হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংস্কারের পদক্ষেপ যেখানে আটকে আছে

ভয়েস অব আমেরিকা: বাংলাদেশের হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কারের বিষয়টি ‘সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার’ প্রসঙ্গে এসে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। প্রচলিত হিন্দু দায়ভাগ আইন এবং সংস্কারের জন্য প্রস্তাবিত খসড়া আইনের পার্থক্য খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে আইন সংস্কারের বিরোধিতাকারীরা ‘স্ত্রীধনকে পর্যাপ্ত’ আখ্যা দিয়ে ‘শাস্ত্রের বাইরে’ যেতে নারাজ। অন্যদিকে সংস্কারের পক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছেন তারা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হিন্দু নারীদের জন্য সবক্ষেত্রে ছেলে সন্তানের মতো সমান অধিকার চাইছেন।

আইনটি সংস্কারের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার বেশ সতর্ক। দুইপক্ষের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নিতে চাইছেন না আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানান দুইপক্ষের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের ‘ন্যায়ের পক্ষে সমঝোতায়’ আনার চেষ্টা করছেন।

আইনে যা আছে

পুত্রের উপস্থিতিতে হিন্দু কন্যা সম্পত্তির অধিকার থেকে ‘বঞ্চিত হন’। যদি পুত্র না থাকে তবে অবিবাহিতা কন্যা এবং পুত্রবর্তী কন্যারা জীবনস্বত্বে সম্পত্তির অধিকার পান। অন্যদিকে বন্ধ্যা, বিবাহিতা কন্যা বা বিধবা কন্যা এবং কন্যা জন্মদানকারী কন্যারা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। অর্থাৎ কন্যার অধিকার নির্ভর করবে পুত্র থাকা বা না থাকার ওপর। তবে তারা ‘স্ত্রীধন’ পান।

বাংলাদেশে প্রচলিত হিন্দু দায়ভাগ আইন অনুযায়ী স্বীকৃতিপ্রাপ্ত পাঁচজন নারী উত্তরাধিকারী হতে পারেন: বিধবা, কন্যা, মাতা, পিতার মাতা, পিতার পিতার মাতা। নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে তারা সম্পত্তি ভোগে অধিকার পান। এই অধিকার widow’s estate হিসেবে পরিচিত।

এমন অধিকারে তারা কেবলমাত্র জীবনসত্বে সম্পত্তি ভোগের অধিকার পান। অর্থাৎ জীবন অবসানের সাথে সাথে এই সম্পত্তি পূর্ব-মৃত ব্যক্তির পুরুষ উত্তরাধিকারীর কাছে চলে যায়। সীমিত কিছু ক্ষেত্র ছাড়া (legal necessity) এই সম্পত্তি হস্তান্তর করার অধিকার বিধবা মহিলা উত্তরাধিকারীদের নেই।

বাংলাদেশের আইন কমিশন তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেছে, ‘‘এমন সীমিত অধিকারের উদ্দেশ্য ছিল যাতে বিধবা তার মৃত স্বামীর আত্মার আধ্যাত্মিক কাজ ও মৃত স্বামীর ‘দায়’ পরিশোধ এবং অবিবাহিত কন্যার বিয়ের খরচ নির্বাহ করতে পারেন। পরে The Hindu Women’s Right to Property Act, 1937 প্রণয়নের মাধ্যমে বিধবাদের অংশ সুনির্দিষ্ট করা হয় (অর্থাৎ এক পুত্রের সমান অংশ), কিন্তু সাথে সাথে এটিও সুস্পষ্ট করা হয় যে এটি শুধুমাত্র সম্পত্তিতে জীবনস্বত্বের অধিকার হিসেবে গণ্য করা হবে।’’

‘প্রথা’ বনাম ‘সম-অধিকার’

বিয়ের সময় বাবার বাড়ি এবং স্বামীর বাড়ি থেকে পাওয়া উপহারকে মূলত স্ত্রীধন বলা হয়। নারীকে যে সম্পত্তি দান বা উপহার দেয়া হয় তা তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকেই আসে। এই সম্পত্তি নারী ইচ্ছামত হস্তান্তর করতে পারে এবং তার মৃত্যুর পর নিজস্ব উত্তরাধিকারীর ওপর এই সম্পত্তির অধিকার বর্তায়। প্রচলিত আইনে সম্পত্তিতে নারীর পূর্ণ অধিকার থাকবে কেবলমাত্র এই স্ত্রীধনের ওপর।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই উপহারের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে দাতাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। আধুনিক যুগে এই উপহারকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার ‘যৌতুক’ হিসাবেও বিবেচিত হয়।

অধ্যাপক হীরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস- সভাপতি- বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতি।

আইন সংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতির সভাপতি অধ্যাপক হীরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন, ‘‘হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীদের বিয়ের সময় যে উপহার দেয়া হয় তা একপুত্রের সমান। মুনি-ঋষিদের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে যুগ-যুগ ধরে এই প্রথা চলে আসছে। এই রীতিতেই আমরা শান্তিতে বসবাস করছি।’’

স্ত্রীধন পাওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্রীয় আইনে পরিণত হলে তাদের সমস্যা আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘প্রচলিত আইনে হিন্দু নারীদের এই অধিকার সুরক্ষিত। স্ত্রীধন থেকে কেউ বঞ্চিত হলে তিনি আদালতে যেতে পারবেন। এক্ষেত্রে সবার সমান অধিকার।’’

কিন্তু আইন কমিশন তাদের সুপারিশে বলেছে, উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির অধিকারী হবে নারী। জীবনস্বত্বের পরিবর্তে সম্পত্তিতে নারীর পূর্ণ অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়ে আইন করতে হবে।

পুলক ঘটক – হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক।

বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক পুলক ঘটক আইনটি সংস্কারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে জনমত গঠনের কাজ করছেন। আইন কমিশনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তিনি বলেন, ‘‘হিন্দু দায়ভাগ আইনে অনেক বৈষম্য আছে। প্রথমত পুত্র সন্তান থাকলে কন্যা সন্তান পৈত্রিক সম্পত্তির কিছুই পায় না। এখানে আমরা সমঅধিকারের কথা বলছি। আমরা চাই ছেলেও ঠকবে না, মেয়েও ঠকবে না।’’

স্ত্রীধনের বিষয়ে তার বক্তব্য, ‘‘বিয়ের সময় যে উপহার দেয়া হয়, তাকে বলা হচ্ছে স্ত্রীধন। এর বড় ঝুঁকি হলো অঘোষিতভাবে এটা যৌতুক। এটা নিষিদ্ধ এবং বেআইনি।’’

‘‘নারীধন এবং স্ত্রীধন কনসেপ্টের ওপর আজকে আর কিছু দাঁড়ায় না। এই থিওরিতে যেভাবে সম্পত্তি বণ্টনের কথা বলা হচ্ছে, সব জায়গায় তা না। অতীতেও ছিল না। ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন প্রথা। এগুলোর সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক নেই। এভাবে হবে কেন? একজন মানুষ হিসেবে আইন অনুযায়ী, মানবাধিকার অনুযায়ী ছেলে-মেয়ে পিতার সম্পত্তিতে সমান অধিকার পাবে। স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রী অধিকার পাবে, স্ত্রীর সম্পত্তিতেও স্বামী অধিকার পাবে। প্রত্যেকের মানবিক মর্যাদা স্বীকৃত হবে।’’

শাহীন আনাম- নির্বাহী পরিচালক- মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)।

আইনটি সংস্কারের চেষ্টায় প্রায় এক যুগ ধরে বাংলাদেশে কাজ করছেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। তিন ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন, “নারীর সমঅধিকারের বিষয়টি সামনে রেখে আমরা আন্দোলনটা করছি। এটা একটা বৈষম্যমূলক প্রথা। যেমন একটি মেয়ে জন্ম নিলেই বুঝিয়ে দেয়া হয় যে তার চেয়ে তার ভাইয়ের অধিকার বেশি। পরিবারে তার ভাইয়ের মান-মর্যাদা বেশি থাকে। জন্ম নেয়ার পরপরই বৈষম্যের পরিবেশ তৈরি হয়। তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এই আন্দোলন করছি। হিন্দু নারীরা বহুবার আমাদেরকে বলেছে যে তাদের সম্পত্তি, ডিভোর্স এবং বিয়ের বিষয়ে সঠিক কোনো আইন নেই। তারা জানিয়েছে এসবের জন্য নানান ধরনের অসুবিধা হয় তাদের। বিশেষ করে অর্থনৈতিক। যখন কোনো নারী সম্পত্তির অধিকার পান, জায়গাটা তখন শক্তিশালী হয়ে যায়। ক্ষমতায়ন বেড়ে যায়।”

আইন সংস্কারের এই চেষ্টার কারণে শাহীন আনাম এবং তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে হিন্দুদের একাংশ প্রায়ই নানা ধরনের অভিযোগ করেন। এ প্রসঙ্গ তুললে কিছুটা দুঃখপ্রকাশ করে তিনি বলেন, “আমাদের ভুল বোঝার কোনো কারণ নেই। আমাদের ওপরে যে অপবাদ দেয়া হচ্ছে, আমরা হিন্দু সমাজ বিভক্ত করতে চাচ্ছি, সরলপ্রাণ হিন্দু নারীদের আমরা বিপথগামী করছি-এর কোনো কথাই সঠিক না। সঠিক হলো বাংলাদেশের হিন্দু নারীদের দাবি। দাবির কারণেই আমরা এই কাজে নেমেছি। হিন্দু, বৈদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বাংলাদেশের সকল নারী, সে যে ধর্মেরই হোক, আমরা চাই সমাজে যেন তার সমান অধিকার থাকে।”

আরমা দত্ত- এমপি।

পিতার সম্পত্তিতে হিন্দু নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশে প্রায় ৩০ বছর ধরে কাজ করছেন এমপি আরমা দত্ত। স্ত্রীধনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমি বাস্তবতার নিরিখে বলি: আমাকে বিয়ের সময় যে স্ত্রীধন দেয়া হয়, সেটা কী। উপহার মানে কটা গয়না তো। আমি যদি মেয়েকে জমি দেই, তাহলে সেটাকে স্ত্রীধন বলব। কিন্তু স্ত্রীধন হিসেবে আমি যদি একটা গয়না দেই, একটা খাট দেই, একটা ড্রেসিং টেবিল দেই, তাহলে ২০ বছর পরে এর মূল্য কী। দোকানে নিয়ে গেলে অর্ধেক দামেই তো বিক্রি করতে হবে। আমাদের প্রশ্ন হলো এটা সিকিউরিটির ভেতর পড়ছে কি না।’’

গত তিন দশকের অভিজ্ঞতা থেকে আরমা দত্ত বলেন, ‘‘এখন মানুষের ভেতর অনেক পরিবর্তন এসেছে। আজকাল সাধারণ পুরুষেরা চাচ্ছেন যে তাদের কন্যাসন্তানেরা সম্পত্তি পাক। এটা একটা অভূতপূর্ব পরিবর্তন।’’

‘পারিবারিক বিশৃঙ্খলা’র আশঙ্কা কতটা যুক্তিযুক্ত

আইনে কোনো ধরনের সংযোজন-বিয়োজনের পক্ষেই সায় নেই সংস্কারের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া হিন্দু নেতাদের। তারা বলছেন, আইনে পরিবর্তন আনলে পারিবারিক বিশৃঙ্খলা বাড়বে। এই দাবির বিরোধিতা করে পুলক ঘটকের যুক্তি, ‘‘এখনো তো ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা হচ্ছে। যখন বোন তার অধিকার চাইবে, তখন পারিবারিক শৃঙ্খলাভঙ্গের কথা আপনি কীভাবে বলেন। এই অজুহাত দিয়ে কারো মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া যায় না।’’

‘‘প্রতিবন্ধী শিশু আমার হিন্দু আইন অনুযায়ী অধিকার পান না, যৌন অক্ষম ব্যক্তি পান না, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিও পান না। এটা কোনো মানবিকতার ভেতর পড়ে না।’’

আইন সংস্কারের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এখনো সাংগঠনিকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। তবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি আইনটিতে কিছু সংযোজন আনার পক্ষে। মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এই প্রসিকিউটর বলেন, ‘‘কেউ কেউ বলেন হিন্দু আইনের কোনোরকম পরিবর্তন, পরিবর্ধন কিংবা সংযোজন করা যাবে না। এটা করলেই নাকি হিন্দু ধর্ম এবং সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। এই স্লোগান অনেক পুরোনো।’’

৭৪ বছর বয়সী এই আইনজীবী বলেন, ‘‘আইন সংস্কারের কারণে ভারতের হিন্দু সমাজ ধ্বংস হয়ে যায়নি। বাংলাদেশে এটি অত্যন্ত প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। এখানে আইন পরিবর্তন হবে না। নতুন-নতুন আইনের সংযোজন হবে।’’

সরকার যা বলছে

আইনটি সংস্কারের বিষয়ে সর্বশেষ অগ্রগতির কথা জানতে চাইলে বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘‘কোনো আইন করতে গেলে, বিশেষ করে পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে এর গ্রহণযোগ্যতাটা হচ্ছে মুখ্য বিষয়। আমরা অর্থাৎ সরকার চাচ্ছে সকলের ঐক্যমত্য এবং ন্যায় একটা সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে আইনটা করা হোক। এজন্য ওনারা দুইপক্ষ, কমিউনিটির বয়জ্যেষ্ঠরা যখন বলেছেন বসে একটা সিদ্ধান্তে আসবেন, তাই আমি অপেক্ষা করছি।’’

আনিসুল হক- বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী।

দুইপক্ষ ঐক্যমত্যে না আসলে সরকারের পদক্ষেপ কী হবে-এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘‘এটা সত্য, অপেক্ষা তো সারাক্ষণের জন্য করা যাবে না। এটা একটা সময়ের ব্যাপার। ধরেন কিছুদিন পরে, কিছুদিন মানে ছয় মাস, এক বছর পরে…মানে আমি একটা ব্রিদিং স্পেস দিতে চাচ্ছি। এর মধ্যেও আমি তাদের সঙ্গে বসব। ওনারা কী সিদ্ধান্ত নিলেন জানার চেষ্টা করব। আমি চেষ্টা করব যে ওনাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় দুইপক্ষকেই ন্যায়ের পক্ষে একটা সমঝোতায় আসার জন্য ব্যবস্থা করতে।’’

বাংলাদেশের আইন কমিশনসহ কয়েকটি সংস্থা এবং সংগঠন আইনটি সংস্কারের বিষয়ে খসড়া তৈরি করে সরকারকে দিয়েছে। এই খসড়া উপযুক্ত কি না-নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে এমন প্রশ্নের সরাসরি কোনো জবাব দিতে চাননি আনিসুল হক, “আমি সবই দেখেছি। কিন্তু দেখেন আমি যদি এখন ওপিনয়ন দিয়ে দেই, তাহলে আমার যে নিউট্রাল ভূমিকাটা, সমঝোতায় আনতে সেটা ব্যাহত হবে। আমি চাই বিষয়টা ন্যায্য হোক।”

ঐক্যমত্য নিয়ে দোটানা

আইনমন্ত্রীর বক্তব্য মেনে সমঝোতায় আসতে চাওয়ার কথা বললেও একটা ‘কিন্তু’ রাখছেন হিন্দু আইন পরিবর্তন প্রতিরোধ সম্মিলিত পরিষদের নেতারা। অ্যাডভোকেট শংকর চন্দ্র দাস ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘আমরা আলোচনায় বসতে রাজি। কিন্তু কাদের সঙ্গে বসব, সে বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে।’’

অন্যদিকে হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক পুলক ঘটক বলছেন, ‘‘কতজন চাইলেন, চাইলেন না এই সংখ্যাতত্বের ভিত্তিতে কোন দেশ আইন করার চিন্তা করলে ধরে নিতে হবে মানবতার প্রতি অবিচার হচ্ছে।’’

সমঝোতার বিষয়ে তার মন্তব্য, ‘‘কতগুলো বিষয় অন্যায্য হলেও আমরা মেনে নেয়ার ব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছি। এটা অবশ্য আমার ব্যক্তিগত মতামত। তিনভাবে আইন কার্যকর হতে পার: এক. যেদিন থেকে আইন পাশ হবে, সেদিন থেকে কার্যকর, দুই. অতীতের থেকে আইনটা কার্যকর,তিন. আরেকটা উপায় হতে পারে তারিখ দেয়া থাকবে, সেই সময় থেকে কার্যকর হবে। আমি এই প্রস্তাবটা (তিন নম্বর) দিয়েছি। সরকার একটা সময় দেবে। যেগুলো ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে গেছে, সরকার তাতে হাত দেবে না।”

অস্তিত্ব বিলীনের ‘গোপন ভয়

হিন্দু আইন সংস্কারের ক্ষেত্রে পারিবারিক বিশৃঙ্খলার বিষয়টি নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরলেও তাদের ‘গোপন’ আরেকটা ভয় রয়েছে। ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকার সেগুনবাগিচায় অবস্থিত রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হিন্দু আইন পরিবর্তন প্রতিরোধ সম্মিলিত পরিষদের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। সংবাদ সম্মেলন শেষে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, ‘‘আমরা একটা কথা সরাসরি বলতে পারি না। আইন সংস্কার হলে হিন্দু মেয়েদের ধর্মান্তরিত করতে উঠেপড়ে লাগবে একটি চক্র। অনেক সময় আবার ধর্মান্তরিত না করেও সম্পত্তি দখলের চেষ্টা চলবে। এক সময় এদেশে আমাদের অস্তিত্বই থাকবে না।’’

এই শঙ্কার প্রসঙ্গে আইন কমিশনের প্রতিবেদনে অবশ্য একটা যুক্তি দেয়া হয়েছে, ‘‘নারীদের ধর্মান্তরিত হবার আশংকার ক্ষেত্রে এটি বলা যায় যে, The Caste Disabilities Removal Act, 1850 যা প্রকান্তরে The Freedom of Religion Act নামে পরিচিত তা বাংলাদেশে প্রযোজ্য নয়। কেননা এই আইনটি The Bangladesh Laws (revision and declaration) Act, 1973 দ্বারা বাতিল করা হয়েছে। এই আইনটি না থাকার কারণে কেউ ধর্মান্তরিত হলে হিন্দু ধর্মের প্রচলিত নীতি অনুযায়ী সে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে। সুতরাং, সম্পত্তির লোভে অন্য ধর্মের লোক হিন্দু নারীদের ধর্মান্তরিত করতে প্রলোভিত করবে এ আশংকা ভিত্তিহীন।’’

আরমা দত্তও একই কথা বললেন, ‘‘সম্পত্তি এভাবে যায় না। ধর্মান্তরিত হলে সম্পত্তি পাবে না। হয়ে গেল। আমার যুক্তি হলো সন্তান আমার- ছেলেও যেমন, মেয়েও তেমন। ছেলে যখন সব সম্পত্তি নিয়ে বাবা-মাকে ছেড়ে চলে যায়, তখন কী হলো। আমরা দেখছি যে মেয়েদের কাছেই বাবা-মা বেশি ফিরে আসে। খুব কম সংখ্যক দেখা যায় ছেলের ঘরে বাবা-মা জায়গা পেয়েছে।’’

নারীদের অধিকার দিলে হিন্দুদেরই লাভ

হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীরা তাদের পিতার সম্পত্তিতে অধিকার পেলে সামগ্রিক অর্থে সমাজেরই লাভ বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মী এবং সম্প্রদায়টির সচেতন নারীরা।

সুলতানা কামাল- মানবাধিকারকর্মী।

কয়েক যুগ ধরে নারী অধিকার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা সুলতানা কামাল বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘এটা স্বতঃসিদ্ধ। প্রত্যেকেই মেনে নিয়েছে যে একটা সমাজে নারীরা যদি স্বাধীনভাবে জীবন-যাপন করতে না পারে, নাগরিক হিসেবে তাদের যে অধিকার সেটা যদি না দেয়া হয়-তাহলে সে সমাজ কখনোই অগ্রসর হতে পারে না। হিন্দু নারীদের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা প্রযোজ্য।’’

যারা বিরোধিতা করছেন তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘‘তারা হয়তো নারীদের উন্নতিতে সমাজের অগ্রসরতা দেখেন না। অগ্রসরমানতার নানা সংজ্ঞা তো মানুষের কাছে থাকতে পারে। অনেকে মনে করেন অর্থনৈতিক উন্নতি হলেই হলো। অনেকে ভাবেন রাস্তাঘাট হলেই সাংঘাতিক উন্নত হয়ে গেলাম। কিন্তু প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে যদি স্বাধীনতা না থাকে, সাম্য না থাকে, সামাজিক মর্যাদা না থাকে, তাহলে সেই সমাজকে উন্নত সমাজ বা অগ্রসর সমাজ বলা যায় না। সেক্ষেত্রে হিন্দু সম্প্রদায় তাদের নারীদের যদি সম্পত্তির অধিকার না দেয়, তাহলে তাদের অগ্রসর বলা যাবে না।’’

ডা. শিলা সেন।

ডা. শিলা সেন তার দুই মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত। বললেন, মেয়েরা প্রায়ই এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করে, ‘‘আমার পরিবারে দুই মেয়ে। এরা সব সময় আতঙ্কিত থাকে। তাদের বাবা মারা যাওয়ার পরে সম্পত্তির কী হবে, এটা নিয়ে বিভিন্ন রকম হ্যাসেলও হয়।’’

‘‘একটা সভ্য দেশে এমন হতে পারে না। আমি মনে করি এটা কোনো ধর্মীয় আইন না। যদি তাই হতো, তাহলে পাশের দেশ ভারতেও একই আইন থাকত। সেখানে কিন্তু হিন্দু জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি। ভারতে মেয়েরা পিতার সম্পত্তিতে সমান অধিকার পায়। বাংলাদেশে না পাওয়ার কারণে আমাদের সম্প্রদায় পিছিয়ে পড়ছে।’’

প্রতিবেশি দেশের সংস্কার

ভারত স্বাধীনের পর হিন্দু আইনের ব্যাপক সংস্কার হয়েছে। দেশটির হাইকোর্ট এবং ডিসট্রিক্ট কোর্টের আইনজীবী অনির্বাণ গুহ ঠাকুরতা নিজের দেশের আইনের প্রসঙ্গে ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘ভারতবর্ষে অনারেবল সুপ্রিমকোর্ট একটা রায় দিয়েছেন।

অনির্বাণ গুহ ঠাকুরতা- ভারতের হাইকোর্ট এবং ডিসট্রিক্ট কোর্টের আইনজীবী।

সেই রায়ে বলেছেন ভারতবর্ষে বাবার সম্পত্তিতে ছেলে এবং মেয়ের সমান অধিকার। সেটাই কিন্তু এখন বলবৎ হচ্ছে। এখানকার ভদ্রমহিলারা পুরুষের মতো সম্পত্তিতে সমান অধিকার পান। রাইট অব ইনহেরিটেন্স অনুযায়ী তাদের সমান অধিকার হয়েছে। যে আইন আছে সেখানে এই কথাটা উল্লেখ রয়েছে। মৌলিক অধিকারের যে ধারা সেখানে সমঅধিকারের বিষয়টি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।’’

বাংলাদেশের প্রসঙ্গে ৪২ বছর বয়সী এই আইনজীবী বলেন, ‘‘বাংলাদেশের আইন সম্পর্কে আমার খুব একটা ধারণা নেই। তবে এটা একটা জেনারেল কনসেপ্ট। সারা পৃথিবীতেই এই আইন সমানভাবে বাস্তবায়ন হওয়া উচিত। আপনি তো জানেন শচীন টেন্ডুলকার যেমন বিখ্যাত ক্রিকেটার, তেমনি মিতালি রাজও। যদি তাই হয়, তাহলে সম্পত্তির অধিকারে পার্থক্য থাকা ঠিক নয়। আমার মনে হয় সমাজ সুস্থ করতে এই পার্থক্য দূর করা অত্যন্ত মঙ্গলজনক।’’

বিভিন্ন ধর্মে উত্তরাধিকার আইন

হিন্দুদের পাশাপাশি বাংলাদেশে মুসলিম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য প্রায় সব ধর্মাবলম্বীর উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিধি-বিধান আছে। সেটি থাকলেও অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের জন্য বাস্তবতা কঠিন বলে জানালেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক (প্রোগ্রাম) নিনা গোস্বামী।

নিনা গোস্বামী- পরিচালক (প্রোগ্রাম)- আইন ও সালিশ কেন্দ্র।

এই অভিজ্ঞ আইনজীবী ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “ইসলাম ধর্মে যেটা দেখা যায় নারীর যে শেয়ারটা সেখানে স্বামীর কাছ থেকে হোক, ভাইয়ের থেকে হোক-এই সব জায়গাগুলোতে পুরুষরা যেভাবে পাচ্ছেন, তার থেকে অর্ধেক পাবেন নারীরা। তবে বাস্তব চিত্র আলাদা। যতটা পাওয়ার কথা ততটা নারীদের দেয়া হয় না।”

‘‘আর খ্রিষ্টান ধর্মে বলা আছে অর্ধেক-অর্ধেক পাবে। তবে বাস্তব চিত্র এখানেও আলাদা। কেউ ক্যাথলিক, কেউ ব্যাপিস্ট-এই ঘরানা অনুযায়ী সম্পত্তির অধিকারে নারীদের জন্য কিছু কিছু জায়গায় ব্যত্যয় দেখা যায়।’’

বৌদ্ধদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী হিন্দু আইন অনুযায়ী তাদের উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে থাকে।’’

নিনা গোস্বামী ১৯৯৪ সালে আইনপেশায় নাম লেখান। বছর দুই বাদেই হিন্দু আইন নিয়ে কাজ শুরু করেন। এই সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গে এসে বলেন, ‘‘অবশ্যই নারীদের সমান অধিকার দেয়া উচিত। যদি ভারতের কথা বলি, নেপালের কথা বলি, তাহলে দেখা যায় হিন্দু ধর্মে কোনো বাধা নেই। ১৯৫৫ সালে ভারতের নারীরা কৃষি জমিতে সমান-সমান অধিকার পান। এরপরে তারা বসতবাড়িতেও সমান-সমান অধিকার পান। আমাদের বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের পরে কোনো ধরনের সংস্কার হয়নি। আমি মনে করি সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার জন্মগত। সব নারীরই পিতার সম্পত্তি পাওয়ার এই অধিকার আছে।’’

সকৃতজ্ঞ স্বীকৃতি⇒ ভয়েস অব আমেরিকায় প্রকাশিত

ওয়েবসাইট⇒ বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ

ফেসবুক গ্রুপ লিংক⇒ হিন্দু আইন সংস্কার চাই

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ