পুলক ঘটক
নর-নারীর সম্পর্ক এবং তার মাধ্যমে উৎপাদিত সন্তান নিয়ে গড়ে ওঠে পরিবার। সেই পরিবার এবং পারিবারিক আইনের ভিত্তি হল বিবাহ। উত্তরাধিকার আইনের ভিত্তিও এই বিবাহ। কারণ পিতা, মাতা, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী, কাকা, কাকি, মামা, মাসি ইত্যাদি সকল সম্পর্ক গড়ে ওঠে বিয়ের মাধ্যমে। বিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত সন্তানের বৈধতা এবং বিবাহবহির্ভুতভাবে প্রাপ্ত সন্তানের বৈধতা এক রকম নয়।
বৈধ সন্তানের যে অধিকার অবৈধ সন্তানের অধিকার সে রকম নয়। তাই উত্তরাধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবাহই মূখ্য নিয়ামক। সেই বিবাহের আচার, কার কার মধ্যে বিবাহ বৈধ, বর্ণভেদ বা জাতিভেদে বিবাহের বৈধতা, বিবাহের প্রক্রিয়া, বিবাহ নিবন্ধন, বিবাহ বিচ্ছেদ ইত্যাদি সবকিছু হিন্দু আইনের অংশ।
পুরুষের সম্পত্তির অধিকারের ক্ষেত্রে সে বিবাহিত নাকি অবিবাহিত তা দেখার বিষয় না হলেও নারীর অধিকারের ক্ষেত্রে সে বিবাহিত কিনা, বিধবা হয়েছে কিনা, তার পুত্র সন্তান আছে কিনা ইত্যাদি বিষয় বিদ্যমান হিন্দু আইনে বিবেচ্য। বিবাহে নারীকে দান করা এবং গোত্রান্তর করার সংস্কৃতি চালু আছে। এসব আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে ধর্মীয় বিধান এবং প্রথা – এই দুইটি বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
সনাতন ধর্মমতে বিবাহে কন্যা দান করার বিধান আছে। তবে তা অপরিহার্য কোনো বিধান নয়। কন্যা দান না করেও বিয়ে হতে পারে। শাস্ত্রে ১১ প্রকার বিয়ে এবং বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নারীর পুন:বিবাহের বিধান আছে। এগারো প্রকারের বাইরেও নানা প্রথায় বিয়ের দৃষ্টান্ত আছে। স্বয়ংবর পদ্ধতিতে বিয়ের দৃষ্টান্ত আছে -যেখানে নারী নিজেই তার পছন্দের পাত্র বেছে নেয়।
অন্যদিকে ক্ষমতার জোরে নারী অপহরণ করে (রাক্ষস বিবাহ) বিয়ের বিধানও আছে। শিশু কন্যাকে যজ্ঞের দক্ষিণা হিসেবে পুরোহিতকে দান করার বিধান (আর্য বিবাহ) আছে। তেমনি আবার প্রাপ্তবয়স্ক নরনারীর পারস্পরিক সম্মতিতে গান্ধর্ব্য বিবাহের বিধানও আছে। আমাদের সমাজে প্রচলিত প্রাজাপত্য বিয়েতে সপ্তপদীর সাথে গান্ধর্ব্য বিবাহের নিয়মে মালা বদলের প্রথাটিও সংযুক্ত আছে। ভারতবর্ষের অঞ্চলভেদে প্রথাভেদ আছে। বর্তমান যুগের সনাতন ধর্মাবলম্বী সবাইকে বুঝতে হবে, কোন ধরনের বিয়ে উত্তম।
শাস্ত্রে মারাত্মক বর্ণবৈষম্যের বিধান আছে। কিছু বিধান নিম্নবর্ণের মানুষকে পশুর চেয়ে অধম হিসেবে ব্যবহার করেছে। আবার শাস্ত্রে সর্ব প্রাণীতে সমদৃষ্টির বিধানও আছে। আপনাকে বিবেকবোধ ও সভ্যতাবোধ দিয়ে বিবেচনা করতে হবে কোনটি গ্রহণ করবেন। শাস্ত্রে বেদ, স্মৃতি, সদাচার ও বিবেকের বাণী অনুসরণের নির্দেশ আছে। স্বয়ং ব্রহ্মাও যদি অযৌক্তিক কথা বলে তবে তা পরিত্যাগের নির্দেশ শাস্ত্রে আছে।
বৃহস্পতি সংহিতার সুস্পষ্ট নির্দেশ,
কেবলং শাস্ত্রমাশ্রিত্য ন কৰ্ত্তবো বিনির্ণয়ঃ
যুক্তিহীনবিচারেণ ধৰ্ম্মহানিঃ প্রজায়তে।
অর্থ:‘কেবল শাস্ত্রকে আশ্রয় করে কর্তব্য নির্ণয় করা উচিৎ নয়। কারণ যুক্তিহীন বিচারে ধর্মহানী হয়ে থাকে।’
সেখানে আরও শক্তভাবে বলা হচ্ছে,
যুক্তিযুক্তমুপাদেয়ং বচনং বালকাদপি৷
অন্যং তৃণমিব ত্যজ্যমপ্যুক্তং পদ্মজন্মনা৷৷
অর্থ:একজন বালকও যদি যুক্তিযুক্ত কথা বলে তা মানা উচিত, স্বয়ং ব্রহ্মাও যদি অযৌক্তিক কথা বলেন, তা তৃণবৎ পরিত্যাগ করবে৷
যুক্তি দিয়ে বিচারের নির্দেশ সনাতন শাস্ত্রগ্রন্থেই আছে। আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানে সমৃদ্ধ মানুষকে আজ সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কোন নির্দেশনা মানব মর্যাদাকে মহত্তম পর্যায়ে উন্নীত করে এবং কোনো প্রথাটি মানব মর্যাদা লঘু করে। বিবাহে কন্যা সন্তান দান করা একমাত্র বিধান নয়। প্রাজাপত্য বিবাহের সকল আচার এবং রীতি মেনেও শুধুমাত্র কন্যাদানের আচারটি পরিহার করে নারীর মানব মর্যাদা স্বীকৃতি দিয়ে বিয়ে দেয়া যায়।
হিন্দু আইন সংস্কারের সঙ্গে এই কন্যাদান প্রথাও প্রাসঙ্গিক বিষয় হওয়ায় ৯ জুলাই ২০২৪ তারিখে ফেসবুক লাইভে বিষয়টি নিয়ে আমরা শাস্ত্র এবং আইনের রেফারেন্স দিয়ে উন্মুক্ত আলোচনা করেছি। [লাইভ ভিডিওটির লিংক]
[পুলক ঘটক; সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ]
⇒ ফেসবুক পেজ, ফেসবুক প্রোফাইল, টুইটার অ্যাকাউন্ট
⇒বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের ফেসবুক গ্রুপ