স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা

ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ: ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল একটি ভূ-খ-ের, যার নাম বাংলাদেশ। সবুজের জমিনে রক্তিম সূর্য খচিত মানচিত্রের এ দেশটির ৪৯ বছর পূর্তি উদযাপন করছি আমরা। ৫০ বছরে পা রাখতে চলেছে প্রিয় বাংলাদেশ। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবে বাঙালি জাতি।

বিজয় অর্জনের পর ৪৯ বছরের পথচলায় দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ দেশ আখ্যা দিয়ে যারা অপমান-অপদস্থ করেছিল, তাদের কণ্ঠেই এখন বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা। দারিদ্র্য আর দুর্যোগের বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের পথে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের মুষ্টিমেয় সহযোগী ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের জয় হয়েছিল। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের পর সেদিন মানুষ হাঁফ ছেড়ে নিঃশ্বাস নিয়েছিল। যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জন-স্বজনদের জন্য কেঁদেছিল চিৎকার করে। এ জয়ের পেছনে রয়েছে বাঙালির বহু ত্যাগ ও নির্যাতন সহ্য করার ইতিহাস। তবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সেই স্বজন হারানো, সম্ভ্রম হারানোর শোক ও লজ্জাকে শক্তিতে পরিণত করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চেয়েছে এ দেশের মানুষ। এর মাঝে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি ছিল মানুষ্য সৃষ্ট নানা সংকটও। তবুও বাংলাদেশ পিছু হটেনি। জয়ী হয়েছে শত বাধা পেরিয়ে। বাধা-বিঘœকে পেছনে ফেলেই সৃষ্টি করেছে নতুন ইতিহাস, নতুন গল্পের, নতুন জীবনের, নতুন প্রেরণার।

বিজয়ের পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশে ফিরেই সহযোদ্ধা-সহকর্মীকে নিয়ে শুরু করেন একটি বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজ। তার সেই সময় নেওয়া উদ্যোগগুলো ছিল বেশ প্রশংসনীয় ও সময়োপযোগী। তিনি চেয়েছিলেন এ দেশের মানুষ মাথা উঁচু করে বাঁচুক। গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন সোনার বাংলা। এ লক্ষ্যে গ্রহণ করেন নানা অসাধ্য কর্মসূচির। একটি রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় এমন কোনো বিষয় নেই যা তিনি স্পর্শহীন রেখেছেন। প্রযুক্তিনির্ভর জাতির ভিত গড়তে তিনি স্বাধীনতার পর রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় স্থাপন করেন ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র। জোর দেন শিক্ষার ওপর। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগকে বঙ্গবন্ধু সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ বলেছিলেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনার প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পদক্ষেপে।

বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা সরকারিকরণে সংবিধানের ১৭নং অনুচ্ছেদে গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার বিধান রাখেন। নিরক্ষরতা দূর করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথাও সংবিধানে বলা হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে বিনামূল্যে বই, অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ ও খাবার বিতরণ করার উদ্যোগ নেন। বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে যে সাফল্য, এর পেছনেও বঙ্গবন্ধুর এসব পদক্ষেপের বড় ভূমিকা রয়েছে। এরই আলোকে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ মানসম্মত শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করছেন।

দেশে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৪৭ শতাংশ, এখন তা মাত্র ৬.২ শতাংশ। এ হার আরও কমানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে সরকার। প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি উভয় সূচকের স্থিতিশীলতার বিচারেও দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। এছাড়া রপ্তানি খাতে বিশাল রূপান্তর ঘটেছে। ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ৩৮৩ মিলিয়ন ডলার। মূলত পাকিস্তান আমলে গড়ে ওঠা রপ্তানি নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ায় স্বাধীনতার পরপর রপ্তানি কমে গিয়েছিল। আর বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি ৮১ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১.২ বিলিয়ন ডলার। একই সঙ্গে বেড়েছে রপ্তানি পণ্যের সংখ্যাও। স্বাধীনতার পর রপ্তানি আয়ের সত্তর ভাগ ছিল পাটের দখলে। বর্তমানে মোট রপ্তানির ৮২ শতাংশই তৈরি পোশাক খাতের দখলে। তৈরি পোশাকে বিশ্বে এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ। চল্লিশ লাখের বেশি শ্রমজীবী এ খাতের পেশায় নিয়োজিত রয়েছে যার বেশিরভাগই নারী শ্রমিক।

কিন্তু বাংলাদেশের এ অবস্থায় আসা সহজ ছিল না। বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতিতে নেমে আসে হত্যা-খুন ও অপসংস্কৃতির ধারা। একাত্তরের যে ঐক্যে জাতি জন্মভূমিকে শত্রুমুক্ত করেছিল, ১৯৭৫ সালে সেই ঐক্যে ফাটল ধরে। বারবার সামরিক শাসন। তবে অনেকটা ঐক্যবদ্ধভাবে ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাংলাদেশের মানুষ। স্বৈরাচারের কবল থেকে মুক্ত হয় গণতন্ত্র। গণতন্ত্র আছে বলেই মানুষ নানা দলে-উপদলে ভাগ হয়ে আছে। অথচ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্ত ভিত্তির ওপর স্থাপিত হয়নি। এখনো নানা সময়ে শোনা যায় সাম্প্রদায়িক শক্তির মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার খবর, ধর্মীয় গোঁড়ামির খবর। এসবের বিরুদ্ধে সচেতনভাবে চিন্তা করতে হবে।

আমরা এমন একটি সময়ে উদযাপন করলাম যখন চারদিকে বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের থাবা। প্রতিদিনই খবর আসছে অদৃশ্য এ শত্রুর হানায় মৃত্যুর খবর। এদিকে করোনাকালে পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কায় সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বছরজুড়ে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানমালাসহ বেশিরভাগ অনুষ্ঠান আয়োজনই বাতিল কিংবা সীমিত করা হয়েছে। এছাড়া ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’র সুফল কাজে লাগিয়ে অনলাইনেও কিছু কিছু অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হচ্ছে। ৫০ বছরে পা রাখতে চলেছে বাংলাদেশ স্বভাবতই একটু আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা। সেখানে আমাদের মানতে হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব, সঙ্গনিরোধ, বিচ্ছিন্ন থাকা ইত্যাদি। আমরা বাধ্য হচ্ছি ঘরে থাকতে।

দীর্ঘ লকডাউন শেষে জীবনযাপনের প্রয়োজনে ‘নিউ নরমাল’ হতে শুরু করেছে বিশ্ব। বাংলাদেশও খুলতে শুরু করেছে কলকারখানা, অফিস-আদালত। এরই মধ্যে লেগেছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। স্কুল-কলেজ এখনো খুলছে না। লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয়। মানুষের মাঝে হতাশাও বাড়ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেড়েছে অপরাধ। সরকারের উদ্যোগে এ ধরনের সামাজিক বিষয়কে বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।

বলা হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবজাতি এত ভয়াবহ সংকটে আর পড়েনি। প্লেগ, কলেরা, ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো মহামারীতে ব্যাপক মানুষের মৃত্যু হলেও পৃথিবীজুড়ে এমন শঙ্কা, অনিশ্চয়তা নাকি আর কখনো দেখা যায়নি। পৃথিবী আগে কখনো এভাবে স্থবির হয়নি, অবরুদ্ধ হয়নি। যুদ্ধ, মহামারী যা-ই হয়েছে তা সীমাবদ্ধ থেকেছে কয়েকটি দেশের গ-িতে, সীমিত সংখ্যক মানুষের মধ্যে। কিন্তু করোনা যেন কিছুই মানছে না। কী ধনী, কী গরিব। এই দুর্যোগে সবাই আক্রান্ত। পৃথিবীতে কোনো দুর্যোগই স্থায়ী হয় না। এ দুর্যোগও কাটবেই। হয়তো অচিরেই। এরই মাঝে টিকা আবিষ্কারের কথা শোনা যাচ্ছে। অনেক দেশ বলছে এগুলো কার্যকরও। তবে এ অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণের ক্ষত শুকাতে সময় লাগবে।

বৈশ্বিকভাবে যে অর্থনৈতিক দুর্দশা দেখা দিয়েছে বাংলাদেশেও এর বাইরে নয়। তবে এ দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার বিপুল অর্থের অনেক প্রণোদনা প্যাকেজসহ বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। যা বেশ ফলদায়ক। মাঠপর্যায়ে এসব উদ্যোগের সুষমবণ্টন ও সবাই এ সুবিধা ভোগ করুক আমরা তা-ই প্রত্যাশা করি। আশার কথা, বাংলাদেশের মানুষ জন্মগতভাবেই বেশ সহনশীল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেই নিজেদের টিকে থাকার পথ বের করে এগিয়ে চলে তারা। বাংলাদেশ নামক দেশটিও জন্মের পর থেকেই নানা সংকট কাটিয়ে আলোর পথে যাত্রা করে এগিয়ে চলেছে। এবারও পিছু হটবে না। তারুণ্যনির্ভর এ জাতি সব বাধা উপেক্ষা করে ফের আকাশে বিজয় কেতন ওড়াবে।

প্রায়ই অনেককে বলতে শুনি, বিজয়ের ৪৯ বছরে আমাদের অর্জন কতটুকু? সবাই কি স্বাধীনতার সুফল পাচ্ছে? এর উত্তর বেশ সোজা। বাংলাদেশের গ্রামগুলোই এর প্রমাণ। দরিদ্রতার কুঠারাঘাতে কেউ না খেয়ে থাকে না। নারীরা কাজ করছে। ভূমিকা রাখছে পারিবারিক সিদ্ধান্তে। অনেক ক্ষেত্রেই উন্নয়ন ও সাফল্য অর্জিত হয়েছে। প্রসার ঘটেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে। বিশ্বের উন্নত দেশের মতো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে অবতীর্ণ হতে প্রস্তুতি নিচ্ছে ঠাকুরগাঁও কিংবা সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলের তরুণটিও। বাংলার ছেলেমেয়েরা এখন সিলিকন ভ্যালিতে উচ্চপদে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আবিষ্কারে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে বিশ্বকে। এটা আমাদের গৌরবই বটে।

তবে সামগ্রিকভাবে গৌরব করার জন্য আমাদের আরও জায়গা রয়েছে। সেই জায়গাগুলোতে এগিয়ে যেতে হবে, আরও কিছু কাজ করতে হবে। সুষ্ঠু ও উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রচলন করতে হবে, যার প্রভাব পড়বে সমাজে-অর্থনীতিতে।

করোনার কারণে পুরো বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য একটি ধাক্কা। করোনা-পরবর্তী বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে এরই মধ্যে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহ যে, করোনা-পরবর্তী বিশ্বে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। বদলে যাবে মানুষের চিন্তাধারা। নতুন আলো ফুটবে চিন্তার জগতে। সৃষ্টি হবে সভ্যতার নতুন দিগন্ত। যদিও কভিড-১৯-এর মতো অদৃশ্য ভাইরাসের কাছে মানুষের কোনো অহংকার টিকছে না। তাই এখন সময় এসেছে মানুষের সার্বজনীন কল্যাণ নিয়ে ভাববার, সেখানে কোনো রেষারেষি নয়, ধ্বংস নয়, মনোযোগ নিহিত হতে হবে শুধুই কল্যাণে। এ নিয়ে ভাবতে হবে বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ ও রাষ্ট্রচিন্তকদের।

লেখক উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ