ড. মিল্টন বিশ্বাস: যে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল সেই দেশ এখন মৌলবাদী শক্তির উত্থানের কারণে সহিংসতায় পূর্ণ হতে চলেছে। অথচ করোনা সংকটের মধ্যে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিববর্ষ উদযাপন করছি। এদেশের রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাপী পরিচিত কেবল তাঁর সততা ও সাহসী ভূমিকার জন্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মানুষের কল্যাণে তাঁর রাজনীতি পরিচালিত হচ্ছে। আশ্চর্যজনক হলো তাঁর কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে মৌলবাদী শক্তি তারই রাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে মানুষকে উস্কানি দিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে।
লজ্জাজনক হলো ১৭ মার্চ (২০২১) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার একটি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে হেফাজতে ইসলামের সমর্থক কয়েক হাজার মানুষ হামলা করে ৮৮টি বাড়িঘর এবং ৭/৮টি পারিবারিক মন্দির ভাংচুর করে এবং ব্যাপক লুটপাট চালায়। অগ্নিঝরা মার্চ মাসে এই সহিংসতার পর আমরা বিস্ময় নিয়ে দেখতে পাই ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এদেশে আসার ঘটনা নিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির অপতৎপরতা।
আসলে চলতি বছর (২০২১) ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে ২৬ থেকে ২৮ মার্চ দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়ে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা দেশের ওপর সাম্প্রদায়িকতার কালিমা লিপ্ত করে দেয়। হেফাজতে ইসলামের বহুল আলোচিত নেতা মামুনুল হক এবং শিশুবক্তা মাদানীকে ধর্মীয় উগ্রবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা গেছে। উস্কানি ও সহিংস ঘটনায় দু’জনই এখন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে বিচারের সম্মুখীন হয়েছে। এরা বেআইনি জন সমাবেশে লিপ্ত ছিল। কখনো কখনো সাধারণ মানুষকে এলোপাতাড়ি মারধর, হত্যার উদ্দেশ্যে আঘাত করে গুরুতরভাবে জখম করেছে, হুমকি দেওয়া আর ধর্মীয় কাজে ইচ্ছাকৃতভাবে গোলযোগ সৃষ্টি ও প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ তো আছেই। এমনকি চুরি ও অপরের পরিবারের নারীদের অপদস্ত এবং প্রতারণার ঘটনার অভিযোগও আছে। ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের তাণ্ডবের সঙ্গেও এদের কোনো না কোনোভাবে সম্পর্ক রয়েছে।
কেবল হেফাজত-জামায়াত নয় শিক্ষিত মৌলবাদী সোস্যাল মিডিয়ায় সাম্প্রদায়িক আচরণের প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছে। জনপ্রিয় নায়িকা কবরী মারা যাওয়ার পর ফেসবুকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো মানুষকে শুনতে হয়েছে- এই নায়িকা হিন্দু ছিলেন তার আবার আত্মা কিসের কিংবা আগের নাম মিনা পাল থাকায় তাঁকে নিয়ে কুৎসিত কথা বলেছে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মৌলবাদীরা।
বাংলা একাডেমির সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক প্রয়াত শামসুজ্জামান খানকে নিয়ে কথাসাহিত্যিক-কবি মাসরুর আরেফিন একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেখানে তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক মতাদর্শ তুলে ধরা হয়েছে। বাঙালির পরিচয় নিয়েও তাঁর মতামত তুলে ধরেছেন মাসরুর। কিন্তু ব্রাত্য রাইসু এর বিপরীতে গিয়ে ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের প্রসঙ্গ টেনে যে কথা বলেছেন তাতে মৌলবাদিতাকে উস্কে দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের ফেসবুকীয় সাম্প্রদায়িকতার ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যেও দেখা যায়।
২০২১ সাল নয় এদেশে একাধিকবার মৌলবাদী শক্তি সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়েছে। যেমন ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা আক্রান্ত হন একইভাবে। সেখানে ১৫টি মন্দির ও শতাধিক বাড়িতে নারকীয় হামলা এবং কিছুদিন পরে পুনরায় কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ছিল মারাত্মক। যদিও শেখ হাসিনা সরকারের নানামুখি পদক্ষেপ এবং হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ ও আওয়ামী লীগের দলীয় উদ্যোগে সমস্যা মোকাবেলায় তৎপরতা লক্ষ করা গিয়েছিল কিন্তু শেষ পরিস্থিতিতে নিরীহ জনগোষ্ঠীর মনোবল ফিরিয়ে আনতে দরকার ছিল আরো বেশি প্রশাসনিক গতি এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণ। একথা সত্য হরহামেশায় আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলে থাকি কিন্তু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ে হিন্দু-খ্রিস্টান- বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর সদস্যদের প্রতি সাম্প্রদায়িক ও বৈরি আচরণ নিয়ে কথা বলি না। কিংবা সাম্প্রদায়িক আচরণের অভিযোগ পেলেও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকি। অথচ মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল চেতনা জাগ্রত রাখতে বাংলাদেশের সকল জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত কর্মপ্রয়াসকে বারবার সামনে আনা হয়। এজন্য কঠোর আইন ও জিরো টলারেন্সের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে।
একথা সকলের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে সহিংসতা শুরু হয়েছিল তার ভয়ঙ্কর রূপটি শেষ হয় নির্বাচনোত্তর হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর ওপর নির্মম আঘাতের মধ্য দিয়ে। সেসময় গ্রামের পর গ্রামের অমুসলিম জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হয়েছেন। বীভৎস অত্যাচার আর লুটপাটের শিকার হয়েছেন সাধারণ সহজ-সরল নারী-পুরুষ। আহত ও নিহতের সংখ্যা দিয়ে সেই নিপীড়ন বিবেচনা না করে বরং ধর্মীয় সংখ্যালঘুর অস্তিত্ব সংকটের বাস্তবতা পর্যালোচনা করা দরকার। কারণ আমরা কথায় কথায় বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে থাকি। কিন্তু অত্যাচার থেকে মুক্ত করা সম্ভব হয় না সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে। এমনকি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও নির্মম সব ঘটনা ঘটেছে এদেশে। যদিও তা ২০০১-এর নির্বাচনোত্তর বিএনপি-জামায়াতের ব্যাপক হত্যা ও সহিংসতার মতো ছিল না।
অন্যদিকে ২০১২ সালে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণের পর সংবাদপত্র লিখেছিল, ‘দেশ ও জাতির জন্য এক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হলো। গত শনি ও রবিবার কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার কয়েকটি স্থানে যে নারকীয় ঘটনা ঘটেছে তার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ দেশের ইতিহাসে এ ধরনের জঘন্যতম ঘটনার উদাহরণ আর একটিও পাওয়া যাবে না। অন্য দেশের সাম্প্রদায়িক ঘটনার সুযোগ গ্রহণ করে অতীতে কুচক্রী মহল বিচ্ছিন্নভাবে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ঘটালেও গত শনি ও রবিবারের ঘটনা নজিরবিহীন।’ বৌদ্ধ সম্প্রদায় যে এদেশেরই ভূমিসন্তান; অনেক আগে থেকেই বসতি এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে আসছে; তারও অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা উপস্থাপন করে তাদের ওপর জঘন্য হামলার নিন্দা ও বিচারের দাবি জানানো হয়েছিল সেসময়।
২০২১ সালের শাল্লা কিংবা ২০১৬ সালের নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক এবং সাপ্তাহিকসহ অনেক ইলেক্ট্রনিকস ও অনলাইন সংবাদ মাধ্যম একাত্ম হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য এদেশের মিডিয়ার এই ইতিবাচক ভূমিকা আমাদের মতো খ্রিস্টান ধর্মবিশ্বাসীদেরও আশ্বান্বিত করে তুলেছে। কিন্তু শান্তিপ্রিয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের নানান সংবাদ আমাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘পাবনায় খ্রিস্টান পরিবারের জমি দখলের চেষ্টা’সংবাদের মতো জামালপুর, চট্টগ্রামের কালুরঘাট, চুয়াডাঙ্গা, গোপালগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কুড়িগ্রাম, নিলফামারী, ঝিনাইদহ প্রভৃতি এলাকায় খ্রিস্ট বিশ্বাসীদের জমি দখল থেকে শুরু করে শারীরিক নির্যাতনের নানান সংবাদ এদেশে বেঁচে থাকার বিষয়ে আমাদের সংশয়গ্রস্ত করে তুলেছে।
অর্থাৎ কেবল হিন্দু বা বৌদ্ধ সম্প্রদায় নয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। এমনকি চার্চের ভূ-সম্পত্তি দখলের সংবাদ প্রকাশ করে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে সংবাদপত্রই; যদিও সেই দখল প্রচেষ্টার কোনো সুরাহা হয়নি আজও। কারণ সেই ঘটনার সঙ্গে সন্ত্রাসের সমর্থিত দখলবাজ নেতা-কর্মীরা জড়িত। মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকা অনেক সময় নেতিবাচকে পরিণত হয় ক্ষমতার দাপটে; আবার সরকার সমর্থিত মিডিয়ার ভিন্ন অর্থাৎ সংখ্যালঘুর বিপক্ষে অবস্থানের আচরণও লক্ষ করা গেছে অতীতে।
২০০১ সালে নির্বাচনোত্তর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের সময় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মদদপুষ্ট কয়েকটি পত্রিকার নেতিবাচক আচরণ সকলের স্মরণে আছে নিশ্চয়। সেসব পত্রিকার নেতিবাচক আচরণ বাদ দিলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মিডিয়ার যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সেসময় দেখেছিলাম তাও ছিল গণতন্ত্র ও মানবতার পক্ষের শক্তির জাগরণের অবদান হিসেবে তাৎপর্যবহ।২০১৬ সালে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের ওপর হামলা ও উচ্ছেদের প্রতিবাদে মিডিয়ার ভূমিকা ছিল অনন্য।
তবে বিস্ময়কর হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর তাণ্ডবের মতো ভয়ঙ্কর না হলেও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস হয়েছে। ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে এক হাজার ৭১৪টি মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৩০২ জন হত্যা এবং ৩৯২ জন ধর্ষণের শিকার হন। দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর জঘন্যতম হামলা হয়েছে। তার আগে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারির ৯ ও ১০ তারিখে চট্টগ্রামের হাটহাজারির হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা এবং অগ্নিসংযোগ আর সাতক্ষীরার মতো ঘটনা যেন রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০১৩ সালের ৩১ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল সাতক্ষীরার অগ্নিসংযোগ ও তাণ্ডবের ঘটনায় ছিল জামায়াতের প্রত্যক্ষ ইন্ধন। স্থানীয় একটি পত্রিকায় উস্কানিমূলক খবর প্রকাশের পর কালীগঞ্জের ঘর-বাড়িতে যে আগুন জ্বলেছে, তাতে একইসঙ্গে পুড়েছে হিন্দু ও মুসলমানের পবিত্র গ্রন্থ ‘গীতা’ আর ‘কোরআন’। ধর্মীয় মৌলবাদীরা সুযোগের সন্ধানে রয়েছে; তারই স্পষ্ট আলামত দেখা গেছে সেখানকার ঘটনায়। স্কুলের ছাত্রদের দ্বারা অভিনীত একটি নাটককে কেন্দ্র করে স্থানীয় একটি পত্রিকার উস্কানি ধর্মান্ধ রাজনীতির সংস্কৃতির পরিপূরক হয়ে উঠেছিল। এসব ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া তখন থেকেই উচিত ছিল।
অতীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মানুষ হত্যা ও নারী ধর্ষণ মুখ্য ঘটনা ছিল। কিন্তু কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলায় ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর শনিবার দিবাগত রাতের পরিস্থিতি ও হামলার ধরন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় হামলাকারীদের মূল লক্ষ্য দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা। দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে উন্নতি ঘটেছে; সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এসবকেই ধ্বংস করতে চায় মৌলবাদী জনগোষ্ঠী। অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীদের সাজার হাত থেকে রক্ষার জন্য স্বাধীনতার শত্রুরা অপপ্রচার এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপচেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছিল। রামু উপজেলার বৌদ্ধ পাড়ার উত্তম বড়ুয়া উপলক্ষ মাত্র। কারণ একই অভিযোগে আরেক দল দুষ্কৃতকারী ৩০ সেপ্টেম্বর দুপুরে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কোলাগাঁও ইউনিয়নের লাখেরা এলাকায় হিন্দুদের একটি মন্দির ও ৪টি বৌদ্ধ উপাসনালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। পূর্ণিমা উপলক্ষে সেখানে বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল।
অন্যদিকে কক্সবাজারের উখিয়ার একটি বৌদ্ধ বিহারেও একইদিন সন্ধ্যায় হামলা চালানো হয়েছে। তবে রামুর বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকায় এ হামলা হয়েছে বেশি। বর্তমান সরকারের গত আমলে (২০০৯ থেকে ২০১৩) খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে বড় ধরনের সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ২০১৩ সালে সংঘটিত হয় রাঙ্গামাটি জেলাশহরের সরকারি কলেজে। ঘটনাটি ঘিরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে; হাঙ্গামায় দুই পক্ষের শ’খানেক আহত হয়। ২০১০ সালে রাঙ্গামাটির ৩৬ নম্বর ইউনিয়ন সাজেকে বাঙালি-পাহাড়ি সংঘাতে নিহত হয়েছিল বেশ কয়েকজন। তোলপাড় সৃষ্টি করা সেই ঘটনার পিছনেও মৌলবাদীদের ইন্ধন ছিল। ২০১১ সালে খাগড়াছড়ির বড়পিলাকে বাঙালি-পাহাড়িদের মধ্যে যে সংঘাত হয় তাতেও হতাহতের ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ নিশ্চিতভাবে বলা চলে পরিকল্পিতভাবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের টার্গেট করে হামলা চালানো হয়েছে।
কেউ কেউ বিষয়টিকে ইসলাম বিরোধী চলচ্চিত্রের প্রতিবাদের সঙ্গে এক করে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। মুসলিমদের সঙ্গে হিন্দু ও বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে ফায়দা লুটেচ্ছে কেউ কেউ। এখনো নয়াদিগন্ত, ইনকিলাবের মতো সংবাদপত্র সংবাদ পরিবেশনায় পার্বত্য এলাকায় খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্মপ্রচারকে আক্রমণ করে বৌদ্ধদের সঙ্গে খ্রিস্টানদের দাঙ্গা সৃষ্টির উসকানি দিচ্ছে। মৌলবাদী ও জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রচারণায় ধ্বংসযজ্ঞ চলানোর প্রচেষ্টা রয়েছে এখনো। তবে ধর্মীয় ও সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার হয়েছেন; তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সকল ধর্মের মানুষ।
সত্যিই ‘ধর্মীয় বিষয়ে গুজব ছড়িয়ে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা’আমাদের মতো অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগজনক ঘটনা। উপরন্তু একটি পত্রিকায় ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর ‘পার্বত্য অঞ্চলে খ্রিস্টীয়করণ এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব’ শীর্ষক প্রকাশিত কলামে খ্রিস্টান-বৌদ্ধ এবং মুসলিম-খ্রিস্টান দাঙ্গার সম্ভাবনা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে মিডিয়া দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে; গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সংবাদপত্রের ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও উপেক্ষিত হয়েছে। অথচ বর্তমান সংসদীয় গণতন্ত্রের যুগে একমাত্র মিডিয়াই জনগণের পক্ষে কথা বলছে; আর সেই কথা যদি হয় সম্প্রীতি, শান্তি ও মঙ্গলের পক্ষে তখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তবুদ্ধির পরিপোষকতায় নিবেদিত থাকুক মিডিয়া- এ প্রত্যাশা আমাদের।
তবে সুখের বিষয় (শাল্লা, নাসিরনগর ও অন্যান্য ঘটনায়) শেখ হাসিনার সরকার সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনার পর পরই অবিলম্বে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় এমন কোনো কর্মকাণ্ড সরকার বরদাশত করবে না বলেও প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট সকলকে জানিয়েও দিয়েছেন। তবে আমাদের মধ্যে প্রশ্ন থেকে যায় যে, যদি বলা হয় ‘সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে’- এই ঘটনা ঘটিয়েছে তাহলে গোয়েন্দা সংস্থা ও তৃণমূল প্রশাসন জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হওয়ার আগে এবং মন্ত্রীদের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের পূর্বে কৃতিত্ব নিতে পারত পুলিশবাহিনীসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা।
‘সম্প্রীতি রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের বিকল্প নেই’- বলা হচ্ছে বারবার। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ হতে হবে দল-মত নির্বিশেষ মানুষের দ্বারা; তাহলে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ সম্মিলিতভাবে বেঁচে থাকার প্রয়াস সফল ও সার্থক হয়ে উঠবে। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু আর আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির যা কিছু প্রাণিত সম্পদ তার জন্য দরদ ঢেলে আকাঙ্ক্ষার মেঘ হয়ে ঝরে পড়া আমার বাংলাদেশ। অথচ দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় পাল্টে যায় তার রূপ। এখনো সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের উস্কানি থেমে নেই। হেফাজতের আড়ালে আর কারা আছে তা খুঁজে বের করা দরকার।
মূলত সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখা কঠিন কাজ হলেও একেবারে অসম্ভব নয়। যারা আমাদের ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করছে তারা দেশ জাতি ও সকল ধর্মের শত্রু। সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে এই শত্রুদের মোকাবেলা করতে হবে। কারণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার যত ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে কোনোটির সাথেই ধর্ম নয়, রাজনীতি জড়িত। কোনো ঘটনারই আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি। তবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ। কেবল রাজনৈতিক কারণে বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে জঙ্গি রাষ্ট্র বলা হয়েছিল একে। যারা এই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যারা ধর্ম সম্পর্কে কম জানেন তারাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করেন। নিজেদের স্বার্থেই আমাদের সবাইকে সম্প্রীতি রক্ষায় কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে অসাম্প্রদায়িক। আর সম্প্রীতি বজায় রাখতে হলে আমাদের সকল ধর্মের মানুষের সাথে মিশতে হবে, জানতে হবে। সেই প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে এদেশের সকল মুসলিম-হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধকে।
লেখক : ইউজিসি পোস্ট ডক ফেলো এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।