কাল থেকে কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। স্ক্রীণশট নেয়া ছবিতে যা দেখছেন তিনি তাই বলেছিলেন। তাকে জবাব দিয়েছিলাম:
প্রথমত, “Special Marriage Act অনুযায়ী একটি মেয়ে কাগজে-কলমে ধর্ম না পাল্টিয়েও বিধর্মীকে বিয়ে করতে পারে” – এই কথা সত্য নয়।
দ্বিতীয়ত, “এক্ষেত্রে Special Marriage Act অনুযায়ী ঐ মেয়ে পিতার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয় না” – এই কথাটি সত্য নয়।
তৃতীয়ত, “পশ্চিমবঙ্গে যেসব মেয়ে Special Marriage Act অনুযায়ী বিধর্মীকে বিয়ে করে, তারা কিন্তু পৈত্রিক সম্পত্তি পায়,” এই কথাটি ঠিক।
চতুর্থত, “আপনার “দুলাভাইরা” Special Marriage Act অনুযায়ী তার স্ত্রীর সম্পত্তির ভাগ চাইতে আসতে” পারবে না। তাই আপনাকে কিছুই করতে হবে না।
পঞ্চমত, “এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে আজ থেকে আমি আপনাদের দলে,” – আপনার এই বাক্যটি সত্য এবং সততাপূর্ণ কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। কারণ,
ষষ্ঠত, আপনি আপনার চারটি বাক্যে যথাক্রমে ১. “একটি মেয়ে”, ২. “ঐ মেয়ে”, ৩. “যেসব মেয়ে” এবং ৪. “আপনার দুলাভাইরা” শব্দ ব্যবহার করেছেন। একবারের জন্যেও “কোনও ছেলে” বা “আপনার ভাবীরা” শব্দ ব্যবহার করেননি। এ হল চিন্তায় ও কর্মে অসত্যের প্রকাশ, অসৎ বোধবুদ্ধির নিদর্শন এবং নারীর প্রতি হেয় দৃষ্টির নজির। কাজেই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেও আপনি আমাদের দলে আসবেন তা বিশ্বাস করা কঠিন।
আপনার প্রশ্নে অসততার সঙ্গে মারাত্মক অভব্যতা আছে, যাতে বোঝা যায় আপনি নিজেই বিধর্মী। ধার্মিক মানুষ, বিশেষ করে সনাতন ধর্মের শিক্ষা ও সংস্কার যার মধ্যে আছে, সে আপনার মতো করে প্রশ্ন করবে না। অন্যসব ধর্মগ্রন্থ পড়তে না পাড়ুক, অন্তত গীতা গ্রন্থটি হিন্দুরা পড়ে। তা থেকে সব নিতে না পারলেও শুধু একটি উপদেশ “তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া৷” (৩৪/৪) যদি নিতে পারতেন তাহলেও আপনার প্রশ্নের ভাষা এরকম হতো না। চাইলে আমিও কটু শব্দ চয়ন করে এর জবাব দিতে পারি। কিন্তু তা করব না। আপনার চাহিদামতো প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।
প্রথমত: ভারতের ‘বিশেষ বিবাহ আইন, ১৯৫৪’ (The Special Marriage Act, 1954) এবং বাংলাদেশের ‘বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২’ (The Special Marriage Act, 1872) সম্পূর্ণ আলাদা। ভারত রাস্ট্র স্বাধীন হওয়ার পর দেশটির নেতারা ১৯৫৪ সালে নতুন করে “বিশেষ বিবাহ আইন” প্রণয়ন করেছিলেন। আমার জানামতে এটি ছিল স্বাধীন ভারতের সংসদে পাসকৃত প্রথম পারিবারিক আইন। এরপর ১৯৫৫ সালে সেখানে Hindu Marriage Act 1955 পাস হয়েছে। তারপর পাস হয়েছে “Hindu Succession Act 1956”। আইনমন্ত্রী বি আর আম্বেদকরের উত্থাপিত হিন্দু কোড বিল তিন ভাগে ভাগ করে এই আইনগুলো পাস করা হয়েছিল।
সেই আইনের সঙ্গে বাংলাদেশের হিন্দু আইনের ব্যাপক ব্যবধান আছে। বাংলাদেশে এখনো ১৮৭২ সালে ইংরেজদের প্রণীত The Special Marriage Act, 1872 চালু আছে। তার সঙ্গে যুক্ত আছে আরও বড় জটিলতা। ছেলে এবং মেয়ে উভয়ে নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস বজায় রেখে বাংলাদেশের বিশেষ বিবাহ আইনের আওতায় বিয়ে করতে পারে না। এই আইনের আওতায় ভিন্ন ধর্মের পুরুষ ও নারী বিয়ে করতে চাইলে উভয়কে এফিডেভিট করে ধর্মত্যাগের ঘোষণা দিতে হয়। ১৮৭২ সালের মূল আইনটিতে ধর্মত্যাগের বাধ্যবাদকতা সুস্পষ্ট না থাকলেও ১৯৪৬ সালের “মুস্তাফিজুর রহমান বনাম রিনা খান” মামলার রায়ে আদালতের দেওয়া ব্যাখ্যার (১৮ ডিএলআর ৫০৯) কারণে এ ধরনের বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীকে এফিডেভিট করে নিজেদের ধর্মত্যাগী বা নাস্তিক হিসেবে ঘোষণা দেওয়া বাধ্যতামূলক হয়েছে। সুতরাং ধর্ম না পাল্টিয়েও বিয়ে করা যায় – এরকম ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।
দ্বিতীয়ত: হিন্দু আইনের একটি স্বাভাবিক শর্ত হল, কেউ de-caste হলে (কাস্ট থেকে অর্থাৎ বর্ণ বা জাতি বা ধর্ম থেকে বিচ্যুত হলে) সে সম্পত্তির উত্তরাধিকার হারাবে। বৃটিশ সরকার ১৮৫০ সালে খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরকরণ সহজ রাখার জন্য Caste Disabilities Removal Act,1850 শিরোনামে একটি আইন প্রণয়ন করেছিল। ঐ আইনের বিধানে কেউ ধর্মান্তরিত হলেও সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতো না। তারা একে ধর্মীয় স্বাধীনতা আইন বলত। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর তাদের দেশে সেই আইনটি চালু থাকলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বৃটিশের সেই আইনটি গ্রহণ করা হয়নি। ফলে বাংলাদেশের হিন্দু আইন অনুযায়ী কেউ ধর্মান্তরিত হলে সম্পত্তির অধিকার হারায়।
কয়েক বছর আগে ভারতে ১৮৫০ সালের আইনটি (Caste Disabilities Removal Act) রিপিল হয়েছে। তবে তাদের আইনে ধর্মীয় স্বাধীনতার বিশেষ কিছু সুযোগ এবং আদালতের কিছু ব্যাখ্যার কারণে সেখানে বিশেষ বিবাহ আইনে বিয়ে করার কারণে কেউ সম্পত্তির অধিকার হারায় না। তার অন্যতম কারণ হল, তাদেরকে বিশেষ আইনের আওতায় বিয়ে করার জন্য ধর্মত্যাগ করার ঘোষণা দিতে হয় না। ভিন্ন ধর্মের দুজনের বিয়ে হলে বিয়ের পর স্বামীর ধর্মবিশ্বাস পালন করতে কোনো নারীকে বাধ্য করা যাবে না মর্মে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা আছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত সাংবিধানিক বেঞ্চ গুলরোখ এম গুপ্তা নামের এক পার্সি নারীর দায়ের করা মামলায় ৭ ডিসেম্বর, ২০১৭ এ রায় দিয়েছেন ।
লক্ষণীয় বাংলাদেশের আদালত হিন্দু আইনের ক্ষেত্রে এখনো বৃটিশ আমলে যেসব রায় হয়েছে সেগুলো অনুসরণ করছে। দেশভাগের পর ভারতের হিন্দু আইন আলাদা হলেও আমাদেরকে এখনো বৃটিশ লেগাসি বহন করতে হচ্ছে। সে সময়ের আদালতের অনেক ব্যাখ্যা এবং আইনের অনেককিছু সময়ের পরিক্রমায় আজ অচল (obsolete) হয়ে গেছে; আদালতে মামলা পরিচালনায় জটিলতা হচ্ছে। তবুও এখনো হিন্দু আইন সংস্কারে হাত দিতে পারেনি বাংলাদেশ। মামলা জটিলতা নিরসন তথা আদালতের কার্যক্রম সহজ এবং যুগোপযোগী করার জন্য হলেও হিন্দু আইন সংস্কার করতেই হবে।
বন্ধুরা আপনাদের কাছে আবেদন, Profulla Ray ‘র এই পোস্টের, ভাষা এবং গ্রহণযোগ্যতা আপনার সবাই বিবেচনা করবেন। সাথে খেয়াল রাখবেন তার শপথের কথা। তিনি বির্ধমী না হলে অবশ্যই আজ থেকে আমাদের দলে আসবেন। তিনি তার পিতা-মাতার ধর্ম ও সততা অনুবর্তন করলে আমরা নিরাশ হব না।