বেদে সতীদাহ নিরুৎসাহিত; হিন্দু আইনে বেদের রেফারেন্স নেই
পুলক ঘটক
ইংরেজ আমলে প্রণীত The Sati Regulation Act 1829 একটি গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু আইন। রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে সামাজিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ইংরেজরা এই আইনটি জারি করেছিল। এই আইনের দ্বারা স্বামীর চিতায় স্ত্রীর সহমরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
পৃথিবীর সমাজ পরিবর্তনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হল সহমরণ প্রথার অবসান। সহমরণ প্রথা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে চালু ছিল। শুধু স্বামীর চিতায় স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা নয়, স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীকে কবরে পাঠানোর কাহিনীও সহস্র এক আরব্য রজনীর গল্পে পাওয়া যায়। এগুলো প্রাচীন সামন্তযুগ এবং দাসযুগীয় বর্বর সমাজ ব্যবস্থার নিদর্শন। সে কালে কোথাও কোথাও সামন্তপ্রভূদের মৃত্যু হলে কবরে তাদের সেবাযত্ন করার জন্য দাস-দাসীদেরকেও তাদের সঙ্গে কবর দেয়া হতো।
ভারত উপমহাদেশে সুপ্রাচীন কাল থেকে সতীদাহ প্রথা চালু ছিল। তবে বেদ সতীদাহকে নিরুৎসাহিত করেছে। ঋক বেদ এবং অথর্ব বেদে সতীদাহ নিরুৎসাহিত করে দুটি মন্ত্র আছে। বৈদিক যুগে সতীদাহ চালু ছিল বলেই ঐ দুটি মন্ত্রে স্বামীর চিতায় জীবন বিসর্জন না দিয়ে বিধবাকে পুনরায় পতি গ্রহণে উৎসাহিত করা হয়েছে। সেখানে দেবর/ভাসুর চিতা থেকে সদ্য বিধবাকে নামিয়ে এনে পুনরায় জীবন শুরু করার কথা বলছে। সতীদাহের অস্তিত্ব সে যুগে না থাকলে এই বৈদিক মন্ত্র আসত না।
বেদ বিধিবিধানমূলক গ্রন্থ নয়। ব্যক্তিগত জীবনাচরণ, বিধিবিধান এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আইন সংক্রান্ত নির্দেশগুলি আছে সনাতন ধর্মের সংহিতা শাস্ত্রে। সেই সংহিতা ও পুরাণগুলিতেই সতীদাহের বিধান সুস্পষ্ট। বেদে হিন্দু আইন নেই; সতীদাহের নির্দেশনাও নেই। বেদের কোনো মুনি বা ঋষি মেয়েদের প্রতি বৈষম্য করার হিন্দু আইন বানায়নি। হিন্দু আইনের কোথাও বেদ থেকে কোনো উদ্ধৃতি দেখাতে পারবেন না।
মনুসংহিতা, পরাশর সংহিতা, যাজ্ঞবল্ক সংহিতা, বৃহস্পতি সংহিতা, বিষ্ণু সংহিতা, নারদ সংহিতা, ব্যাস সংহিতা ইত্যাদি বিভিন্ন বিধিবিধানের গ্রন্থ থেকে বিভিন্ন মতামত উদ্ধৃত করে দায়ভাগ ও মিতাক্ষরার মতো গ্রন্থগুলি লেখা হয়েছে। সে সব গ্রন্থের কিছু মতামত ইংরেজ আমলে হিন্দু আইন হিসেবে স্বীকৃত হয়।
তবে সে সব বিধানের বাইরে গিয়েও ইংরেজরা অনেকগুলি কোডিফাইড হিন্দু আইন বানায়। আঞ্চলিক এবং গোষ্ঠীগত প্রথাকেও আইন হিসেবে স্বীকৃতী দেয়। বিভিন্ন আদালতের রায়কেও হিন্দু আইন হিসেবে অনুসরণ করা হয়। এই সবকিছু নিয়েই বিদ্যমান হিন্দু আইন। তাতে বেদের বা বেদের কোনো মুনি ঋষির মতামত নেই।
যে সব ধর্মশাস্ত্রের রেফারেন্স দিয়ে হিন্দু আইন বানানো হয়েছে, সে সব গ্রন্থের প্রায় সবগুলিতে সতীদাহের বিধান আছে। সেসব গ্রন্থে বিবাহ বিচ্ছেদ, নারীর পুন:বিবাহ এবং বিধবা বিবাহের বিধানও আছে। নারীকে ক্ষেত্র হিসেবে ভাড়া দেওয়ার বিধান আছে। মারাত্মক বর্ণবৈষম্য আছে। নারী, শুদ্র এবং চন্ডালকে উচ্চবর্ণের সেবাদাস বানানো হয়েছে এবং কোথাও কোথাও পশুর চেয়েও অধম হিসেবে পরিগণিত করা হয়েছে।
মহাভারত এবং ভাগবতসহ প্রায় সকল পুরাণে সতীদাহের অনেক নজির এবং বিধিবিধান রয়েছে। একদল বাটপার সত্য গোপন করে; মিথ্যাচার করে। সত্যই ধর্ম, মিথ্যা ধর্ম নয়। সতীদাহ অবশ্যই শাস্ত্রে আছে এবং এর প্রচলন প্রাচীনকাল থেকে ছিল। সত্য গোপন করা বা শাস্ত্রবাণী গোপন করা ধর্ম নয়।
লেখক: সাংবাদিক; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ
বৈষম্যের আইন বাতিল করা উচিত।
সত্যই ধর্ম, মিথ্যা ধর্ম নয়। সত্য গোপন করা বা শাস্ত্রবাণী গোপন করা ধর্ম নয়।