হিন্দু আইন: নারীর প্রতি বৈষম্যের ইস্যুগুলোতে সংস্কার চাইছে তরুণ হিন্দুদের নতুন সংগঠন, হিন্দু নেতৃত্বে বিভক্তি

বিবিসি বাংলা: বাংলাদেশে তরুণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি সংগঠন নারী, প্রতিবন্ধী এবং তৃতীয় লিঙ্গের সম্পত্তির ভাগ পাওয়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে হিন্দু আইনে সংস্কারের দাবি তুলেছে।

এই তরুণরা বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ নামে একটি নতুন সংগঠন তৈরি করে এই দাবি নিয়ে শুক্রবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেছে।

তবে হিন্দুদের পুরোনো একটি সংগঠন তাদের আইন সংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

ফলে, হিন্দুদের নেতৃত্ব সংস্কার প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।

হিন্দু নেতাদেরই অনেকে বলেছেন, সংস্কার ইস্যুতে তাদের বিভক্তির পেছনে তাদের কোন কোন গোষ্ঠীর কট্টরচিন্তা এবং প্রভাব বিস্তারের বিষয় থাকতে পারে বলে তারা মনে করেন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, হিন্দু নেতাদের বিভক্তির কারণে সরকার কোন পদক্ষেপ নিতে পারছে না।

সংস্কারের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেয়া হিন্দু নেতারা তাদের স্ব স্ব অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন।

হিন্দু আইনে সংস্কারের দাবি নিয়ে বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেছে।

‘স্বামী বেঁচে থাকতেই তার সম্পত্তি লিখে দিতে হচ্ছে’

ঢাকায় একজন গৃহিনী শ্যামলী মুখার্জী দুই মেয়ে সন্তান নিয়ে স্বামীর সম্পত্তির অধিকার পেতে তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন।

তিনি বলছেন, কোন নারী বিধবা হলে তার ছেলে সন্তান না থাকলে তিনি স্বামীর সম্পত্তি ভোগ করতে পারলেও অংশীদার হতে পারেন না।

সেজন্য শ্যামলী মুখার্জী তার স্বামী বেঁচে থাকতে দুই মেয়ে সম্পত্তির অংশীদার করতে গিয়ে দেবরদের বাধা পেয়েছিলেন।

“আমার স্বামী বেঁচে থাকতেই তার সম্পত্তি লিখে দিতে হচ্ছে. না হলে আমার দুই মেয়ে সম্পত্তি পাবে না,” বলেন মিজ মুখার্জী।

সংস্কারের দাবিতে তরুণদের নতুন সংগঠন

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্য থেকে বিভিন্ন সময় বিক্ষিপ্তভাবে হিন্দু আইনে সংস্কারের দাবি করা হয়েছে।

এখন হিন্দুদের একদল তরুণ একটি সংগঠন তৈরি করে এই দাবি তুলেছে।

হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ নামের এই সংগঠনটি হিন্দু আইনে নারী, প্রতিবন্ধী এবং তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে সে ব্যাপারে সংস্কারের কথা বলছে।

তারা চাইছে বিয়ের নিবন্ধন ব্যবস্থা।

হিন্দু আইনে পিতার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নেই। আর বিয়ের পর স্বামীর মৃত্যু হলে বিধবা নারী স্বামীর সম্পত্তিতেও অংশিদার হতে পারেন না।

হিন্দু মেয়েদের পিতার সম্পত্তিতে অধিকার নেই।

সেখানে মেয়েরা যাতে পিতার সম্পত্তিতে ছেলেদের সাথে সমান অধিকার পায়-নতুন সংগঠনটি আইনে সংস্কারের দাবিতে এই ইস্যুকে এক নম্বর অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের সভাপতি ড: ময়না তালুকদার বলেছেন, নতুন কোন আইন নয়, তারা প্রচলিত প্রথানির্ভর আইনে সংস্কার চাইছেন।

“হিন্দু আইনে উত্তরাধিকার সূত্রে নারীদের পিতার সম্পত্তিতে যেমন অধিকার নেই, তেমনি স্বামীর সম্পত্তিতেও তারা অধিকার পান না। সেটাই আমরা পরিস্কার করতে চাইছি” বলেন মিজ তালুকদার।

কিন্তু এসব সংস্কারের বিষয়ে হিন্দু নেতৃত্ব ঐক্যবদ্ধ না থাকার বিষয়ও তিনি উল্লেখ করেন।

সংস্কার প্রশ্নে হিন্দু নেতৃত্বে বিভক্তি

আইনে সংস্কারের ব্যাপারে হিন্দুদের মধ্যেই চরম বিরোধিতা রয়েছে।

কয়েকদিন আগেই জাতীয় হিন্দু মহাজোট নামের একটি পুরোনো সংগঠন সংবাদ সম্মেলন করে সংস্কার-বিরোধী বক্তব্য দিয়েছে।

সংগঠনটির নেতা গোবিন্দ প্রামাণিক বলেছেন, তাদের মধ্যে সংঘাত তৈরির জন্য হিন্দু আইনে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে।

“হিন্দু নারীদের বিয়ের সময়ই পিতার সম্পত্তির বদলে স্বর্ণের অলংকার এবং নগদ অর্থ দেয়া হয়। সেখানে কখনও কোন হিন্দু নারী বা পুরুষ সংস্কার চায়নি,” তিনি দাবি করেন।

এমন দাবির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মি: প্রমাণিক আরও বলেছেন, “কিছু এনজিও এবং কিছু মুসলিম লোকজন এখানে ইন্ধন জুগিয়ে আইনে সংস্কারের বিষয় আনছে।”

রানা দাশগুপ্ত, হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক।

‘সব জট একসাথে খুললে জটলা লেগে যেতে পারে’

হিন্দুদের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সব সময় সোচ্চার থাকে হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ।

এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রাণা দাশগুপ্ত বলেছেন, নির্দিষ্ট এই ইস্যুতে তারা এখনও সাংগঠনিকভাবে কোন অবস্থান ঠিক করেন নি।

তিনি ব্যক্তিভাবে মনে করেন, প্রচলিত আইনে সংস্কার না করে নতুন আইন প্রণয়ন করে কিছু ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা যেতে পারে।

তবে সংস্কার প্রশ্নে হিন্দুদের মধ্যেই পক্ষে বা বিপক্ষে মতামত যে রয়েছে, সেই বাস্তবতার মুখে ধাপে ধাপে সংস্কারের পক্ষে রাণা দাশগুপ্ত।

“জট অনেক আছে। সব জট একসাথে খুললে দড়িতে জটলা লেগে যেতে পারে। ফলে যেটা আপাতত করা সম্ভব- সেটা নিয়ে এগুনো উচিত,” তিনি মন্তব্য করেন।

মি: দাশগুপ্ত মনে করেন, পিতার সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকারের বিষয়ের আগে প্রথমে বিধবা হিন্দু নারীদের সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্ন সামনে আনা যেতে পারে।

“স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা নারী যখন স্বামীর সম্পত্তির অধিকার পাবেন, তখন সমাজটাকে উপলব্ধি করানো যাবে যে, মাকে সম্পত্তি দিলে ধর্ম এবং সমাজ ধ্বংস হয়ে যায় না,” বলেন মি: দাশগুপ্ত।

যদিও গত বছর একজন বিধবা হিন্দু নারীর এক রিট মামলায় হাইকোর্ট স্বামীর কৃষিজমিতে বিধবা নারীর ভাগ পাওয়ার পক্ষে রায় দিয়েছে।

কিন্তু হিন্দু সমাজে এর বাস্তবায়ন নেই বলে হিন্দু নারীদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীরা বলছেন।

রাণা দাশগুপ্ত বলেছেন, “হিন্দুরা যত দেব দেবতার পূজা করে, তার বেশিরভাগ মূর্তিই হচ্ছে নারী। আমরা নারীদের পূজা করতে ভালবাসি। কিন্তু যখনই সম্পত্তি দেয়ার প্রশ্ন ওঠে, তখনই আমরা চিৎকার করতে থাকি।”

এদিকে, পিতার সম্পত্তিতে মেয়ের সমান অধিকার দেয়া এবং বিবাহ বিচ্ছেদের সুযোগ রাখাসহ বেশ কিছু বিষয়ে হিন্দু আইন সংস্কারের প্রস্তাব সরকারের আইন কমিশন তৈরি করেছিল ২০১৭ সালে।

কিন্তু তা আর সামনে এগোয়নি।

আনিসুল হক, আইনমন্ত্রী

হিন্দু আইনে সংস্কারে বাধা নেতৃত্বের বিভক্তি: সরকার

আইন মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, হিন্দুদের নেতারা একমত না হওয়ায় তারা কোন পদক্ষেপ নিতে পারছেন না।

“একপক্ষ আমার কাছে সংস্কারের প্রস্তাবসহ আইনের খসড়া দিয়ে গেছেন। আরেকপক্ষ এসে সেটার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন। আমি তাদের দুই পক্ষকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঐকমত্য হয়ে তারপর আসতে বলেছি,” বলেন মি: হক।

তিনি আরও জানিয়েছেন, হিন্দুদের সিনিয়র নেতা এবং মুরব্বীরাও তার সাথে দেখা করেছেন।

“তারা আশ্বস্ত করেছিলেন যে ঐকমত্য হয়েই তারা আমার কাছে আসবেন। এপর্যন্তই ব্যাপারটা গড়িয়েছে।”

এখন সংস্কারের দাবি তুলেছে নতুন যে সংগঠনটি, তারা বিরোধিতাকারী নেতৃত্বের সাথে আলোচনা করে ঐক্যবদ্ধ একটা জায়গায় আসার চেষ্টা চালানোর কথা বলছেন।

কিন্তু হিন্দু আইন নিয়ে যাদের কট্টোর অবস্থান, তারা বলছে, সংস্কার ইস্যুতে তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে এগুনো কতটা সম্ভব হবে – তা নিয়ে তারা সন্দিহান।

 

সকৃতজ্ঞ স্বীকৃতি⇒ বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

ওয়েবসাইট⇒ বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ

ফেসবুক গ্রুপ লিংক⇒ হিন্দু আইন সংস্কার চাই

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ