ইমতিয়াজ মাহমুদ: বাংলাদেশে ম্রো জনগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা খুব বেশী নয়। অফিশিয়াল পরিসংখ্যান জানিনা- আমি যেটা জেনেছি যে বাংলাদেশ ম্রোদের সংখ্যা বিশ হাজারের মত, কেউ কেউ বলেন যে সংখ্যাটা আরেকটু বেশী হবে। হোক, বেশী হলেই আর কত হবে? বাংলাদেশে যে কয়টা জনগোষ্ঠী আছে, তাদের মধ্যে এই জনগোষ্ঠীটি জনসংখ্যার দিক দিয়ে খুবই ক্ষুদ্র। গতকাল ওরা একটা অসাধারণ প্রতিবাদ কর্মসূচী করেছে। কালচারাল শোডাউন। আজকের খবরের কাগজে আপনারা দেখেছে, শত শত ম্রো আদিবাসী ওদের ট্র্যাডিশনাল পোশাকে ট্র্যাডিশনাল বাদ্য যন্ত্র নিয়ে জড়ো হয়েছে- বাঁশির সুরে, ঢোলের তালে সঙ্গীত ও কান্নায় ওরা পৃথিবীর সকলের কাছে ফরিয়াদ জানিয়েছে- আমাদের ভূমিতে আমাদেরকে বাঁচতে দাও, আমাদেরকে আমাদের ভূমি থেকে তাড়িয়ে দিও না।
আদিবাসী শব্দটায় আমাদের সরকারের আপত্তি আছে, সরকার সমর্থক ও সরকার বিরোধী অনেক বাঙালীরই এই শব্দটিতে আপত্তি আছে। ঠিক আছে, সেই তর্কে গেলাম না। আপনি ওদেরকে আদিবাসী বলবেন কি বলবেন না সেই তর্ক পরে করি। কিন্তু ওরা যে মানুষ, এবং ওদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার ধরন যে আমাদের চেয়ে ভিন্ন এবং বান্দরবানের পাহাড়গুলিতে পাহাড়গুলিকে কেন্দ্র করেই যে ওরা জীবন যাপন করছে শত শত বছর সেটা নিয়ে তো আর তর্ক নাই? নাকি? সেই স্বাধীনতার পর পর ১৯৭২ সন থেকে বহুবছর আমি চকরিয়া, টেকনাফ, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার এইসব এলাকায় বাস করেছি। ম্রোদেরকে আমি দেখেছি সেই শৈশব থেকেই। নিরীহ বনজিবি মানুষ। ওদেরকে ওদের ভূমি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া এটা কি মানবিক কাজ হবে? বলেন?
একটা বেসরকারি ব্যাবসায়ি গ্রুপের উদ্যোগে সেখানে নাকি ম্যারিয়ট হোটেল হবে একটা। সেই হোটেলের জন্যে সেখানে ম্রোদের গ্রামগুলি দখল করে নেওয়া হচ্ছে। উচ্ছেদ করা হচ্ছে ওদেরকে। ইতোমধ্যে জায়গা চহ্নিত করা হয়েছে- একজনের পোস্টে দেখলাম একটা গ্রামের মাঝখানে লাল নিশান টাঙ্গানো হয়েছে। উচ্ছেদ করা হবে ওদেরকে। ম্রোরা কথায় যাবে?
(২)
একটা দেশে নৃতাত্বিকভাবে সংখ্যালঘু কিছু মানুষ যখন থাকে, তখন সেই দেশের সংখ্যাগুরু মানুষ এবং সরকারের দায়িত্ব হয় সেইসব মানুষের জীবনধারণের কায়দা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধরন, ওদের সঙ্গীত নৃত্য কলা এইসব রক্ষা করা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে এই ধরনের জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ওদের জমিজমা যেভাবে ব্যবহার করে সেটার সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জমির ব্যাবহারের ধরনের মিল হয়না। এইরকম জনগোষ্ঠীগুলি প্রকৃতির সাথে মিশে ওদের শত বছরের অর্জিত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান দিয়ে ভূমির ব্যাবহার করে- এমনভাবে করে যেন প্রকৃতি বিনষ্ট না হয়, যেন অরণ্য ও প্রকৃত তার বৈশিষ্ট্য বজার রাখতে পারে। প্রয়োজনই ওদেরকে শিখিয়ে দেয় কিভাবে প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে বাস করতে হয়।
এইজন্যে ওদের জমির মালিকানার ধরনও একরকম হয় না। আমরা সমতলের সংখ্যাগুরু মানুষেরা জমির মালিকানা একভাবে নির্ধারণ করি। পাহাড়ের মানুষেরা ঐতিহাসিকভাবে কখনোই সেইভাবে জমির মালিকানা নির্ধারণ করেনি। কমিউনিটি হিসাবে একেকটা এলাকা ব্যবহার করেছে ওরা। আমাদের যে ভূমি ব্যাবস্থা, সেঁতা আমাদেরকে করে দিয়ে গেছে কলোনিয়াল শাসকেরা। এরপর জমিদারি প্রথা বিলোপ হয়েছে, এছাড়া জমির মালিকানা আর দকলের রেকর্ড রক্ষার যে ইংরেজ প্রবর্তিত কায়দা সেটা আর পাল্টায়নি। পাহাড়ের জমিগুলির বিলিবণ্টনের ব্যাবস্থা ইংরেজ আমলেও সেইভাবে হয়নি। ফলে ম্রো জনগোষ্ঠীসহ অনেক জনগোষ্ঠীই আছে যাদের ভূমি ব্যাবস্থা ওদের ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতিতেই হওয়া দরকার।
এখন আমরা কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছি বলে, আর আমাদের হাতে পুলিশ মিলিটারি আছে বলে, আমাদের গায়ের জড় বেশী হয়েছে বলে আমরা ওদের জীবনযাত্রার মৌলিক ভিত্তি মৌলিক ধরন এইসব ভেঙে দিব, ওদেরকে উৎখাত করে দিব ওদের পিতৃপিতামহের ভিটা থেকে এটা কি ধরনের ন্যায়? গায়ের জোরে দুর্বলের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া এটা কি খুব ভালো কিছু? আপনিই বলেন।
(৩)
অনেকে ‘উন্নয়ন’এর কথা বলেন। ওদের বলেন যে পাহাড়ের মধ্যে রাস্তা ঘাট বানিয়ে হোটেল রেস্টুরেন্ট করে টুরিস্টদের জন্যে ইনফ্রাস্ট্রাকচার বানিয়ে সেখানে টুরিস্টদের আনাগোনা বাড়িয়ে দিলে তাতে করে সকলেরই লাভ। স্থানীয় লোকজন চাকরী পাবে, স্থানীয় ছোট ব্যাবসায়িরা টাকা বানাতে পারবে, স্থানীয় কটেজ ইন্ডাস্ট্রির বিকাশ হবে, স্থানীয় মেয়েরা টুরিস্টদেরকে নানাভাবে বিনোদন দিয়ে টাকা কামাতে পারবে এইরকম কতো কিছু! এই কথাগুলি একদম উড়িয়ে দেওয়ার মত না। ট্যুরিজমএর বিকাশ ঘটলে স্থানীয় লকেদের কিছু আয় তো বাড়েই। আর রাস্তাঘাট তৈরি হলেও অনেক সুবিধা হয়। কথা সত্যি। কিন্তু আপনি যদি পুরো পাহাড় কংক্রিট দিয়ে ম্যরিয়ে দেন তাইলে তো আর সেখানে পাহাড়ও থাকবে না, ট্যুরিজম এট্রাকশনও থাকবে না- একেকটা জায়গা পরিণত হবে একেকটা বিনোদন কেন্দ্রে। মানুষ ফুর্তি করতে যাবে সেখানে। তো ফুর্তির জায়গা তো যে কোনখানেই করা যায়। পাহাড়ে কেন?
পাহাড়ে বা অরণ্যে যেখানে সংখ্যালঘু আদিবাসীরা বাস করে সেইসব এলাকার ট্যুরিজম ডেভেলাপমেন্ট একটু হিসাব করে করতে হয়। সংখ্যালঘু পাহাড়ি মানুষের সংস্কৃতি দেখতে যাবে লোকে, কিন্তু আপনি যদি পাহাড়ি মানুষকেই তাড়িয়ে দেন তাইলে তো আর সেই বৈশিষ্ট্য থাকলো না। অরণ্য দেখতে যাবে মানুষ, অরণ্য ধ্বংস করে সেখানে যদি বিলাসবহুল ফাইভ স্টার হোটেল তৈরি করেন তাইলে তো আর অরণ্যের বৈশিষ্ট্য থাকলো না। সারা দুনিয়াতেই এইটা নিয়ে নানা আলোচনা আছে, আন্দোলন আছে, নানারকম মতামত আছে। আপনারা যদি ঐ পাহাড়ের উপর একটা ফাইভ স্টার হোটেলই বানাতে চান, তার আগে একটু আলোচনা করা দরকার ছিল না? পরিবেশের উপর কি ইমপ্যাক্ট হবে সেটা একটু দেখা দরকার ছিল না? করেছেন সেইসব? বিশেষ করে স্থানীয় লোকজনের সাথে আলোচনা? করেছেন?
শোনেন, উন্নয়ন মানে বিত্তবান ব্যাবসায়ি গোষ্ঠীর হাতে জমি তুলে দেওয়া নয়। এইরকম করলে ঐ ব্যাবসায়ি গোষ্ঠীর লাভ হবে। তার বিপরীতে এই একটা জনগোষ্ঠী তাঁদের ভূমি হারাবে, এখানকার জনগণের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বিলোপ হবে। এটা তো উন্নয়ন নয়- এটা হচ্ছে মুনাফা, নোংরা অপবিত্র নষ্ট মুনাফা। আমরা পাহাড়ের মানুষকে ওদের বাসভূমি থেকে উৎখাত করে একটা পরিবার বয়া একটা ব্যাবসায়ি গ্রুপের মুনাফার ব্যাবস্থা করবো? একটা জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব বিলোপ করে, ওদেরকে ধ্বংস করে কয়েকজনের মুনাফার ব্যাবস্থা করবেন? কাজটা কি হালাল হচ্ছে?
(৪)
আগেই বলেছি যে আদিবাসী অধিকার ইত্যাদি নিয়ে কিছু বলছি না। আপনারা ওদেরকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলেন, সেইটা ধরেই বলছি- কাজটা অন্যায় হচ্ছে, অনৈতিক হচ্ছে, রাজনৈতিক ও নৈতিকভাবে অবৈধ হচ্ছে। আপনারাই সংবিধানে ঢুকিয়েছেন যে “রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।” (সংবিধানের ২৩ক অনুচ্ছেদ)। এইটাই করেন না কেন? ঐখানে একটা বেসরকারি কোম্পানিকে ফাইভ স্টার হোটেল করে দিলে সংবিধানের এইসব উদ্দেশ্যের কোনটা প্রতিপালিত হবে? বলেন।
পাহাড়ের নাম হচ্ছে ‘শোং নাম হুং’, এই পাহাড়কে মানুষ শত বছর, অথবা কে জানে হয়তো হাজার বছর, এই নামে ডেকেছে। সেটাকে করেছেন নীলগিরি।
এতে করে কি ‘অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি’র বিকাশ হলো? বলেন। পাহাড়ের নাম ছিল ‘তেংপ্লং চূট’, কে কিভাবে কখন জানিনা সেই নাম পাল্টে নাকি চন্দ্রপাহাড় করে দিয়েছে? কেন? কি বকাসের জন্যে কে এই নাম বদল করেছে? কি অধিকারে করেছে? বুঝিয়ে বলতে পারবেন আমাকে? আমরা সংখ্যাগুরু, আমাদের গায়ের জোর বেশী, আমাদের পুলিশ আছে আমাদের মিলিটারি আছে- আমরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। এছাড়া আর কি যুক্তি আছে?
আমরা আমাদের শহরগুলির নামের ইংরেজি বানান পাল্টেছি। কেন? কারণ আমরা আমাদের ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে চাই। ইন্ডিয়ায় ওরা ইংরেজদের দেওয়া নগরের নাম, প্রদেশের নাম সরিয়ে পুরনো নাম ফেরত এনেছে। পাহাড়ের নাম কেন আমরা পাল্টে দিচ্ছি? এটা তো উপনিবেশবাদী আচরণ হয়ে গেল। কাজটা কি ন্যায় হচ্ছে? এটা কি সাংস্কৃতিক অত্যাচার নয়?
(৫)
না, আমি সরকারের রুঢ় সমালোচনা করছি না। আমি নিবেদন করছি- জোর হাতে অনুনয় করছি, বিনয় করে বলছি- এই অন্যায়টা করবেন না। একটা জনগোষ্ঠীকে ওদের ভূমি থেকে উৎখাত করবেন না। ঐখানে ফাইভ স্টার হোটেল করবেন না। পাহাড়গুলির পুরনো নাম ফিরিয়ে দিন। আমাদের স্বার্থেই এটা করতে বলছি। যদি পাহাড়ের ঐখানে কিছু করতেই চান, হাসপাতাল করুন কয়েকটা। প্রাইমারি স্কুল করেন পাড়ায় পাড়ায়। ওখানে শিশুরা বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, স্কুলে যেতে পায়না সহজে।
ট্যুরিজম বাড়াতে চান, পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জায়গা ন্রিবাচন করুন। সাতকানিয়া বা চকরিয়ার দিকে ঐসব জায়গায় ফাইভ স্টার হোটেল খোলেন, সুইমিং পুল গলফ কোর্স শুঁড়িখানা ডিস্কোটেক এইসব খোলেন। সেখান থেকেই মানুষ গহীন অরণ্যে বেড়াতে যাবে। পৃথিবীর অনেক জায়গায় এরকম দেখবেন- অরণ্য বা পাহাড় থেকে একটু দূরে মানুষ বড় হোটেল খোলে। সেখান থেকে পর্যটকরা অরণ্যে বা পাহাড়ে এডভেঞ্চার করতে যাবে। সেরকম কিছু করেন। একটা পুরো জনগোষ্ঠীকে উৎখাত কেন করবেন?
ক্ষুদ্র একটি জনগোষ্ঠী, ওদেরকে তাড়িয়ে দিবেন না। অসহায় মানুষের কান্না আমাদের জন্যে কোন মঙ্গল বয়ে আনবে না। পাহাড় ধ্বংস করবেন না। পর্বত ধ্বংস করবেন না। বৈচিত্র্য ধ্বংস করবেন না। পাহাড় প্রকৃতি অরণ্য এরা আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিবে। মানিদার একটা গান আছে, ‘ন লাইজ্জ মুড়ারে’। চাকমা গান। বাংলা করলে দাঁড়ায় অনেকটা এরকম যে, পাহাড়কে বিরক্ত করবে না, পাহাড়ের ঝর্নাকে বিরক্ত করবে না, অরণ্যকে বিরক্ত করবে না। সেই গানটা শুনতে বলি। মেহেরবানী করে পাহাড়কে এই ম্রো জনগোষ্ঠীকে মারবেন না। অন্যায় করবেন না।