আর মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা এসেছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে। সুতরাং স্বাধীনতার ইতিহাসে যে বা যারা ক্ষিপ্র হয়ে আঁচড় কাটে কিংবা নখর বসাতে চায়, তারা আসলে তাদের নিজেদের কুৎসিত-লোলুপ-বিশ্বাসঘাতক-প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গিটারই প্রতিফলন ঘটায়।

অবশেষে ইতিহাসের চাকা ঘুরে বুড়িগঙ্গায় অনেক পানি গড়িয়ে গেল। বঙ্গবন্ধুর এ বাংলায় এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির কাছে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে গেছে, স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসকে বিভ্রান্ত করতে চায় কারা। বর্তমান সময়ে সর্বাধিক আলোচিত শব্দ ‘হাইব্রিড’। এ হাইব্রিডই বা কারা? এ হাইব্রিডরা আসলে কী চায়? কেন এ হাইব্রিডদের নিয়ে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির প্রতি এত বিষোদ্গার!

নিশ্চয়ই আমরা হাইব্রিডদের ব্যাপারটি এত সরল চোখে দেখব না। হাইব্রিডদের প্রসঙ্গে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলব, তারা স্বার্থান্বেষী, তারা রাতের আঁধারে প্রতিক্রিয়াশীল। আড়ালে তাদের স্বরূপ ভিন্ন। কিন্তু দিনের আলোতে তারা জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করে। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, কেউ যদি প্রতিক্রিয়াশীল চেতনা থেকে সরে এসে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়, তাকে কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কাতারে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হবে না?

এর উত্তর হল, অবশ্যই সুযোগ দেয়া হবে। কেন নয়? তবে এখানে একটা কথা আছে। সেটা হল, হাইব্রিডদের প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের প্রতি রোষানল কিংবা অবচেতনে প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব তাদের ছদ্মবেশের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে পড়ে। তাদের ষড়যন্ত্র যত গোপন হোক না কেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান যত অস্পষ্ট হোক না কেন, তা সময় ও মানুষের কাছে এক সময় উন্মোচিত হয়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির আদর্শে কুঠারাঘাত এবং রাজনীতির ময়দান থেকে আখের গোছানোর উদ্দেশ্যেই তারা কখনও কখনও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে আঁতাত করে। হ্যাঁ, আঁতাত বটে! কারণ, আজকাল মাঠ পর্যায়ে দেখা যায়, ক্ষুদ্র ঠুনকো স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে কিছু লোক বরং হাইব্রিডদের সঙ্গে হাত মেলায়। প্রকৃতপক্ষে চর্ব-চোষ্য ভোগ করার জন্যই এ আদর্শহীনতার মেলবন্ধন। তখনই হাইব্রিডদের প্রতি এবং ট্র্যাকচ্যুত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের প্রতি ঘৃণা দানা বাঁধতে থাকে।

ব্যাপারটাকে আমরা এভাবে বলতে পারি, কয়লা ধুলে ময়লা যায় না। সুতরাং হাইব্রিড ও আদর্শ বিসর্জনকারীর দল যতই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মেতে উঠুক না কেন, তাদের স্বরূপ সবার জানা। পেছনের জীবনে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির যে ছাপ হাইব্রিডরা রেখে এসেছে সেটা কোনো না কোনোভাবে বের হয়ে পড়েই। মানুষ চাইলেই তার নেতিবাচক অতীত থেকে মুক্ত হতে পারে না। অতীত তাকে তাড়িত করে ফেরে।

তাই হাইব্রিডরা যতই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মেতে থাকুক না কেন, প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের অনুসারীদের এ দেশের স্বার্থে, রাজনৈতিক আদর্শের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, উন্নয়নের স্বার্থে হাইব্রিডদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। সুতরাং সতর্কতাই হতে পারে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির একমাত্র রক্ষাকবচ।

মেহেরুন্নেছা : সহযোগী অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ