হারুন হাবীব: ২০২০-এর মহামারি বিশ্বকে বড় ধাক্কা দিয়ে চলেছে। সেই ধাক্কায় বেশিরভাগ রাষ্ট্রই বেসামাল হয়ে পড়ে বটে, কিন্তু সময় গড়াতে জীবনের স্বাভাবিক তাগিদে প্রায় সবাই সচল হতে বাধ্য হয়েছে। কাজেই কোনো কিছুই থেমে নেই। থামার সুযোগও নেই। সেই প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ ও ভারতের শীর্ষ পর্যায়ের একটি বৈঠক ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ। বাংলাদেশ ও ভারতের সাম্প্রতিক সম্পর্ক নিয়ে যারা জল্পনাকল্পনা করেছেন এই বৈঠক হয়তো তাদের উত্তেজনা প্রশমন করতে পারে।
মহামারি পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ বৈঠক ভার্চুয়াল, অর্থাৎ ডিজিটাল পদ্ধতিতে হয়ে থাকে। শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির শীর্ষ বৈঠকটিও সেভাবে হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের সামনে বৈঠকের বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশে ভারতের নতুন হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বৈঠকের খুঁটিনাটি প্রকাশ করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তি বাড়াতে ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিদেশীয় মহাসড়কে যুক্ত হতে গভীর আগ্রহ দেখিয়েছেন। এজন্য তিনি ভারতের সহযোগিতা চেয়েছেন। আমরা সবাই জানি, এই সড়কে যুক্ত হওয়ার জন্য আগেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া রাজি হননি।
দুই শীর্ষ নেতার আলোচনা শেষে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতেও ত্রিদেশীয় মহাসড়কে যুক্ততার বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ভারতের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সংযুক্তির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ হয়ে পশ্চিমবঙ্গের হিলি থেকে মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জে সহজে যাতায়াত করা যাবে। বলে রাখি, মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জ আমার মতো হাজারো মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতির অঞ্চল, যেখানে গড়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টরের প্রধান কেন্দ্র, যেখান থেকে পরিচালিত হয়েছে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে ২২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার লাগাতার যুদ্ধ। সুবিবেচক সবাই আশা করবেন এই মহাসড়কের বাস্তবায়ন হোক।
১৯৭১ থেকে সামনে এগিয়ে ভারত ও বাংলাদেশ ২০২০ সালে এসে উপনীত হয়েছে। এরই মধ্যে পার হয়েছে ৪৯ বছর। অনেক চড়াই-উতরাই গেছে দুই পড়শির সম্পর্কের। অনেক অমীমাংসিত বিষয়, এমনকি যুগপ্রাচীন বহুবিধ সংকটেরও সমাধান করেছে দুই দেশ। পাকিস্তান আমলের সন্দেহ-অবিশ্বাস দূর করেছে এবং বলা যায়, ২০১০ সাল থেকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন যাত্রা শুরু করেছে। সেই যাত্রায় কখনও সংকটের সৃষ্টি হয়েছে বটে, কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতার কারণে সেই সংকট উতরেছে। বলতেই হবে, ছিটমহলগুলোর শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর ও সমুদ্রসীমা মীমাংসার মতো বড় বিষয়গুলো যারা স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার সঙ্গে সমাধান করতে পারে, তারা অন্য সংকটগুলোর সমাধান দিতে পারে না- এমনটা মানার যুক্তি নেই।
বলতেই হবে, দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে অনেক বছর ধরেই দুটি বড় বিষয় ঝুলে আছে। এর একটি তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের চুক্তি এবং অন্যটি সীমান্ত হত্যা বা দুই দেশের বর্ডারে চোরাচালানের প্রেক্ষাপটে প্রায় প্রতিনিয়ত গুলি করে মানুষ হত্যার মতো ঘটনা। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। মোদির বরাত দিয়ে তিনি বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা কোনো সীমান্ত হত্যা চাই না। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আরও বলেছেন, সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার নির্দেশ তিনি আবারও জারি করবেন।
একটি বিষয় অবশ্যই আলোচনায় আনা সংগত হবে। দুই দেশের সীমান্তে যেসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলে, তার সঙ্গে জড়িত আছে একদিকে ভারতের কিছু মানুষ; অন্যদিকে তাদের বাংলাদেশের সহযোগীরা। এই সংকটের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ, অপরাধ দমনে রাইফেলের গুলিই একমাত্র পথ হতে পারে না। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সীমান্তের প্রায় নিত্য রক্তপাতের বিষয়গুলো প্রকাশিত হয়, যা দুই দেশের সম্পর্কের একটি দুষ্টক্ষত। এ ক্ষতকে জরুরি ভিত্তিতে সারাতে হবে। অন্যদিকে তিস্তা ও অন্যান্য অভিন্ন নদীর চুক্তির প্রসঙ্গটিও গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি ভারতের রাজনৈতিক মহল বিষয়টি কার্যকরভাবে ভাববে। তবে করোনা মহামারি মোকাবিলা ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় ভারত এবং বাংলাদেশ একসঙ্গে কাজ করবে বলে দুই প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করায় সামগ্রিক পরিস্থিতির অগ্রগতি ঘটবে বলে ধারণা করা যায়।
ভারত ও বাংলাদেশের গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী মোদি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনায় একটি বিষয় সবিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। বলেছেন, বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশীকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি থেকে ভারত কোনো অবস্থাতেই সরে আসবে না। মোদির ভাষায়- বাংলাদেশ বরাবরই ভারতের ‘নেইবার ফার্স্ট’ নীতির গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। অন্যদিকে ভারতকে অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে অভিহিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। শেখ হাসিনার ভাষায়- ভারত আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর যেসব সদস্য জীবন দান করেছেন, শহীদ হয়েছেন তাদের প্রতিও বঙ্গবন্ধুকন্যা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ১৯৭১ সালের সেই ইতিহাস সৃষ্টিকারী সময়ে সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতার জন্য ভারতের সরকার ও জনগণের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তিনি।
ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের ভিত রচনা করেছে ১৯৭১, যখন সেদিনকার পূর্ব পাকিস্তান থেকে এক কোটি মানুষ পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্বিচার গণহত্যা ও নারী নির্যাতন থেকে বাঁচতে ভারতের মাটিতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। সেই সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী বলে, জাতীয় রণাঙ্গনের একজন সৈনিক বলে দেখেছি- ভারতের গণমানুষের স্বতঃস্ম্ফূর্ত সহযোগিতায় কীভাবে সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে হাজারো শরণার্থী ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল, কীভাবে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল, কীভাবে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় মিত্রবাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে। সে কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ভারতের সরকার ও গণমানুষের অবদান ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এই শীর্ষ বৈঠকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমাধা করেছেন দুই প্রধানমন্ত্রী। তারা যৌথভাবে মহাত্মা গান্ধী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে তৈরি ‘বাপু-বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল প্রদর্শনী’র উদ্বোধন করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর এবং ভারতের জাতীয় জাদুঘরের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। দুই জাদুঘরের মধ্যে সম্পাদিত এই সমঝোতা স্মারকটি দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়।
আরও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। দুই প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে ৫৫ বছর পর নতুন করে চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রেল যোগাযোগ প্রকল্পের সূচনা করেছেন, যা ভারতের উত্তরবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগকে সহজ করবে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ওই রেলপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এ রেলপথ চালুর ফলে বাংলাদেশের মোংলা বন্দর এবং উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশ, নেপাল এবং ভুটানের মধ্যে বাণিজ্যিক কার্যক্রম জোরদার হবে। বাংলাদেশ থেকে সহজে দার্জিলিংসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে ভ্রমণ করা যাবে।
মোদি এবং হাসিনার বৈঠকের সময় তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা-সংক্রান্ত একটি চুক্তিও সই হয়েছে। এ ছাড়া বাণিজ্য, কৃষি, হাইড্রোকার্বন এবং সীমান্তে হাতি চলাচলের করিডরগুলোর সুরক্ষা-সংক্রান্ত কয়েকটি চুক্তি সই হয়েছে। ভারতের নতুন হাইকমিশনার বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করে ভারত।
সরকারিভাবে বলা না হলেও গত বছর ভারতের নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন চালু হওয়ার পরে দু’দেশের সম্পর্কে কমবেশি টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল। অনুপ্রবেশ বিতর্কের পাশাপাশি করোনা আবহে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় প্রকাশ্যে ক্ষোভ জানিয়েছিল ঢাকা। এই আবহে দুই প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্স ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক যারা পর্যবেক্ষণ করেন তারা বিলক্ষণ জানেন, এক দশক আগে ভারত ঋণচুক্তির আওতায় যে সহায়তা দিচ্ছে, তার বাস্তবায়ন যথেষ্ট ধীরগতির। এ ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত যে সমস্যাগুলো আছে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। কারণ বলতেই হবে, দুই দেশের সম্পর্ক ইতিহাসের নানা টানাপোড়েন সত্ত্বেও এক নতুন মাত্রায় এসে দাঁড়িয়েছে, যা দু’দেশকেই উপকৃত করতে পারে। অতএব, সে সম্পর্ক যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, অযথা সংকটের সৃষ্টি না হয়, সেদিকে সংশ্নিষ্ট সবার দৃষ্টি থাকা বাঞ্ছনীয়।
বলা বাহুল্য, রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সংকট, যা কেবল স্থানীয় জনজীবনের বিপদ ডেকে আনছে না, একই সঙ্গে আঞ্চলিক অনিরাপত্তারও আশঙ্কাও সৃষ্টি করেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে ভারতের নিশ্চয়ই কার্যকর কিছু করার আছে। প্রয়োজন দ্রুত রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়ার পরিবেশ তৈরি করা; এমন পরিবেশ তৈরি করা যাতে সেখানকার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত দূর হয়। কাজেই দ্রুত, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ২০২১ সালে অর্থাৎ আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর। যতটা শুনেছি, সেই মহালগ্ন যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করতে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত। এ উপলক্ষে আগামী বছর নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বলেছেন, বাংলাদেশ ও তার দেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সহযোগিতা রয়েছে, তারই ফল ১৭ ডিসেম্বরের ভার্চুয়াল বৈঠক। আগামী বৈঠকের আগে সম্পর্কের আরও কিছু দৃশ্যমান উন্নতি দেখা যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। আজকের মুক্ত বিশ্বে কোনো দেশের পক্ষেই একলা চলার নীতির চর্চা হয় না। কোনো দেশ বা জনপদ দুয়ার বন্ধ করে থাকে না বা থাকতে পারে না। ইতিহাস, সংস্কৃতি ও লাগোয়া সীমান্তের দেশগুলোর জন্য সে কারণেই নিবিড় যোগাযোগ প্রয়োজন। দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যত বেশি বিষয়টি অনুভব করবেন, তত বেশি দুই দেশের মানুষ উপকৃত হবে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও সাংবাদিক