পুলক ঘটক: মহাভারতের রাজা পাণ্ডু অভিশপ্ত হয়ে স্ত্রী মিলনে অক্ষম হয়ে পড়েন। কিন্তু বংশবিস্তার দরকার; রাজ পরিবারের উত্তরাধিকার দরকার। কি করা যায়? সে যুগে সন্তান দত্তক নেয়ার প্রথা খুব একটা চালু হয়নি। কদাচিত হলেও তা প্রকৃষ্ট বিবেচনা করা হতো না। পুত্র জন্মানোই প্রকৃষ্ট এবং স্ত্রী হল তার ‘ক্ষেত্র’। নিজে না পারলে সন্তানহীন পুরুষরা অন্য কাউকে নিয়োগ দিয়ে তার ক্ষেত্রে’র মাধ্যমে সন্তান নিত। সহজ করে বললে ক্ষেত্র (স্ত্রী) ভাড়া দিত।
মহারাজ পাণ্ডু তাই করেছিলেন। তিনি তার স্ত্রী কুন্তিকে দিয়ে তিন জন ব্যক্তির (দেবতার) মাধ্যমে যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুন এবং আরেক স্ত্রী মাদ্রীকে দিয়ে নকুল ও সহদেব নামক পুত্র সন্তান লাভ করেছিলেন।
কিন্তু ক্ষেত্র ভাড়া দিলে সেই সন্তানের বাবা কে হবে? ক্ষেত্র যার, সন্তান তার; নাকি বীর্য যার সন্তান তার? এ বিষয়ে সে যুগে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল এবং এর শাস্ত্রীয় মিমাংসার প্রয়োজন হয়েছিল।
সন্তানের অভিভাবকত্ব আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমরা যদি প্রাচীন শাস্ত্র ও বিচার ব্যবস্থার দিকে দৃকপাত করি, তবে মহাভারত ও বিভিন্ন সংহিতার এ সংক্রান্ত অধ্যায়গুলি তাৎপর্যপূর্ণ। বর্তমান যুগে উন্নত চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে পুরুষের বন্ধ্যাত্ব বা অক্ষমতার ক্ষেত্রে শুক্রানু দান (sperm donation) এবং সন্তান ধারণে মায়ের শারীরিক অক্ষমতার ক্ষেত্রে ‘সারোগেসি’ (surrogacy) অর্থাৎ অন্য নারীর গর্ভে ভ্রুণ স্থানান্তর করে সন্তান জন্মদানের পদ্ধতি চালু হয়েছে। শুক্রদান এবং সারোগেসি’র নৈতিক ও আইনগত দিক আলোচনায় এবং এরকম সন্তানের অধিকার ও অভিভাবকত্ব নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রাচীনকালের ক্ষেত্রজ সন্তানের বিধিবিধান প্রাসঙ্গিক। মনুসংহিতার ৯ম অধ্যায়ের ৩১ থেকে ৫৫ নম্বর শ্লোক পর্যন্ত মোট ২৫টি শ্লোকে এবং আরও কয়েক জায়গায় এ নিয়ে আলোচনা আছে। সেখানে বীজ যারই হোক, ক্ষেত্রের মালিকানা যার, পুত্র তারই হবে – এই মতের প্রাবল্য দেখা যায়।
যদন্যগোষু বৃষভো বৎসানাং জনয়েচ্ছতম্
গোমিনামেব তে বৎসা মোঘং স্কন্দিতমার্ষভম্।। (মনু ৫০/৯)
অর্থ: একের বৃষভ (ষাঁড়) যদি অন্যের গাভীতে বৎস (বাছুর) জন্মাইয়া দেয়, ঐ বৎস গোস্বামীর (অর্থাৎ গাভীর মালিকের) হইবে, বৃষভস্বামীর (অর্থাৎ ষাঁড়ের মালিকের) নহে। উহার শুক্রসেচন নিস্ফল। (মনু ৫০/৯)
তথৈবাক্ষেত্রিণো বীজং পরক্ষেত্রপ্রবাপিণঃ
কুর্ব্বন্তি ক্ষেত্রিণামর্থং ন বীজী লভতে ফলম্।। (মনু ৫১/৯)
অর্থ: যেমন গবাদিগর্ভে উৎপন্ন বৎস (বাছুর) গোস্বামীর (গাভীর মালিকের) হয়, তেমনই পরভার্যার (অপরের স্ত্রীর) উৎপাদিত সন্তান উৎপাদকের হয় না, ক্ষেত্রের মালিকের (অর্থাৎ নারীর স্বামীর) ঐ সন্তান হয়। (মনু ৫১/৯)
অন্যান্য সংহিতাতেও এ বিষয়ে আলোচনা আছে। গৌতম সংহিতার অষ্টাদশ অধ্যায়ের ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্লোকে মনুসংহিতার বিপরীত কথা বলা হয়েছে:
“জনয়িতুরপত্যম্ সময়াদন্যত্র জীবতস্য ক্ষেত্রে পরস্মাৎ তস্য দ্বয়োর্বা রক্ষণাদ্ ভর্ত্তুরেব।।” (গৌতম ৫-৬/১৮)
অর্থ: জনয়িতারই (উৎপাদনকারির) অপত্য (সন্তান)। যাহার শুক্র তাহারই পুত্র; তবে, এ বিষয়ে ভিন্ন চুক্তি থাকিলে ভিন্নরূপ হইবে। স্বামী জীবীত থাকিলে সন্তানটি জনয়িতার ও স্বামীর উভয়েরই হইবে; কিন্তু উহাদিগের মধ্যে একজন যদি ভরণ-পোষণ না করে অপর জন করে, তাহা হইলে যে ভরণ-পোষণ করে সন্তান তাহারই হইবে।
মনুসংহিতার ৯ম অধ্যায়ের ৫২ এবং ৫৩ শ্লোকেও এরকম সন্তানের মালিকানা নিয়ে চুক্তি সম্পাদনের ধারণা ব্যক্ত হয়েছে
ক্রিয়াভ্যুপগমাত্ত্বেতদ্বীজার্থং যৎ প্রদীয়তে।
তস্যেহ ভাগিনৌ দৃষ্টৌ বীজী ক্ষেত্রিক এব চ।। (মনু ৫৩/৯)
অর্থ: যদি এ অপত্য (সন্তান) আমাদিগের উভয়েরই হইবে, এমত অভিসন্ধি থাকে, তবে ঐ সন্তান উভয়ের হইবে। (মনু ৫৩/৯)
মহাভারতের বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুন বিধবা বিবাহ করেছিলেন। তার চার স্ত্রীর মধ্যে দ্বিতীয়জন নাগকন্যা উলূপী ছিলেন বিধবা। উলূপী’র গর্ভে অর্জুনের ঔরসে ইরাবান (ইলাবন্ত) নামক এক পুত্র জন্মলাভ করে। কিন্তু ইরাবান তার মায়ের পূর্বের স্বামী’র ক্ষেত্রজ পুত্র হিসেবে পরিচিতি পান। (–মভা, ভীষ্মপর্ব ৪-৯/৯১) অর্থাৎ অর্জুনের সঙ্গে উলূপী’র বিয়ে হলেও ক্ষেত্রের মালিকানা বদল হয়নি। উলূপী সারাজীবন তার আগের স্বামীর ক্ষেত্র হিসেবে বহাল ছিলেন। ইরাবান কখনো অর্জুনপুত্র এবং কখনো তার মায়ের পূর্বস্বামীর সন্তান হিসেবে বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছেন।
এই যে শাস্ত্রের উদ্ধৃতি, এতে কোথাও নিজ সন্তানের উপর নারীর কোনো অধিকার বা মালিকানা উল্লেখ হয়নি। নারী একটি ক্ষেত্র মাত্র। তিনি নিজেই অন্যের। তার মালিকানা অন্যের হাতে; তিনি অন্যের ক্ষেত্র। সেই ক্ষেত্রকে ভাড়া দেয়া যায়, তাতে বীজ বপনের জন্য অন্যকে নিয়োগ করা যায় এবং সেই সন্তান কার হবে, তা নিয়ে দর কষাকষি করা যায়।
লক্ষণীয়, সন্তান উৎপাদনে নারীও বীজদাতা, সে ধারণা এখানে অনুপস্থিত। আধুনিক বিজ্ঞানে প্রমাণিত সত্য, নারী কেবল গর্ভধারিনী ক্ষেত্র নয়; নারী বীজদাত্রীও বটে। দুটি বীজের সম্মিলনে নতুন প্রাণের উন্মেষ হয়। একটি বীজের নাম ডিম্বানু এবং আরেকটি বীজের নাম শুক্রাণু। সুতরাং একটি সন্তানের মধ্যে নারী ও পুরুষের যৌথ অস্তিত্ব বিদ্যমান। নারী একদিকে সন্তান গর্ভে ধারণ করছেন; তার রক্ত, মাংস এবং নিজ খাদ্যের সারাংশ সরবরাহ করে গর্ভের শিশুর পুষ্টি যোগাচ্ছেন এবং আরেকদিকে তিনি স্বয়ং সন্তানের বীজ বটে। জন্মের পর স্তন দান থেকে শুরু করে সন্তান বড় হওয়া পর্যন্ত মায়ের অবদান অনেক বেশি। কিন্তু প্রাচীন যুগের শাস্ত্রবাণীতে এই বিষয়টি উপেক্ষিত।
এই শাস্ত্র তৎকালীন বিজ্ঞান এবং তৎকালীন সমাজচিন্তার উপর প্রতিষ্ঠিত। সে যুগের বিজ্ঞানে যতটা আবিস্কৃত হয়েছিল, ততটুকুরই প্রতিফলন সেখানে রয়েছে। সেখানে নারীর স্বাতন্ত্র ছিল না। আমি একজন মানুষ, আমার মালিক আমি নিজে, আমার স্বাধীনতা আছে, আমি নিজেই আমার অস্তিত্ব – এরকম ধারণার ভিত্তিতে সে যুগের বিধিবিধান রচিত হয়নি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ সেযুগে ছিল না। সেখানে ব্যক্তি অন্যের উপাদান। আধুনিক আইন প্রণয়নে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মানব মর্যাদা বিবেচ্য। তাই হিন্দু অভিভাকত্ব আইনে সন্তানের উপর মায়ের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে, নাকি প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী নারীকে ক্ষেত্র হিসেবে দেখানো বর্তমান প্রচলিত আইন বহাল থাকবে ভাবা দরকার। বিবাহ এবং উত্তরাধিকারসহ সকল ক্ষেত্রে নারীর সমঅধিকার স্বীকার করা হবে কিনা ভাবা দরকার। নারীকে মানুষ হিসেবে স্বীকার করা হবে, নাকি নারীকে অপরের ক্ষেত্র হিসেবে দেখা হবে ভাবা দরকার।
মহাভারতের যুগে মনুসংহিতার বিধান সবচেয়ে বেশি অনুসৃত হয়েছে। মহাভারতের বহু জায়গায় মনু’র বিধানের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। আবার মনুসংহিতাতেও মহাভারতের কাহিনীর উদ্ধৃতি দেখা যায়। কোন গ্রন্থটি আগে এবং কোনটি পরে তা বোঝা কঠিন। তবে গবেষকদেরে মতে মনুসংহিতাই বেশি প্রাচীন। সে সময়ের সমাজে যেসব প্রথা চালু ছিল, মনুসংহিতায় তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
মহাভারতে ক্ষেত্রজ সন্তানের দৃষ্টান্ত অনেক। অর্থাৎ এগুলো বিধানমাত্র নয়, এগুলোর প্রায়োগিক সত্যতা আছে। ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাইকে নিয়োগ দেয়া হতো। তবে অন্য পুরুষ নিয়োগের নজিরও আছে। যেমন পাণ্ডুর পাঁচ পুত্র লাভের ক্ষেত্রে তার ভাই ধৃতরাষ্ট্রকে নিয়োগ দেয়া হয়নি।
অন্যদিকে পাণ্ডু, ধৃতরাষ্ট্র এবং বিদুর – এই তিনজনও ছিলেন তাদের বাবা বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রজ পুত্র। রাজা শান্তনুর পুত্র বিচিত্রবীর্য অপুত্রক অবস্থায় যক্ষারোগে মারা যান। রেখে যান দুই বিধবা স্ত্রী অম্বিকা ও অম্বালিকা। এ অবস্থায় রাজমাতা সত্যবতী বংশ রক্ষার প্রয়োজনে ঐ দুই বিধবা নারীর গর্ভে সন্তান প্রদানের জন্য ভীস্মকে আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ভীষ্মদেব তার ব্রহ্মচর্যের প্রতিজ্ঞা ভাঙতে রাজি হননি।
তখন ডাকা হয় ব্যাসদেবকে। ব্যাসদেব ছিলেন রানী সত্যবতীর কুমারি অবস্থায় জন্ম নেয়া পুত্র। ঋষি পরাশরের ঔরসে তার জন্ম হয়েছিল। পরে রাজা শান্তনু সত্যবতীকে বিয়ে করেছিলেন। কোনো নারীর কুমারী জীবনে কোনো সন্তান হয়ে থাকলে, ঐ নারীকে যে পুরুষ বিয়ে করবে ঐ সন্তানের মালিকানাও তার হবে। এ ধরনের পুত্রকে বলে কানীন পুত্র। ব্যাসদেব পরাশরের ঔরসে জন্ম নিলেও রাজা শান্তনুর কানীন পুত্র ছিলেন। যেমন মহাবীর কর্ণ কুন্তির বিবাহপূর্ব সন্তান হলেও পরবর্তীতে তিনি রাজা পাণ্ডুর কানীন পুত্র হিসেবে স্বীকৃতি পান।
মহাভারতে ক্ষেত্রজ পুত্রের আরও অনেক উদাহরণ আছে। রাজা বলি ঋষি দীর্ঘতমাকে দিয়ে নিজের স্ত্রী সুদেষ্ণার গর্ভোৎপাদন করিয়েছিলেন (সূত্র: মভা আদিপর্ব ১৪ অধ্যায়); ক্ষত্রিয় কল্মাষপাদ ব্রাহ্মণ বশিষ্ঠকে দিয়ে নিজ স্ত্রী দময়ন্তীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করান (সুত্র: মভা আদিপর্ব ১৮২তম অধ্যায়) এবং ঋষি উদ্দালক শিষ্যকে দিয়ে নিজের পত্নীর গর্ভোৎপাদন করিয়েছিলেন (সুত্র: মভা শান্তিপর্ব ৩৪/২২)।
সমাজের সবচেয়ে উচু তলার মানুষদের অর্থাৎ রাজপরিবারগুলোর কাহিনী পুরাণে ও মহাভারতে বেশি। তাই সাধারণ জনসমাজে এসব প্রচলন বা বিস্তৃতি কতটা ছিল তা অনুমান গ্রাহ্য। বিবাহ এবং তথা নর-নারীর সম্পর্কবিধির ক্ষেত্রে সংহিতাগুলোতে শূদ্রদের ক্ষেত্রে কম কঠোরতা দেখা যায়। তাই আমজনতার স্তরে বিষয়গুলো আরও সহজ ছিল মনে হয়। শাস্ত্র গবেষক অমল কুমার রায় তার ”মনুসংহিতায় বিবাহ” গ্রন্থে বলেছেন, “কখনো কখনো নিযুক্ত পুরুষকে অর্থদানও করা হতো।”
সংহিতার এসব বিধান আপৎকালীন ধর্ম হিসেবে বিহিত। কারও সন্তান থাকতেও অন্যকে নিয়োগ দিয়ে স্ত্রীর গর্ভে সন্তান জন্মানোর সমর্থন শাস্ত্রে নেই। সুতরাং সে যুগে ঘরে ঘরে এরকম ঘটনা ঘটত বলা যাবে না। বিয়ে, পিতা-মাতা এবং তাদের মাধ্যমে সন্তান – এভাবে গড়ে ওঠা পরিবার প্রথা সেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিল। পরিবারগুলো ছিল পিতৃতান্ত্রিক যৌথপরিবার। জ্যেষ্টভ্রাতা পরিবারের কর্তা হতেন। পরিবারে পুত্ররা পিতার অধিনস্ত ছিল এবং কন্যাদের মতো তাদেরকেও হস্তান্তরযোগ্য পন্যের মতো ব্যবহারের নজির আছে। কনিষ্ঠ ভ্রাতারাও জ্যেষ্ঠভ্রাতার সম্পদ এবং আজ্ঞাবহ ছিল। সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধে অধিকারের ধারণা প্রকট ছিল না। যার যার স্থান থেকে দায়িত্ব পালনের শিক্ষা ছিল। ফলে সেই পরিবারে স্বার্থের সংঘাত কম ছিল এবং পারিবারিক বন্ধন প্রবল ছিল। আধুনিক আইন ও অধিকার এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। অধিকার বনাম কর্তব্যের নিরিখে আইন ও নীতিকাঠামো আলোচনা করলে সেযুগের সঙ্গে আধুনিক সমাজ-ধারণা মেলানো কঠিন।
সে যুগের মনুর বিধান অনুযায়ী বিয়ের মধ্য দিয়ে কন্যা সন্তানকে একজন পুরুষের কাছে এমনই এক হস্তান্তর; যার থেকে নারীর আর মুক্তি নেই।
ন নিস্ক্রয়বিসর্গাভ্যাং ভতৃর্ভার্যা বিমুচ্যূতে।
এবং ধর্মং বিজানীম: প্রাক্ প্রজাপতিনির্মিতম্।। (মনু ৯/৪৬)
অর্থ: “বিক্রয় ও বিসর্গ (ত্যাগ) দ্বারা স্বামী হইতে স্ত্রী বিমুক্ত হয় না। এইরূপ ধর্মই পূর্বে প্রজাপতি নির্ণয় করিয়াছেন বলিয়া জানি।”
অথচ আশ্চর্য বিষয় মনু সংহিতাসহ বেদাদি শাস্ত্রেই স্ত্রী ত্যাগ ও স্বামী ত্যাগের বিধান আছে; নারীর পুন:বিবাহের বিধান আছে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের নির্দশনও সে যুগের শাস্ত্রে আছে। একেবারে নেই তা বলা যাবে না। বিধিবিধানের মধ্যে অনেক ধরনের স্ববিরোধিতা আছে। একই গ্রন্থে পরস্পর বিরোধী কথা আছে; মুনিদের মধ্যে মতান্তর আছে। কিছু ক্ষেত্রে নারীর অধিকারের স্বীকৃতি আছে যা আমাদের পথ দেখায়। তাছাড়া গ্রন্থগুলোর অবিকল সংস্করণ পৃথিবীতে সংরক্ষিত আছে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ আছে। লিখন পদ্ধতি আবিস্কারের আগে দীর্ঘকাল এসব গ্রন্থ বিদ্বান ব্রাহ্মণরা গুরুশিষ্য পরম্পরায় মুখস্ত হিসেবে সংরক্ষিত রেখেছিলেন। কাগজের আবিস্কার, মুদ্রনযন্ত্রের আবিস্কার ইত্যাদি ইতিহাসের অনেক পরের ঘটনা। সুতরাং এসব গ্রন্থ থেকে আমরা তৎকালীন সমাজচিত্র সন্ধান ও ইতিহাস গবেষণা করতে পারি; সেই সমাজকে অনুকরণ করতে পারি না। সেখানে অনেক ভাল আদেশ-নির্দেশ আছে, উত্তম নিদর্শন আছে; যা থেকে আমরা চিন্তার সূত্র গ্রহণ করতে পারি। কিন্তু আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আধুনিক বাস্তবতা বিবেচনা করতে হবে।
সেদিনের সমাজ এবং আজকের সমাজ এক নয়। আমি যে সময়ের বর্ণনা এই প্রবন্ধে তুলে ধরছি, তারও আগে পৃথিবীতে মানব বসতি ছিল; মানব সমাজ ছিল এবং সেই সমাজ আরও অন্যরকম ছিল। আদিতে আইনহীন মুক্ত সমাজ ছিল। আদিমকালে সমাজ কেমন ছিল মহাভারত থেকেই তার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন এই পর্যায়ে তুলে ধরব।
রাজা পাণ্ডু নিজে অপারগ হওয়ায় যখন তার স্ত্রী কুন্তিকে অন্য পুরুষের কাছ থেকে সন্তান গ্রহণের নির্দেশ দেন, তখন সতী কুন্তি তাতে সহজে রাজি হননি। এতে পাপ বা অধর্ম হবে বলে তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন। তখন পাণ্ডু তাকে বোঝালেন, এটা কোনো ব্যাপার নয়। ধর্ম এরকম কোনো বাঁধাধরা জীবন-ব্যবস্থা নয়। অতীতে নারীরা যৌনতার ক্ষেত্রে মুক্ত ও স্বাধীন ছিল। স্বামীর কাছে নারীদের এই যে এখনকার বাঁধা দেয়া অবস্থা, অতীতে তা ছিল না। এইসব বিধিবিধান নতুন।
পাণ্ডু বলছেন,
অথ ত্বিদং প্রবক্ষ্যামি ধর্মতত্ত্বং নিবোধ মে।
পুরাণম ঋষিভির্দৃষ্টং ধর্মবদ্ভির্মহাত্মভিঃ॥
অনাবৃতাঃ কিল পুরা স্ত্রিয় আসন্ বরাননে।
কামচারবিহারিণ্যঃ স্বতস্ত্রাশ্চারুহাসিনি॥
তাসাং ব্যুচ্চরমাণানাং কৌমারাৎ সুভগে পতীন্।
নাধর্মোহভূদ্ বরারোহে স হি ধর্মঃ পূরাভবৎ॥
তঞ্চৈব ধর্মং পৌরাণং তিথ্যগ্ষোনিগতাঃ প্রজাঃ।
অদ্যাপ্যনুবিধীয়ন্তে কামক্রোধবিবর্জিতাঃ॥
প্রমাণদৃষ্টো ধর্মোহয়ং পূজ্যতে চ মহর্ষিভিঃ।
উত্তরেষু চ রম্ভোরু কুরুস্বদ্যাপি পূজ্যতে॥
স্ত্রীণামনুগ্রহকরঃ স হি ধর্মঃ সনাতনঃ।
অস্মিংস্তু লোকে ন চিরাম্মর্যাদেয়ং শুচিস্মিতে॥
স্বাপিতা যেন যস্মাচ্চ তন্মে বিস্তরশঃ শৃণু।
–মভা, আদিপর্ব ১২২।৩-৯।
অর্থ: “মহাত্মা ধর্মপ্রাণ ঋষিগণ যাহা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন সেই প্রাচীন ধর্মতত্ত্ব তোমার নিকট বলিতেছি, শ্রবণ কর। পুরাকালে স্ত্রীলোকগণ অবারিত ছিল; তাহারা স্বাধীনভাবে স্বেচ্ছানুযায়ী বিহার করিয়া বেড়াইত। এই ভাবে যে তাহারা কৌমার অবস্থা হইতেই পতিকে উল্লঙ্ঘন করিত, ইহাতে কোনও অধর্ম হইত না। ইহাই পুরাকালে ধর্ম ছিল। অদ্যাপি এই প্রাচীন ধর্ম পশুপক্ষিকীটপতঙ্গাদি জীবগণ কামক্রোধশূন্য চিত্তে অনুসরণ করে। মহর্ষিরা এই বিধিসম্মত ধর্মের আদর করেন। আজও উত্তর কুরুতে এই প্রথা আদৃত হয়। স্ত্রীলোকদিগের পক্ষে সুবিধাজনক এই ধর্ম সনাতন। পরন্তু অল্পকাল হইল, বর্তমানে প্রচলিত নিয়ম নির্দিষ্ট হইয়াছে। যিনি যে কারণে বর্তমান নিয়ম স্থাপন করিয়াছেন তাহা বিস্তারিত বলিতেছি, শোনো।”
এ কথা বলে পাণ্ডু শ্বেতকেতুর উপাখ্যানটি বর্ণনা করেন। শ্বেতকেতু দেখেন তার পিতার সামনেই তার মাকে একজন পরপুরুষ হাত ধরে নিয়ে গেল। তা দেখে শ্বেতকেতু নিয়ম ঘোষণা করেন, যে নারী স্বামীকে অতিক্রম করবে সে পাপেরভাগী হবে। মহাভারত বলছে, তখন থেকে নারী একজন পুরুষের অধীন হয়েছে, তার আগে ছিল না।
আমরা সমাজবিজ্ঞানে পড়েছি আদিকালে যখন কাপড় আবিস্কার হয়নি, তখন মানুষ নগ্ন থাকত। নব নব আবিস্কার এবং প্রযুক্তির কল্যাণে সেই সমাজের পরিবর্তন হয়েছে। কালক্রমে পরিবার প্রথা গড়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে নতুন নতুন বিধিবিধান ও আইন কানুন তৈরি হয়েছে।
সমাজ ও আইন পরিবর্তনশীল। অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও যুগের সাথে সমাজ, নিয়ম এবং আইন বদলায়। দিন বদলে গেছে, কিন্তু ক্ষেত্রজ পুত্রের সেই আইন ও আইনি দৃষ্টিভঙ্গি আজও বাংলাদেশে “হিন্দু আইন” হিসেবে রয়ে গেছে। ইংরেজরা তৎকালীন সমাজে প্রচলিত প্রথা ও বিধিবিধানকে আইন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর কিছু কোডিফাইড অইন বানিয়ে গেছে। তাতে তারা অনেককিছু গ্রহণ, বর্জন, সংযোজন ও পরিবর্তন করেছে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর সেদেশে ঐ আইন ফেলে দিয়ে নতুন হিন্দু আইন হয়েছে। নেপালের হিন্দু আইন আগে থেকেই ভিন্ন ছিল। সেখানেও বর্তমানে সমঅধিকার ভিত্তিক আধুনিক আইন চালু হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দু আইন সেই ইংরেজ আমলেই এখনো আটকে আছে। অচল অনড় বিধিবিধান উন্নতি ও সমাজ প্রগতির অন্তরায়।