জাহাঙ্গির হোসাইন: গারো ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারোপাহাড় ও বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় বসবাসকারী আদিবাসী সম্প্রদায়।
জাতিগত পরিচয়ে গারোরা নিজেদের ‘আচিক মান্দি’ বলে পরিচয় দেন। গারোদের ভাষায় ‘মান্দি’ শব্দটি এসেছে Manni de থেকে; যার অর্থ মানবসন্তান। ইরাবতী নদীর তীরে মন্দালয় নামক স্থানে বসবাস কিংবা পূর্বপুরুষ নরমান্দির নাম থেকে ‘মান্দি’ নামের উদ্ভব বলে অনেকের ধারণা।
অন্যদিকে ‘আচিক’ শব্দের অর্থ মাটি কামড়ে থাকা। গারো পাহাড় ত্যাগ না করা এবং বহিঃশত্রুর হাত থেকে তাকে রক্ষা করার জন্য এক মুঠো মাটি মুখে নিয়ে পণ করে কিছু মানুষ। তারাই পরে পরিচিত হয় আচিক নামে।
গারো সমাজে পরিবার প্রথা মাতৃতান্ত্রিক। গারোদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মের নাম ’সাংসারেক’। প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের নাম ‘ওয়ানগালা’। গারোদের প্রধান দেবতার নাম তাতারা রাবুগা।
গারো বিশ্বাস মতে, সৃষ্টির আদি অবস্থায় বিশ্বজগত বলতে আদতে কিছুর অস্তিত্ব ছিলো না। চারিদিকে কেবল নিঃসীম ঘোর অন্ধকার এবং অসীম জলরাশি।
প্রধান দেবতা তাতারা-রাবুগা প্রথম পৃথিবী সৃষ্টির ব্যাপারে মনস্থির করলেন। তার ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার জন্য মনোনীত করা হলো সহকারী দেবতা নন্তু-নপান্তুকে। নন্তু-নপান্তু একজন স্ত্রীলোকের বেশে শুরু করলেন পৃথিবী সৃষ্টির প্রক্রিয়া। সঙ্গ ও সহযোগিতা দিল সহকর্মী ‘মাচি’।
নন্তু-নপান্তু প্রথমে পানির উপর বিছানো মাকড়সার জালে আশ্রয় নিলেন। হাতে ছিল তাতারা-রাবুগার কাছ থেকে পাওয়া এক মুঠো বালি। হাতের বালি দিয়ে পৃথিবীর আকার দেবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বালিকে একত্র করে আটকে রাখাটা অসম্ভব। আটকে রাখতে হলে প্রয়োজন একটু কাদামাটির। নন্তু-নপান্তু কাদা মাটির জন্য কাঁকড়াকে পাঠালেন পানির নিচে। গভীরতা খুব বেশি হবার কারণে কাদা অব্দি পৌঁছানোই সম্ভব হলো না। বরং ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এল কাঁকড়া। এর পর পাঠলেন ‘চিফং-নকমা বালফং-গিটেল’ নামক প্রাণীকে। পানির গভীরতা দেখেই ভয় পেয়ে ফিরে এলো সে। অবশেষে দায়িত্ব দিলেন ‘চিচিং বারচিং’ নামের ছোট্ট এক প্রাণীকে। পানির গভীর তলদেশে প্রবেশ করে কাদা নিয়ে ফিরে এলা চিচিং বারচিং। সেই মাটির সাহায্যে সৃষ্টি করা হলো পৃথিবী। নন্তু-নপান্তু পৃথিবীর নাম রাখলেন ‘মনোপিল্টে’।
তখনো পৃথিবীর উপরিভাগ খুবই নরম। বসবাস দূরের কথা, হাঁটাহাঁটির জন্যও উপযোগী হয়নি। নন্তু-নপান্তু সাহায্য প্রার্থনা করলেন পরম দেবতা তাতারা-রাবুগার কাছে। প্রার্থনা মঞ্জুর হলো। তাতারা রাবুগা আকাশে সূর্য আর চন্দ্র এবং জমিনে বাতাস দিলেন। আলো আর বাতাসের স্পর্শে পৃথিবীর উপরিভাগ হয়ে উঠতে শুরু করলো শক্ত আর কঠিন। তাতারা-রাবুগা রিংকিং বা পেটিকোট দান করলেন পৃথিবীকে। সাথে দিলেন মেঘের তৈরী পাগড়ি। মাথায় সৌন্দর্যের জন্য দান করলেন আমফাং, রিসিক, প্রাপ ও বললেং গাছের মূলের ন্যায় চুল।
প্রাণীদের মধ্যে তাতারা রাবুগা প্রথমে সৃষ্টি করেছেন লেজহীন বানর। তার দায়িত্ব ছিল বিকট আওয়াজের মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে সজাগ ও সচল রাখা। এরপর জন্ম নেয় হনুমান ও বাদামি রঙের বানর। পরে ধারাবাহিকভাবে অন্যান্য বিভিন্ন স্তরের প্রাণী।
জলচর প্রাণীদের মধ্যে সবার আগে সৃষ্ট বিশালাকার ব্যাঙ। তার কাজ ছিল বিকট শব্দের মাধ্যমে আকাশে মেঘের আগমন বার্তা ঘোষণা করে দেওয়া। তার পরের দফায় তৈরি হলো মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী।
পৃথিবী সৃষ্টির পর মাটির নিচে অনেক পানি থাকলেও উপরে পানি ছিল না। তাতারা রাবুগা শুষ্ক ধরণীতে আনলেন নদীর প্রবাহ। আকাশ থেকে পানি বর্ষণের জন্য নিয়োজিত হলেন বৃষ্টির দেবী ‘নরে-চিরে-কিমরে-বকরে’। সাথে পাঠানো হলো বজ্রের দেবতা গোয়েরাকেও। পৃথিবী এখন বসবাসের জন্য প্রস্তুত।
মানুষের আগমনঃ
তাতারা-রাবুগা তার সকল সহকারীর সাথে পরামর্শ করে সৃষ্টির সেরা মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিলেন। দেবী সুস্মিকে পৃথিবীতে পাঠানো হলো প্রথম মানব-মানবীর জন্য স্থান নির্বাচন করতে। তাতারা-রাবুগার আদেশে নন্তু-নপান্তুই প্রাচ্যের আমিতিং-আফিলজাং নামক স্থানে আদি মানব-মানবী শানী এবং মনিকে প্রেরণ করেন। এই প্রথম জুটি থেকেই জন্ম নেয় গানচেং এবং দুজং। এই দু’জনই বর্তমান গারো জাতির পূর্বপুরুষ।
তখন পৃথিবীতে খাবার বলতে গাছের ফল, বনের পশু-পাখির মাংস খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতে হতো। নিজেদের প্রয়োজনে জঙ্গল কেটে পৃথিবীতে প্রথম ভূমি চাষ করে ফসল উৎপাদন করেছে বনজাসকো এবং তার স্ত্রী জানেগানদো। শিকারজীবন থেকে তারাই প্রথম কৃষি সভ্যতার সূচনা করে। দেবতাদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য কৃতজ্ঞতা হিসাবে উৎপাদিত ফসলের কিছু অংশ উৎসর্গ করে তাদের নামে। সেই থেকে জন্ম নেয় ধর্মচর্চার নতুন উদাহরণ।
দেবদেবীদের সাধারণ অর্থে ডাকা হয় মিদ্দে বলে। প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেন একেকজন মিদ্দে। দেবতাদের মধ্যে সালজং (Saljong) উর্বরতার দেবতা এবং সূর্য সালজং এর প্রতিনিধি। ফসলের ভালোমন্দ এই দেবতার উপর নির্ভর করে। চোরাবুদি শষ্য রক্ষা করেন। সুসাইম(Susime) ধন দৌলতের দেবী এবং চন্দ্র এই দেবীর প্রতিনিধি। গোয়েরা(Goera) গারোদের শক্তি দেবতার নাম। কালকেম(Kal Kame) জীবন(মানুষ ও প্রাণের) নিয়ন্ত্রণ এবং নাওয়াং জীবন হরণকারী দেবতা বলে গারোদের বিশ্বাস।
মিদ্দেদের সন্তুষ্টির জন্য পূজা বা আমুয়া পালন করতে হয়। পালিত হয় ওয়ানগালার মতো উৎসব। গাড়োরা পুরোহিতকে কামাল বলে।
সময়ের ব্যবধানে গারো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তির পথে। বর্তমান গারোদের প্রায় শতকরা ৯৯ ভাগই খ্রিস্টিয় সম্প্রদায়ের মিশনারি কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট হয়ে ধর্মান্তরিত। কয়েক হাজার বছর আগের সভ্যতা খোঁড়াখুঁড়ি করে পশ্চিমা বিশ্ব পুরাণ সংগ্রহ করে যাচ্ছে। ঠিক সেই সময়েও গারো পুরাণ যেন আমাদের কাছে অজানা অচেনা অবহেলিত একটা ধর্ম।