“পঞ্চ অংশের দুই অংশ তোমার উচিত”

পুলক ঘটক: “গজ-কচ্ছপের লড়াই” একটি প্রচলিত বাগধারা। বিষয়টি এসেছে পৌরাণিক কাহিনী থেকে। মহাভারতে, রামায়ণে এবং গরুড় পুরাণে আমি এই কাহিনী পড়েছি। আজ কৃত্তিবাসী রামায়ণ নতুন করে পড়ার সময় গজ-কচ্ছপের লড়াই উপাখ্যানের একটি শ্লোক আমার বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করল। প্রথমে রামায়ণের উল্লেখিত অংশটি পুরো তুলে ধরছি। শেষে বিশেষ ঐ শ্লোকটির প্রসঙ্গে বলব।

“সন্তাপন নামে বিপ্র ছিল পূর্ব্বকালে।
তিন কোটি ধন রাখি স্বর্গবাসে চলে।।
সন্তাপনের দুই পুত্র পরম সুন্দর।
সুপ্রতাপ বিভাস এ দুই সহোদর।।
জ্যেষ্ঠপুত্র স্থানে ধন থুয়ে গেল বাপে।
কনিষ্ঠ করেন দ্বন্দ্ব ধনের সন্তাপে।।
ধন-শোকে ছোট ভাই হইল দুঃখিত।
জ্যেষ্ঠেরে কহেন ভাগ দেহ সমুচিত।।
জ্যেষ্ঠ বলে পিতা ভাগ না করিল ধন।
মম স্থানে ভাগ চাহ তুমি কি কারণ।।
ধন না পাইয়া কহে বশিষ্ঠের ঠাঁই।
পিতৃধন অংশ নাহি দেয় জ্যেষ্ঠ ভাই।।
কত অংশ পাই আমি বলহ এখন।
সেই দাওয়া করিয়া লইব পিতৃধন।।
বশিষ্ঠ বলেন আছে বেদের বিহিত।
পঞ্চ অংশের দুই অংশ তোমার উচিত।।
কনিষ্ঠ কহিল গিয়া জ্যেষ্ঠ বিদ্যমান।
পঞ্চ অংশের দুই অংশ দেহত এখন।।
আমি গিয়াছিনু ভাই বশিষ্ঠের স্থানে।
বশিষ্ঠ বলিল ভাই নাহি দেয় কেনে।।
জ্যেষ্ঠ বলে কনিষ্ঠ করিলে হেন কেনে।
জাতি-নাশ করিলে কহিয়া অন্য স্থানে।।
হীন জন জ্ঞান বুঝি কৈলা মুনিবর।
ধনের লাগিয়া এত হইলে কাতর।।
বারে বারে নিষেধিনু না শুনিলে কানে।
গজ হয়ে পাপিষ্ঠ প্রবেশ কর বনে।।
কনিষ্ঠ দিলেক শাপ জ্যেষ্ঠের উপরে।
কচ্ছপ হইয়া তুমি থাক সরোবরে।।
দুয়ের শাপেতে জন্তু হয় দুই জন।
কনিষ্ঠ গজের দেহ করিল ধারণ।।
দশ যোজন গজ দেহ কনিষ্ঠ ধরিল।
গজের গর্জ্জনে গিয়া বনে প্রবেশিল।।
কচ্ছপ সলিলে গেল গজ গেল বন।
শুণ্ডের ভিতরে গজ রাখে যত ধন।।
যতন করিয়া ধন যেই জন রাখে।
খাইতে না পায় ধন যায়ত বিপাকে।।
ধন পেয়ে যে জন না করে বিতরণ।
যথাকার ধন তথা যায় অকারণ।।
ধনেতে বিরোধ বাধে শুন মহাশয়।
যত ব্যয় করে, তত পরলোকে হয়।।
বশিষ্ঠের শাপে ধন নাহি পায় রক্ষা।
গজ-কচ্ছপের শুন ধনের পরীক্ষা।।
কহিলাম ধনের বৃত্তান্ত তব স্থানে।
গজ-কচ্ছপের কথা শুন সাবধানে।।
জলেতে কচ্ছপ আছে সেই সরোবরে।
দৈবযোগে গজ গেল জল খাইবারে।।
প্রখর রৌদ্রেতে গজ তৃষ্ণায় বিকল।
সরোবর দেখি গজ খেতে গেল জল।।
গজে দেখি কচ্ছপের পড়ে গেল মনে।
পূর্ব্বশোকে কচ্ছপ সে শুণ্ডে ধরে টানে।।
গজ টানে বনেতে কচ্ছপ টানে জলে।
গজ আর কচ্ছপ উভয়ে তুল্য বলে।।
কেহ কারে নাহি পারে দুজনে সোসর।
দুইজনে টানাটানি একই বৎসর।।”

এখানে আমার মনোযোগ কেড়েছে যে শ্লোকটি তা হল,

“বশিষ্ঠ বলেন আছে বেদের বিহিত।
পঞ্চ অংশের দুই অংশ তোমার উচিত।।”

অর্থাৎ সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠপুত্র পাবে পাঁচভাগের তিনভাগ এবং কনিষ্ঠজন পাবে দুইভাগ। এই বন্টন ব্যবস্থা দায়ভাগ অথবা মিতাক্ষরায় মান্য করা হয়নি।

এখানে লক্ষণীয় হল, সম্পদের ভাগাভাগির জন্য বিচার চেয়ে ছোটভাই রাজার কাছে যাননি; বিচারকের কাছেও নয়। তিনি গেছেন একজন ব্রাহ্মণ ঋষির কাছে। সেই ব্রাহ্মণ যে মতামত দিলেন সেটাই মেনে নিয়ে বড় ভাইয়ের কাছে তিনি তার অংশ চাইলেন। এ বিষয়টি সেই যুগের সমাজ ব্যবস্থার একটি প্রতিচ্ছবি।

সেই প্রাচীনকালে ভূমি বন্টনের আইন ছিল না, আদালত ছিল না। সাধারণ বিরোধ মীমাংসায় রাজার শাসনও ব্যাপকভাবে বলবৎ ছিলনা।

বস্তুনিষ্ঠতার প্রয়োজনে আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করতে হবে। তা হল, বাল্মীকি রামায়ণে এই আখ্যানটি আমি পাইনি। তবে মহাভারতে এবং গরুড় পুরাণে পেয়েছি। আরও অনেক পুরাণেই হয়তো আছে। কবি কৃত্তিবাস সে যুগের বহুশাস্ত্র বিশারদ একজন শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ও বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ছিলেন। বাংলায় রাম চরিত্র রূপায়নে তিনি বাল্মীকি রামায়ণ ছাড়াও অনেক গ্রন্থের আখ্যায়িকার সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন।

এখানে সম্পদ বন্টন ব্যবস্থার এই শ্লোকটি তিনি কোন গ্রন্থ থেকে নিয়েছেন জানি না। তবে ঋষি বশিষ্ঠের মুখ দিয়ে বেদের রেফারেন্সে কথাটি বলা হচ্ছে।

হতে পারে এটি কোনো পুরাণের বা সংহিতার সিদ্ধান্ত। অথবা হতে পারে এটা কৃত্তিবাসের সমসাময়িক সমাজ ব্যবস্থায় প্রচলিত বন্টন ব্যবস্থা, যা তার লেখায় বেড়িয়ে এসেছে।

কৃত্তিবাস ওঝা খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকের বাংলা কবি। দায়ভাগের রচয়িতা পন্ডিত জীমুৎবাহন একাদশ শতকের এবং মিতাক্ষরার রচয়িতা স্মৃতিকার বিজ্ঞানেশ্বর দ্বাদশ শতকের পণ্ডিত বলে গবেষকরা ধারণা করেন। তাদের দু’জনের একজনের মতবাদও যে কৃত্তিবাসের আমলে চালু ছিলনা তা বোঝা যায় ঐ শ্লোকে। হিন্দু মূল শাস্ত্রগন্থের সঙ্গে তাদের দেওয়া মতবাদের যে যথেষ্ট ফারাক আছে তাতেও সন্দেহ নেই।

আসলে ইংরেজরা হিন্দু আইন প্রবর্তনের আগে এরকম আইনের কোথাও কোনো প্রায়োগিক ভিত্তি ছিল না।

 

[পুলক ঘটক; সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ]

 ফেসবুক পেজফেসবুক প্রোফাইলটুইটার অ্যাকাউন্ট

বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের ফেসবুক গ্রুপ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ