পিতা-মাতার দায় কে নেবে?

হিন্দু নারীর সমঅধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করার পর থেকে আমরা ফেসবুকে বিচিত্র সব মন্তব্যের মুখোমুখী হচ্ছি। স্বার্থপর ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী নারীর উপর কর্তৃত্ব তথা সম্পত্তির উপর কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখার স্বার্থে নানা পদের অযৌক্তিক কথাবার্তা বলে যাচ্ছে। যেমন প্রফুল্ল রায় নামে এক ভদ্রলোক ফেসবুকে আমাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, “ঘটক বাবুর কাছে আমার প্রশ্ন, কারও পিতা-মাতা বৃদ্ধাশ্রমে গেলে তাদের মেয়েদের প্রতি কেনো আঙ্গুল তোলা হয় না যে, তারা কেনো পিতা-মাতাকে দেখে না? ভরন-পোষণ দেয় না? কেনো স্বামীর বাড়িতে নিয়ে যায় না? শুধু ছেলেদে কি পিতা-মাতাকে দেখার জন্মগত কর্তব্য, মেয়েদের নয়?”

এ কথার জবাবে আমার প্রশ্ন হল, আমরা আমাদের মেয়েদের দায়িত্ব দিতে চাই কি-না? বার্ধ্যকে পিতামাতার দায়িত্ব নেয়াসহ সব দায়িত্ব….। মেয়েদের আত্মনির্ভর মানুষ হিসেবে গড়ে তুলে তাদেরকে সন্তান হিসেবে প্রাপ্য সমঅধিকার বুঝিয়ে দিয়ে দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে দেখতে চাই কিনা?

মেয়েদের আমরা গরু-বাছুরের মতো এবং পণ্য সামগ্রীর মত দান করে দেই; বিদায় করে দেই; পিতার সম্পত্তিসহ সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত করি; এমনকি পিতার পরিচয়টুকুও তার নামের সঙ্গে বহন করার সুযোগ রাখিনা– একদম বংশচ্যুত ঘোষণা করি, গোত্রচ্যুত করে দেই – পিতা-মাতার পারলৌকিক কর্ম করার অধিকারও দেই না। শ্বশুরবাড়িতে জীবনটা লাঞ্চনাময় হলে যার ফিরে আসারও জায়গা থাকে না – সেই মেয়ের প্রতি এইরকম অভিযোগ মানুষ হিসেবে আমাদের কোথায় নিয়ে দাঁড় করায় সে বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য সবাইকে অনুরোধ করি।

এ দৃশ্য পৃথিবীর মধ্যে ব্যতিক্রম। পৃথিবীর কোথাও কোনো জাতির মেয়ে সন্তানদের প্রতি এরকম অবিচার আর নেই।

ভবিষ্যতে আমরা আমাদের কন্যা সন্তানদের জীবনকে ঠিক এভাবেই নির্ধারিত করে দেবো কিনা সে বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আমাদের মেয়েরা যাতে আমাদের দায়িত্ব নেওয়ার মতো সামর্থ্য অর্জন করে, সেভাবে আমরা আমাদের কন্যা সন্তানদের জীবনকে গড়ে দেবো কিনা সে বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাদের ভবিষ্যৎকে নির্ভরশীল জীবন বানিয়ে দেব, নাকি তাদেরকে পৈত্রিক সম্পত্তিতে অধিকার দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ও সক্ষম হওয়ার সুযোগ দেবো? সবাই দয়া করে বিষয়গুলো ভাবুন।

মেয়ের নিজের কিছু থাকবে না, তাকে স্বামীর উপর এবং শ্বশুরের উপর নির্ভর করে বাঁচতে হবে, পিতার সম্পত্তিতে তার অধিকার থাকবে না –এ কেমন জীবনধারা? যে মেয়ের স্বাধীন কোন জীবনই নেই, যাকে আমরা পরাধীন হতে অন্যের ঘরে পাঠিয়ে দেই, সেই মেয়েরা পিতা মাতার দায়িত্ব নেয় না বলে কটাক্ষ করার চেয়ে অমানবিক নিষ্ঠুর পরিহাস আর কি হতে পারে? চিন্তা চেতনায় আমাদের মানুষজন এখনো কোন পর্যায়ে আছে এসব মন্তব্য থেকে তা বোঝা যায়। এই হিন্দু সমাজ আর সকলের কাছে পরাভূত ও বিপর্যস্ত হবে না কেন?

আমাদের মেয়েরা এখন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্চে। পৃথিবী আজ তাদের হাতের মুঠোয়। তারা ঘরে বসে গোটা পৃথিবীর সমাজ ব্যবস্থাকে দেখতে পারে। জ্ঞান বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে আমাদের মেয়েরা এই সমাজের পশ্চাদপদ চিন্তাধারা কতদিন তাদের মনস্তত্ত্বে লালন করবে তা আমাদের বুঝতে হবে। এর ভবিষ্যৎ পরিণতি কি হতে পারে তা অনুধাবন করতে হবে। গোটা পৃথিবী একদিকে, আর আমরা অন্যদিকে·– এভাবে আমরা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব ব্যবস্থায় কতটুকু এগোতে পারবো? সবাই ভাবুন এবং ভেবে মতামত দিন দাদারা।

নিচের কথোপকথন ফেসবুক থেকে কপি করা
***
প্রফুল্ল রায় (Profulla Ray) বিশেষ দ্রষ্টব্যে নিজে যে মন্তব্য করেছেন এবং তার পোস্টের নিচে তিনিসহ হিন্দু নারী’র অধিকার হরণকারী পক্ষের কিছু মন্তব্য তুলে ধরে সেসবের জবাব দিচ্ছি।

Profulla Ray: বি.দ্র. ব্যতিক্রমি ঘটণা হিসেবে অল্প সংখক যেসব মেয়েরা দেখে, তাদের উদাহরণ টানবেন না। প্রশ্নটা ভালো করে বুঝুন আগে, তারপর উত্তর দিন।

Pulack Ghatack: বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা কত? শতকরা কত শতাংশ মানুষ তাদের পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাচ্ছে? যারা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাচ্ছে তারা সমাজের অল্পসংখ্যক ব্যতিক্রম কিনা? সেই অল্পসংখ্যক ব্যতিক্রমের মধ্যেই আবার অন্যের আশ্রয়ে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে বাস করা মেয়েদের কয়জন ব্যতিক্রম হয়ে বৃদ্ধাশ্রম থেকে পিতা-মাতাকে ফিরিয়ে এনে নিজেদের বাড়িতে রেখেছেন তা আমিও খুঁজে দেখছি না। আপনি বলেছেন, “প্রশ্নটা ভালো করে বুঝুন তারপর উত্তর দিন।” আসলে আপনার জ্ঞানগর্ভ দুরুহ প্রশ্ন বোঝার জন্য সারাজীবন প্রাণান্ত চেষ্টা ছাড়া আর কি করতে পারি?

চপল রায়: অনেক ক্ষেত্রে তাড়াই মা বাবা, ভাইদের নি:স্ব করে।

Pulack Ghatack: বোনদের উপর আপনার অনেক রাগ। রাগ হওয়াই ঠিক; বিশেষ করে তারা যদি নিজেদের অধিকার দাবি করে। অধিকার না চাইলেই মধুর সম্পর্ক।

Profulla Ray: তবে পৈতৃক সম্পত্তি না পেলে কি স্বাবলম্বী হওয়া যায় না?

Pulack Ghatack: ঠিক। তাহলে ছেলেদের পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে এত ভাবনা কেন? পৈত্রিক সম্পত্তি বোনদের দিয়ে নিজেরা স্বাবলম্বী হয়ে পৌরুষ প্রমাণ করুন।

Kingshuk Chakraborty: মেয়েরা এখন মা বাবার দায়িত্ন নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।যে সব মা বাবা বৃদ্ধাশ্রমে আছেন তাদের দায়িত্ব কয় জন মেয়ে নিয়েছেন?

Pulack Ghatack: বৃদ্ধাশ্রমে পাঠামো ব্যতিক্রমী ঘটনাগুলোর মধ্যে কোন মেয়ে আরও ব্যতিক্রম ঘটিয়ে নিজের বাবাকে বৃদ্ধাশ্রম থেকে উদ্ধার করে তার স্বামীর বাড়ি/শশুরের বাড়িতে নিয়ে যেতে পেরেছে সেসব অনুসন্ধান করলে প্রফুল্ল রায়ের আগের আপত্তি লংঘন হয়ে যাবে। তাই মেয়েদের দায়িত্বশীলতা নিয়ে ওনার এই উদ্বেগের জবাব দিচ্ছিনা।

Adhir Sharma: মেয়েরা শশুর বাড়িতে কতটা সুখে আছে এটা নিয়ে গ্রামাঞ্চলে একটা জরিপ চালান।

Pulack Ghatack: জরিপ চালাতে হবে না। অনেক নারীই নির্যাতিত হয় না। অনেকেই তাদের অধিকারহীনতাকে স্বাভাবিক জীবন হিসেবে মেনে নিয়ে ভাল আছে। যখন দাস ব্যবস্থা চালু ছিল, তখন দাসদেরও সবাই নির্যাতিত হতো না। অনেক ভাল মনিব ছিল, যারা তাদের দাস-দাসীর উপর অত্যাচার করতো না। দাস জীবনকেই স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিয়ে মনিবের সেবা করা ধর্ম মনে করত অধিকাংশ দাস দাসী। বেশিরভাগ দাস-দাসী বলত, “নুন খাই যার, গুণ গাই তার।” দাসপ্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সূচনা করেছে অল্প সংখ্যক মানুষ, যাদের সবাই নিজেরা দাস ছিলেন না। ‘দাস’ টাইটেলটাকেও বিনা আপত্তিতে গ্রহণ করেছে এদেশেরই অসংখ্য মানুষ। আপনারা খেয়াল করে দেখবেন, আপনার বাড়ির পোষা গরুগুলোও তাদের গলার দড়ি মেনে নিয়েছে। তাতে সবাই কষ্টে আছে – এমনও নয়। এই জীবনেই তারা অভ্যস্ত। কিছু খারাপ লোক তাদের পোষা প্রাণীকে কষ্ট দেয়। বাকি গেরস্তরা তাদের পোষা প্রাণীগুলোর প্রতি যত্নআত্তি করে; পর্যাপ্ত ঘাষ দেয়, খইল দেয়। কয়জন সুখে আছে সেই জরিপের ভিত্তিতে নারীর অধিকার নির্ধারিত হবে না। আসলে একজন মানুষেরও অধিকার হরণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়। মানুষ হিসেবে সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করা দায়িত্ব।

Profulla Ray : ১। ঘটক বাবু, পিতা-মাতার পারলৌকিক কর্ম করার অধিকার না দেওয়ার পেছনে দায়ি কে? আপনি কি বলতে চাচ্ছেন এটা হিন্দুদের শাস্ত্রে লেখা আছে, নাকি এটা তাদের নিজেদের বানানো নিয়ম, কোনটা? আপনি কি ধর্মটা পরিবর্তন করতে চান? ২। সম্পত্তির ভাগ পেলেই কি মেয়েরা পিতা-মাতার ভরনপোষণের দায়িত্ব নিতে পারবে? ৩। ফ্রি তে লটারিতে পাওয়া পুরষ্কারের টাকা আর যৌতুকের টাকা কিন্তু আটে না।একটা বিবাহিত মেয়ে ও তার স্বামী এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে কীভাবে পৈতৃক সম্পত্তি আবাদ করবে? ভাইদের মাধ্যমে? আর বিক্রি করলে সেই টাকাটাও কিন্তু স্বামীর পকেটে যাবে। ৪। জমি বিক্রির টাকা দিয়ে একটা মেয়ে কীভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে, উদাহরণ দিন।

Pulack Ghatack: ১। পিতা-মাতার পারলৌকিক কর্ম করার অধিকার না দেওয়ার পেছনে মানুষই দায়ি। মানুষ শাস্ত্রগুলো বানিয়েছে। হিন্দুদের মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ঘরানার এবং বিভন্ন বর্ণের মানুষ বিভিন্ন ধরনের শাস্ত্র মানে। জীবনাচরণ ও আনুষ্ঠানিকতার ক্ষেত্রে হিন্দুদের এমন কোনো সুনির্দিষ্ট শাস্ত্রগ্রন্থ নেই, যেটি সার্বজনীন এবং মানা সবার জন্য মানা বাধ্যতামূলক। যারা এগেুলো মানে তারাও হিন্দু, যারা আংশিক মানে তারারও হিন্দু এবং যারা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার প্রায় কিছুই মানে না তারাও হিন্দু। যেমন আপনি ‍ব্রাহ্মণ না হলে আপনার বেদাদী শাস্ত্রসকল পাঠ করা এবং আলোচনা করা নিষিদ্ধ – এরকম বিধান সবাই মানছেন না। শাস্ত্রে কঠোর বর্ণবাদ ও মানুষে মানুষে বিভেদ থাকলেও সবাই তা মানছে না। শাস্ত্রে সতীদাহের বিধান থাকলেও সবাই তা মানছে না। বিয়ের ক্ষেত্রে ১১ প্রকার বিধান আছে। অথচ নারীকে দান করার শুধু এক প্রকার বিয়ের আচার বাঙালি হিন্দুরা মানছে।

আরেকটি কথা হল, “ধর্মটা পরিবর্তন করতে চাই” কিনা? আসলে সনাতন ধর্ম পরিবর্তনশীল ও বৈচিত্রময়। পরিবর্তনশীল হওয়ার কারণেই এই ধর্ম পরিবর্তনশীল বিশ্ববাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে এবং টিকে আছে; থাকবে। এখানে আপনার-আমার কিছুই করার নেই।

২। সম্পত্তির ভাগ পেলে মেয়েরা পিতা-মাতার ভরনপোষণের দায়িত্ব নিতে পারবে। অবশ্যই পারবে; এবং পারতে হবে। যে পারবে না, সে সন্তান নয়; তার অধিকারও নেই। মনে রাখবেন, সম্পত্তি আসে উত্তরাধিকার হিসেবে। পিতা-মাতা যতদিন বেঁচে আছেন সম্পত্তি ততদিন তাদের। তাদেরটা খেয়ে তাদের দায়িত্ব নিতে পারব না- এমন কথা পাষণ্ডরা বলতে পারে। সন্তান হয়ে এমনটা করার অধিকার কারও নেই – ছেলেরও নেই মেয়েরও নেই।

৩। এগুলো ফালতু চিন্তা। যার সম্পত্তি সে কিভাবে সেটা ম্যানেজ করবে এই ভাবনা আপনার নয়। এই অজহাত দেখিয়ে কারও অধিকার হরণ করার চেষ্টা শঠতা। তার অধিকার তার প্রাপ্য।

৪। পিতার সম্পত্তি পেয়ে স্বাবলম্বী হওয়া নিয়ে আগেই বলেছি। কেউ স্বাবলম্বী হতে না পারলে সেটা তার দায়। ‍তুমি স্বাবলম্বী হতে পারবে না – এই অজুহাত দেখিয়ে সন্তান হিসেবে প্রাপ্য অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না। সম্পত্তি পেলে যদি স্বাবলম্বী হওয়া না যায় তাহলে আপনারা ছেলেরাই অধিকার ছেড়ে দিয়ে বাহাদুরি দেখান প্লিজ।

লেখক: সাংবাদিক; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ