আলোর হাতছানি

পুলক ঘটক: বদ্ধ ঘরের অন্ধকার দূর করার জন্য একটি মাত্র দিয়াশলাই যথেষ্ট। শতবর্ষের জমাট বাঁধা অমানিশা ধীরে ধীরে একটু একটু করে দূর করতে হয় না। আলো জ্বালালে আঁধার তৎক্ষণাৎ কেটে যায়। আঁধার যায় বটে; অন্ধকারের জীবরা কি নতুন আলোকে সহজভাবে নিতে পারে? মাত্র এক বছর আগে একটি ঘরে তালা দিয়ে গেছেন। আজ রাতে সে ঘরে গিয়ে আলো জ্বালিয়ে দেখুন, সেখানে বাসা বাঁধা অন্ধকারের জীবরা নিদারুণ বিচলিত হবে; আলোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে; টিকতে না পেরে দিগ্বিদিকে ছুটে পলাবে! সভ্যতার আলোক সম্পাতে এমনই হয়।
 
বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ মেয়েদের সমঅধিকার ও সমমর্যাদার দাবি শুনে পরস্বাপহারী কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী আজ বিচলিত। আঁধারে বাস করতে অভ্যস্তরা আলো দেখে ভীতসন্ত্রস্ত ও বিচলিত হয়েছে। ঝাড়ু মিছিল, জুতা মিছিল, কুশপুত্তলিকা দাহ, অশ্লীল গালাগাল, হুমকি এবং হত্যা ছাড়া তারা আর কি করতে পারে? আলোর বিপরীতে তাদের কাছে আলো নেই; যুক্তির বিপরীতে তাদের কাছে যুক্তি নেই; মহত্ত্বের বিপরীতে তাদের কাছে মহত্ত্ব নেই। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া এমনই হয়। উগ্র মৌলবাদীরা তাদের প্রকৃত রূপ দেখাচ্ছে। আলোর সামনে সবার আসল রূপ ধরা পরে; তারা বেশিক্ষণ টিকতে পারে না।
 
নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এক রাতেই জয়ী হবে – এমন আশা আমরা করিনি। আমাদের আরও হাঁটতে হবে। বিদ্যমান হিন্দু আইনে বৈষম্য ও অবিচারের কয়েকটি বিষয় চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে শুধু দুইটি রিট আবেদন হয়েছে। উভয় মামলায় আদালত রুল জারি করেছে। আমরা আশা করছি, প্রতিটি বৈষম্য ও অবিচারের বিধান চ্যালেঞ্জ করে আলাদা আলাদা রিট আবেদন হবে। অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের আইনগত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আরও অনেকগুলি মামলা হবে। সুপ্রিম কোর্টে এসব মামলা নিস্পত্তি হতে দুই থেকে সাত বছর লেগে যেতে পারে। আদালত আইন প্রণেতা নয়; আইন প্রণয়ন করবে সংসদ। আদালত শুধু বৈষম্য ও অসঙ্গতিকে অবৈধ ঘোষণা করতে পারে এবং সরকারকে আইন প্রণয়ণে নির্দেশনা দিতে পারে।
 
সরকার কি শুধু আদালতের দিকে তাকিয়ে থাকবে? বঞ্চিত জনগোষ্ঠী এবং বিবেকবান মানুষেরা কি সেই অপেক্ষায় বসে থাকবে? আদালতে আইনগত লড়াইয়ের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন বেগবান করার প্রচেষ্টা অবশ্যই অব্যাহত থাকবে। আদালতের মাধ্যমে হোক অথবা সরাসরি সংসদে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে হোক, কিছুটা সময় লাগবে বৈকি।
 
আমরা বিরোধীদের কাছ থেকে এই সামাজিক আন্দোলনের সূচনালগ্নে বড় সহায়তা পেয়েছি। প্রতিক্রিয়াশীল হেফাজতি হিন্দুত্ববাদীদের আন্দোলন আমাদের জন্য সহায়ক হয়েছে। আমাদের দাবি’র কথা জনসমক্ষে পৌঁছে দিতে এখন পর্যন্ত তারাই বেশি করেছে। তারা তাদের মিথ্যাচার এবং অশ্লীল আচরণের মাধ্যমে শুরুতেই বর্জনীয় হয়েছে। মেয়েদের সমঅধিকারের দাবির বিরুদ্ধে তারা মিথ্যাচার ও কটুকথা ছাড়া আর কোনো অবলম্বনই পায়নি। সরকার আইন সংশোধন করে ফেলছে, বোনরা কালই তোমার সম্পত্তির ভাগ নিতে আসছে, ঘরে ঘরে গৃহযুদ্ধ বাঁধবে, মেয়েরা সব মুসলমান হয়ে যাবে, হিন্দু মেয়েদের মুসলমানরা জোর করে তুলে নিয়ে যাবে, হিন্দু আইন না থাকলে ধর্ম থাকবে না – এইসব অপপ্রচার চালিয়ে সমাজে ভীতি ছড়িয়েছে। আমাদের নেতৃত্ব সম্পর্কে এবং আমাদের আন্দোলনের বিষয়ে মিথ্যা ছাড়া তারা এক লাইন সত্য কথা বলেনি। মিথ্যা এবং নোংরামি তাদের অস্ত্র। নিছক মিথ্যা প্রচার করে কতক্ষণ টিকবে? সুতরাং তাদের প্রচারে আমাদেরই প্রসার হয়েছে। যে মানুষ মেয়েদের সমঅধিকার নিয়ে আগে ভাবেনি, আজ সে একবার হলেও ভাবছে। যারা আগে থেকেই মেয়েদের সমঅধিকার প্রদানের পক্ষে ছিল, তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এই আন্দোলন আমরা এখন ধীরে ধীরে গড়ব; তারা ক্রমশ গুড়িয়ে যাবে।
 
তাদের নুইয়ে পড়ার ছোট একটি দৃষ্টান্ত দেই। তারা এখন বলছে, “মেয়েদের স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকার দেয়া হোক।” তার মানে, তারা আমাদের দাবি আংশিক মানছে। পৈত্রিক সম্পত্তিতে মেয়েদের সমঅধিকারের দাবি নিয়ে আমরা মাঠে নামার আগে তারা একথা বলেনি। এখন তারা নতুন নতুন প্রস্তাব দিচ্ছে। কিছু ছাড় দিয়ে তারা বৈষম্যের ধারা অব্যাহত রাখতে চায়। আমাদের সুস্পষ্ট কথা – নারী ও লিঙ্গবৈচিত্রময় জনগোষ্ঠীর প্রতি কোনো প্রকার বৈষম্য ও অবিচার চলবে না।
 
গত দুই বছর যাবত মোটে ৩০ থেকে ৩৫ জন হিন্দু হেফাজতি ফেসবুকে বিভিন্ন নামে আইডি খুলে আমাকে কুৎসিত গালাগাল করছে। গত দুই সপ্তাহে তাদের সঙ্গে আরও প্রায় একশো জন যুক্ত হয়েছে। এরাই ঘুরে ফিরে আমার পোস্টে এসে গালি দিচ্ছে। এই শ’খানেক গালিবাজকে ব্লক করে দেওয়া কঠিন কিছু নয়। কিন্তু আমি ব্লক করে দেইনা। কারণ আমি জানি এই গালি দেওয়া লোকগুলিও একসময় বদলায়। তাছাড়া তাদের গালির প্রতিক্রিয়ায় ভাল মানুষেরা তাদের প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়। তারা ঘৃণিত ও অসভ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়। তাদের অপকর্মের দায় তাদের নিজের। আমি কেন বিচলিত হব? তাদের অন্ত:গৃহ পর্যন্ত সভ্যতার আলো পৌঁছানোর জন্য যতটুকু সময় লাগে ততটুকু সময় আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে বৈকি। এই সময় বেশি নয়। তারা অসময়ে জোর দেখাচ্ছে, সময়ে দুর্বল হবে। হিন্দু-বৌদ্ধ মেয়েরা তাদের সমঅধিকার অবশ্যই পাবে। এটা বুঝতে পারে বলেই তারা এতটা কাতর হয়েছে। মানব সভ্যতার জয় হোক। 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ