সারাবাংলা: সম্পত্তিতে হিন্দু নারীদের সমঅধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় হিন্দু আইনে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ।
শুক্রবার (২৯ সেপ্টেম্বর) সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির শহিদ শফিউর রহমান মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে এমন দাবি জানানো হয়। বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের প্রথম দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন বক্তারা এমন দাবি করেন।
হিন্দু আইন সংস্কার আন্দোলনের পথিকৃৎ মহাপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০৩তম জন্মজয়ন্তীর যুগপৎ আয়োজন হিসেবে এই সম্মেলনের মূলভাব নির্ধারণ করা হয় ‘বিদ্যাসাগরের পথ ধরে’। অনুষ্ঠান থেকে বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ এবং হিন্দু আইনের আওতাভুক্ত বিভিন্ন জাতির নারী ও লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর সমঅধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয়।
সম্মেলনে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত।
মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘বর্ণবৈষম্যের দরকষাকষি সবচেয়ে বেশি হয় বিয়ের সময়। এ বড় জটিল অহংবোধ, যা মানুষকে মানুষের মর্যাদা থেকে বিচ্যুত করে। ইংরেজরা ১৯৪৬ সালে ‘The Hindu Marriage Disabilities Removal Act, 1946’ শিরোনামে একটি আইন প্রণয়ন করে গেছে। এই আইনেও ভিন্ন বর্ণের নারী-পুরুষের বিয়েকে বৈধ করা হয়নি। শুধু একই বর্ণ ও গোত্রের মধ্যে যে সকল উপবিভাগ রয়েছে তার মধ্যে বিয়েকে বৈধ করা হয়েছে। এটাও হয়েছে বিদ্যাসাগরের বর্ণবাদ বিরোধী সংস্কারের প্রায় ৮০ বছর পরে ইংরেজরা ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নেওয়ার মাত্র এক বছর আগে।’
‘উত্তরপ্রজন্ম বিদ্যাসাগরের দেখানো পথে সমান তালে চলতে পারেনি। অনেক দেরি হয়েছে, সমাজ উন্নয়ন ব্যাহত হয়েছে। তবে ভারত স্বাধীন হওয়ার প্রথম দশকেই হিন্দু আইন নতুন করে প্রণয়ন করেছে। সময়ের ধারাবাহিকতায় লিঙ্গবৈষম্য নিরসন করেছে। কিন্তু অচলায়তনের গহ্বরে আটকে গেছে পাকিস্তানের খপ্পরে পড়া বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ ও বিভিন্ন জনজাতি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আইয়ুব সরকার The Muslim Family Laws Ordinance, 1961 জারির মাধ্যমে এদেশের মুসলিম আইনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ও অগ্রগতি সাধন করলেও ইংরেজ চলে যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত হিন্দু আইন সংশোধন হয়নি। এই আইনের আওতাভুক্ত সকল নারী ও লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী নিদারুণ বৈষম্যের যাতাকলে পিষ্ট হবে। শুধু নারী হয়ে জন্মানোর কারণে কেউ পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে রঞ্জিত হবে- আধুনিক পৃথিবীতে এ রকম বাস্তবতা এক অবিশ্বাস্য সত্য। বাংলাদেশ রাষ্ট্র নাগরিকদের প্রতি এ রকম বৈষম্য করবে না বলে সংবিধানে অঙ্গিকার করেছে। অথচ হিন্দু ও বৌদ্ধ নারীরা পিতার সম্পত্তির ভাগ পাওয়া জন্য আদালতের স্মরণ নিলে তাদের হিন্দু আইন দেখিয়ে বিদায় করা হয়। রাষ্ট্র হিন্দু আইন মানছে, সংবিধান মানছে কি না প্রশ্ন।’
‘রামমোহন হয়ে বিদ্যাসাগরের পথ ধরে ইংরেজদের ২০০ বছরের শাসনের শেষ দিকে বেশ কিছু কোয়ালিফাইড হিন্দু আইন হয়েছে। এবং পুরাতন প্রথার পরিবর্তন হয়েছে। কিছুক্ষেত্রে নারী ও প্রতিবন্ধীদের সীমিত অধিকার দেওয়া হয়েছে, তা নিতান্তই সীমিত । The Hindu Inheritance (Removal of Disabilities) Act, 1928 অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ও দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সম্পত্তিতে অধিকার প্রদানের কড়াকড়ি ব্যবস্থা কিছুটা প্রশমিত করা হয়। কিন্তু তা বাংলার দায়ভাগ আইনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হওয়ায় এদেশে প্রতিবন্ধী ও কুষ্ঠরোগীরা এখনো সম্পত্তির অধিকার পায় না। The Hindu Women’s Rights to Property Act, 1937 এবং The Hindu Married Women’s Right to separate Residence and Maintenance Act, 1946 ভারতীয় নারীদের প্রতি ইংরেজ শাসকদের করুণার ফল নাকি বিদ্যাসাগরদের সে যুগের আন্দোলনের বিলম্বিত ধারা, সে বিতর্কে যেতে চাই না। তবে বিদ্যাসাগরের পথ ধরে। চলতে পারেনি স্বাধীন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ। বাঙালি নেতৃত্ব সে পথে থাকলে হিন্দু মেয়েদের সম্পত্তিতে সমঅধিকারের দাবি তোলার কারণে বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্যকে লাঞ্ছিত হতে হতো না। আজ যখন শিক্ষায় ও কর্মজীবনে বিপুল নারীর সমাবেশ তখনও হিন্দু নারীদের অধিকারের কথা বললে অশ্লীল গালাগাল, হুমকি, কুৎসা, অপপ্রচার ও ঝাড়ু মিছিলের সংগঠক পাওয়া যায়। এ অবস্থা থেকে সমাজকে ফেরাতে হবে। সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষকে দায়িত্ব নিতে হবে। হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, যে বুদ্ধিজীবী নিজের সময় ও সমাজ নিয়ে সন্তুষ্ট, সে গৃহপালিত পশু।’
‘আসলে মানুষের সমর্থন নিয়ে উদ্বেগ নেই। বিধবা বিবাহের পক্ষে বিদ্যাসাগরের আবেদনে স্বাক্ষর করেছিলেন মোটে ৯৮৭ জন ব্যক্তি। আর এ আবেদনের বিরোধিতাকারী পাল্টা আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন প্রায় ৩৬ হাজার ব্যক্তি। আইনটি পাস হওয়ার ২০০ বছর পরে আজ আমরা দেখছি বিধবা বিবাহের অধিকার দেওয়া অন্যায় হয়েছিল এ রকম কথা কেউ বলছে না। আর সতীদাহ সম্পর্কে কী বলব? সতীদাহ বলতে অতীতে আদৌ কিছু ছিল, আমাদের দাদারা তা এখন পুরোপুরি অস্বীকার করতে চান। আমরা নিশ্চিত বিশ্বাস করি হিন্দু আইনের আওতাধীন নারীদের সমঅধিকারের জন্য আমরা যেসব সংস্কার দাবি করছি তা শতভাগ বাস্তবায়িত হবে। জনগণ তা সার্বিকভাবে গ্রহণ করবে এবং উপকার পাবে। তারপর একদিন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও বিশ্বাস করতে চাইবে না। তারা অবাক হয়ে ভাববে, এমনও একটি সময় ছিল যখন নারী হয়ে জন্মানোর কারণে সমাজের অর্ধেক মানুষের পিতার সম্পত্তি লাভের অধিকার ছিল না। তারা ভেবে আরও আশ্চর্য হবে, তাদের পূর্বপুরুষদের অনেকে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের বিরোধিতা করেছিল। আমরা ভবিষ্যতের বিস্ময় হব। আমরা বিদ্যাসাগরের পথ ধরে হাঁটব।’
অনুষ্ঠানে বক্তারা হিন্দু উত্তরাধিকার আইন ও হিন্দু বিবাহ আইনেরও সংস্কারের দাবি জানান। তারা বলেন, হিন্দু নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এ দুটি আইন সংস্কার করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এ জন্য সম্পত্তিতে হিন্দু নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তারা।
বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক পুলক ঘটকের সঞ্চালনায় সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন- বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধ্যাপক ময়না তালুকদার, যুগ্ম সম্পাদক ঢাবি শিক্ষক নীরু বড়ুয়া, সাংগঠনিক সম্পাদক ঝর্ণা বাড়ৈ, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোজাম্মেল হক মঞ্জু, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক আব্দুন নূর দুলাল, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন কমিটির সাবেক সভাপতি মিলন কান্তি দত্ত, হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের সহ-সভাপতি ও সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি সুভাষ সাহা, সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব অশোক ধর, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের সহ-সভাপতি রীনা রায়, সাবেক ডিআইজি ভানুলাল দাস, হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের কোষাধ্যক্ষ পুলক রাহা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ভূপেন্দ্র চন্দ্র ভৌমিক দোলন, বাংলাদেশ মহিলা ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দীপালি চক্রবর্তী, খুলনার সম্মিলিত নারী অধিকার সুরক্ষা ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সুতপা বেদজ্ঞ, নারী নেত্রী গীতা বিশ্বাস ও রত্না সিনহা প্রমুখ।
সকৃতজ্ঞ স্বীকৃতি⇒ সারাবাংলা ডট কম
ওয়েবসাইট⇒ বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ
ফেসবুক গ্রুপ লিংক⇒ হিন্দু আইন সংস্কার চাই