পুলক ঘটক
রামকৃষ্ণ মিশন যিশু খ্রিস্টের পূজা করে। প্রায় শতবর্ষ যাবত প্রতিবছর বড়দিনের (২৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় তারা যিশুখ্রিস্টের পূজা আয়োজন করে থাকে। কেন্দ্রীয়ভাবে বেলুরমঠ থেকে শুরু করে পৃথিবীর যে সকল দেশে মিশনের আওতায় রামকৃষ্ণ আশ্রম বা মঠ রয়েছে সেখানে এই পূজা হয়ে থাকে। হিন্দুসহ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যারা রামকৃষ্ণ মঠের আদর্শে বিশ্বাস করে তারা এই পূজায় অংশ নেয়। এ নিয়ে অতীতে কোনো সমস্যা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। বিপত্তি শুরু হয়েছে গতবছর থেকে, যখন ভারতের নয়া হিন্দুত্ববাদী একটি গোষ্ঠী মিশনের এই যিশুপূজা প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। ২০২০’র ২৪ ডিসেম্বর ভারতের মেঘালয় প্রদেশের শিলংয়ে রামকৃষ্ণ মিশন যিশুপূজার আয়োজন করলে সেখানকার বজরং দলের সদস্য হামলা চালায় এবং বিবেকানন্দ কালচারাল সেন্টারে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এবছর সেই উগ্রবাদের ঢেউ আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশেও। বড়দিন আসার একসপ্তাহ আগে থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রামকৃষ্ণ মিশন এবং দেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লেখালেখি ও বিষোদ্গার শুরু হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের একজন শিক্ষক ২৩ ডিসেম্বর ফেসবুকে লেখেন,
“প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে সাধারণ হিন্দুরা রামকৃষ্ণ মিশনের যিশুপূজার বিরোধিতা করে; পক্ষান্তরে মিশন অশাস্ত্রীয় যিশুপূজা প্রতিবার করেই চলে। বিষয়টির স্থায়ী সমাধান কি?”
রামকৃষ্ণ মিশনের ভক্ত হিন্দুরা তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী যিশু পূজা করে থাকেন। অন্য কোনো হিন্দু তাতে কখনো বাঁধা দিয়েছে এমন দৃষ্টান্ত অতীতে ছিলনা। সুতরাং এধরণের স্ট্যাটাস উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যাচার সন্দেহ নেই। অথচ ঐ ফেসবুক স্ট্যাটাসে প্রায় দুই হাজার মানুষ প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। সেখানে মন্তব্যকারীদের অনেকেই রামকৃষ্ণ মিশন বর্জনের জন্য হিন্দুদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কারও কারও মন্তব্য অতি উগ্র। একজন লিখেছেন, “লাঠি থেরাপি স্থায়ী সমাধান হতে পারে।” আরেকজন এর সরল সমাধান খুঁজেছেন হত্যার মাধ্যমে। তিনি মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে’র পথ অনুসরণকে “কার্যকরী ফর্মূলা” হিসেবে মতামত দিয়েছেন। অনেকেই আলাদাভাবে ফেসবুকে রামকৃষ্ণ মিশন ও যিশু খ্রিস্টের প্রতি বিদ্বেষমূলক স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দৃশ্যমান কিছু মানুষের এই প্রবণতা নতুন উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে। ধর্মীয় বিশ্বাস কিভাবে পর্যায়ক্রমে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কূপমণ্ডূকতা, রাজনৈতিক মৌলবাদ এবং শেষে উগ্রবাদে পর্যবসিত হতে পারে এটি তার প্রাথমিক লক্ষণ কি-না?
প্রথম কথা হল, রামকৃষ্ণ মিশনের ভক্তরা কিভাবে উপাসনা করবে, কি রকম ধর্মীয় বিশ্বাস ও চর্চা অবলম্বন করবে –তাতে বাধা দেওয়ার বা তা নির্ধারণ করে দেওয়ার অধিকার আমারও নেই, আপনারও নেই। কি পালন করবে বা না করবে -এটা তাদের অধিকার।
দ্বিতীয়ত: মিশনের যিশুপূজা “অশাস্ত্রীয়” অ্যাখ্যা দিয়ে এটা বন্ধের জন্য সমাধান খোঁজা অপরাধমূলক ধৃষ্টতা। এটা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে রীতিমত হুমকী। শুধু রামকৃষ্ণ মিশন নয়, হিন্দু ধর্মাবলম্বী কিংবা অন্য কোনো ধর্মের মানুষের ধর্মচর্চাকে অশাস্ত্রীয় আখ্যা দেওয়া উস্কানিমূলক সাম্প্রদায়িকতা। এটা এক হিন্দু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আরেক হিন্দু জনগোষ্ঠীকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা।
তৃতীয়ত, সনাতন ধর্মের বৈচিত্র ধ্বংস করে একমুখী ধর্মীয় উগ্রবাদীতা গড়ে তুললে হিন্দু সমাজেরই বেশি ক্ষতি হবে। তাতে সনাতন ধর্মের শ্বাশত ঐতিহ্য থাকবেনা। নয়া মৌলবাদের মাঝে সনাতনী বহুত্ববাদী সমাজদর্শন হারিয়ে যাবে।
মিশন কি অশাস্ত্রীয় কিছু করছে?
ঊনবিংশ শতক থেকে রামকৃষ্ণ মিশন সনাতন ধর্মের প্রাণ ভ্রমরা এবং বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ধর্মীয় চর্চাকেন্দ্রগুলোর একটি। সনাতন ধর্মাবলম্বী বিদ্যান ও শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ এই মিশনে রয়েছেন। যিশুপূজা শাস্ত্রীয় না অশাস্ত্রীয় সে জ্ঞান তাদের রয়েছে। তাদের যিশু খ্রিস্টের পূজা মোটেই অশাস্ত্রীয় নয়; সনাতন ধর্ম বিরুদ্ধ নয়। কারণ, প্রথমত: সনাতন ধর্মের উপাসনা পদ্ধতি কোনো একক শাস্ত্রদ্বারা নির্ধারিত নয়। সনাতন ধর্ম বহুত্ববাদী, বৈচিত্রমণ্ডিত -বহুমত ও বহু পথের সমাহার। সনাতনে উপাস্য দেব-দেবী, ঈশ্বর এবং পূজাপদ্ধতিও বিচিত্র। বাংলায় যে দেবতার পূজা মূখ্য, ভারতের অন্য অনেক অঞ্চলে সেসসব দেবতা অপরিচিত। আমি দক্ষিণ ভারতের চেন্নাই ও ভেলরের বিভিন্ন মন্দিরে ঘুরে সেখানকার দেবতাদের চিনতেই পারিনি। একদম নাম না জানা দেবদেবির মন্দির দেখে এসেছি। সেজন্য আমি বলতে পারিনা সেইসব দেবদেবির পূজা করা অশাস্ত্রীয়। বাংলার মনসা পূজা হয়তো বা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিচিতই নয়। সেজন্য ভারতের অন্য অঞ্চলের মানুষ বলতে পারে না এগুলো অশাস্ত্রীয় বা নিষিদ্ধ। যেখানে শক্তির আধার; যেখানে ভীতি কিংবা সম্ভ্রম – সেখানেই মাথা ঠেকানো হিন্দু সমাজের পুরাতন সংস্কৃতি। শুধু প্রচলিত সংস্কৃতি বললেও ভুল হবে -সনাতন ধর্মগ্রন্থে এর সুস্পষ্ট স্বীকৃতি আছে।
গীতায় ভগবান শ্রী কৃষ্ণ বলেছেন, “যদযদ্বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্ৰীমদুৰ্জিতমেব বা । তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজোহাংশসম্ভবম্ ৷৷” ৪১/১০
অর্থ: ”ঐশ্বর্য্যযুক্ত, শ্রী-সম্পন্ন ও বল-প্রভাবাদির আধিক্যযুক্ত যত বস্তু আছে, সে সবই আমার তেজাংশসম্ভূত বলে জানবে।”
এই অধ্যায়ে (১০ম) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আগুনে, বায়ুতে, অন্তরিক্ষে, সাগরে, পর্বতে, বৃক্ষে, দেবতাদের মধ্যে, মানুষের মধ্যে, যোদ্ধাদের মধ্যে, মুনিদের মধ্যে, ঋষিদের মধ্যে, বিভিন্ন প্রাণীতে ইত্যাদি সবকিছুর মধ্যে যেখানে যেখানে তাঁর বিভূতির বিশেষ প্রকাশ আছে তা বর্ণনা করেছেন। এটি ঈশ্বরের অবতারবাদের একটি আঙ্গিক। তদনুযায়ী হিন্দুরা যেখানেই বড় বা শক্তিমান হিসেবে কিছু পায় তাকে ঈশ্বরেরই বিশেষ প্রকাশ হিসেবে দেখে এবং তাঁর পূজা করে। অতীতে বসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ’মা শীতলা’র পূজা করার ব্যাপক প্রচলন ছিল। সম্প্রতি তারই আদলে পশ্চিমবঙ্গে “করোনা মাতা”র পূজা করার সংবাদ শুনেছি। হিন্দু ধর্মের শাস্ত্রীয় বৈচিত্র অনুযায়ী এগুলো অশাস্ত্রীয় বা নিষিদ্ধ নয়।
এখানে সনাতন ধর্মের মূল দর্শনটি বুঝতে হবে। হিন্দুদের এই বহুদেবতা বা ঈশ্বরের বহুরূপ হলো বহুত্বের মধ্যে ঈশ্বরের একত্বের প্রকাশ। তাই হিন্দুধর্ম একাধারে বহুঈশ্বরবাদী এবং একেশ্বর বাদী। সনাতন ধর্মে যখন যার পূজা করা হচ্ছে তখন তাতেই এক ঈশ্বরের সামগ্রিক প্রকাশ দেখা হচ্ছে। যেমন ধরুন, সরস্বতী বিদ্যার দেবী। পৃথিবীর সকল জ্ঞানের আধার এবং মূর্ত প্রতীক হিসেবে তাঁর উপাসনা করা হয়। জল যেমন ঘনীভূত হয়ে রূপ ধারণ করে এবং বরফ খন্ড হয়ে যায়- হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী পৃথিবীর তাবৎ বিদ্যা ও তাবৎ জ্ঞান তেমনিভাবে মানবের ভক্তিতে ঘনীভূত হয়ে স্বরস্বতী মূর্তীতে ধরা দেন। এই জ্ঞান ঈশ্বরের একটি রূপ। এখানে ঈশ্বরের “একটি রূপ” বলা হলেও সরস্বতীর যখন ধ্যান বা প্রণাম করা হচ্ছে তখন তাকেই “বিশ্বাবাসং বিশ্বরূপং বিশ্বেশ্বং পরমেশ্বরম্” অর্থাৎ “বিশ্বের আবাস, বিশ্বের স্বরূপ, বিশ্বের ঈশ্বর ও পরমেশ্বর” হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। তাঁকে বলা হচ্ছে “ইন্দ্রোহপি বসবো ব্রহ্মা চন্দ্রার্কৌ জ্যোতিরেব” অর্থাৎ “ইন্দ্র, বসুগণ, ব্রহ্মা, চন্দ্র, সূর্য বা অন্যান্য জ্যোতির্ময় পদার্থ সকল, তাহার স্বরূপ।” (সূত্র মার্কণ্ডেয় পুরাণ)। সনাতন ধর্মের সকল উপাসনায় ও সকল বিশ্বাসে এই ভাবটির উপস্থিতি দেখতে পাবেন। এই ভাবাদর্শের ভিত্তিতেই এখানে বহু অবতারবাদ একত্ববাদেরই রূপান্তর।
এখন বলুন, যদি সূর্যকে, পাহাড়কে, নদীকে, সমুদ্রকে, বৃক্ষকে এমনকি বিষধর সাপকেও পূজা করা যায়, তাহলে মানুষকে কেন পূজা করা যাবে না? মানুষকে পূজা করা সনাতন ধর্মে বৈধ। সনাতন ধর্মে মানুষকে গুরু রূপে এবং ঈশ্বর রূপে পূজা করা হয়। কাজেই সনাতনী বিশ্বাসে যিশু খ্রিস্টের পূজায় অন্যায় নেই। কারণ এখানে ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজিত।
রজনীকান্ত সেনের ভাষায়,
“আছ অনল-অনিলে, চির নভোনীলে, ভূধর-সলিলে, গহনে
আছ বিটপীলতায়, জলদের গায়, শশী-তারকায়, তপনে।”
সাধনার সর্বোচ্চ স্তর ’সমাধি’ থেকে নেমে এসে ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ ঘোষণা দিয়েছিলেন “যত্র জীব তত্র শিব”। তিনি “শিব জ্ঞানে জীব সেবা“ করার নির্দেশ দেন। তারই নির্দেশিত পথে স্বামী বিবেকানন্দ গড়ে তুললেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন। স্বামীজি প্রচার করলেন,
“ব্রহ্ম হতে কীট-পরমাণু, সর্বভূতে সেই প্রেমময়,
মন প্রাণ শরীর অর্পণ কর সখে, এ সবার পায়।
বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।”
যারা অনু-পরমাণু এমনকি কীট পতঙ্গকেও ঈশ্বরের প্রকাশ হিসেবে উপাসনা করেন, তারা মানুষ – বিশ্ব ইতিহাসের একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ- তাঁর পূজা করবে না কেন? আপনার-আমার দৃষ্টিতে তিনি মানুষ। খ্রিস্টানদের দৃষ্টিতে তিনি ঈশ্বরের পুত্র এবং রামকৃষ্ণ পরমহংস ও তার ভক্তদের দৃষ্টিতে তিনি স্বয়ং ঈশ্বরের অবতার – তিনি যিশু খ্রিস্ট। দেখার এবং বোঝার এই বৈচিত্র নিয়েই মানব সমাজ। এই বহুত্ববাদিতাকে ধ্বংস করতে চান কেন?
আমার বিবেচনায় রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব মানবসভ্যতার ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম ধর্ম প্রচারক; সনাতন ধর্মের শ্রেষ্ঠ প্রচারক তো বটেই। অন্য কারও চোখে হয়তো তিনি কিছুই নন। আবার রামকৃষ্ণ আশ্রমের ভক্তদের চোখে তিনি সাক্ষাৎ ভগবান। ভগবানের অবতার। “ত্রেতায় যে রাম, দ্বাপরে যে কৃষ্ণ; কলিতে তিনি একাধারে রামকৃষ্ণ।” আপনি শ্রী রামকৃষ্ণকে ঈশ্বরের অবতার হিসেবে না মানতে পারেন। কিন্তু রামকৃষ্ণ ভক্তদের বিশ্বাসকে অশাস্ত্রীয় বলতে পারেন না। কারণ সনাতন ধর্ম আপনাকে সেই অধিকার দেয় না। সনাতন ধর্মে অনন্ত অবতার।
বৈদিক সনাতন ধর্মের বাইরে গিয়েও গৌতম বুদ্ধ এবং জৈন ধর্মের প্রবক্তা মহাবীর তীর্থঙ্কর কিছু কিছু পুরাণে ঈশ্বরের অবতার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। শুধু পৌরাণিক যুগে নয়, গত কয়েকশ’ বছরে সনাতন ধর্মে অবতারের সংখ্যা দশকে দশকে বেড়েছে। এ হচ্ছে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস- তার উপর আপনি জোর করতে পারেন না। এই বাংলায় চৈতন্য মহাপ্রভূ, ঠাকুর অনুকূল, নিগমানন্দ পরমহংস, জগদ্বন্ধু সুন্দর প্রমুখ সকল ধর্মগুরুর অনুসারীরা তাদেরকে ঈশ্বরের অবতার হিসেবে বিশ্বাস করে এবং তাদের পথ অনুসরণ করে। শঙ্করাচার্য় পরমহংস এবং স্বামী বিবেকানন্দ শিবের অবতার হিসেবে তাদের ভক্তদের কাছে পূজনীয়। এটা কি অশাস্ত্রীয়? না, তা নয়। সনাতন ধর্মে নিজের গুরুকে ঈশ্বর হিসেবেই উপাসনা করতে বলা হয়েছে।
গুরুকে প্রণাম করতে গিয়ে বলা হচ্ছে,
“মন্নাথ শ্রী জগন্নাথ
মদ্গুরু শ্রী জগদ্গুরু
মমাত্মা সর্বভূতাত্মা
তস্মৈ শ্রী গুরবে নমঃ।।”
অর্থ হল, “আমার যিনি প্রভূ, তিনি এই জগতের প্রভূ। যিনি আমার গুরু, তিনি সমগ্র বিশ্বের গুরু। আমার এই আত্মা, সৃষ্টি জগতের সবকিছুর আত্মা। সেই হেতু আমি শ্রী গুরুকে প্রণাম করি।”
তাহলে বিভিন্ন ঘরানার প্রবর্তক কিংবা ধর্মগুরুদেরকে তাদের অনুসারিরা যদি ঈশ্বরের অবতার হিসেবে মানেন, তাকে আপনি অশাস্ত্রীয় বলতে পারেন না।
বলা হচ্ছে,
“গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণুঃ গুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ।
গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।”
অর্থ হচ্ছে, “গুরুদেবই ব্রহ্মা, গুরুই বিষ্ণু, গুরুই দেব মহেশ্বর, শ্রীগুরুই পরব্রহ্ম স্বরূপ; সেই শ্রীগুরুদেবকে পুনঃ পুনঃ ভক্তিভরে প্রণাম করি।”
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে নিজ গুরুকে ঈশ্বর বলে মানা সনাতন ধর্মে স্বীকৃত।
ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সর্বধর্ম সমন্বয়ের মতাদর্শ প্রচারের কারণে জগতে বিশেষভাবে পূজ্য। “যত মত তত পথ” – এই যে ঘোষণা, এটি শ্রী রামকৃষ্ণের একটি কথামাত্র নয়। এটি তাঁর প্র্যাক্টিকাল উপলব্ধি এবং এটাই রামকৃষ্ণ ভাবাদর্শের সারবত্তা। সারা পৃথিবীতে ধর্ম বিস্তারের ইতিহাসে শুধুমাত্র এই একজন ধর্মগুরু বলে গেছেন, যে তিনি শুধুমাত্র একটি পথে সাধন করে সিদ্ধি লাভ করেন নি। তিনি একাধিক পথে সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করেছেন বলে দাবি করেছেন। তিনি প্রথমত: কালি সাধক। কালি সাধনায় সিদ্ধি লাভের একপর্যায়ে তাঁর কৌতুহল হল, কৃষ্ণ সাধনায় সিদ্ধি লাভ হয় কি-না? তিনি রাধাভাব (বৈষ্ণবীয় মধুর রস) ধারণ করে কৃষ্ণের সাধনা করেন এবং কৃষ্ণের দর্শন লাভ করেন। এরপর মা যশোদার ভাব (বৈষ্ণবীয় বাৎসল্য রস) নিয়ে বালগোপালের সেবা করেন এবং বাৎসল্য প্রেমের শীর্ষগতিতে পৌঁছান। এরপর তিনি হনুমানের ভাব (বৈষ্ণবীয় দাস্য রস) অবলম্বন করে রাম সাধনা করেন এবং রামের দর্শন লাভ করেন। শুধু ভক্তিপথের সাধনা নয়, তিনি নিরাকার নির্গুন ব্রহ্মের সাধনা করেছেন। গৌতমবুদ্ধের নির্দেশিত পথে বোধিসত্ত্ব লাভ করেছেন। এক পর্যায়ে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে খ্রিস্টের দর্শন লাভ করেছেন। এমনকি ইসলাম ধর্মে দিক্ষা নিয়ে আল্লাহর উপাসনা করেছেন এবং আল্লাহর দিদার লাভ করেছেন। তাঁর এই ধর্ম সাধনার প্রতিটি কাহিনী অনেক বড় – যা বিস্তারিত করা এখানে সম্ভব নয়। তবে শ্রী রামকৃষ্ণের দাবি অনুযায়ী তিনি নানা পথে সাধনা করে ভগবানকে লাভ করেছেন। তার ভিত্তিতেই তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি, “যত মত তত পথ” ঘোষণা করেছেন। তাঁরই নির্দেশিত পথে তাঁর সাধকশিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বব্যাপি সর্বধর্ম সমন্বয়ের বাণী প্রচার করেছেন। শ্বাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে স্বামীজি বারবার বলে গেছেন,
“রুচিনাং বৈচিত্র্যাদৃজুকুটিলনানাপথজুষাং।
নৃণামেকো গম্যস্ত্বমসি পয়সামর্ণব ইব।।”
-(শিবমহিম্নঃ স্তোত্র)
অর্থাৎ, “হে প্রভো, বিভিন্ন পথে গিয়েও যেরূপ সকল নদী একই সমুদ্রে পতিত হয়, ভিন্ন ভিন্ন রুচিহেতু সরল ও কুটিল প্রভৃতি নানা পথগামীদেরও তুমিই সেইরূপ- একমাত্র গম্যস্থান।”
বিবেকানন্দ বারবার গীতা থেকে উদ্ধৃত করেছেন,
“যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাং স্তথৈব ভজাম্যহম্। মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।”
অর্থাৎ, “যে যেরূপ মত আশ্রয় করে আসুক না কেন আমি তাকে সেভাবেই অনুগ্রহ করে থাকি। হে অর্জুন, মনুষ্যগণ সর্বতোভাবে আমার নির্দিষ্ট পথেই চলে থাকে।”
বিশ্বভ্রাতৃত্ব তথা ভিন্ন মতাবলম্বীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিবেকানন্দ প্রচার করেছেন ঋগ্বেদের নির্দেশ,
‘‘সম্মিলিত হও, একত্রে বাক্যালাপে নিয়োজিত হও।……….তোমাদের প্রার্থনা অভিন্ন হোক, এক হোক তোমাদের বাসনা ও উদ্দেশ্য এবং অভিন্ন হোক তোমাদের সাফল্য। তোমাদের অভিন্ন প্রার্থনার কথা পুণরাবৃত্তি করছি এবং অভিন্ন নৈবেদ্যের প্রস্তাব করছি। তোমাদের অভিপ্রায় অভিন্ন হোক, অভিন্ন হোক তোমাদের হৃদয়, অভিন্ন হোক তোমাদের চিন্তা যার ফলে তোমাদের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হবে সর্বাঙ্গীন ঐক্য।’’(ঋগ্বেদ, ১০/১৮৭/২-৪)।
তিনি তুলে ধরেছেন গীতায় উক্ত শ্রী কৃষ্ণের বাণী,
‘‘যিনি সকল প্রাণীর প্রতি দ্বেষহীন, মিত্রভাবাপন্ন, দয়ালু, মমত্ববুদ্ধিশূন্য, নিরহংকার, সুখেদুঃখে সমভাবাপন্ন, ক্ষমাশীল, সর্বদা সন্তুষ্ট, সদাসমাহিত চিত্ত, সদা সংযত স্বভাব, সদা তত্ত্ববিষয়ে দৃঢ় নিশ্চয় এবং মন ও বুদ্ধি আমাতে অর্পিত, তিনিই আমার প্রিয় ভক্ত’ (গীতা, ১২/১৩-১৪)।
অরাজনৈতিক ধর্মজীবনে রাজনৈতিক বিপত্তি
গীতায় এবং বেদে উক্ত সাম্য ও বহুত্ববাদের বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে গিয়ে ইদানিং তৈরি হচ্ছে নতুন বিপত্তি। কারণ “মমাত্মা সর্বভূতাত্মা” (আমার আত্মাই সমস্তকিছুর আত্মা) বললে বিভেদের রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বা নয়া “রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদ” টিকতে পারে না। রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদ জাগাতে গেলে বহুত্ববাদ খতম করতে হবে, একমুখী মৌলবাদ রচনা করতে হবে। রামকৃষ্ণ মঠের আদর্শ এবং তার বাস্তব প্রয়োগ এই নয়া উগ্রবাদী রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিপক্ষ হয়ে গেছে। ফলে ইদানিং বারবার উগ্র সাম্প্রদায়িক সমালোচনার টার্গেট হচ্ছে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন। টার্গেটটা ভারতীয় ভুখন্ড থেকেই ভেসে আসছে –কিছু ব্যক্তি এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। রামকৃষ্ণ মিশনের উপর আঘাত বরদাস্ত করা যাবে না। সনাতন ধর্মের বৈচিত্রময় রূপ, বহুত্ববাদ তথা সনাতন ধর্মকে রক্ষা করতে হলে রামকৃষ্ণ আশ্রম বিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। নইলে কেউ একজন মিষ্টি ভাষায় রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যক্রমকে অশাস্ত্রীয় বলে ফতোয়া দেবেন এবং তার অনুসারীরা “লাঠি থেরাপি” থেকে শুরু করে নাথুরাম গডসে’র পন্থা অবলম্বনের দিকে যাবেন। এভাবে ধর্মীয় বিশ্বাসকে রাজনৈতিক উগ্র মৌলবাদে পর্যবসিত করতে দেওয়া যাবে না।
বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া নিছক পাগলামী। এখানে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা করা মানে ইসলামী মৌলবাদী শক্তিকে সহযোগিতা করা। আমরা ধর্মে সহনশীলতা চাই, রাজনীতিতেও সহনশীলতা চাই। আমরা অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল বাংলাদেশ চাই। সকলের সহঅবস্থান শুধু নয় -সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিয়ে বাঁচতে চাই। এই চাওয়ার প্রতিপক্ষের নাম মৌলবাদ। এই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জয় হোক মনুষত্বের। রামকৃষ্ণ মিশনের ধর্মীয় শিক্ষা, “যত মত তত পথ” নিয়ে এগোলেই সকল মানুষ বাঁচবে।
[পুলক ঘটক; সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ]
⇒ ফেসবুক পেজ, ফেসবুক প্রোফাইল, টুইটার অ্যাকাউন্ট
⇒বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের ফেসবুক গ্রুপ