পুলক ঘটক
হিন্দু আইনে বিদ্যমান লিঙ্গবৈষম্য নিরসনের জন্য আমরা দাবি জানানোর পর থেকে নারীবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র নানারকম কথা বলে যাচ্ছে। মূল প্রোপাগান্ডা ফেসবুকে। তাদের কথাগুলো অবান্তর হলেও এসবের জবাব না দিয়ে আমাদের উপায় থাকে না। যেমন অনিমেষ মন্ডল নামে একজন লিখেছেন, “হিন্দু নারীদের এই জন্য ডিভোর্সের অধিকার দেয়া হয়না কারন তারা কোনো কাগজ কলমে বিবাহ করেনা। তারা অগ্নি শাক্ষী রেখে কপালে সিদুর দিয়ে একে অপরকে জীবনসঙ্গী হিসেবে অন্তরে স্থাপন করে। বিবাহ যেখানে বানিজ্যের মত কাগজ কলমে হবে সেখানে ডিভোর্সও থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। আমার মত এই যে হিন্দু প্রথা বিবাহের নিয়ম পরিবর্তন করতে যাবেন না। আপনারা যেই হোন না কেন।”
অনিমেষ মন্ডলের এই মন্তব্য ভাল এবং যথার্থ বলব, যদি তিনি প্রমাণ করতে পারেন এই মন্তব্যটি প্রতারণামূলক নয়। যদি আপনারা কেউ প্রমাণ করতে পারেন, “অগ্নি স্বাক্ষী রেখে কপালে সিঁদুর দিয়ে একে অপরকে জীবনসঙ্গী হিসেবে অন্তরে স্থাপনের” ফলে ঐ নারী এবং পুরুষ তাদের নিজেদের দু’জনের বাইরে আর অন্য কাউকে চিন্তা করতে পারে না। যদি মন্ত্র দিয়ে তাদের দু’জনের মনকে এমনভাবে বেঁধে দেওয়া যায়, যাতে করে তারা দু’জনের বাইরে আর কারও দিকে তাকানোর আগ্রহ না পায়, তবে যথার্থ।
যদি প্রমাণ করা যায়, মন্ত্র পাঠ করে গোত্রান্তর করার ফলে নারীর ডিএনএ পরিবর্তন হয়, তবে আরও বেশি যথার্থ। যদি প্রমাণ করা যায়, গোত্রান্তরের ফলে মেয়েটি আর তার বাবার সন্তান থাকছে না, তার ডিএনএ বদলে গিয়ে শ্বশুরের ডিএনএ বা তার স্বামীর ডিএনএ তার শরীরে চলে এসেছে, তবে আমরা তা মানতে বাধ্য। নইলে এগুলো প্রথামাত্র।
আমরা যেমন প্রিয়জনকে হাজার বছর বেঁচে থাকার জন্য আশির্বাদ করি, কিন্তু ঐ আশির্বাদের ফলে বাস্তবে কারও যমের দুয়ারে তালা লাগে না, বিবাহের মন্ত্র এবং অগ্নিস্বাক্ষীও তেমন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত পুরোহিত, পিতামাতা, আত্মিয়স্বজন ও দশজনকে সাক্ষী রেখে বিয়ে করাটাই আসল। সূর্য, চন্দ্র, অগ্নী, দেবতা ও পিতৃপুরুষকে সাক্ষী রাখা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। বাস্তবে তারা কেউ প্রয়োজন হলে সাক্ষ্য দিতে আসেন না।
এত দূরেও না যাই। প্রমাণ করতে হবে, অগ্নি সাক্ষী করে একজন নারীকে বিয়ে করার পর ঐ পুরুষের আর দ্বিতীয় কোনো নারীকে বিয়ে করার সুযোগ শাস্ত্রে বা আইনে নেই। অর্থাৎ বিয়ে নামক এই স্থায়ী বন্ধনটা শুধু নারীর জন্য নয়; বিয়েটা পুরুষের জন্যেও স্থায়ী বন্ধন। প্রমাণ করতে হবে, একজন হিন্দু পুরুষ শাস্ত্র অনুযায়ী একাধিক বিয়ে করতে পারে না। কারণ নারীর মতোই তার ক্ষেত্রেও একটি অবিভাজ্য বিবাহ বন্ধন হয়ে গেছে। সেখান থেকে তার আর ফেরার উপায় নেই। আরও প্রমাণ করতে হবে শাস্ত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের নির্দেশ নেই। বিবাহ অবিভাজ্য বন্ধন হলে বিবাহ বিচ্ছেদের নির্দেশ শাস্ত্রে কিভাবে থাকতে পারে? আপনাকে এও প্রমাণ করতে হবে শাস্ত্রে নারীর বহুবিবাহের আদেশ নেই বা দৃষ্টান্ত নেই।
সঙ্গে আরও একটি জিনিস আপনাকে প্রমাণ করতে হবে। তা হল, শাস্ত্র অনুযায়ী কন্যা দান করাই একমাত্র বিবাহ পদ্ধতি। অন্য কোনও বিবাহ পদ্ধতি নেই। যদি কন্যাদান ছাড়াও বিবাহ করার পদ্ধতি শাস্ত্রে থাকে তবে তার কোনটি গ্রহণ করা যায়, কোনটি যায় না তা প্রত্যেককে বিবেক দিয়ে বিচার করতে হবে।
আমরা যে প্রজাপত্য নিয়মে বিয়ে দেই, শাস্ত্র অনুযায়ী সেটাই সর্বোত্তম বিয়ে, প্রমাণ হওয়া দরকার। শাস্ত্রে যজ্ঞের পুরোহিতকে দক্ষিণা হিসেবে কন্যা দান করার বিধান আছে, যাকে আর্য বিবাহ বলে। শাস্ত্র অনুযায়ী আর্য বিবাহ অর্থাৎ পুরোহিতকে কন্যা দান করা প্রজাপত্য বিয়ের চেয়েও উত্তম। তাহলে সেই উত্তম বিবাহ পদ্ধতি থাকতে, আপনি অধমটিকে কেন বেছে নেবেন?
শাস্ত্রে কন্যাদান না করে প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর পারস্পরিক সম্মতিতে তাদের পছন্দ অনুযায়ী বিবাহের নিয়ম আছে। তাকে গান্ধর্ব বিবাহ বলে। আবার কারও মেয়েকে বলপূর্বক অপহরণ করে বিয়ে করার বিধানও শাস্ত্রে আছে; যাকে রাক্ষস বিবাহ বলে। প্রাপ্তবয়স্ক নরনারী’র পারস্পরিক পছন্দে অনুযায়ী বিয়ে করার চেয়ে এই আসুর বিবাহকে অর্থাৎ বলপূর্বক হরণ করাকে উত্তম বলা হয়েছে।
শাস্ত্রে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের বিধান যেমন আছে, তেমনি এই ধরনের নানাপন্থায় বিয়ের কথা আছে। “অগ্নি সাক্ষী রেখে কপালে সিঁদুর দিয়ে একে অপরকে জীবনসঙ্গী হিসেবে অন্তরে স্থাপন” করার সেই বক্তব্য এবার সবাই প্রণিধান করুন।
লেখক: সাংবাদিক; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ