বেদে সতীদাহ নিরুৎসাহিত করা হলেও পুরাণের যুগে অনেক সতীদাহ
পুলক ঘটক
শ্রীকৃষ্ণের বাবা বসুদেবের ছিল চার স্ত্রী– দেবকী, ভদ্রা, রোহিণী ও মদিরা। বসুদেবের মৃত্যুর পর এই চারজনকেই এক চিতায় পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। সৎকার কার্য করেছিলেন স্বয়ং পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুন –যার কাছে ভগবান গীতার জ্ঞান প্রকাশ করেছিলেন। তবে পার্থ তাদেরকে জোর করে পুড়িয়ে মারেননি। তারা স্বেচ্ছায় স্বামীর সাথে সহমৃতা হয়েছিলেন। শুধু মহাভারতে নয়, শ্রীমদ্ভাগবত এবং বিষ্ণু পুরাণেও এ কাহিনী বর্ণিত আছে।
মহাভারতের মৌষল পর্বে আত্মকলহে যদুবংশ বিনাশের বর্ণনা আছে। সেখানেই আছে যদুকুল রমণীদের বিলাপ এবং চিতায় আরোহণের বিবরণ। মৌষল পর্বের সপ্তম অধ্যায়ে কৃষ্ণের পিতা বসুদেবের মৃত্যুর পর–
তং দেবকী চ ভদ্রা চ রোহিণী মদিরা তথা।অন্বারোহন্ত চ তদা ভর্ত্তারং যোষিতাং বরাঃ।। ১৮।।……………………………তং চিতাগ্নিগতং বীরং শুরপুত্রং বরাঙ্গনাঃ।ততোহন্বারুরুহুঃ পত্ন্যুশ্চতস্রঃ পতিলোকগাঃ।।২৪।।তং বৈ চতনৃভিঃ স্ত্রীভিরন্বিতং পাণ্ডুনন্দনঃ।অদাহরচ্চন্দনৈশ্চ গন্ধৈরুচ্চাবচৈরপি।।২৫।।
অর্থ: “দেবকী, ভদ্রা, রোহিণী ও মদিরা নামে বসুদেবের পত্নীচতুস্টয় তাঁহার সহমৃতা হইবার মানসে দিব্য অলঙ্কারে বিভুষিত ও অসংখ্য কামিনীগণে পরিবেষ্টিত হইয়া তাঁহার অনুগামিনী হইলেন। ঐ সময় জীবদ্দশায় যে স্থান বসুদেবের মনোরম ছিল, বান্ধবগণ সেই স্থানে তাঁহাকে উপনীত করিয়া তাঁহার প্রেতকৃত্য সম্পাদন করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন তাঁহার দেবকী প্রভৃতি পত্নী চতুস্টয় তাঁহাকে প্রজ্বলিত চিতাতে আরোপিত দেখিয়া তদুপরি সমারুঢ় হইলেন। মহাত্মা অর্জ্জুন চন্দনাদির বিবিধ সুগন্ধ কাষ্ঠ দ্বারা পত্নীসমবেত বসুদেবের দাহকার্য্য সম্পাদন করিতে লাগিলেন। (কালিপ্রসন্নসিংহের মহাভারত/মৌষল পর্ব/৭ম অধ্যায় ১৮-২৫)
শুধু বসুদেবের স্ত্রীরা সহমৃতা হয়েছিলেন এমন নয়। কৃষ্ণ, বলরাম এবং তাদের পুত্র-পৌত্রাদি অন্যান্য যাদবশ্রেষ্ঠদের স্ত্রীরাও তাদের নিজ নিজ স্বামীর চিতায় সহমৃতা হয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের ঠিক কতজন স্ত্রী তাঁর চিতায় উঠে জীবনত্যাগ করেছিলেন মহাভারতের বর্ণনায় স্পষ্ট নয়। সেখানে পাঁচজনের নাম –“রুক্মিণী, গান্ধারী, শৈব্যা, হৈমবতী ও দেবী জাম্ববতী ইঁহারা সকলে হুতাশনে প্রবেশ পূর্বক প্রাণত্যাগ করিলেন। সত্যভামা প্রভৃতি কৃষ্ণের অন্যান্য পত্নীগণ তপস্যা করিবার মানসে অরণ্যে প্রবিষ্ট হইয়া ফলমূল ভোজন পূর্বক হিমালয় অতিক্রম করিয়া কলাপ গ্রামে উপস্থিত হইলেন” – উল্লেখ আছে।
বিষ্ণু পুরাণে পরাশর মুনির উদ্ধৃতি অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণের প্রধান আটজন মহিষীর সবাই সহমৃতা হয়েছিলেন। পঞ্চম অংশের ৩৮ অধ্যায়ের ১ থেকে ৪ নম্বর শ্লোক:
“পরাশর উবাচ:অর্জ্জুনোহপি তদান্বিষ্য কৃষ্ণরামকলেবরে।সংস্কারং লম্ভয়ামাস তথান্যেষামনুক্রমাৎ।। ১অষ্টৌ মহিষ্যঃ কথিতা রুক্মিণী প্রমুখাস্তু যাঃ।উপগুহ্য হরের্দেহং বিবিশুস্তা হুতাশনম্।। ২রেবতী চৈব রামস্য দেহমাশ্লিষ্য সত্তম।বিবেশ জ্বলিতং বহ্নিং তৎসঙ্গাহলাদশীতলম্।। ৩উগ্রসেনস্তু তচ্ছ্রত্বা তথৈবানকদুন্দুভিঃ।দেবকী রোহিণী চৈব বিশুর্জাতবেদসম্।। ৪”
অর্থ: “পরাশর বলিলেন- অর্জুন কৃষ্ণ এবং রামের কলেবরদ্বয় এবং অন্যান্য যাদবগণের দেহসকল অন্বেষণ করিয়া ক্রমানুসারে ঔর্দ্ধদৈহিক সংস্কার করাইলেন। ১
রুক্মিণী-প্রমুখা যে আটটি প্রধানা মহিষী কথিত হইয়াছেন, তাহারা সকলেই হরির দেহ আলিঙ্গন করিয়া অগ্নিতে প্রবেশ করিলেন। ২
হে সাধুত্তম! রেবতীও রামের দেহ আলিঙ্গনপূর্বক রামের অঙ্গস্পর্শ আহ্লাদে শীতলবৎ অনুভূত অগ্নিতে প্রবেশ করিলেন। ৩
এই সকল ব্যাপার শ্রবণ করিয়া উগ্রসেন, রোহিণী, দেবকী ও বসুদেব – ইহারাও অগ্নিতে প্রবেশ করিলেন। ৪”
ভাগবতেও শ্রীকৃষ্ণের আটজন স্ত্রী সহমরণে গিয়েছিলেন উল্লেখ আছে। যদুবংশ ধ্বংস এবং কৃষ্ণ ও বলরামের দেহত্যাগের পর তাদের অন্তেষ্টিক্রিয়ার বর্ণনা দেয়া আছে শ্রীমদ্ভাগবতের একাদশ স্কন্দের মৌষল পর্বের ৩১ অধ্যায়ে। কৃষ্ণের পিসতুত ভাই ও সখা অর্জ্জুন যাদবদের অন্তিম সৎকার সম্পাদন করেছিলেন। পার্থ নিজ হাতে সেখানে অসংখ্য যদুকূল রমণীর সতীদাহ সম্পন্ন করেন। ঐ অধ্যায়ের ১৯ ও ২০ নম্বর শ্লোকে বলা হচ্ছে,
১৯। প্রাণাংশ্চ বিজহুস্তত্র ভগবদ্বিরহাতুরাঃ।উপগুহ্য পতীংস্তাত চিতামারুরুহুঃ স্ত্রিয়ঃ।।২০। রামপত্ন্যশ্চ তদ্দেহমুপগুহ্যাগ্নিমাবিশন্।বসুদেবপত্ন্যস্তদ্গাত্রং প্রদ্যুন্মাদীন্ হরেঃ স্নুষাঃ।কৃষ্ণপত্নোহবিশন্নগ্নিং রুক্মিণ্যাদ্যান্তদাত্মিকাঃ।।
ভাগবতের প্রতিটি শ্লোক আনুপূর্বিক পদ্যে অনুবাদের প্রয়াস পেয়েছেন শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর অন্যতম পার্ষদ শ্রীল রঘুনাথ ভাগবাতাচার্য। পণ্ডিতপ্রবর শ্রীমৎ পুরীদাস সম্পাদিত গ্রন্থে ঐ বাংলা পদ্য অনুবাদের ১৯, ২০ এবং ২১ নাম্বার শ্লোকে বলা হচ্ছে:
১৯. পত্নীগণ পতি লৈঞা, চিতার উপরে থুঞা,ভূজপাশে দিয়া আলিঙ্গনে।নিজ-নিজ তনু ছাড়ি’, চলিলা বৈকুন্ঠপুরী,প্রবেশিয়া দীপ্ত হুতাশনে।।২০. কৃষ্ণ-পত্নী অষ্টজন, প্রবেশিলা হুতাশন,বিদর্ভ-দুহিতা-আদি করি’।২১. অর্জ্জুন চিন্তিয়া মনে, কৃষ্ণ-গীতা-সঙরণে,শান্ত হৈলা কৃষ্ণে মন ধরি’।
শ্রীমদ্ভাগবত বৈষ্ণবদের হৃদয়ের ধন; সবচেয়ে আদরণীয় ভক্তিশাস্ত্র। এই গন্থটির টিকাভাষ্য এবং অনুবাদ করেছেন বহু পণ্ডিত। আমি সংস্কৃত, বাংলা এবং ইংরেজি মিলিয়ে ভাগবতের অন্তত ৬টি অনুবাদ স্টাডি করেছি। সকল অনুবাদেই বসুদেব, বলভদ্র ও শ্রীকৃষ্ণসহ শ্রেষ্ঠ যদুবীরদের স্ত্রীগণ সহমরণে গিয়েছিলেন স্পষ্ট বলা আছে।
শ্রী দুর্গাচরণ বন্দোপাধ্যায়ের অনুবাদ:
“স্ত্রীসকল স্বামীদিগকে আলিঙ্গন করিয়া চিতায় আরোহণ করিলেন। রামের পত্নীসকল তাঁহার দেহ আলিঙ্গন করিয়া অগ্নিতে প্রবেশ করিলেন। বসুদেবের কামিনীসকল তাঁহার গাত্রকে; এবং হরির পুত্রবধূসকল প্রদ্যু্ম্ন প্রভৃতিকে আলিঙ্গন করিয়া হুতাশনে প্রবিষ্ট হইলেন। রুক্মিণী আদি করিয়া কৃষ্ণাত্মিকা কৃষ্ণপত্নীসকল অগ্নিতে প্রবেশ করিলেন। শ্রীকৃষ্ণের বিরহে কাতর অর্জ্জুন যথার্থ-বাক্য-সমন্বিতা শ্রীকৃষ্ণের গীতিসকলের দ্বারা আপনাকে সান্তনা করিলেন। অর্জ্জুন নিহত নষ্টবংশ বন্ধুসকলকে আনুপূর্ব্বিকক্রমে পিণ্ড-জলাদি প্রদান করাইলেন।”
এখানে“স্ত্রীসকল”, “রামের পত্নীসকল”, “বসুদেবের কামিনীসকল”, “হরির পুত্রবধূসকল” এবং“কৃষ্ণপত্নীসকল” – এই পদগুলো ব্যবহারে বহুবচনের প্রয়োগ দেখুন। তাদের স্ত্রী যেমন একজন ছিল না, তেমনি তাদের সঙ্গে সহমরণেও গেছেন অগুণতি নারী।
শ্রীযুক্ত শ্যামাকান্ত তর্কপঞ্চানন অনূদিত ভাগবতের ঐ অংশে বলা হচ্ছে –
“দেবকী, রোহিণী ও বসুদেব ইঁহারা কৃষ্ণ-বলরামকে দেখিতে না পাইয়া অত্যন্ত শোকার্ত্ত হইলেন ও স্মৃতিভ্রষ্ট হইলেন। ১৮এবং তাঁহারা ভগবদ্বিরহে অত্যন্ত কাতর হইয়া প্রাণ পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। হে তাত! স্ত্রীগণ পতির দেহ আলিঙ্গন করিয়া চিতারোহণ করিয়াছিলেন। ১৯রামপত্নীগণ রামের দেহ আলিঙ্গন করিয়া অগ্নিতে প্রবেশ করিলেন, বসুদেবপত্নীগণ তাঁহার দেহ আলিঙ্গন করিয়া অগ্নি প্রবেশ করিলেন, শ্রীকৃষ্ণের পুত্রবধুগণ প্রদ্যূম্নাদির দেহ আলিঙ্গন করিয়া বহ্নিতে প্রবেশ করিলেন, আর কৃষ্ণময়প্রাণ রুক্মিণী প্রভৃতি কৃষ্ণপত্নীগণ অগ্নিতে প্রবেশ করিলেন। ২০
কবিবর সুবোধ চন্দ্র মজুমদার ভাগবতের সংশ্লিষ্ট অংশের বাংলা পদ্যানুবাদ করেছেন এভাবে:
“যদুকুল-কামিনীরা আকুলিত মন।নিজ নিজ পতি সবে করে পরশন।।তদন্তর চিতানলে করি আরোহণ।নিজ নিজ পতি সহ হইল দহন।।”
শাস্ত্র অনুযায়ী সতীদাহ দুই প্রকার – ১. সহমরণ ও ২. অনুমরণ। স্বামীর সবদেহ আলিঙ্গনপূর্বক একই চিতায় নারীরা প্রাণত্যাগ করলে তাকে বলে সহমরণ। স্বামী নিখোঁজ হলে বা কোনো কারণে মৃতদেহ না পাওয়া গেলে তার পাদুকা অথবা কোনো স্মৃতিচিহ্ন চিতায় দিয়ে স্ত্রীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হলে তাকে বলে অনুমরণ। বেদ-পুরাণের যুগে সহমরণ ও অনুমরণের অনেক অনেক দৃষ্টান্ত আছে। শাস্ত্রগ্রন্থে সতীদাহের যেসব উদাহরণ আছে তার প্রায় সবই ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় তথা রাজ পরিবারের বিশিষ্টজনদের কাহিনী। বৈশ্য ও শূদ্র তথা আমজনতার মধ্যে এই সংস্কৃতি কতটা প্রচলিত ছিল তা গবেষণার বিষয়।
গত ৫০০ বছরে পরিশীলিত বাঙালি হিন্দু মানস গঠনে মহাকবি কাশীরাম দাসের রচিত বাংলা মহাভারতের অবদান সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। ঐ মহাকাব্যে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর স্ত্রীপর্বে “যুধিষ্ঠিরাদি কর্তৃক স্বজনগণের দেহ-সৎকার” বর্ণনায় কাশীরাম দাশের পয়ার—
“জ্ঞাতিগণে অগ্নি দিল ধর্ম্মের নন্দন।চিতাধূমে অন্ধকার হইল গগন।।অপর যতেক রাজা মৃত কুরুক্ষেত্রে।যুযুৎসু দিলেন অগ্নি রাজ-আজ্ঞামাত্রে।।অস্টাদশ অক্ষৌহিণী হইল দাহন।অনুমৃতা হৈল তাহে কত নারীগণ।।”
এখানে “অনুমৃতা হৈল তাহে কত নারীগণ” বাক্যটি খেয়াল করুন। আগেই বলেছি, যদি মৃতদেহ পাওয়া না যায়, তবে সহমৃতা নয়, শাস্ত্র অনুযায়ী স্ত্রীদের “অনুমৃতা” হতে হয়। মৃতের দেহাংশ, পাদুকা বা স্মৃতিচিহ্ন বুকে ধারণ করে নারীকে চিতায় ওঠানো হয়। উল্লেখ্য, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ অবসানে নিহত বীরদের সঙ্গে সতীদাহের বর্ণনা সংস্কৃত মহাভারতে আমি পাইনি। পণ্ডিত কাশীরাম দাশ মধ্যযুগীয় পঞ্চদশ শতকের কবি। তিনি মহাভারতের আনুপূর্বিক অনুবাদ করেননি। মূল কাহিনীগুলো যথাসম্ভব অক্ষুণ্ণ রেখে নিজস্ব ভাষায় মহাকাব্য রচনা করেছেন। তার এই কাব্যে নারীদের “অনুমৃতা হওয়ার” তথ্য মূলত সমকালীন বাংলায় নারীজীবনের চরম দশার চিত্র।
মহাভারতে সতীদাহের দৃষ্টান্ত অনেক। সেখানে রাজপরিবারের কাহিনীগুলোর মধ্যে পাণ্ডুর অকাল মৃত্যুর পর তার স্ত্রী মাদ্রী’র সহমরণ বেশি আলোচিত। কেউ কেউ যুক্তি দেখান মাদ্রী শোকে দুঃখে দেহত্যাগ করার পর পাণ্ডুর শবদেহের সঙ্গে তাকে একত্রে দাহ করা হয়েছিল। একে সতীদাহ হিসেবে ধরা যায় না। কিন্তু লক্ষণীয়, মহাভারতের ঐ পর্বে সহমরণের উচ্চকিত মাহাত্ম্য উপস্থাপন করা হয়েছে। কে সহমরণে যাবেন, কুন্তী নাকি মাদ্রী – এ নিয়ে দু’জনের রীতিমত প্রতিযোগিতা ও বাহাস দেখানো হয়েছে। কারণ পঞ্চপাণ্ডব তখনো শিশু। গর্ভবতী নারী এবং শিশুসন্তানের জননীর ক্ষেত্রে সহমরণ অথবা অনুমরণ শাস্ত্রে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এছাড়াও রজঃস্বলা অবস্থায় সহমরণেও শাস্ত্রে নিষেধ আছে। স্ত্রী রজঃস্বলা অবস্থায় কারও মৃত্যু ঘটলে মৃতদেহ তাৎক্ষণিক দাহ না করে স্ত্রীর পবিত্র হওয়া পর্যন্ত অন্তত একদিনের জন্য স্বামীর লাশ রেখে দেওয়ার নির্দেশনা শাস্ত্রে আছে।
শুধু মাদ্রী নয়, ভাগবতের বর্ণনা অনুযায়ী কৌরব জননী গান্ধারীও তাঁর স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে অনুমৃতা হয়েছিলেন। ধৃতরাষ্ট্রকে বনের মধ্যে দাবানলে দগ্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করতে দেখে সতী গান্ধারী সেই অনলে অনুমরণের সিদ্ধান্ত নেন। তবে মহাভারতের বর্ণনায় দেখা যায় ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী এবং কুন্তি তিনজন একসাথে বনের মধ্যে ভয়াবহ দাবানলের কবলে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। তারা শেষ জীবনে সন্ন্যাসব্রত নিয়ে তপস্যার জন্য বনবাসী হয়েছিলেন। মহাভারত এবং ভাগবত উভয় গ্রন্থে দেবর্ষি নারদের মুখ থেকে তাদের অন্তিম সময়ের বর্ণনা এসেছে।
ভাগবতের প্রথম স্কন্দের ত্রয়োদশ অধ্যায়ের ৫৭-৫৮ শ্লোকে নারদ বলছেন,
“তস্যান্তরায়ো মৈবাভুঃ সন্ন্যস্তাখিলকর্ম্মণঃ।স বা অদ্যতনাদ্রাজন্ পরতঃ পঞ্চমেহহনি।কলেবরং হাস্যতি স্বং তচ্চ ভস্মীভবিষ্যতি।। ৫৭দহ্যমানেহগ্নিভির্দেহে পত্যুঃ পত্নী সহোটজে।বহিঃস্থিতা পতিং সাধ্বী তমগ্নিমনুবেক্ষ্যতি।।৫৮”
অর্থ: নারদ বলছেন, “অদ্য হইতে পঞ্চম দিবসে তিনি আপন পাঞ্চভৌতিক দেহ ত্যাগ করিবেন; এবং সেই কলেবরও হোমাগ্নি দ্বারাই ভস্মীভূত হইবে; তাঁহার পত্নী বাহিরে থাকার সময় যখন দেখিতে পাইবেন যে, কুটীর এবং পতির দেহ দগ্ধ হইতেছে, তখন তিনি পতির অনুসরণ করিয়া সেই অগ্নিতেই প্রবেশ করিবেন।।”
গান্ধারী অনুমৃতা হয়েছেন বলে মহাভারতে রাজা যুধিষ্ঠিরও উল্লেখ করেছেন। বিজন বনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিজ মাতা কুন্তীর অসহায় মৃত্যুতে আক্ষেপ করে যুধিষ্ঠির বলছেন, “আমি পুত্রবিহীনা জননী গান্ধারীর নিমিত্ত অনুতাপ করি না। তিনি পতির অনুগামিনী হইয়া ভর্ত্তৃলোক লাভ করিয়াছেন।” –সূত্র: মহাভারতের আশ্রমবাসিক পর্ব্ব ৩৮ অধ্যায়।
মোটকথা, সনাতন ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থে সতীদাহ আছে। কি মন্ত্র পাঠ করে নারীকে পোড়াতে হবে, পোড়ানোর পর ঐ নারীর শ্রাদ্ধ-শান্তি কিভাবে হবে, কয়দিন অশৌচ পালন করতে হবে – সেগুলোরও বর্ণনা আছে। শুধু মুঘল আমলে বা ইংরেজ আমলে সতীদাহ হতো – এসব কথা একশ্রেণীর মানুষের মিথ্যাচার। সত্য গোপন করলে বা মিথ্যা বললে ধর্ম হয় না। সত্যই ধর্ম; মিথ্যা ধর্ম নয়। অথচ ইদানীং কেউ সত্য বললে ক্ষিপ্ত হওয়া, চলমান মিথ্যাকে রক্ষায় নতুন নতুন মিথ্যা বলা এবং সাথে গালাগাল করে নিজের আসল ধর্মের পরিচয় দেওয়ার প্রবণতা সমাজে বাড়ছে। দৃশ্যতঃ মনে হচ্ছে, সত্য যেন মানুষ জানতেই চায় না! মিথ্যার মধ্যে বাস করাই বুঝি ধর্ম!
যে সকল শাস্ত্রগ্রন্থে এক বা একাধিকবার স্পষ্টভাবে সতীদাহের উদাহরণ, বিবরণ কিংবা বিধিবিধান আছে তার মধ্যে পরাশর সংহিতা, ব্যাস সংহিতা, দক্ষ সংহিতা, বিষ্ণু সংহিতা, অত্রি সংহিতা, রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত, বিষ্ণু পুরাণ, গরুড় পুরাণ, ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ, পদ্মপুরাণ, দেবীভাগবত, শিবপুরাণ, স্কন্দ পুরাণ, ব্রহ্ম পুরাণ, অগ্নি পুরাণ, কূর্ম পুরাণ, বৃহন্নারদীয় পুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অন্যতম। এসব বই আমি নিজে কমবেশি স্টাডি করেছি; খতিয়ে দেখিছি। এর বাইরেও থাকতে পারে, যা আমার পড়া হয়নি।
চৈতন্য মহাপ্রভুর সমসাময়িক যুগের বাঙালি শাস্ত্রজ্ঞ স্মার্তপ্রবর রঘুনন্দন ভট্টাচার্য্য বঙ্গীয় শাস্ত্রচর্চার দিকনির্দেশক প্রধান পণ্ডিত। তার গ্রন্থগুলো প্রাচীন শাস্ত্র সংকলনের উৎস হিসেবেও ব্যবহার হয়। তিনি তার ‘শুদ্ধিতত্ত্বম’ গ্রন্থে ঋষি পরাশর, ব্যাস, নারদ, অত্রি, জৈমিনিসহ ধর্মশাস্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা অনেক মুনিঋষির উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন, যেখানে সতীদাহের বিধিবিধান আছে। ঐ উদ্ধৃতিগুলোর উৎস আনুপূর্বিক পড়াশোনা করার সুযোগ আমি এখনো পাইনি।
এখন আসি বেদের কথায়। বিশ্বের প্রাচীনতম শাস্ত্রগ্রন্থ ঋগ্বেদে সহমরণের উল্লেখ আছে। তারমধ্যে ১০ম মণ্ডলের ১৮ সূক্তের ৭ নম্বর ঋকটি নিয়ে বিগত ২০০ বছর যাবত শাস্ত্রজ্ঞদের বিতর্ক চলছে। মন্ত্রটি হল,
ইমা নারীরবিধবাঃ সুপত্নীরাঞ্জনেন সর্পিষা সং বিশন্তু।অনশ্রবোহনমীবাঃ সুরত্না আরোহন্তু জনয়ো যোনিমগ্রে (অথবা ‘যোনিমগ্নেঃ’)।।
বিতর্ক হল, এই মন্ত্রের শেষ শব্দটির শেষাংশে ”অগ্রে” হবে, না-কি“অগ্নে” হবে? “যোনিমগ্রে” না বলে যদি“যোনিমগ্নেঃ” বলা হয় তবে মন্ত্রটির অর্থ সম্পূর্ণ বদলে যায়। অতীতে “অগ্নে” পাঠ করা হতো। কিন্তু রমেশচন্দ্র দত্ত দাবি করেছেন “অগ্নেঃ” উচ্চারণটি সঠিক নয়। তিনি ‘অগ্নেঃ’র পরিবর্তে “অগ্রে” শব্দ ব্যবহার করে ঋকটির অর্থ করেছেন,
“এই সকল নারী বৈধব্য দুঃখ অনুভব না করিয়া, মনোমত পতি লাভ করিয়া অঞ্জন ও ঘৃতের সহিত গৃহে প্রবেশ করুন। এই সকল বধূ অশ্রুপাত না করিয়া, রোগে কাতর না হইয়া উত্তম উত্তম রত্ন ধারণ করিয়া সর্বাগ্রে গৃহে আগমন করুন।”
এই অনুবাদ এর পরের ঋকের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ। “অগ্নে” হলে এর অর্থ পরের ঋকের বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়। যদি আগের মতো “অগ্নেঃ” শব্দ ব্যবহার করা হয়, তবে এর অর্থ,
“এইসকল নারী বৈধব্য ক্লেশ ভোগাপেক্ষা ঘৃত ও অঞ্জন অনুলিপ্ত পতিকে প্রাপ্ত হইয়া উত্তম রত্ন ধারণ পূর্বক অগ্নিতে প্রবেশ করুক।”
এই অর্থ ভয়াবহ। মনে রাখতে হবে লিখন পদ্ধতি আবিস্কারের আগে কয়েক হাজার বছর যাবত বেদ ব্রাহ্মণদের মুখে মুখে বাহিত হয়ে এসেছে। সুতরাং উচ্চারণের বৈকল্যে মূল শব্দ বদলে গিয়ে অর্থের পরিবর্তন ঘটতেও পারে। তাই আমি ইতিবাচক অর্থে “অগ্রে” শব্দটিই গ্রহণ করার পক্ষে। সতীদাহের মতো ঘোরকর্মের প্রতি উৎসাহসূচক কোনো শব্দ না থাকাই ভাল।
সুপ্রাচীন ঐ গ্রন্থের পরবর্তী ঋকটি আরও উৎসাহব্যঞ্জক। এটি হল,
“উদীর্ষ্ব নার্ষভি জীবলোকং গতাসুমেতমুপ শেষ এহি।হস্তগ্রাভস্য দিধিষোস্তবেদং পত্যুর্জনিত্বমভি সং বভূথ।।” (ঋগ্বেদ ১০/১৮/৮)
অর্থ: “হে নারি! সংসারের দিকে ফিরিয়া চল, গাত্রোত্থান কর, তুমি যাহার নিকট শয়ন করিতে যাইতেছ, সে গত অর্থাৎ মৃত হইয়াছে। চলিয়া আইস। যিনি তোমার পাণিগ্ৰহণ করিয়া গর্ভাধান করিয়াছিলেন, সেই পতির পত্নী হইয়া যাহা কিছু কর্তব্য ছিল, সকলি তোমার করা হইয়াছে।” (অনুবাদক-রমেশচন্দ্র দত্ত)
এ যেন নারীর মরণের পরিবর্তে জীবনের প্রতি এক অমোঘ আহ্বান। খুবই সুন্দর! তবে এটি প্রাচীনযুগে–ঋগ্বেদের যুগেরও আগে থেকে – সহমরণ প্রথা চালু থাকার একটি নমুনা। যদি সেযুগে সহমরণের প্রথা না থাকত, তবে তাকে নিরুৎসাহিত করে “তুমি যাহার নিকট শয়ন করিতে যাইতেছ, সে গত হইয়াছে। চলিয়া আইস,” – এই কথা বলার মানে কি? স্বামীর চিতায় শয়নের সংস্কৃতি সে যুগে ছিল বলেই তা নিরুৎসাহিত করে মন্ত্র এসেছে। সে যুগে সতীদাহ না থাকলে এ মন্ত্রের আবশ্যকতা থাকে না।
আসলে সহমরণ প্রথা অনেক প্রাচীন। এটা শুধু ভারতবর্ষে ছিল তা নয়। চীন, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপেও সহমরণ ছিল। শুধু স্বামীর চিতায় স্ত্রীকে দাহ করা নয়, মৃত স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীকে কবর দেয়ার কথা ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’র গল্পে আছে। মিসরের ফারাও সম্রাটদের পিরামিডে এবং চীন দেশে মনিবের সঙ্গে দাসদাসীদের কবর দেয়ার প্রমাণ উদ্ঘাটিত হয়েছে।
অথর্ব বেদের অষ্টাদশ কাণ্ডের তৃতীয় অনুবাকেও সতীদাহ প্রসঙ্গ আছে। ঐ অনুবাকের প্রথম সুক্তের প্রথম মন্ত্রে সহমরণের জন্য চিতায় আরোহন এবং এরপর দ্বিতীয় মন্ত্রে নারীকে চিতা থেকে উঠে আসার জন্য জীবনের আহ্বান আছে। সে আহ্বান আরও বলিষ্ঠ। এতে নারীকে শুধু বেঁচে থাকার আহ্বান নয়; যে পৃথিবী থেকে চলে গেছে তার জন্য শোক বা তার জন্য বৈধব্যের কৃচ্ছতা অবলম্বন করে জীবন কাটানোর আহ্বান নয় –বরং পুনরায় বিয়ে করে মধুময় জীবন যাপনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে যুগেও সতীদাহ ছিল এবং তা পরিহার করে জীবনের জয়গান গেয়ে গেছেন বৈদিক ঋষি।
“উদীষর্ব নার্যভি জীবলোকং গত্যসুমেতমুপ শেষ এহি।হস্তগ্রাভস্য দধিষোস্তবেদং পত্যুর্জনিত্বমভি সং বভূথ।।” অথর্ববেদ ১৮/৩/২
অর্থ: হে ধর্মপত্নী, এ জীবলোকের উদ্দেশে পতির কাছ থেকে উঠে এস। যে মৃত পতির কাছে শয়ন করেছ, সেখানে দৃষ্ট প্রয়োজনের অভাবে তার কাছ থেকে চলে এস। তোমার পাণিগ্রহণকর্তা পতি অপত্যাদিরূপে জন্মলাভ করেছে। (অনুবাদ: শ্রী বিজনবিহারী গোস্বামী)
কিন্তু আমরা কি দেখছি? বেদ সতীদাহ নিরুৎসাহিত করছে। কিন্তু তার পরবর্তী যুগে বিভিন্ন পুরাণ ও সংহিতায় (স্মৃতিশাস্ত্রে) সহমরণের উৎসাহ দেয়া হচ্ছে এবং শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের দ্বারাই বহু নজির স্থাপিত হয়েছে। বেদের অনেককিছুতেই স্মৃতিশাস্ত্রের যুগের চেয়ে তুলনামূলকভাবে উৎকৃষ্ট প্রিমিটিভ সভ্যতার লক্ষণ বোঝা যায় –মধ্যযুগে এসে যার নির্মম অধ:পতন ঘটেছিল। পণ্ডিত জিমুৎবাহনের লেখা ‘দায়ভাগ’ গ্রন্থে সেসব বিকৃতযুগের সংহিতাকে অনুসরণ করা হয়েছে – যেখানে সতীদাহ আছে। দায়ভাগে বেদকে সম্পূর্ণরুপে উপেক্ষা করে স্মৃতিশাস্ত্র নির্ভর বিধান দেওয়া হয়েছে।
হিন্দু আইনের পুরাতন বিধিগুলো নিছক প্রথা ও সংহিতানির্ভর; মোটেই বেদনির্ভর নয়। আর ইংরেজদের বানানো কোডিফাইড হিন্দু আইনগুলোতে বেদ বা স্মৃতি কোনোটারই কোনো রেফারেন্স নেই। এ সবই নারীর জন্য ভয়াবহ লাঞ্চনা।
বুঝতে হবে, সনাতন ধর্মের বিধিবিধান স্থান, কাল ও পাত্রভেদে আলাদা এবং পরিবর্তনশীল। এসব বিধান ইসলামের মতো ‘ফরজ’ এবং‘সুন্নত’ স্টাইলে ভাগ করা নেই। এখানে বিধানগুলো উৎসাহব্যঞ্জক অথবা নিরুৎসাহব্যঞ্জক শব্দে বর্ণিত হতে দেখা যায়। এটা করলে স্বর্গে যাবেন, ওটা করলে নরকে যাবেন, এটা বিধেয়, ঐটা অবিধেয় ইত্যাদি স্টাইলে বিবৃত। কিছু ক্ষেত্রে “অবশ্য কর্তব্য” হিসেবে কিছু বিষয় বর্ণিত হতে দেখা যায়। কিন্তু গ্রন্থান্তরে সেই একই বিধানের বিকল্প দেখা যায়। এখানে কোনোটাই বাধ্যতামূলক নয়। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে শাস্ত্রবিধি উপেক্ষা করে যুক্তি ও বিবেকের বাণী অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। সনাতন ধর্মীয় বিধান পরিবর্তনশীল, সম্প্রসারণশীল এবং যুগের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে বলেই এই ধর্ম টেকসই; চিরন্তন –সময়ের স্রোতে বিলীন হওয়ার ধর্ম নয়।
হিন্দু আইনও বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নরকম এবং ইংরেজরা যখন চালু করেছিল তখন থেকে তা বহুবার পরিবর্তন হয়েছে। যে নিয়মে আগে আইন হয়েছে এবং পরিবর্তন হয়েছে, সে নিয়মেই নতুন হিন্দু আইন হবে; পরিবর্তন হবে। নারীরা মানুষ; মানুষ হিসেবে তাদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। যেভাবে সতীদাহ নিষিদ্ধ হয়েছে সেভাবেই নারীর সকল আপদ ও বৈষম্য নিপাত যাবে। জয় মানুষ।
লেখক: সাংবাদিক; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ