পুলক ঘটক
কোরআনে হাফেজ এক ছোট হুজুর একজন স্কুলছাত্রীকে আক্রমণ করে জোরপূর্বক চুমু খেয়ে পালানোর দৃশ্য ভাইরাল হয়েছে। অভিযুক্ত ছেলেটি যদি মাওলানা না হয়ে বকাটে গুন্ডা হতো তাহলে হয়তো এত সমালোচনা হতো না। হিন্দু সাধু ধরা পড়লেও সমালোচনা বেশি হবে। এমনই হয়।
মাদ্রাসার হুজুররা ঘন ঘন ছেলে ধর্ষণের দায়েও সমালোচিত হন। নির্দয় সমালোচনা আর কঠোর পুলিশি অ্যাকশনে মানুষ এর সমাধান খুঁজছে। কিন্তু তাতে কি এমন অপরাধ বন্ধ হবে? আমরা একদিকে সমাজকে অপরাধী উৎপাদনের কারখানা বানাবো, আর অন্যদিকে পুলিশ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করব?
তার চেয়ে বরং মানুষগুলো কেন এমন প্রবৃত্তির হচ্ছে, কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। হুজুরদের বিকৃত যৌনপ্রবৃত্তি ও মনস্তাত্তিক বিকলাঙ্গতার উৎস সন্ধান করে সমাধান করতে হবে। অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে দমনের চেয়ে অপরাধী উৎপাদন বন্ধ করা বেশি জরুরি।
ঐ মাদ্রাসার ছেলেটি কি জন্মঅপরাধী? সে কি মানুষ নয়? পুলিশ নিয়ে যাওয়ার আগে মানুষের হাতে মার খেয়ে ছেলেটা কিভাবে তার মাকে জড়িয়ে ধরেছে দেখুন। এ দৃশ্যে কি মনে হয় না, সে একজন মানব সন্তান? বিপন্ন অবস্থায় অসহায় মায়ের কাছে সে আশ্রয় খোঁজে।
সে তার মাকে ভালবাসে। এই যে ভালবাসা, এর মধ্যেই তো সমাধান! আমরা কি ছেলেটির মধ্যে ভালবাসার বিকাশ হতে দিয়েছি? অজানা মেয়েটির সঙ্গে যে খারাপ আচরণ ছেলেটি করেছে, একই আচরণ সে কি তার প্রিয় জননীর সঙ্গে করতে পারে? কেউ করে না।
ছেলেটি তার পরিমণ্ডলের, কাছের বা দূরের নারীদের প্রতি প্রেমবোধ বিকশিত করার সুযোগ পায়নি। মায়ের প্রতি প্রেম, বোনের প্রতি প্রেম, বান্ধবীর প্রতি প্রেম ও শ্রদ্ধাবোধ তার মধ্যে বড় হয়নি। তার মধ্যে বড় হয়েছে এক অবদমিত যৌন তাড়না। কোনো মানুষ বিরুদ্ধ শিক্ষায় যৌন অবদমনের চেষ্টা করলে ঐ প্রবৃত্তি তার মধ্যে বিকৃতি নিয়ে বাড়বে। অপপ্রবৃত্তি বিদ্রোহ করে তাকে বিপথগামী করবে।
খোঁজ নিয়ে দেখুন, ছেলেটি ছোটকাল থেকে মেয়েদের সঙ্গে মুক্ত পরিবেশে খেলাধুলা করার সুযোগ পায়নি। অনেক ছেলে বন্ধুর মতো তার অনেক মেয়ে বন্ধু নেই। মেয়েদের প্রতি স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে সে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। মেয়েরা তার যৌনতার উপাদান নয়, মেয়েরা পুরুষের মতোই আত্মমর্যাদা ও মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষ –এই সেন্সটিও তার অধিগত হয়নি। পুরুষতান্ত্রিক পরিমণ্ডলে পাওয়া পুরুষকর্তৃত্বের শিক্ষায় সুস্থ জীবনবোধ অধিগত করা যায় না।
শুধু মেয়ে বন্ধু বলব কেন? এই ছেলেটি কোনো মেয়েকে হয়তো বিশেষভাবে ভালবাসারও সুযোগ পায়নি, এবং ভবিষ্যতেও পাবে না। তার মতো পরিমণ্ডলে যারা বেড়ে ওঠে তারা হয়তো সামর্থ্য থাকলে তিনটি বা চারটি বিয়ে করে। সেই মেয়েগুলো তাদের ঘরে বউ ও অধিনস্ত সেবিকা হয়ে যায়। প্রেমিকা হয় না। নারীদের সাথে এরকম সম্পর্ককে সে তার অধিকার ও স্বাভাবিক ব্যাপার মনে করে। কিন্তু জীবনে কখনই সে প্রেম করতে পারে না; প্রেমিকা পায় না। সে কোনোদিন গাইতে পারে না,
“খেলাঘরে কবে ধূলির খেলায়
দু’টি হিয়া ছিল বাঁধা,
আমার বীণাটি তোমার বাঁশিটি
একসুরে ছিল সাধা।”
বিকৃত শিক্ষায় বেড়ে ওঠা পুরুষদের নিরেট বাস্তবতা হল, নারীর সাথে তাদের জীবন একসুরে সাধা হয় না। তারা কবিতা পাঠ করে না, গান গায় না, সুকুমার বৃত্তির চর্চা করে না। তারা ভালবাসে না, রেপ করে। মেয়ে না পেলে ছেলেদের রেপ করে।
খবরের লিংক: স্কুলছাত্রীকে জোর করে চুমু খাওয়া মাদরাসার ছাত্র গ্রেপ্তার
মানুষগুলো অপরাধী হয়ে জন্মায় না, অপশিক্ষা, অপসংস্কৃতি ও সুন্দর জীবনবোধের ঘাটতি মানুষের অপরাধ প্রবৃত্তি বাড়ায়। যৌন অপরাধ থেকে নিরস্ত রাখতে কাউকে শৈশব থেকে যৌন অবদমন চর্চা করাতে যাবেন না। তাকে বরং ওসব নিয়ে ভাবার সময় কম দিন। তাকে সুস্থ বিনোদনের মধ্যে রাখুন। খেলতে দিন, গান গাইতে দিন, ছবি আঁকতে দিন এবং সর্বোপরি পৃথিবিটাকে ভালবাসতে দিন। নারী-পুরুষ, দূরের-কাছের সবার প্রতি প্রেম জাগ্রত হতে দিন। মানুষ যাকে ভালবাসে তার বিরুদ্ধে তার অপরাধ প্রবৃত্তি কম হয়।
মাদ্রাসার ছেলেরা আমাদের দেশের সন্তান। আসুন ওদের প্রেমের পরিবেশে বড় করি, প্রেম শেখাই।
[পুলক ঘটক; সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ]
⇒ ফেসবুক পেজ, ফেসবুক প্রোফাইল, টুইটার অ্যাকাউন্ট
⇒বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের ফেসবুক গ্রুপ