খান মো. রবিউল আলম
গত ৯ মে ২০২৪ দ্য ডেইলি স্টারে পার্টিশন বিষয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা করলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মননকুমার মন্ডল। বক্তৃতায় তিনি দেশভাগ নয়, পার্টিশন শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কেনো তিনি পার্টিশন শব্দটি ব্যবহার করলেন সে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তার ভাষায় পার্টিশন একটি আয়োজিত বিষয়। ব্রিটিশেরা সেই আয়োজন করেছিল দক্ষতা সঙ্গে। দেশভাগ শব্দের ভেতর পার্টশনের পুরো বিষয়টি আসে না।
অধ্যাপক মননকুমার মনে করেন, পার্টিশন শব্দটি বহু ব্যবহারে বাংলা হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষ যখন এই বিষয়ে কথা বলেন তখন সহসাই পার্টিশন শব্দটি ব্যবহার করেন। শব্দ চয়ন ও তার ব্যবহার নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, শব্দের ভেতর থাকে মনোভঙ্গি, রাজনীতি ও আগামীর নিশানা। ধর্মের ভিত্তিতে করা পার্টিশনের ব্যাপ্তি সাগরঅবধি।
অধ্যাপক মননকুমার মণ্ডলসহ সংশ্লিষ্ট গবেষকদল পার্টিশনের টেক্সট উন্মুক্ত করতে কাজ করছেন। পশ্চিম বাংলায় মুদ্রিত ফর্মে পার্টিশনের রিপ্রেজেটেশন মূলত ট্রমা, স্মৃতিকারতা, হাহাকার ও শূন্যতার বয়ান- যা মূলত ট্রমায় ঠাসা। এ ট্রমা মূলত পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম বাংলায় যাওয়া শিক্ষিত ও উচ্চবিত্তের অভিজ্ঞতা। বৈচিত্র্যতার দিক থেকে দেখলে এ টেক্সটের ভেতর খুব বেশি ভিন্নতা নেয়। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম বাংলায় যাওয়া হিন্দুরা শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর ছিলেন বলে তাঁরা অভিজ্ঞতা সহজে তুলে ধরতে পেরেছেন।
অন্যদিকে, পশ্চিম বাংলা থেকে পূর্ব বাংলায় আসা মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা মূলত ছিলেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির যারা শিক্ষা-দীক্ষায় ততটা অগ্রসর ছিলেন না। পার্টিশন বিষয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা লিখতে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি। একইভাবে আর্থ-সামাজিক সূচকে অনগ্রসর হিন্দু জনগোষ্ঠী পূর্ব বাংলা থেকে যারা পশ্চিম বাংলায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতাও মুদ্রিত আকারে অধরা থেকে গেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, যারা পার্টিশনের অভিজ্ঞতা লিখতে পারেননি তাদের বয়ান কী অজানা থেকে যাবে? কিংবা কেউ যদি লিখিত ইতিহাসের বাইরে পার্টিশনের ইতিহাস জানতে চান তাহলে কোথায় তা অনুসন্ধান করবেন?
ইতিহাসকে যদি সামগ্রিকতার আলোকে দেখতে হয় তবে এ অনুসন্ধান জরুরি। কারণ, মুখে মুখে থাকা টেক্সটের মূল্য মুদ্রিত টেক্সটের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। লিখিত টেক্সট কেবল মান উত্তীর্ন, অলিখিত টেক্সটও গুরুত্বপূর্ণ বটে। কারণ, বাঙালির যাপিতজীবনের বড় অংশ চলে কথকতায়, মুদ্রিতজীবনের ব্যাপ্তি সেখানে খুব বিস্তৃত নয়। কথার জগৎ অনেকবড়। এ কথার পড়তে থাকে সামগ্রিকতা। সুতরাং পার্টিশনের কথার যে ভাণ্ডার তা মুদ্রিত আকারে আনতে পারলে পার্টিশন ইতিহাসের পরিকাঠামো আরও সমৃদ্ধ হবে।
অন্যভাবে দেখলে, মুদ্রণের প্রতি এদেশের সাধারণ মানুষের এক ধরনের নির্লিপ্ততা রয়েছে। তারা মূলত কথাশ্রয়ী। কথার ভেতর বাঁচতে চায়। পূর্ব বাংলার বাউল সাধক শাহ্ আবদুল করিমের বক্তব্য তা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে-“কালির কলমে হয় না কালাম।” অর্থাৎ লিখে ফেললেই জ্ঞান হয়ে যায় না। এমনকি বর্ণের শরীরে সবসময় সত্য থাকে না। কথা অমূল্য।
তাই এপার বাংলা ওপার বাংলার মানুষের মুখেমুখে থাকে পার্টিশনের কথা শুনতে হবে। কথার ভেতর ঢুকতে হবে। এ অ্যাপ্রাচ পার্টিশনের বহুমাত্রিকতার সন্ধান দিবে। মানুষের মুখে বেঁচে থাকা, স্মৃতিকথা ও অভিজ্ঞতা পার্টিশনের টেক্সট উদারীকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অধ্যাপক মননকুমার মণ্ডলেরা সেই পথে হাঁটছেন। পার্টিশনের টেক্সটকে সংকীর্ণ বাইনারি ভালো বা মন্দ, ট্রমা না স্মৃতিকারতা সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার দিন শেষ হয়ে আসছে। পার্টিশন একটি বিস্তৃত প্রপঞ্চ যাকে সংকীর্ণ ফ্রেমে বাধা যায় না। পার্টশনের জনভাষ্য যথাযথভাবে তুলে আনতে পারলে নিশ্চিত ইতিহাসের স্বাস্থ্য আরও সমৃদ্ধ হবে।
এলেক্স হেলি তার রুটস্ উপন্যাসে উল্লেখ করেছেন, কেবল বিজয়ীদের নয় যথাযথভাবে মূল্যায়িত হলে বিজিতদের ইতিহাসও মহত্তর হতে বাধ্য। সমাজের নিচুস্তরে বাস করা প্রান্তিক মানুষদের পার্টিশনের গল্প অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। এ উদ্যোগের ভেতর নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার ঘ্রাণও পাওয়া যাচ্ছে। পার্টিশনের ঝড় কীভাবে সমাজের নিচুস্তরের মানুষদের ওপর দিয়ে বয়ে গেলো? কী নির্যাস সঞ্চিত হলো তাদের মানসপটে? তা জানার আবশ্যকতা অস্বীকার করার উপায় নেই।
এখন প্রশ্ন তো উঠতে পারে পার্টিশনের ৭৫ বছর পর কতোজন প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যাবে? কতটুকু রয়েছে তাদের শারীরিক বা মানসিক স্থিতি? বা স্মৃতি থেকে তারা অভিজ্ঞতা কতোটুকু পুনরুৎপাদন করতে পারবেন? গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক তার বিখ্যাত প্রবন্ধ ক্যান সাবঅলটার্ন স্পিক?-এ এমন প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি মন্তব্য করেছেন টেক্সট আরোপিত না হয়ে সার্বভৌম হলে সেখান থেকে নতুন নতুন বিষয়ের জন্ম হতে পারে। পার্টিশনের টেক্সট সীমাবদ্ধ গন্ডির মধ্যে না রেখে উদার করা গেলে সেই শার্সি দিয়ে নতুন আলো আসবেই।
উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিক মিশেল ফুকোকে উদ্বৃত্ত করে গায়ত্রী স্পিভাক আরও বলেছেন- অদেখা বিষয়কে যদি দেখানো যায় তাহলে তা এক ধরনের পরিবর্তন আসে অর্থাৎ পার্টিশন নিয়ে প্রান্তীয় মানুষদের যে অজানা অভিজ্ঞতা তা যদি তুলে আনা যায় তবে এই ধারার ইতিহাস চর্চায় প্যারাডাইমগত পরিবর্তন আসবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অধ্যাপক মননকুমার মণ্ডলদের এ অনুসন্ধানের দার্শনিক ও অ্যাকাডেমিক পাটাতন শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। তারা কয়েকবছর ধরে পার্টিশনের এ বহুমাত্রিক বয়ান অনুসন্ধান করছেন।
ইতিমধ্যে সংগ্রহ করেছেন প্রায় সাড়ে এগারশো ঘণ্টা জনভাষ্য-যা রেকর্ডবদ্ধ করা হয়েছে। এ অ্যাপ্রাচকে বলা হচ্ছে, রিপোজিটরি বা তথ্যভাণ্ডার। আর্কাইভ নয়। কারণ, আর্কাইভের রাজনীতি আছে, আর্কাইভ সবসময় নৈর্ব্যক্তিক নয়। আর্কাইভের মালমসলা যোগাড়ে রাষ্ট্রের বিশেষ পক্ষপাত থাকে। রাষ্ট্র স্বস্তিদায়ক ও প্রচারসর্বস্ব তথ্য জমাতে চায়। রিপোজিটরি বা তথ্যভাণ্ডার উন্মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি। যেখানে থরে থরে থাকবে, তরতাজা ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত ও বয়ান। নিঃসন্দেহে বস্তুনিষ্ঠ ও প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে রিপোজিটরি অভিনব ও উদ্ভাবনী উদ্যোগ।
পার্টিশন বিষয়ে ইতিহাস চর্চার নতুন ধারা ট্রমানির্ভর ন্যারেটিভির সীমানা ভাঙছে। উঠে আসছে নানাধরনের অভিজ্ঞতা নির্ভর গল্প, যেসব গল্প লেখার সার্মথ্য অভিঘাতীদের নেই। ইতিমধ্যে উত্তর প্রজন্মের খোঁজে শিরোনামে এ গবেষণা প্রকল্পের কয়েকটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে-যা পাঠকপ্রিয়তাও পেয়েছে।
পার্টিশন নিয়ে চোখ খোলা এ উদ্যোগের অগ্রনায়ক অধ্যাপক মননকুমার মণ্ডলসহ তার গবেষণা দলের সদস্যদের অভিবাদন। পার্টশন বিষয়ে উন্মোচিত টেক্সট পাঠককে আরও গভীরে নিয়ে যাচ্ছে। এ টেক্সট কেবল শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত ও ধনিক শ্রেণির অভিজ্ঞতার সীমিত গন্ডির বিষয় নয়। এর পরিধি অনেক বিস্তৃত যার কেন্দ্রে রয়েছে মূলত আমজনতা। আমজনতার অভিজ্ঞতানির্ভর পার্টিশনের টেক্সট লিবারেটেড বা উন্মুক্ত হচ্ছে-যা খুব জরুরি ছিল।
সকৃতজ্ঞ স্বীকৃতি:।।স্বয়ংক্রিয় পোস্ট ⇒সোর্স লিংক।।
⇒বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের ফেসবুক গ্রুপ