ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও বিভ্রান্তি

কামরুজ্জামান তোতা: হেফাজতে ইসলাম ধর্মের আবরণে ক্ষমতার স্বাদ পেতে উদগ্রীব। যারা পবিত্র ধর্মকে নোংরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে চায় তারা আর যাই হোক, ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিবশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে ২৬ মার্চ থেকে সংঘটিত ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে নারকীয় তা-ব হয়েছে, তা অনেকের কাছে অভাবনীয় মনে হলেও মোটেই অদৃষ্টপূর্ব নয়।

রাজনীতি এক কথায় ক্ষমতার লড়াই তা রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র সব অবস্থাতেই। রাজনীতিতে, ছলচাতুরি, কূটকৌশল, চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র, অর্থবল, পেশিবল ও ধর্মীয় বল এসব নানা পন্থা প্রয়োগ করা হয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য। তাই ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে, ধর্মকে কখনো রাজনীতির ডামাডোলে টেনে আনা উচিত নয়। তবে এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় আছে বলে মনে হয় না, ধার্মিকরা ধর্মের মূল চেতনায় যত না মনোযোগী, এর চেয়ে বেশি আনুষ্ঠানিকতায় নিষ্ঠাবান।

এবার বিজয় দিবসে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে নতুন করে শপথ উচ্চারিত হয়েছে। ভাস্কর্যের বিরোধিতার নামে সাম্প্রদায়িক শক্তি নতুন করে ফণা তোলার কারণেই এক ধরনের প্রতিবাদী মনোভাব বিজয় দিবস উদযাপনকে ঘিরে দেখা গেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনাও এবার বিজয়ের মাসে ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিজয় দিবসের আলোচনা সভায় বলেছেন, মনে রাখতে হবে, সকলে এক হয়ে মুক্তিযুদ্ধে রক্ত ঢেলে দিয়ে এদেশ স্বাধীন করেছি। যার যা ধর্ম তা পালনের স্বাধীনতা সকলেরই থাকবে। আমরা সেই চেতনায় বিশ্বাস করি এবং ইসলাম আমাদের সে শিক্ষাই দেয়। সংবিধানের প্রাধান্য এবং উল্লেখ্য (১) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে (২) জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন। মানুষকে সংখ্যা দিয়ে গণনা করে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু হিসেবে বিভাজন করাটা সমীচীন না হলেও এটা বিশ্বব্যাপীই হয়ে আসছে। সংখ্যালঘুরা সব দেশে, সব সমাজেই কিছুটা আলাদা, তাদের অধিকার ও মর্যাদা সব ক্ষেত্রে এক রকম নয়।

মূলত ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে এটা নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে আরও নানাভাবেই এই ভাগ-বিভক্তি করা যায়, করা হয়। ধর্ম ছাড়াও মানুষের বর্ণ (গায়ের রং), বিশ্বাস, চিন্তা ইত্যাদি দিয়েও সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু নিরূপিত হয়ে থাকে। মোটা দাগে পৃথিবীতে ধর্মবিশ্বাসীরা সংখ্যাগুরু আর ধর্মে অবিশ্বাসীরা সংখ্যালঘু। আস্তিক-নাস্তিক লড়াই নতুন নয়। কোথাও সাদা রঙের মানুষ সংখ্যাগুরু, কোথাও কালো রঙের। কোথাও মুসলমান সংখ্যাগুরু, কোথাও হিন্দু, কোথাও খ্রিস্টান, কোথাও বৌদ্ধ কিংবা অন্য কোনো ধর্ম বিশ্বাসী। এক ধর্মের মানুষের মধ্যেও সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু আছে, থাকতে পারে। যেমন কোথাও শিয়া মুসলমান সংখ্যালঘু, কোথাওবা সুন্নি। খ্রিস্টানদের মধ্যে ক্যাথলিক প্রোটেস্টান্ট আছে। হিন্দুদের বর্ণ বিভাজন তো মারাত্মক। জাতীয়তাবাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার রক্ষণের ব্যাপারে বলা হয়েছে আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।

ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছে সংবিধানে (১) আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে; (খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর দেশের গুরু দায়িত্ব অর্পিত রয়েছে। নাগরিকের প্রাণের নিরাপত্তা এবং সম্পদ ও সম্পত্তির সুরক্ষায় তারা নিয়োজিত। সুতরাং এই বাহিনীর ওপর যারা জেনে-বুঝে হামলা করে প্রকারান্তরে তারা দেশের মানুষের সামাজিক নিরাপত্তার জায়গাটিকেই বিপন্ন করতে চায়। সম্প্রতি হেফাজতে ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে অধর্ম বিস্তারকারী এই কাজেই লিপ্ত হয়েছে। দেশবিরোধী ধর্মাশ্রয়ী অপরাজনীতির হেফাজতের দুই ঘনিষ্ঠ দোসর হলো বিএনপি ও জামায়াত। এদের সম্মিলিত যোগসাজশে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনকালে ধারাবাহিকভাবে সন্ত্রাস সংঘটিত হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে গত ২৬-২৮ মার্চ ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এই তিন দিনে সরকারি হিসেবেই অন্তত ১৭ জন নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশে ধর্ম পরিচয় নির্বিশেষে সব মানুষ সমান সুযোগ ও অধিকার ভোগ করে থাকে বলে যে দাবি করা হয় তা যথার্থ। এটা ঠিক যে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলতে যা বোঝায় বাংলাদেশে তা দীর্ঘদিন ধরেই হয়নি বা হয় না। তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা নেই। এক সময় হয়তো কিছুটা প্রচ্ছন্ন ছিল, এখন তা প্রকট এবং প্রকাশ্য হয়েছে। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার পরিবর্তে তাকে তার ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে বিচার করার প্রবণতা এখন প্রবল। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের একটি অন্যতম মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থায় ‘ধর্ম’ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবেই থেকে যায়। সাধারণ মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনার জন্য যে রকম প্রচার-প্রচারণার প্রয়োজন ছিল, শিক্ষা-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণার অনুকূলে যে রকম মজবুত গাঁথুনি তৈরি করা দরকার ছিল তা পরিকল্পিতভাবে করা হয়নি। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যে চেতনার, তার নাম মানবতা।

আজকের পৃথিবীর অন্যতম বড় সমস্যা দেশে দেশে বিরাজমান ধর্মীয় সংকীর্ণতা, ধর্ম নিয়ে জঙ্গিপনা। নিজ নিজ ধর্ম রক্ষার দোহাই দিয়ে অন্য ধর্মে অনুসারীদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো এক ধরনের অলিখিত প্রবণতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সারা বিশ্বে প্রায় প্রতিটি সমাজে। সব দেশেই এ কাজে বেশি ভূমিকা রাখতে দেখা যায় সমাজপতি বা ধর্মীয় মোড়লদের। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র চেতনার নাম অসাম্প্রদায়িকতা। আজ সমাজের মধ্যে আবার সাম্প্রদায়িক অপশক্তি নানা ধরনের অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। জাতির পিতার নেতৃত্বে একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনায় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক দুরন্ত রিপুরা আমাদের আদর্শ-চেতনার বৃক্ষকে সমূলে বিনাশে নিরন্তর রত। আর সে কারণে আমাদের চেতনাও লোপ পাচ্ছে। আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের জন্মের ইতিহাস, ত্যাগের ইতিহাস, অনুভূতির ইতিহাস, বাংলাদেশ রাষ্ট্র ধারণার ইতিহাস তথা জাতির পিতার আদর্শের ইতিহাস। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ, উন্নয়নের ছোঁয়া পড়েনি এমন কোনো ক্ষেত্র দৃশ্যমান নেই বাংলাদেশের। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা-অর্জনের ঐতিহাসিক সাফল্য একদিনের নয় অনেক চড়াই উতরাই পার করে আসতে হয়েছে আজকের এই অবস্থানে। বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন ও বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়েছেন। তার সেই আদর্শিক ধারায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেধা ও দূরদর্শিতাসম্পন্ন রাজনীতিতে জনগণের ভাগ্য বদলে দিয়েছেন। জননেত্রীর নেতৃত্বে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অগ্রগতি অসামান্য। শেখ হাসিনা তার নিজের কাজে প্রমাণ করেছেন, রাজনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশ ও জনগণের ভাগ্য-উন্নয়ন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এদেশের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনার খাত মানুষ। অতিরিক্ত জনশক্তির দেশ এটি। ষোল কোটি মানুষের মেধা আর বত্রিশ কোটি দক্ষ কর্মীর হাতের পরশে যেকোনো ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। বিভিন্ন পর্যালোচনায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের সাফল্যম-িত এ গর্ভ। উন্নয়নের ছোঁয়া পড়েছে শিক্ষাখাতে, স্বাস্থ্যসেবায়, নারী ও শিশু উন্নয়নে, নারীর ক্ষমতায়নে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে, কৃষিতে কৃতিত্ব এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, প্রবাসী শ্রমিকদের উন্নয়নে অর্জন, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে, বিদ্যুৎখাতে সাফল্য, শিল্প ও বাণিজ্য খাতে অর্জন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাংলাদেশের অর্জন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় অর্জন, মন্দা মোকাবিলায় সাফল্যম-িত করেছে বাংলাদেশকে। গত এক দশকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় মার্কিন ডলারের নিরিখে ৮০ শতাংশ বেড়েছে। বলা বাহুল্য, তৈরি পোশাক খাতের হাত ধরেই এটা ঘটেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ উদযাপনের মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে দেশবাসী পেয়েছে আনন্দবার্তা। জননেত্রী জানিয়েছেন দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির অসীম সম্ভাবনার কথা। আসলে ২৬ ফেব্রুয়ারি (২০২১) বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতিসংঘ কর্তৃক গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি অর্জিত হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ওঠার যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতিপত্র পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশের পথে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো।

জাতি প্রত্যাশা করে, যে যত ক্ষমতাবানই হোক না কেন নাশকতামূলক কর্মকা-ে লিপ্ত থাকলে তাকে আইনের আওতায় দ্রুত নিয়ে আসা। আশা করি, সরকার বর্তমান সহিংসতার চক্র ভেঙে শিগগিরই সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। তবে টেকসইভাবে সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে ধর্ম নিয়ে সহিংসতার উৎস ও কারণ সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে হবে। অন্যথায় রোগের পরিবর্তে রোগের উপসর্গের চিকিৎসা করা হবে। ধর্ম নিয়ে সহিংসতা ও সম্প্রীতিহীনতার ফলে সমাজে অস্থিরতা, অনৈক্য ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। আর দ্বন্দ্ব থেকেই সূত্রপাত হয় সহিংসতার এবং অব্যাহত সহিংসতা জাতিকে চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে। যার লাগাম এখনই টেনে ধরা উচিত।

কামরুজ্জামান তোতা : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

বার্তা সূত্র

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ