ইদানিং সনাতন ধর্মকে বৈষম্যমূলক, অমানবিক ও নির্মম হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য একটি মহল পরিকল্পিতভাবে হিংরেজদের বানানো বৈষম্যমূলক হিন্দু আইনকে ‘পবিত্র’ এবং ‘ধর্মীয়’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য নারীর অধিকার অস্বীকার করা হলেও পক্ষান্তরে তারা ধর্মকেই হেয় করছে। আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি, সনাতন ধর্ম এবং “হিন্দু আইন” একদম আলাদা জিনিস। সনাতন ধর্মের আবহমানকালের ইতিহাসে ‘হিন্দু আইন’ নামক আইনের অস্তিত্ব নেই। ইংরেজদের মস্তিস্কই এই আইনের মূল উৎস; ধর্ম মূল উৎস নয়।
পুলক ঘটক
হিন্দু আইনের সঙ্গে সনাতন ধর্মের সম্পর্ক কতটুকু? এ প্রসঙ্গে কলিকাতা ও বোম্বে হাইকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি এ. এম. ভট্টাচার্য বলেছেন, “ঈশ্বর বা অতীন্দ্রিয় সত্তার অস্তিত্বে কট্টর বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তিও হিন্দু আইন ভগবানের কাছ থেকে এসেছে -একথা বিশ্বাস করবে না, যদি তার বিশেষ কোনো মতলব বা ধান্দা না থাকে।”
“I cannot think that “even a staunch believer in any divine existence, transcendent or immanent, can believe in the ‘divine origin’ of Hindu law, unless he has a motive behind such profession of belief or has not read the Smritis or is ready to believe anything and everything with slavish infidelity.” -Justice A.M. Bhattacharjee”
দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছি, সনাতন ধর্ম এবং ‘হিন্দু আইন’ একদম আলাদা জিনিস। সনাতন ধর্মের আবহমানকালের ইতিহাসে ‘হিন্দু আইন’ নামক আইনের অস্তিত্ব নেই। ইংরেজদের মস্তিস্কই এই আইনের মূল উৎস; ধর্ম মূল উৎস নয়। ১৭৭২ সালের ২১ আগস্ট ইংরেজ শাসক ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁর বিচার ব্যবস্থা পরিকল্পনা ‘A Plan for the Administration of Justice in Bengal’র আওতায় ‘হিন্দু আইন’ প্রণয়নের ঘোষণা দেন। আইনগুলো প্রণয়নের সময় বৃটিশরা তাদের পছন্দমতো কিছু বিধান ধর্মশাস্ত্র থেকে নিয়েছে, বেশিরভাগ নেয়নি; এবং সার্বিকভাবে উপেক্ষা করেছে সনাতন ধর্মীয় দর্শনকে। আদালতে আইনজীবীদের ব্যবহার্য কিছু বইয়ে ঢালাওভাবে বেদ, স্মৃতি, ন্যায় মীমাংসা এবং প্রথাকে হিন্দু আইনের মূল উৎস বলা হয়েছে। দীর্ঘ ঐতিহ্য দেখিয়ে অহেতুক গর্ববোধ সৃষ্টি এবং হিন্দু আইনের দৃঢ়ভিত্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এসব কথা লেখা হয়েছিল বলে প্রতিয়মান হয়। এটা করতে গিয়ে উপেক্ষিত হয়েছে আইনের ইতিহাসনিষ্ঠ গবেষণা।
হিন্দু আইন প্রণয়নের সময় ইংরেজরা স্মৃতি, ন্যায় মীমাংসা এবং প্রথা থেকে প্রচুর উপাদান আত্মিকরণ করেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু ‘শ্রুতি’ অর্থাৎ বেদ থেকে বিধানসমূহ হিন্দু আইনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি (এলাহাবাদ, মাদ্রাজ এবং দিল্লী হাইকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং ইন্ডিয়ান প্রেস কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান) মার্কন্ডেয় কাটজু স্পষ্টভাবে বলেছেন, “হিন্দু আইন বেদ থেকে উদ্ভূত নয়।” ২০১০ এর ২৭ নভেম্বর বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন,
“There are many who propound that Hindu law originated from the Shrutis but this is a fiction.”
অর্থ হল, “অনেকেই দাবি করেন যে হিন্দু আইন বেদ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, কিন্তু এটি একটি কল্পকাহিনী।” স্মৃতিশাস্ত্র থেকে বিভিন্ন বিধান হিন্দু আইনে আত্মিকরণের কথা বিচারপতি কাটজু স্বীকার করেছেন। তবে বেদ থেকে মোটেও নয়।
‘আইন সকলের জন্য সমান’ – এই নীতি থেকে সরে গিয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা আইন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইংরেজরা। একেক মানুষের জন্য একেক ধরণের আইন করার এই নীতির নাম দেওয়া হয় ‘Legal Pluralism’ বা ‘আইনের বহুত্ববাদ’। ভারতের সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের জন্য ব্রিটিশ আইন এবং মুসলমানদের জন্য মুসলিম পারিবারিক আইন করা হয়। বাকি জনগোষ্ঠির জন্য করা হয় ‘হিন্দু আইন’। তবে সকল হিন্দুর জন্য এক ও অভিন্ন হিন্দু আইন করা হয়নি। বাংলা ও আসামের জন্য প্রবর্তন করা হয় দায়ভাগ আইন এবং ভারতের বাকি অংশের জন্য করা হয় মিতাক্ষরা আইন। সেই মিতাক্ষরা আইনও ভারতের সকল অঞ্চলের জন্য একরকম ছিল না। গুজরাটের জন্য কঙ্কনা আইন, মাদ্রাজের ময়ুখ আইন, কেরালার জন্য দেওয়া হয় মারুমাক্কাথায়ম ও নাম্বুদ্রি আইন। বৌদ্ধ, জৈন্য এবং শিখদের জন্য কোনো আলাদা আইন করা হয়নি। তাদেরকে ‘হিন্দু আইনে’র আওতাভুক্ত করা হয়। হিন্দু আইন ধর্মীয় বিশ্বাসনির্ভর হলে বৌদ্ধ ও জৈনরা এই আইনের আওতায় পরে কিভাবে? তাছাড়া, বিশাল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাচীনযুগ থেকে বিভিন্ন আদিবাসী ধর্মীয় গোষ্ঠীর বসবাস আছে। তাদের সবাইকে হিন্দু আইনের আওতায় ফেলা হয়। তবে হিন্দু আইনের আওতাভুক্ত হলেও আদিবাসী গোষ্ঠী ও গোত্রসমূহের প্রথা অনুযায়ী প্রত্যেকের জন্য আলাদা বিধান অনুসরণের সুযোগ রাখা হয়।
ইংরেজরা হিন্দু আইন বানানোর প্রায় ১০০ বছর পর ১৮৫৪ সালে নেপালে প্রণীত হয় ‘মুলুকি আইন’। মুলুকি আইন একাধারে দেওয়ানি আইন এবং ফৌজদারী আইন। নেপালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী (যিনি তখন নেপালের একনায়ক বা অঘোষিত রাজা) জং বাহাদুর রানা এই আইন প্রণয়ন করেন। সেসময় নেপালে কোনো লিখিত আইন ছিলনা। সত্য হল, ইংরেজরা লিখিত বা সংবিধিবদ্ধ (codified) আইন চালু করার আগে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় একই চিত্র বিদ্যমান ছিল। কাজীরা তাদের বুঝ অনুযায়ী একই ধরণের অপরাধে একেকজনকে একেক ধরণের সাজা দিত। নেপালের জং বাহাদুর নিজেও একসময় কাজী ছিলেন। তিনি বিলেতে গিয়েছিলেন এবং গ্রেট ব্রিটেনে আইনের শাসন, সংসদ, গণতন্ত্র, বিচার ব্যবস্থা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। পাশ্চাত্যের অনুপ্রেরণায় তিনি নেপালের প্রশাসন ও আইনহীন বিচারব্যবস্থা পরিবর্তনের ঐতিহাসিক উদ্যোগ নেন। দেশটির প্রায় ২০০ প্রশাসক, কাজী, ধর্মজ্ঞ ও বিদ্যানব্যক্তিদের নিয়ে তিনি “কৌশল আড্ডা” প্রতিষ্ঠা করেন। ঐ আড্ডাকে তিনি আইন প্রণয়নের দায়িত্ব দেন। জং বাহাদূরের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে আড্ডার সদস্যরা সনাতন ধর্মশাস্ত্র, নেপালের বিভিন্ন প্রথা, জাতিগত ও বর্ণগত অবস্থা ও সামাজিক পরিস্থিতির উপর টানা তিন বছর গবেষণা করেন। আড্ডার সদস্যদের একাংশ ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চালু করা আইনও অধ্যয়ন করে। তাদের যৌথ গবেষণায় প্রণীত হয় নেপালের মুলুকি আইন। দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু নয়, বিশ্বের ইতিহাসে এটিই সম্ভবত একমাত্র লিখিত (codified) হিন্দু আইন যা হিন্দু শাসক এবং হিন্দু আইন প্রণেতাদের হাত দিয়েই প্রণীত হয়েছিল এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে বলবৎ করা হয়েছিল।
তবে আরও অতীতে নেপালের মল্ল রাজবংশের সময় রচিত হয়েছিল ‘মানব ন্যায় শাস্ত্র’- যেটিকে নেপালের প্রথম লিখিত আইন বলে অনেকে দাবি করেন। চতুর্দশ শতকে রাজা জয়স্থিতি মল্ল পাঁচজন বিদ্বানব্যক্তির সাহায্যে ”মানব ন্যায় শাস্ত্র” রচনা করেছিলেন। উক্ত পঞ্চপন্ডিত হলেন: কীর্তিনাথ উপাধ্যায় কন্যাকুব্জ, রঘুনাথ ঝা মৈথিলী, শ্রীনাথ ভট্ট, মহিনাথ ভট্ট এবং রমানাথ ঝা। মনুস্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি, বৃহস্পতি স্মৃতি, নারদ স্মৃতি এবং অন্যান্য শাস্ত্রগ্রন্থ অধ্যয়নের পর তার ভিত্তিতে তাঁরা আইনগ্রন্থটি রচনা করেন। তখনকার সমাজে প্রচলিত প্রথাকে কেন্দ্র করেই লেখা হয়েছিল এই বই। ‘মানব ন্যায় শাস্ত্র’ বাড়ি, জমি, বর্ণব্যবস্থা, মৃতদেহ সৎকার ইত্যাদি সম্পর্কিত অনেক আইনি বিধান সমাজে প্রবর্তন করেছিল। মধ্যযুগীয় সময়ে এটি ন্যায়বিচার প্রদানের প্রধান উৎস ছিল মনে করা হলেও রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে তা প্রয়োগ করার বাস্তব নিদর্শন পাওয়া যায়নি। উক্ত গ্রন্থের আইনগত কার্যকরতা আদৌ ছিল কিনা বা থাকলেও কতটুকু ছিল তা গবেষণার বিষয়। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও বিভিন্ন রাজাদের আমলে কিছু আইনের বই রচিত হয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে তা প্রয়োগের প্রমাণ কই? ধর্মীয় ও সামাজিক নানারকম বিধিবিধান, বিশ্বাস ও প্রথাতো হিন্দুদের আছেই। সেগুলো সব ধর্মেই আছে – যা আইন নয়। আইনের আওতায় বিচার হয় এবং আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ থাকে। ধর্মীয় গ্রন্থ এবং আইন এক জিনিস নয়। মানুষ নিজেরা কি বিশ্বাস অনুসরণ করল, কি কি বিধিবিধান পালন করলো, সেগুলো তাদের নিজেদের বিষয়। তারা পালন করলে কেউ বাধা দেবেনা, না করলেও কেউ শ্বাস্তি দেবেনা। কিন্তু আইন হলে তার প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ থাকবে। যেমন ধরুন, ধর্মের দৃষ্টিতে সংগঠিত কোনো ভুল বা অপরাধের জন্য হিন্দুশাস্ত্রে প্রায়শ্চিত্যের বিধান আছে। মানুষ তার অপরাধের প্রায়শ্চিত্য পুরহিত বা পন্ডিতদের পরামর্শ নিয়ে নিজেরাই করতো। সেটা ব্যক্তির নিজস্ব বিশ্বাসের বিষয়। ইংরেজদের হাতে রাষ্ট্রীয় আইন যখন হয়েছে তখন কিন্তু প্রায়শ্চিত্যের বিধান রাখা হয়নি। রামায়নে, মহাভারতে এবং বিভিন্ন পুরানে রাজারা দন্ড দিয়েছেন- এমন নজির আছে। দন্ড দেওয়ার সময় তারা রাজগুরু বা পুরোহিতের কাছে ধর্মীয় পরামর্শ নিয়েছেন -এমন দৃষ্টান্তও আছে। কিন্তু সকল বিচারের জন্য সুনির্দিষ্ট আইন অনুসরণ অথবা আইনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের নজির নেই। তাছাড়া রামায়নে বা পুরাণে যাই থাকুক -সেগুলো ঐতিহাসিক নয়; প্রাগৈতিহাসিক। সেখান থেকে আইনের ইতিহাসগত উপাদান সন্ধান করে হিন্দু আইনের উৎস ও ইতিহাস লেখা গবেষকের কাজ- যা এখনো অসমাপ্ত।
ভারতের হিন্দু আইনের মূল উৎস ছিল ইংরেজদের মস্তিস্ক। বিশেষ কোনো সংহিতা থেকে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু ধারণা বা বিধান আইনের মধ্যে যুক্ত হলেই স্মৃতিশাস্ত্র ঐ আইনের মূল উৎস হয়ে যায় না। তাছাড়া এমন একটি স্মৃতিশাস্ত্রও নেই, যা সর্বজনমান্য বা সার্বজনীন বিধান হিসেবে হিন্দু সমাজে প্রতিষ্ঠিত আছে। বিভিন্ন স্মৃতির বিধান পরস্পর বিরোধী। পৌরাণিক যুগেও মুনি ঋষিরা এসব বিধানের বিষয়ে একমত ছিলেন না। এখনো হিন্দু সমাজ বহুমাত্রিক। ঈশ্বরের উপাসনা, আধ্যাত্ম জ্ঞান বা পরমার্থ সন্ধানের ক্ষেত্রে বৈচিত্রের মধ্যে মিলনের ঐকতান আছে। কিন্তু হিন্দুর ব্যক্তিজীবন ও সামাজিক জীবনাচরণ নির্ধারণ করে দেওয়া অভিন্ন ও সার্বজনীন বিধিনিষেধের কোনো বই নেই। সোজা কথায়, এক ব্যক্তি প্রবর্তিত এক শাস্ত্রের অনুশাসনের ধর্ম সনাতন ধর্ম নয়। একটি শাস্ত্রের বিধান নিয়ে হিন্দুরা চলেনা। বিভিন্ন অঞ্চলের ও বিভিন্ন মতাদর্শের হিন্দুরা বিভিন্ন পথ অনুসরণ করেন, তবে তাদের সকলের গন্তব্য এক বলে মনে করা হয়। সব মিলিয়েই হিন্দু সমাজ; সর্বগ্রাহী সনাতন ধর্ম।
১৮৫৪ সালে মুলুকি আইন প্রণয়নের পর থেকে নেপালের হিন্দু রাজতন্ত্রের আমলেই তা একাধিকবার সংশোধন হয়েছে। দেশটিতে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে আধুনিক বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে সেদেশে নারী, পুরুষ ও লিঙ্গবৈচিত্রময় জনগোষ্ঠীর মধ্যকার বৈষম্য নিরসন করে সময়োপযোগী আধুনিক আইন চালু আছে।
ভারতে ১৭৭২ সালে সর্বপ্রথম হিন্দু আইন চালু করার পর থেকে ১৯৪৭ সালে বিদায় নেওয়ার আগ পর্যন্ত ইংরেজরা বহুবার ঐ আইন সংশোধন করেছে- অনেককিছু নতুন সংযোজন ও বিয়োজন হয়েছে। বৃটিশের আদালতের রায়েও বহুকিছু বদলে গেছে। এসব বিধান শাস্ত্রবাক্য হলে সংশোধন বা সংযোজন-বিয়োজনের সুযোগ থাকত না। ইংরেজ শাসনের শেষদিকে ১৯৩৭ সালে Hindu Women’s Right to Property Act প্রণয়নের পর ইংরেজরা ১৯৩৯ সালে এর সর্বশেষ সংশোধনী আনে। এই সংশোধনীর আগে যা ছিল তাকে ধর্মীয় আইন বলবেন, নাকি সংশোধনের পর বর্তমানে যা চালু আছে তাকে ধর্মীয় বলবেন? ভারত থেকে বিদায় হওয়ার আগমুহুর্তে ইংরেজ সরকার হিন্দু আইন সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দিতে চেয়েছিল। সেই উদ্দ্যেশ্যে তারা ১৯৪১ সালে প্রখ্যাত আইনবিদ বি.এন. রাওয়ের (স্যার বেনেগাল নারসিং রাও) নেতৃত্বে ’হিন্দু ল কমিটি’ গঠন করেছিল। হিন্দু আইন সংস্কার ও কোডিফিকেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ঐ কমিটিকে। রাও কমিটি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে সমান অধিকার দিয়ে আইন সংস্কারের সুপারিশও করেছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়নের আগেই ১৯৪৭ সালের আগস্টে ইংরেজদের বিদায় নিতে হয়। পরে অবশ্য রাও কমিটির সেই সুপারিশের আলোকেই স্বাধীন ভারতের সংসদে আইনমন্ত্রী ড. বিআর আম্বেদকর ‘হিন্দু কোড বিল’ উত্থাপন করেন। শুরু হয় হিন্দু আইনে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার চার বছরের লড়াই; পৃথিবীর সংসদীয় চর্চার ইতিহাসে একটি আইন নিয়ে দীর্ঘতম সংসদীয় বিতর্ক। ভারতের সেই আইন সংশোধনের ইতিহাস পরবর্তীতে আরও লম্বা হলেও সেখানকার হিন্দু আইনের লিঙ্গবৈষম্য শেষমেশ দূর করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশ ১৯৪৭এ পাকিস্তানের খপ্পরে পরার পর থেকে আজ পর্যন্ত এখানে হিন্দু আইনের সংশোধন হয়নি। বৃটিশরা ১৯৩৯ সালে সর্বশেষ সংশোধনীর পর যে অবস্থায় রেখে গিয়েছিল, হিন্দু আইন আজও সেই অবস্থায় রয়ে গেছে। ফলে সমাজের অর্ধেক মানুষের প্রতি চরম বৈষম্য ও অধিকারহীনতা বজায় রয়েছে।
ইদানিং সনাতন ধর্মকে বৈষম্যমূলক, অমানবিক ও নির্মম হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য একটি মহল পরিকল্পিতভাবে হিংরেজদের বানানো বৈষম্যমূলক হিন্দু আইনকে “পবিত্র” এবং “ধর্মীয়” হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য নারীর অধিকার অস্বীকার করা হলেও পক্ষান্তরে তারা ধর্মকেই হেয় করছে।
লেখাটি শেষ করছি মাদ্রাজ হাইকোর্টের ইংরেজ বিচারপতি জেমস হেনরি নেলসনের রেখে যাওয়া একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। তিনি লিখে গেছেন, “হিন্দু আইন-এর মতো কোনও জিনিস কখনও বিদ্যমান ছিল না এবং এর অস্তিত্ব অনুমান করার কোনও উল্লেখযোগ্য ভিত্তি সংস্কৃতবাদীরা (একদল ইংরেজ) পায়নি। ভারত নামক দেশগুলোর সমষ্টিগত ইতিহাস এবং পরিস্থিতির সাথে নিজেদের পরিচিত করার সময় বা সুযোগও তাদের ছিল না।”
“No such thing as ‘Hindu law’ has ever existed, and that its existence has been assumed upon no significant ground by enthusiastic sanskritists, who had neither time or opportunity to acquaint themselves with the actual history and circumstances of the aggregate of the countries called India.”
#Source: A View of the Hindu Law: As Administered by the High Court of Judicature at Madras- By J. H. Nelson
পূলক ঘটক: সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ
Email: ghatack@gmail.com
[পুলক ঘটক; সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ]
⇒ ফেসবুক পেজ, ফেসবুক প্রোফাইল, টুইটার অ্যাকাউন্ট
⇒বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের ফেসবুক গ্রুপ