বাংলাদেশ ও কানাডার সমাজে ধর্মের ভূমিকা কি?

পুলক ঘটক: বাংলাদেশ এবং কানাডা –এই দুই দেশের মধ্যে তুলনা করতে চাই। সুন্দর জীবন যাপনের জন্য কোন দেশটি ভাল? সবাই এক বাক্যে বলবেন, ‘কানাডা’। কেন? ঐ দেশ আমাদের তুলনায় অনেক ধনী এজন্য? ধন সম্পদই যদি কারণ হয়ে থাকে, তবে বাংলাদেশের ধনকুবেররা তাদের সন্তানদের কানাডায় পাঠায় কেন? কেন তারা নিজেরা কানাডায় পাড়ি জমায়?
লক্ষ্য করুন, তেল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশের চেয়ে ধনবান হলেও সেসব দেশকে এই জনগণ বাসযোগ্য ভাবছেনা। আরব দেশে শ্রম দিয়ে টাকা কামিয়ে বাংলাদেশে এসে বাস করাকেই শ্রেয় ভাবছে। অথচ ধর্মীয় বিশ্বাসে নৈকট্যের কারণে ইউরোপ-আমেরিকার আগে মধ্যপ্রাচ্যকেই তাদের বেঁছে নেওয়ার কথা ছিল। হচ্ছে উল্টোটা।
কানাডা অনেক সম্পদশালী হলেও সেখানে টাকাওয়ালাদের জন্য বাংলাদেশের মত যাচ্ছেতাই সুবিধা নেই। এখানে যদি আপনার পর্যাপ্ত টাকা থাকে, তবে সামান্য বেতনের বিনিময়ে বাড়িতে একাধিক মানুষকে আপনার সেবায় দাসদাসীর মত খাটাতে পারবেন। কানাডায় রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী উপযুক্ত বেতন, ছুটি এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা না দিয়ে কাউকে খাটাতে পারবেন না। কানাডায় ধনী ব্যক্তিরাও নিজের কাজ নিজেরাই করতে অভ্যস্ত।
বাংলাদেশে আপনার টাকা থাকলে আপনার প্রতিপত্তি থাকবে। সেই প্রতিপত্তি দিয়ে আপনি হাজার মানুষের উপর প্রভুত্ব করতে পারবেন। চাইলে এক ডজন বডিগার্ড রাখতে পারবেন; আপনি পথ চললে রাস্তার দু’ধারে কত মানুষ আপনাকে সালাম দিবে! কানাডায় এসব পাবেন না। কানাডার জলবায়ুও আমাদের জন্য সুখকর নয় –তীব্র ঠান্ডার দেশ। তবুও বাংলাদেশের ধনী ব্যক্তিরা কানাডায় বাড়ি করে, সম্পদশালী দেশে গরীব দেশের সম্পদ পাচার করে। দেশে অঢেল সুযোগ-সুবিধাভোগী হয়েও তারা কানাডাকে বাংলাদেশের চেয়ে বাসযোগ্য ভাবে। দেশে যাদের তেমন ধনসম্পদ নেই তাদের আর দোষ কি? যে দেশের মাটিতে সকল স্মৃতি, সকল প্রেম মিশে আছে সেই দেশ পিছনে ফেলে মানুষ সেই নির্বান্ধব বিদেশে পাড়ি জমায়! এ হল উন্নত স্বাধীন জীবনের অন্বেষা –যা শুধু টাকাকড়ি নয়; আক্ষরিক অর্থে economic migration নয়।
ইন্টারনেট ঘেটে কানাডা দেশের একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি দেখে নিন। ভাবুন সেখানকার নির্জন জলাধার বা বনরাজি পেরিয়ে জনশূন্য কোনো পথে আপনি একা চলছেন। নারী হন আর পুরুষ হন -ঐ পথে চলতে আপনাকে মানুষের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকতে হবেনা। কেউ ছিনতাই করবেনা। নারী হলে ধর্ষিত হওয়ার ভয়ে আপনার গা ছমছম করবেনা। আপনি স্বাধীন। একা চলুন, আপনার রুচি অনুযায়ী পোশাক পরুন –সমাজ আপনার জন্য বিপদজনক হবেনা। সেখানে সমাজে এবং রাজনীতিতে ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলা নেই। অপনার বিশ্বাস এবং সংস্কৃতি অন্যের স্বাধীনতায় বিঘ্ন না ঘটালে আপনি সেখানে বাধাহীন, বিপত্তিহীন। কেউ বিশ্বাসের জন্য আপনার ঘাড়ে কোপাবে না, বাড়িঘরে হামলা করবে না বা পুড়িয়ে দেবেনা। রাষ্ট্র আপনাকে এবং অপর সকলকে সমভাবে নিরাপত্তা দেবে। সম্ভাব্য যে কোনো বিপত্তিতে আপনি অসংকোচে পুলিশের স্মরণ নেবেন; পুলিশকে ভয় পাবেন না। তাই বাংলাদেশের একজন দাপুটে পুলিশ কর্মকর্তাও অবসরে যাওয়ার পর বাংলাদেশের চেয়ে কানাডাকে নিরাপদ ভাবে।

কেন এরকম হয়?

এ প্রশ্নে বাংলাদেশ এবং কানাডার মধ্যে ব্যাপক ব্যবধানের কথা আবার আসবে। কেমন ব্যবধান? কানাডা বাংলাদেশের চেয়ে ৭০ গুণ বড়। সেখানে মাত্র ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষের বাস; বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি। ঐ দেশের সম্পদের পরিমাণ এক হাজার বাংলাদেশের সমান হবে। আমাদের সীমিত সম্পদ এবং অল্প জায়গায় এত বিপুল জনগোষ্ঠীকে সেবা দেওয়া আসলেই দুরূহ কাজ। দুই দেশের সুখ-অসুখের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টিকারী কারণগুলো একটি একটি করে খুঁটিয়ে দেখুন। আরও কিছু কারণ পাবেন, যা কানাডার চাইতে বাংলাদেশকে পিছিয়ে রাখছে।
এর মধ্যে মানুষের বিশ্বাসও কি একটি কারণ? মানুষের বিশ্বাস কি বাংলাদেশকে ঐ দেশের চাইতে হয় এগিয়ে অথবা পিছিয়ে রাখতে ভূমিকা রাখছে? আমি ধর্ম বিশ্বাসের কথা বলছি। আমাদের ধনসম্পদ না থাক, ধর্ম আছে। এদেশের প্রায় সকল মানুষ ধার্মিক। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই ধার্মিক। ধর্মের পথে এখানে উপাসনা, উদ্দামতা, টানাটানি ইত্যাদি সব আছে এবং দিন দিন তা বাড়ছে। ধর্মের ব্যাপকতার সঙ্গে এখানে ঘুষ-দুর্নীতি, চুরি-ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ, অত্যাচার, নির্যাতন, নৃশংসতাও আছে –কানাডায় যা নেই বললেই চলে।
আচ্ছা, একটি সমাজের সুখ সাচ্ছন্দ্য বিধানে এবং বিশৃঙ্খলার অবসানে সেখানকার মানুষের মনোজগতে বাস করা প্রবল বিশ্বাসের কি কোনো অবদান নেই? অথবা, সমাজের ক্রমবর্ধমান অপরাধ প্রবণতায় জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসগুলো অনুঘটকের ভূমিকা নেয় কিনা? কি বলেন সমাজ বিজ্ঞানীরা? এ নিয়ে গবেষণা কই? দেশে যারা ধর্ষণের মত অপরাধ নিয়ে কথা বলেন বা গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখেন, তাদের কাউকেই জনসাধারণের এই বিশ্বাসমুলক উপাদান নিয়ে টুঁশব্দ করতে দেখি না। বিশ্বাসবদ্ধ মগজে ও বিশ্বাসসংকুল সমাজে মুক্তচিন্তা ও মুক্তভাবে গবেষণার সামর্থ্য থাকেনা।
বাংলাদেশে এখন প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলমান। হিন্দু (৮.৯ শতাংশ), বৌদ্ধ (০.৬ শতাংশ), খ্রিস্টান (০.৪ শতাংশ) এবং আদিবাসী মিলিয়ে আছে প্রায় ১০ শতাংশ। এদের মধ্যে নাস্তিক কত শতাংশ তার সুস্পষ্ট হিসাব নেই। কানাডায় ৬৭ শতাংশ মানুষ খ্রিস্টান হলেও বেশিরভাগ নামকাওয়াস্তে বিশ্বাসী। আর ২৪ শতাংশ মানুষ কোনো ধর্মে বিশ্বাস করেনা। বাকি প্রায় তিন শতাংশ মুসলমান, দেড় শতাংশ হিন্দু, আরও প্রায় দেড় শতাংশ শিখ, এক শতাংশের বেশি বৌদ্ধ, এক শতাংশ ইহুদি এবং এক শতাংশের কম বিভিন্ন আদিবাসী ধর্মের অনুসারী আছে। তাদের ব্যক্তিসাতন্ত্রময় স্বাধীন সমাজ গঠনে এই বিশ্বাসগত বিন্যাসের অবদান কি? এদিকে আমাদের বিশ্বাসের কারণে ঈশ্বর উপর থেকে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসুন বা না আসুন, আমাদের মনোগত বিশ্বাস এই সমাজের জন্য কতটা অনুঘটক তা ভাবতে হবে বৈকি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ