ধর্ম বনাম রাষ্ট্র : মধুচন্দ্রিমা কেন মধুময় নয়?

শিশির ভট্টাচার্য্য: শিরোনামে ধর্মকে আগে রেখেছি স্রেফ জ্যেষ্ঠতার কারণে, গুরুত্বের তারতম্যের কারণে নয়। রাষ্ট্রের চেয়ে ধর্ম আগে এসেছে সমাজে। সমাজে প্রথমে ধর্ম সৃষ্টি হয়েছে, তারপর রাষ্ট্র। জানতে ইচ্ছে হতে পারে, ধর্ম ও রাষ্ট্র- এই দুই প্রতিষ্ঠান পরষ্পর সাংঘর্ষিক কিনা।

আলোচনার মূল নীতি ঠিক করে নেওয়া যাক। যে কোনো বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার মূল নীতি হওয়া উচিত আমার মতে: What you think or believe does not matter, what really matters is the matter of the fact and fact of the matter!

আলোচনার প্রথম দিকে ‘ফ্যাক্টস অব দ্য ম্যাটার’-গুলো একে একে তুলে ধরা হবে এবং উপসংহার টানা হবে ‘ম্যাটার অব দ্য ফ্যাক্ট’ দিয়ে।

ধর্ম ও রাষ্ট্র- এই দুই প্রতিষ্ঠানই সমাজের সৃষ্টি, মানুষের মনোজাগতিক প্রয়োজনে। বলা হয়ে থাকে, মানব সভ্যতার বয়স টেনেটুনে হাজার দশেক বছরের বেশি নয়। ধারণা করা হয়ে থাকে, প্রতি বিশ-ত্রিশ হাজার বছরে পৃথিবী উষ্ণ হতে শুরু করে। উষ্ণতা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং আবার এক সময় কমতে কমতে শুরু হয় বরফযুগ। সভ্যতা-টভ্যতা সেই উষ্ণমান সময়টুকুতেই সৃষ্টি হয়। ধরা যাক, বর্তমান উষ্ণকাল শুরু হয়েছে হাজার বিশেক বছর আগে। সবচেয়ে পুরনো গ্রাম ছিল তুরস্কে, হাজার দশেক বছর আগে। কৃষিজীবী সমাজ সৃষ্টি হবার পরেই প্রথাগত ধর্ম এবং সৃষ্টিকর্তার ধারণা সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করা হয়।

পৃথিবীতে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র একটিও নেই, ছিল না কখনও ইতিহাসে। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র একান্তই ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীবিশেষের স্বপ্ন। যত স্বপ্ন ভঙ্গ হয়, তত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় না। মুসলিম-প্রধান রাষ্ট্র আছে, কিন্তু ইসলামিক রাষ্ট্র নেই। হিন্দুদের রামরাজ্য একটি কাল্পনিক প্রপঞ্চ এবং শ্রী রামের উপস্থিতিতে এমন সব অন্যায় হয়েছে তার রাজ্যে যার ভিত্তিতে দাবি করাই যেতে পারে যে এমন রাজ্যস্থাপন শ্রেয় নয়। আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে খুলাফায়ে রাশেদিনের কথা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এই আমলে সাধারণ মানুষ দূরে থাক, অন্য খলিফা ও সাহাবিরাও যে সন্তুষ্ট ছিল না, তার অন্যতম প্রমাণ: ১. দুই খলিফার অপমৃত্যু, একজন নবীর (স.) হাসিমী গোত্রের হজরত আলী (রা.) এবং অন্যজন শামসী গোত্রের হজরত ওসমান (রা.); ২. হাসিমী খলিফা আলী ও শামসী খলিফা হজরত আবু বকরের কন্যা এবং রসুলের (স.) স্ত্রী হজরত আয়েশার (রা.) মধ্যে জামাল বা উটের যুদ্ধ, যে যুদ্ধে হজরত আলীর নির্দেশে হজরত আয়েশার উটের চার পা কেটে দেওয়া হয়েছিল।

হাসিমী আর শামসী- দুই কুরাইশ গোত্রের বিরোধ থেকেই ইসলামের ইতিহাসে দ্বন্দ্বের শুরু। তবু মানুষ যুগে যুগে ধর্মরাজ্যের স্বপ্ন দেখেছে এবং এর সমাজ-মনস্তাত্বিক কারণ নিশ্চয়ই রয়েছে।মুসলিম-প্রধান দেশ হওয়া সত্তেও পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশে ইসলামপন্থী দলগুলো নির্বাচনে জিতে কখনও ক্ষমতায় আসতে পারেনি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার মাত্র সাত বছর পর প্রথম উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী জমিদার খুররম খান পন্নী আওয়ামী লীগের প্রার্থী তার অতি সাধারণ এক ‘ফইন্নী’ প্রজা, সামসুল হকের কাছে গরুহারা হেরেছিলেন। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন পেয়েছিল। ৭০-এর নির্বাচনে আসন-সংখ্যা আরও কমেছিল। বাংলাদেশ হবার পর তাদের ভোটব্যাংক বেড়েছে- এমন প্রমাণ নেই। ধর্মপন্থী দলগুলো পেশিশক্তি প্রদর্শন করে থাকে, ষড়যন্ত্র চলমান রাখে, সামাজিক মিডিয়ায় তারা অতি সক্রিয়, কিন্তু প্রকৃত জনসমর্থন যে তাদের নেই, তার অন্যতম প্রমাণ এই গোষ্ঠীর প্রাপ্ত ভোটের স্বল্পসংখ্যা। তবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্যে ব্যাপক জনসমর্থন যে অপরিহার্য নয়, তার প্রমাণ ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় লেলিনের অক্টোবর বিপ্লব, লিবিয়ায় গাদ্দাফির ক্ষমতা দখল কিংবা ইরানে খোমেনির ইসলামী বিপ্লব।

ধর্ম ও সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব একান্তভাবে বিশ্বাস-নির্ভর। বিশ্বাস ও সন্দেহ উভয়েই মানবমস্তিষ্কের ভিন্ন দুটি মডিউল (ঠিক যেভাবে ভাষাবোধ মানব মস্তিষ্কের একটি মডিউল; বানরের মস্তিষ্কে এই মডিউলটি নেই!)। বিশ্বাস ও সন্দেহ উভয়েরই প্রয়োজন রয়েছে। অন্ধকার ঘরে কিছু দেখা যায় না বলে কালো বিড়ালে বিশ্বাস না করে পারা যায় না। কিন্তু আলোকোজ্জ্বল প্রতিবেশে কালো বিড়ালের অস্তিত্বে বিশ্বাস করাটা বোকামি, যদিও বিশ্বাস করা সহজ বলে অলস ব্যক্তিরা আলোকোজ্জ্বল প্রতিবেশেও বিশ্বাসপ্রবণ থাকতে চান।

আমার ধারণা, বিশ্বাস মডিউলের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের মানবগোষ্ঠী ধীরে ধীরে মৃত্যুপরবর্তী জীবন, আত্মা, অশরীরি অস্তিত্ব ইত্যাদিতে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। এক সময় বহুদেবতা, অনন্য সৃষ্টিকর্তার ধারণাও সৃষ্টি হয়েছিল কোনো কোনো অঞ্চলের মানব সমাজে, তবে সর্বত্র নয়। মানুষের বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজনে, সমাজবিবর্তনের বিশেষ পর্যায়ে বিভিন্ন ধর্মমতের সৃষ্টি হয়েছে।

তবে বিশেষ ব্যক্তি যেমন ধর্ম ছাড়া বাঁচতে পারেন, তেমনি  পুরো সমাজ বা রাষ্ট্রও ধর্ম কিংবা ঈশ্বরবিশ্বাসবিহীন হয়ে থাকা অসম্ভব নয়। চীনে গেলেই এমন একটি সমাজ ও রাষ্ট্র দেখা যাবে চোখের সামনে। ঈশ্বরবিহীন ধর্মও রয়েছে, বৌদ্ধ ধর্ম।

একটি ধর্মে একাধিক ধারার অনুসারী থাকতে পারে, ইসলামে যেমন শিয়া, সুন্নী, আহমদিয়া। খ্রিস্টান ধর্মে ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট, অ্যাংলিক্যান। এই ধারাগুলোকে ‘মাজহাব’ বলা যেতে পারে, যদিও ‘মাজহাব’ শব্দের অর্থ হিন্দি-উর্দুতে ধর্মও বটে। পৃথিবীতে মাজহাব-বৈচিত্র্য লক্ষ্য করার মতো- হাজার হাজার মাজহাব রয়েছে, বহু শত মাজহাব হারিয়েও গেছে গত পাঁচ হাজার বছরে। টিকে থাকা মাজহাবগুলোর মধ্যে কয়েকটিতে মাত্র উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় অনুসারী রয়েছেন। অনুসারী-সংখ্যার উপর নির্ভর করে, কোন মাজহাব ‘ধর্ম’ পদবাচ্য হবে, আর কোনটি নিছক মাজহাবই থেকে যাবে। ‘যে মাজহাব বা সেক্টের সঙ্গে একটা সেনাবাহিনী থাকে, সেটিই ধর্ম বলে স্বীকৃত হয়!’- এমন কথা রগড় বলা হলেও কথাটা মিথ্যা নয় মোটেই।  সেক্ট কিংবা মাজহাব আর প্রতিষ্ঠিত ধর্মের মধ্যে যৌক্তিক কোনো তফাৎ নেই।

‘আকাশের ঐ সুনীল ঢাকনা!’ জনপ্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীতের বাণী। সিংহভাগ ধর্মে পৃথিবী চ্যাপ্টা, আকাশ তার উপর গামলার মতো একটি ঢাকনা যার সিলিঙে সূর্য-চন্দ্র-তারকা খচিত থাকে। সূর্য-চন্দ্র পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরে এবং পৃথিবীই মহাবিশ্বের কেন্দ্র। বাইবেলের দাবি অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তা প্রথম মানুষ আদম ও হাওয়াকে সৃষ্টি করেছিলেন টেনেটুনে হাজার ছয়েক বছর আগে। সৃষ্টিকর্তা কেন জানি শুধু পৃথিবী নিয়ে বিশেষ চিন্তিত এবং মানুষকে সঠিক রাস্তা দেখানোর জন্যে, রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছেন: ‘ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছো বারে বারে, দয়াহীন সংসারে।’

আমার ধারণা, জীবনে অনিশ্চয়তা ও মৃত্যু আছে বলে ধর্ম আছে। প্রকৃতপক্ষে, মৃত্যু হচ্ছে যেকোনো ধর্মবিশ্বাসের জননী, আরবিতে বলা যায়, ‘উম্মুল মাজহাব’। মৃত্যু যতদিন আছে, ততদিন ধর্মও থাকবে, কোনো না কোনো ফর্মে। ধর্ম মাত্রেই বিশ্বাস-নির্ভর। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে বিশ্বাস অপরিহার্য হলেও চিন্তার ইতিহাসে কোনো বিশ্বাসই সত্যে পরিণত হবার উদাহরণ নেই। মানুষের সব বিশ্বাসই কালক্রমে মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যায়। ছোট্ট শিশুও আজ জানে, পৃথিবী গোল। মহাবিশ্বে আমাদের বিশ্ব একটি ধূলিকণার চেয়েও হাজার, লক্ষগুণ ছোট। এর মানে হচ্ছে অতীতের অনেক (ধর্ম) বিশ্বাস ইতিমধ্যে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বাকি অনেক বিশ্বাস ডাহা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র- এমন দাবি অমূলক নয়। কিন্তু মানব জীবন কখনও বিশ্বাসহীন হবে না। আমরা সবাই বিশ্বাস করি, করতে আমরা বাধ্য। ‘সাত দিনে এক সপ্তাহ’, ‘পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ’ জাতীয় মানব জীবনে অপরিহার্য শত শত ধারণা বিশ্বাস বৈ তো নয়।

ধর্মের তুলনায় রাষ্ট্র নবীনতর একটি প্রতিষ্ঠান। সংসদ, রাজার ক্ষমতা সীমিতকরণ ইত্যাদি রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা হয়েছিল ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে শ তিন-চারেক বছর আগে, পুনর্জাগরণ-উত্তর কালে। রাষ্ট্রকাঠামের অন্য দুটি প্রধান উপাদান: রাজনৈতিক দল, পূর্ণাঙ্গ সংবিধান রচনা ইত্যাদি ছিল ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম কর্মসূচি। মানবাধিকার, দাসপ্রথার অবসান, সবার জন্যে রাষ্ট্রের উদ্যোগে বিনামূল্যে শিক্ষা, ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণসহ ফ্রান্সের বিপ্লবী সরকার যুগান্তকারী একেকটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। পৃথিবীর প্রথম আধুনিক জাতিরাষ্ট্র ফ্রান্স এবং শুধু তাই নয়, বর্তমান পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রই কোনও না কোনো ভাবে ফরাসি বিপ্লবোত্তর ফ্রান্সের অনুলিপি। আধুনিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল বিপ্লবপূর্ব যুগের ফরাসি দার্শনিকদের রচনায় এবং বাস্তবায়িত হয়েছিল ফরাসি বিপ্লবে।

ধর্মকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ফ্রান্সের রাজারা অসুবিধায় পড়তেন প্রায়ই- ক্যাথলিক গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দিতে গিয়ে অন্য সব গোষ্ঠী যেমন প্রোটেস্ট্যান্টদের কচুকাটা হতে হতো, কিংবা তাদের ধর্মচ্যুত ঘোষণা করা হতো, অনেকটা আমাদের যুগে পাকিস্তানে আহমদীয়া বা কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের মতো। ফ্রান্সে ক্যাথলিকেরা সংখ্যাগুরু ছিল বলে ফরাসি রাজারা কখনও তাদের অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, হয়তো করতে চায়ওনি। ফরাসি বিপ্লবের আগে পৃথিবীর কোনো অঞ্চলেই ধর্মের উপর রাষ্ট্রের সর্বময় নিয়ন্ত্রণ ছিল না। বিপ্লবী সরকারের দশ বছরের শাসনে খান তিনেক সংবিধান রচিত হয়েছিল। প্রথম সংবিধানেই প্রত্যেক নাগরিকের স্ব স্ব ধর্মপালনের অধিকার স্বীকৃত হয়েছিল এবং একই সাথে রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের বিচ্ছেদও ঘোষণা করা হয়েছিল। এই বিচ্ছেদ ছিল যুগের দাবি। সমকালীন সাহিত্যে আমরা দেখি যে অষ্টাদশ-উনবিংশ শতকের ফ্রান্সে ধর্ম একটি হাস্যকর সামাজিক আচরণে পরিণত হয়েছিল, যাজকেরা ছিল একেকটি হাস্যকর প্রাণী, তাদের পশ্চাদপদ পোশাক, আচরণ ও বক্তব্যে।

বিপ্লবীরা ফ্রান্সের সব গির্জার দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল, গির্জার সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছিল। এই তুঘলকী পরিস্থিতি যদিও বছর দশেকের বেশি স্থায়ী হয়নি, কিন্তু রাষ্ট্র ও ধর্মের এই বিচ্ছেদও কখনও আর জোড়া লাগেনি ফ্রান্সে এবং ফ্রান্সের দেখাদেখি ইউরোপের অন্য সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে। এই বিচ্ছেদ কালক্রমে গণতান্ত্রিক সরকার পরিচালনার অপরিহার্য মূলনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফরাসি ভাষায় ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের এই নিরপেক্ষতার মূলনীতির নাম Laïcité যার চমৎকার বাংলা প্রতিশব্দ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। ফরাসি রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ, যার অর্থ হচ্ছে, নাগরিকেরা তাদের পছন্দমতো যেকোনো ধর্ম পালন করতে পারেন, রাষ্ট্র তাতে কোনো আগ্রহ কিংবা বিরাগ দেখায় না। বাংলাদেশের পাসপোর্টের আবেদন করার সময় আবেদনকারীকে নিজের পৈতৃক ধর্মের উল্লেখ করতে হয়, এখনও। শ দুয়েক বছর আগেই ফ্রান্সে এমন নিয়ম তামাদি হয়ে গেছে। ফরাসি সরকারে কোনো ধর্ম মন্ত্রণালয় নেই। কোনো অনুষ্ঠান শুরু করার আগে ধর্মগ্রন্থ পাঠের নিয়ম নেই। আদালতে ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে সত্যবাদনের প্রতিজ্ঞা করার বাধ্যবাধকতা নেই। কোনো ধর্ম বা ধর্মগোষ্ঠী ফরাসি রাষ্ট্রের মনোযোগ কিংবা প্রণোদনা পায় না। কোনো বিশেষ ধর্মের বিদ্যালয় থাকতেই পারে, কিন্তু এ ধরনের বিদ্যালয়ে কোনো প্রকার রাষ্ট্রীয় সহায়তা প্রদান করা হয় না। যদি তারা রাষ্ট্রের নির্ধারিত সিলেবাস অনুসরণ না করে, তবে এই সব বিদ্যালয়ের সনদও রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত হয় না। এত কিছুর পরও কিন্তু ফ্রান্সের সমাজ ও রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকা চীনের তুলনায় বেশি ছাড়া কম নয়।

পৃথিবীর বেশির ভাগ রাষ্ট্রে বিচিত্র জাতিগোষ্ঠী, ভাষাগোষ্ঠী, ধর্মগোষ্ঠীর বসবাস। মানুষ রাষ্ট্র গঠন করে সুখে থাকার জন্যে, কিন্তু সংখ্যালঘুর ‘সুখের সেই বাড়া ভাতে ছাই দিতে’ ধান্দাবাজেরা ব্যবহার করে সংখাগুরু জনগোষ্ঠীকে। বিচিত্র জাতের ফুলের গাছ থাকাতেই একটি বাগানের সার্থকতা, কিন্তু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী চেষ্টা করে, বাগানে যাতে এক ধরনের গাছই থাকে। রাষ্ট্র এদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে জনবৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যায়, যেমনটা হয়েছে, এখনও হয়ে চলেছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে। বাংলাদেশেও একই প্রক্রিয়া চলমান। এখানে ওখানে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েই চলেছে, আক্রান্ত হচ্ছে সংখ্যালঘুদের ধর্মস্থান। এর ফলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। ভারতে সম্প্রতি নাগরিকত্ব আইন পাশ হবার কারণে এই প্রক্রিয়া আরও বেগবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বিতাড়নের সঙ্গে একটি বিশেষ ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের পক্ষপাতের সম্পর্ক অবশ্যই রয়েছে। বাংলাদেশ সংখ্যালঘু শূন্য হয়ে গেলে সংখ্যালঘুর ক্ষতি তাতে সাময়িক, এক প্রজন্মেই সেই সব পরিবারের ক্ষতি পুষিয়ে যাবে, কিন্তু সংখ্যাগুরুর ক্ষতি হবে দীর্ঘমেয়াদী, শিক্ষা ও সংস্কৃতিসহ জীবনের সবক্ষেত্রে। দেশভাগ উত্তর সময়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দুদের বিতাড়িত করাতে এই অঞ্চলে শিক্ষা ও সংস্কৃতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে- এমন কথা অনেকেই জনান্তিকে বলে থাকেন। জনবৈচিত্র্য একটি দেশের জন্যে সম্পদ, বৃক্ষবৈচিত্র্য যেমন সম্পদ একটি উদ্যানের। অন্য সব সম্পদের মতো জনবৈচিত্র্য রক্ষারও দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হয়। বাট্রান্ড রাসেল বলেছেন, রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব, সংখ্যালঘুর স্বার্থরক্ষা করা। সংখ্যাগুরুর ব্যাপারে রাষ্ট্রের চিন্তিত হবার কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ নিজেদের স্বার্থ তারা নিজেরাই রক্ষা করতে পারে, সংখ্যাগুরুত্বের জোরে।

সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে বিশেষ সুবিধা দেওয়াটা যৌক্তিক নয় এ কারণে যে সংখ্যাগুরু কিংবা সংখ্যালঘু হওয়াটা একান্তই কাকতালীয় ব্যাপার। সীমান্ত ব্যাপারটাই কৃত্রিম। সীমান্তরেখাটা কোথায় গিয়ে পড়েছে, তার উপর নির্ভর করে একটি গোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু নাকি সংখ্যাগুরু বিবেচনা করা হবে। বাংলাদেশের একজন মুসলমান কয়েক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়েই সংখ্যালঘু হওয়ার স্বাদ নিতে পারে, মায়ানমার কিংবা ভারতে গিয়ে। যেদিন থেকে তথাকথিত জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রথা শুরু হয়েছে সেদিন থেকে সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরুর প্রশ্ন উঠছে। আজ থেকে শ চারেক বছর আগে মানুষ যখন একেকটি সাম্রাজ্যের অধিবাসী ছিল, তখন কোনো গোষ্ঠীর সদস্য-সংখ্যার গুরুত্ব কিংবা লঘুত্ব ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। যৌক্তিক দিক থেকে দেখলে, সংখ্যাগুরুত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ মানবাধিকারেরও পরিপন্থী, কারণ সখ করে কেউ সংখ্যালঘু হয় না।

রাষ্ট্র মাত্রেরই ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া উচিত। ধর্মনিরপেক্ষতা যে রাষ্ট্রের নীতি নয়, সেটি কখনই আদর্শ রাষ্ট্র হতে পারে না। যে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ নয়, সে রাষ্ট্র অবশ্যই পশ্চাদপদ। ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে যে রাষ্ট্র যত দূরে, সে রাষ্ট্র জনবৈচিত্র্য ধ্বংস করার পথেও তত এগিয়ে। যে জনবৈচিত্র্য রাষ্ট্রের অমূল্য সম্পদ, সেটি ধ্বংস করা কোনো কাজের কথা হতে পারে না। জনবৈচিত্র্যসহ রাষ্ট্রের যাবতীয় সম্পদ রক্ষা করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব বটে।

সোনার পাথরবাটি যেমন হয় না, তেমনি রাষ্ট্রেরও কোনো ধর্ম থাকতে পারে না। এর কারণ, রাষ্ট্র নিজেই একটি ধর্ম। রাষ্ট্রের নিজের গ্রন্থ আছে: সংবিধান; প্রার্থনামন্ত্র আছে: জাতীয় সঙ্গীত; পরিচয় চিহ্ন আছে: পতাকা কিংবা শাপলা ফুল; প্রবর্তনের সময় আছে: ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ। এই বিশেষ তারিখে নির্ধারিত হয়ে গেছে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি কারা নির্মাণ করেছে এবং কাদের সেই বিশেষ রাষ্ট্রে থাকার অধিকার রয়েছে। মুসলমান এবং কাফেরের আচরণ ইসলাম ধর্মে কমবেশি নির্ধারিত। বাংলাদেশের নাগরিক হবার শর্তগুলোও ৭২-এর সংবিধানে নির্ধারিত। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ- সংবিধানের এই চতুর্মূলনীতিতে যাদের বিশ্বাস নেই, তাদের বাংলাদেশে থাকার কোনো অধিকার নেই। এমন ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী দেশত্যাগ করে পছন্দমতো দেশে চলে গেলেই চিরদিনের মতো ঝামেলা চুকে যায়, তাদের এবং দেশের।

ধর্মে জোরজবরদস্তির স্থান নেই- বলা হয়, মানা হয় না। রাষ্ট্রধর্মে প্রয়োজনে জোরজবরদস্তি করার পূর্বনজির আছে। পৃথিবীর কোনো দেশে স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি নেই, থাকতে পারে না। বাংলাদেশ পৃথিবীতে একমাত্র ব্যতিক্রম। স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি এই দেশে বহাল তবিয়তে আছে শুধু নয়, রাষ্ট্রক্ষমতায় জাঁকিয়েও বসেছে একাধিক বার। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পাবার জন্যে স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তির সঙ্গে আঁতাত করতেও বাধ্য হয়েছে অতীতে। এটা অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ব্যর্থতা।

রাষ্ট্র অন্য ধর্মকে সহ্য করে, কিন্তু অন্য কোনো ধর্মকে নিজের ব্যাপারে নাক গলাতে দিতে পারে না। যদি দেয়, তবে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব হবে না। সম্ভব না হবার কারণ বলার অপেক্ষা রাখে না- খ্রিস্টান ধর্মের নিয়মে কি বৌদ্ধধর্ম পালন করা যাবে? সুতরাং রাষ্ট্র কীভাবে চলবে বা না চলবে কিংবা রাষ্ট্র ভাস্কর্য নির্মাণ করবে কি করবে না, ধর্মগুরুরা সেটা নির্ধারণ করবেন না, সেই ধর্ম সংখ্যাগুরুর ধর্ম হলেও না। সংখ্যাগুরুর মতই যে সর্বোত্তম হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। হিটলারের জার্মানিতে সংখ্যাগুরু জার্মানরা সংখ্যালঘু বেদে-ইহুদি-কমিউনিস্টদের কচুকাটা করেছিল এবং সেটা নিশ্চয়ই ভালো কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না।

রাজা-মহারাজারা ধর্মগুরুদের বক্তব্য মানতেন হয়তো এককালে, কিন্তু ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই (ফরাসি বিপ্লব) তারিখ থেকে সেই ঐতিহ্য বাতিল হয়ে গেছে। কোনো রাষ্ট্রপ্রধান যদি রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মগুরুদের মতামতের অপেক্ষা করেন, ধর্মগুরুদের তেল দিয়ে চলেন, তবে নিজের কবর তিনি নিজেই খুঁড়ছেন এবং রাষ্ট্রকে মধ্যযুগে পিছিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করছেন।

রাষ্ট্রের নিজস্ব চিন্তাভাবনা, সিদ্ধান্ত থাকবে, থাকতেই হবে। রাষ্ট্র যদি মনে করে, মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-মনোজাগতিক পরিবর্তন কিংবা নগরের সৌন্দর্য বর্ধনের প্রয়োজনে ভাস্কর্য নির্মাণ করা দরকার, তবে রাষ্ট্র তা করতেই পারে। রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত যদি রাষ্ট্রস্থ কোনো ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তবে রাষ্ট্রের দাবিই অগ্রগণ্য হবে, হওয়াটাই যৌক্তিক। এমন পরিস্থিতিতে নজরুল হয়তো লিখতেন: ‘গাহি রাষ্ট্রের গান। রাষ্ট্রের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!’

রাষ্ট্রপিতার স্মৃতি কিংবা অবদান জনমানসে জাগরুক রাখার জন্যে রাষ্ট্র যদি তাঁর ভাস্কর্য নির্মাণের প্রয়োজন বোধ করে, তবে রাষ্ট্রকে অবশ্যই সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। শুধু দেখতে হবে, সিদ্ধান্তটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা। সংবিধানে নিষেধ না থাকলে প্রয়োজন অনুযায়ী রাষ্ট্র যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার হকদার।

বাংলাদেশের জন্মেরও আগে থেকে বিভিন্ন রাষ্ট্র রাস্তাঘাটে ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়ে আসছে এবং এর মধ্যে মুসলিম-প্রধান দেশও একাধিক আছে, যার মানে হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকারের ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত অভূতপূর্ব নয়। রাষ্ট্রের এই কর্মসূচিতে যারাই বাধা দিতে আসবে, রাষ্ট্র বিনা দ্বিধায় এবং অনতিবিলম্বে তাদের দমন করতে হবে। ফরাসি বিপ্লবের পর নতুন ফরাসি রাষ্ট্রের সঙ্গে যারা একমত ছিল না, তাদের দেশত্যাগ করতে হয়েছিল মৃত্যু এড়াতে। বাংলাদেশে রাজাকারদের ক্ষমা করা হয়েছিল এবং যে কোনো বুনিয়াদী বেঈমানের মতো তারা এবং তাদের উত্তরপুরুষেরা বিস্মৃত হয়েছে যে কোনো ক্ষমাই অপরাধীকে একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করার অধিকার দেয় না।

‘ধর্মম পনসসদৃসম’- অর্বাচিন সংস্কৃতে রচিত এই শ্লোকের অর্থ হচ্ছে কাঁঠালের সঙ্গে ধর্মের মিল রয়েছে। কাঁঠালে ভূতি থাকে, কোয়া থাকে, আঠাও থাকে বৈকি। তিন মানসিকতার লোক থাকে সমাজে: মুক্তপন্থী, রক্ষণপন্থী ও উগ্রপন্থী। এই তিন ধারার আবার তিনটি করে উপধারা রয়েছে (মুক্তবাজ, মুক্তবাদী, মুক্তশীল) (রক্ষণবাজ, রক্ষণবাদী, রক্ষণশীল) (উগ্রবাজ, উগ্রবাদী এবং উগ্রশীল)। উগ্রবাজেরাই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া।

‘বাজ’ প্রত্যয়ের অর্থ হচ্ছে, উগ্রতাকে তারা নিজেদের উপায় হিসেবে ব্যবহার করে। কাঁঠালের স্বাদু কোয়াটা নিজে খেয়ে ক্রমাগত বিস্বাদ ভূতি কিংবা আঠা খাইয়ে খাইয়ে উগ্রশীলদের উত্তেজিত করে উগ্রবাদীতে পরিণত করতে সক্রিয় হয় তারা, যাতে নিছক তাদের সংখ্যার জোরে রাষ্ট্রক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা যায়। কোনো রাষ্ট্রে মুক্তপন্থী ও রক্ষণপন্থীদের তুলনায় উগ্রপন্থীর সংখ্যা অধিক হলে সেই রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।

ধর্মীয় উগ্রপন্থী মাত্রেই ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ মানে ‘ধর্মহীনতা’- বলে থাকে উগ্রপন্থীরা। এই কথা বলার কারণ আছে তাদের দিক থেকে। কোনো রাষ্ট্র ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ না হবার অর্থ হচ্ছে, সেই বিশেষ রাষ্ট্র সংখ্যাগুরু ধর্মগোষ্ঠী (কিংবা গোষ্ঠীগুলোকে) বেশি সুবিধা দেবে। রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে সংখ্যাগুরু ধর্মগোষ্ঠী যা খুশি তাই করতে পারে, ভিন্ন মতাবলম্বীকে খুন করতে পারে, সংখ্যালঘু ধর্মগোষ্ঠীকে কচুকাটাও করতে পারে। এরও সহজাত সমাজমনস্তাত্ত্বিক কারণও রয়েছে বৈকি।

ঘৃণা বনাম ভালোবাসা- মানুষের এই দুটি প্রবৃত্তির মধ্যে প্রথমটি (প্রধানত) সহজাত এবং দ্বিতীয়টি (প্রধানত) অর্জিত। মানুষকে (কিংবা কোনো প্রাণীকে) ঘৃণা করা শেখাতে হয় না। নিজের অস্তিত্বের স্বার্থে প্রাণীমাত্রেই অন্য প্রাণীকে ঘৃণা করে, কারণ দ্বিতীয় প্রাণী থাকা মানেই হচ্ছে নিজের ভোগে কম পড়ে যাওয়া যখন কিনা জীবনরক্ষার জন্যে ভোগ অপরিহার্য। পক্ষান্তরে ভালোবাসতে শেখাতে হয়- বিশেষ করে পারিবরিক ও সামাজিক পরিবেশে থাকতে থাকতেই মানুষ ভালোবাসতে শেখে। তেমন পরিবেশের ব্যবস্থা যদি রাষ্ট্র না করতে পারে, তবে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সহজাত ঘৃণা ধর্ম, বর্ণ, অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক শ্রেণী ইত্যাদি ঠুনকো অজুহাতকে অবলম্বন করে অতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠে- এমন উদাহরণ প্রচুর।

কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি রাষ্ট্র আগ্রহ দেখাতে পারে না, কারণ রাষ্ট্রের কর্তব্য, মানুষে-মানুষে ঘৃণা প্রশমিত এবং ভালোবাসা উজ্জীবিত করে সকলের বাসযোগ্য একটি আদর্শ সমাজ সৃষ্টি করা। বিশেষ একটি ধর্ম কিংবা গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করলে রাষ্ট্রের পক্ষে এই কর্তব্যটি পালন করা সম্ভবই হবে না। ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী যেভাবে খুশি নিজ নিজ ধর্ম পালন করুক, রাষ্ট্রের কিছু বলার থাকবে না তাতে। কিংবা কোনো বিশেষ ব্যক্তি ধর্ম পালন না করতে চাইলেও রাষ্ট্র তাতে বাধা দেবে না। মোট কথা হচ্ছে, ধর্মের ব্যাপারে রাষ্ট্র সব সময় মুখে কুলুপ এঁটে থাকবে। এটা রাষ্ট্রের অন্যতম modus operandi কিংবা কার্যনীতি।

কিন্তু ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণীভিত্তিক একটি গোষ্ঠী যদি অন্য একটি গোষ্ঠী দ্বারা আক্রান্ত হয়, তবে রাষ্ট্র দুর্গতকে রক্ষা এবং দুর্জনকে দমন করবে। সুতরাং শব্দটা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ হলেও এর অন্তর্নিহিত অর্থ কিন্তু ‘গোষ্ঠীনিরপেক্ষতা’। রাষ্ট্রকে প্রধানত দুই কারণে যে কোনো (ধর্ম/বর্ণ/শ্রেণি) গোষ্ঠীর প্রতি নিরপেক্ষ থাকতেই হবে। এর মধ্যে মুখ্য কারণ হলো জন (বৈচিত্র্য) রক্ষা। গৌণ কারণ হলো, উজানে আগেও একবার বলেছি, রাষ্ট্র নিজেই যেহেতু একটি ধর্মসদৃশ প্রতিষ্ঠান, সেহেতু কোনো একটি ধর্ম যার নিয়মগুলো কমপক্ষে হাজার বছরের পুরনো, সেই সব নিয়ম অনুসারে রাষ্ট্রের মতো একটি আধুনিক প্রতিষ্ঠান চালানো অসম্ভব।

কোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা বলে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই। ব্যক্তি তার মনমানসিকতায় ধর্মনিরপেক্ষ হতেও পারে, নাও হতে পারে। কিন্তু সেই একই ব্যক্তি যখন কোনো রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকবে, তবে তাকে ধর্মনিরপেক্ষভাবেই কাজ করতে হবে, অর্থাৎ বিশেষ ধর্মের ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীকে বেশি সুবিধা দিলে তিনি অন্যায় করবেন। এমন ব্যক্তি অবশ্যই থাকবে এবং এই সব অন্যায় দমন করতে হলে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটির ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া অপরিহার্য। ‘আপনি আচরি ধর্ম পরকে শিখাবে!’ রাষ্ট্র নিজেই যদি বিশেষ ধর্মগোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাত করে, তবে সে কোন মুখে অন্য ধর্মগোষ্ঠীর প্রতি কৃত অন্যায় নিবারণ করবে? রাষ্ট্রের এই অপারগতার ফলে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী আক্রান্ত হবে এবং রাষ্ট্র তাদের রক্ষা করতে পারবে না। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে এই পরিস্থিতি চলমান রয়েছে দেশভাগেরও আগে থেকে। এই অঞ্চলে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী দেশত্যাগী হতে বাধ্য হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সামনের দিনগুলোতে জনবৈচিত্র্য ক্রমাগত ঝুঁকির মুখের পড়বে। এই পরিস্থিতির প্রজন্মব্যাপী কুফলের কথা উজানে বলা হয়েছে।

ধর্মের নিয়ম টায়ে টায়ে অনুসরণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব হয় না কেন? কেন পৃথিবীতে ধর্মরাজ্য নেই, কখনও ছিল না কেন? উত্তর অতি সোজা এবং কারণটি প্রাকৃতিক। আপনার শৈশবের পোশাক কি আপনার গায়ে লাগবে? শৈশবের পোশাক আপনাকে পরাতে হলে হয় পোশাকটাকে কাটতে হবে, নয়তো আপনার শরীরটাকে। ‘পসন্দ আপকা!’

মানব-সমাজ প্রতি মুহূর্তে বিবর্তিত হচ্ছে, কিন্তু ধর্মের নিয়মগুলো অপরিবর্তনীয়, চিরস্থির। দুই-তিন হাজার বছর আগের নিয়ম দিয়ে কীভাবে আধুনিক একটি সমাজকে চালানো যাবে? পক্ষান্তরে যে গ্রন্থের ভিত্তিতে রাষ্ট্র চলে, সেই সংবিধানে সংশোধনী আনা যায় সবার সম্মতিতে। সময়ের পরিবর্তনের ফলে যা কিছু অযৌক্তিক মনে হয়, সংবিধান থেকে সেসব বাদও দেওয়া যায়। ধর্মের ক্ষেত্রেতো সংযোজন-বিয়োজন অচিন্তনীয়।

রাষ্ট্রনায়কেরা ধর্মের নির্দেশ মানেননি নিজের স্বার্থে কিংবা ইচ্ছায়- এমন উদাহরণ ইসলামের ইতিহাসেই রয়েছে। প্রায় এক শতাব্দী স্থায়ী উমাইয়া খিলাফতের সময়ে প্রতি শুক্রবারের খোৎবায় সাম্রাজ্যের মসজিদে মসজিদে ‘আলভী’ অর্থাৎ হজরত আলীর (রা.) বংশধরদের অভিসম্পাত করা হতো (স্মর্তব্য যে মুয়াবিয়ার (রা.) দাদী ছিলেন হিন্দা যিনি ওহুদ যুদ্ধে শহীদ হামজার (রা.) কলজে চিবিয়ে খেয়েছিলেন!) রাষ্ট্রীয় নির্দেশে। এটা উমাইয়া বংশের খলিফাদের এমন এক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, কোনো বিচারেই ইসলাম যা অনুমোদন করতে পারে না।

এই সিদ্ধান্ত আলেমরা এক শ বছর ধরে মেনেছিলেন, মানতে বাধ্য হয়েছিলেন, কারণ উমাইয়ারা শক্তিশালী শাসক ছিলেন এবং কাউকে সহজে ছাড় দেবার পাত্র ছিলেন না।

সত্যি বলতে কী, ধর্ম ও রাষ্ট্রের নিয়মগুলো স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে পরষ্পর সাংঘর্ষিক। যেমন ধরুন, ধর্মের নিয়ম অনুসারে মিথ্যা বলা যায় না (যদিও সব তথাকথিত ধার্মিকই মিথ্যা বলে, কিংবা অবিশ্বাসীরা বলতে পারেন, ধর্মের নিয়মগুলোতেও অসত্যের নানা আভাস রয়েছে)। সত্য হওয়া উচিত ‘এক’, মিথ্যা হয়ে থাকে ‘অনেক’। পৃথিবীতে হাজার হাজার ধর্ম আছে এবং এর সবগুলো সত্য না হবারই কথা, অথচ প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীরাই দাবি করেন, শুধু তাদের ধর্মই সত্য। এমন অদ্ভুত দাবি কি রাষ্ট্রের আদালতে টিকবে? রাষ্ট্র ও ধর্ম সাংঘর্ষিক হবার এটাও একটা প্রমাণ। প্রতিদিনই মিথ্যার বেসাতি হয় রাষ্ট্রের আদালতে, ধর্মগ্রন্থের উপর হাত রেখে শপথ করার অব্যবহিত পরেই। প্রমাণ যতক্ষণ না পাওয়া যাচ্ছে, মিথ্যাই ততক্ষণ পর্যন্ত সত্য, রাষ্ট্রের চোখে। ইসলাম ধর্মে সুদ গ্রহণ ও প্রদান নিঃসন্দেহে নিষিদ্ধ, কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রের অর্থনীতি শতভাগ সুদনির্ভর। এই হারাম অর্থনীতির অর্থে নিত্য শরীর পুষ্ট করা কি হালাল হতে পারে? আধুনিক রাষ্ট্রে বাস করে শতভাগ ধার্মিক হওয়া প্রায় অসম্ভব বলা চলে।

ধর্মকে মাথায় রেখে রাজনীতি করলে কী বিপদ হতে পারে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অন্যতম দৃষ্টান্ত। পরিবারের লোকজন, ভারত সরকার, বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি, অবশ্যই দেশের স্বার্থে। ধর্মমুখী এবং জীবন-বিমুখ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বহাল রেখেছিলেন জেনেশুনেই। ব্যক্তিগত বিশ্বাসে খাঁটি মুসলমান বঙ্গবন্ধু কারাগারে নিয়মিত নামাজ পড়তেন, সন্ধ্যায় ভাসানীর কাছে কোরানের ব্যাখ্যা শুনতেন, কিন্তু সামসুল হকের মতো সারা রাত ধরে উচ্চস্বরে জিকির করে অন্যের ঘুমের সাড়ে বারোটা বাজাতেন না। বঙ্গবন্ধুর স্থির বিশ্বাস ছিল, মুসলমান এক বারই মরবে। ২৫শে মার্চ কিংবা ১৫ই আগস্টের রাতে অরক্ষিত ৩২ নম্বরে অকুতোভয়ে অবস্থান করার সাহসের উৎস এই বিশ্বাস। কিন্তু এই একই লোক রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাইতেন, ‘আমার সোনার বাংলা’ শুনে অশ্রুসিক্ত হতেন। ইসলাম ও বাঙালিত্ব বিন্দুমাত্র সাংঘর্ষিক ছিল না বঙ্গবন্ধুর মননে-আচরণে।

প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের স্বার্থে বঙ্গবন্ধু কাউকে এক বিন্দু ছাড় দিতেন না, ছেড়ে কথা কননি সৌদী বাদশাকেও। বাঙালিত্ব এবং ইসলাম- এই উভয়ের এক চমৎকার মিশ্রণ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু এই মিশ্রণ বঙ্গবন্ধু কিংবা তার সরকারকে রক্ষা করতে পারেনি। ইতিহাস স্বাক্ষী, তার অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র কয়েক দশকের জন্যে পথভ্রষ্ট হয়েছে। রাষ্ট্রপরিচালনায় যুগান্তরের নিয়ম না মানার ক্ষতি দেশপ্রেম কিংবা জনপ্রিয়তা দিয়ে পুষিয়ে দেওয়া যায় না। নিজের ধর্ম বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয়, কিন্তু একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বিশেষ একটি ধর্মের কথা মাথায় রেখে রাষ্ট্রপরিচালনা করার অর্থ ছিল, রাজনীতিবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে আগুন নিয়ে খেলা। এই খেলায় সাময়িকভাবে লাভের মুখ দেখা গেলেও দীর্ঘমেয়াদে লোকসানই হয় এবং সেই লোকসান গুনতে হয় দেশ ও জাতিকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।

১৯৭২ এর সংবিধানে চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। এরশাদ সরকার ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেছিল, এখনও যা বহাল আছে। রাষ্ট্রধর্মের ধারণাটা, উজানে বলেছি, সোনার পাথরবাটি, স্রেফ মানুষকে ধোঁকা দেবার জন্যে এরশাদ এই অপকর্মটি করেছিল। রাষ্ট্রের যেমন কোনো ধর্ম হয় না, তেমনি ধর্মেরও কোনো রাষ্ট্র হয় না। তেলে জলে মেশে না- মেশাতে গেলে একদিকে জল যেমন পানযোগ্য থাকে না, অন্যদিকে জলমেশানো তেল কড়াইতে দিলে আগুন ধরে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তথাকথিত রাষ্ট্রধর্মের এই বিধান ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়া সত্তেও আওয়ামী লীগ সরকার সমস্যাটি সমাধান করতে পারেনি, তাদের ভাষ্য অনুসারে, অস্থিতিশীলতা এড়াতে, যেহেতু এমনিতেই অন্ধকারের শক্তি দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্যে মুখিয়ে আছে। এই অজুহাত মিথ্যা নয়, কিন্তু ব্যর্থতা ঢাকার জন্যে কোনো অজুহাতই যথেষ্ট নয়।

যেহেতু ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ সেহেতু বিশেষ কোনো ধর্মকে খাতির করা রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে সমীচীন নয়। রাষ্ট্র যদি এই ভুল এক বারও করে, তবে সুযোগসন্ধানীরা লাই পেয়ে মাথায় চড়ে বসার সুযোগ ছাড়বে না। ধর্মকে ব্যবহার করে তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পাঁয়তারা করবেই করবে। সত্যি বলতে কী, ক্ষমতাই এই গোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য, ক্ষমতা দখলের হাজার উপায়ের মধ্যে ধর্ম তাদের কাছে একটি উপায় মাত্র। লক্ষ্য অর্জিত হলে ধর্মকেও ছুঁড়ে ফেলতে তারা দ্বিধা করবে না। ইতিহাসে এই ঘটনা বার বার ঘটেছে। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ উভয় দলই এই একই ভুল করেছে, একাধিক বার। ইতিহাসের ভুলের পুনরাবৃত্তি হওয়াটা দস্তুর বটে। সরকারি সিদ্ধান্তে ধর্ম ও রাষ্ট্রকে গুলিয়ে ফেলার ভুলের মাসুল দিতে হতে পারে দেশ ও জাতিকে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।

তবে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ যে প্রয়োজনে কঠোর ও কৌশলী হতে জানে, সেটাও অস্বীকার করছি না। ধর্ম ও রাষ্ট্রের সংঘর্ষের ইতিহাসে বর্তমান সরকারের কমপক্ষে দুটি রণকৗশল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। একটি ৫ মে ২০১৩ তারিখে মতিঝিলে গভীর রাতে নিদ্রালু প্রতিপক্ষকে বিকট শব্দ দিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত করে বিনা রক্তপাতে পলায়নে বাধ্য করা। দ্বিতীয়টি অতি সম্প্রতি, ২ মে ২০২০ তারিখে আঙ্কারা ও ঢাকায় বঙ্গবন্ধু ও আতাতুর্কের মূর্তি স্থাপনের ঘোষণা। দুটিতেই প্রতিপক্ষ আক্ষরিক অর্থে অ-বাক হয়ে পরাজয় বরণ করেছে। উভয় সিদ্ধান্তই সুচিন্তিত, সঠিক এবং সময়োপযোগী ছিল। যুগান্তরের প্রবাদ ‘যেমনি বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল’ কিংবা ‘শক্তের ভক্ত, নরমের যম’, ইত্যাদি আবারও সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

উজানের facts of the matter-এর ভিত্তিতে এবার matter of the fact নির্ণয় করা যাক। ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধুচন্দ্রিমা কিংবা ‘হানিমুন’ জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্যে একান্ত ‘হানিকর’। ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা বলছে, এই দুইয়ের মধ্যে ক্ষীণতম আঁতাত নাগরিকের জন্যে কোনো প্রকার মঙ্গল বয়ে আনে না। শুধু তাই নয়, ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধুর মিলন রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে পর্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। As a matter of fact, মধুচন্দ্রিমা কদাপি নয়, ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে চিরবিচ্ছেদই কাম্য। এই বিচ্ছেদের ইদ্দতকাল কদাপি শেষ না হলেই বেচারা জনগণের ইজ্জতটা চিরকালের জন্যে বেঁচে যায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ