পুলক ঘটক
“তাই বলে আমাকে আবার নারীবাদী মনে করবেন না” অথবা “আমি অত নারীবাদী নই” – এ জাতীয় কথাগুলো কেন বলেন? এর মানে হল, নারীবাদ সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই। নারীবাদ শব্দটি শুনেছেন, কিন্তু নারীবাদ কি জিনিস, নারীবাদ কাকে বলে -এ বিষয়ে আপনি কিছুই জানেন না, পড়াশোনা করেননি। নারীবাদ সম্পর্কে আপনার মনের মধ্যে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়ে আছে। কেন? একটি বিষয়ে না জেনে সে সম্পর্কে আপনার মনের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা কেন থাকবে? একজন শিক্ষিত মানুষ হয়েও কেন আপনি জানার চেষ্টা করবেন না?
দ্বিতীয়ত: আপনি পুরুষতন্ত্রী কিনা? পুরুষতন্ত্রী হওয়া ভাল না খারাপ? পুরুষতন্ত্রের বিরোধিতা করা মানে কি পুরুষদের বিরোধিতা করা বা পুরুষদের শত্রু ভাবা? এ বিষয়ে আপনার ধারণা কি? একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে নারীবাদ ও পুরুষতন্ত্র সম্পর্কে আপনার সুস্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত। নইলে আপনি প্রতি পদে পদে মুর্খতা দোষে দুষ্ট আচরণ করবেন। আধুনিক সভ্য মানুষের কাতার থেকে পিছিয়ে থাকবেন।
পুরুষতন্ত্র এমন এক ব্যবস্থা যেখানে পুরুষকে কর্তা এবং নারীদের অধিনস্ত ভাবা হয়। নারী হয়ে জন্ম নেয়া এখানে অপরাধ, যে অপরাধে তাকে অধিনস্ত হতে হবে –স্বাধীন নয়, পরাধীন হতে হবে। ব্যক্তিজীবনে, পরিবারে, সমাজে এবং রাস্ট্রে এই ব্যবস্থা। অর্থনীতিতে, সংস্কৃতিতে এবং জীবনবোধেও এই ব্যবস্থা। এখানে লিঙ্গবৈষম্য একটি স্বাভাবিক বিষয়। লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে মানবগোষ্ঠীর একটি অংশ হবে সুবিধাভোগী এবং আরেকটি অংশ হবে শাসিত, শোষিত ও অবদমিত। এই ব্যবস্থায় লিঙ্গপরিচয়ের কারণে মানুষের প্রতি বৈষম্য করা অবিচার নয়। লিঙ্গপরিচয়ের কারণে নিজেকে শ্রেষ্ঠ এবং কর্তা ভাবা এবং অপরকে নিচু বা অধিনস্ত ভাবা পুরুষতান্ত্রিক বোধ-বুদ্ধিতে অপরাধ নয়। কারণ পুরুষতন্ত্র একটি নিম্নমানের অবিচারী সমাজচিন্তা ও নিষ্ঠুর জীবনব্যবস্থা।
পুরুষতন্ত্র আধুনিক উন্নত মানববাদী সভ্যতায় খারাপ জিনিস হিসেবে বিবেচিত। কারণ এটি প্রকৃত সভ্যতার পরিপন্থী। সমাজে সুষম উন্নয়নের প্রতিবন্ধক এই পুরুষতন্ত্র। যেহেতু এই সিস্টেমটি উন্নয়নের প্রতিবন্ধক এবং অবিচারের সমর্থক, তাই সবাই এর ভিকটিম –পুরুষ এবং নারী উভয়ই।
সঙ্গে বুঝে রাখুন, পুরুষতন্ত্র এমন একটি সিস্টেম বা ব্যবস্থা যার ব্যাপ্তি ব্যক্তিজীবন থেকে বিশ্বব্যাপি। পুরুষতন্ত্র সম্পর্কে জানলেও এবং পুরুষতন্ত্র খারাপ –এটা বুঝলেও পুরুষতন্ত্র থেকে তাৎক্ষণিক মুক্তি পাওয়া যায় না। কারণ সমাজে, রাস্ট্রে এবং পরিবারে সর্বত্র পুরুষতন্ত্র ব্যাপ্ত হয়ে আছে। আপনার ও আমার মনে এবং আজন্ম লালিত সংস্কৃতি ও বোধবুদ্ধির মধ্যে পুরুষতন্ত্র মিশে আছে। অল্পকিছু মাতৃতান্ত্রিক সমাজের কথা বাদ দিলে নারীপুরুষ নির্বিশেষে পৃথিবীর প্রায় সকল মানুষ পুরুষতন্ত্রের শিকার –কোথাও কম, কোথাও বেশি। পুরুষতন্ত্রের শিকার গোটা বিশ্ব-জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক অংশ আবার পুরুষতন্ত্রের সুবিধাভোগী। পুরুষরা একাধারে পুরুষতন্ত্রের ভিকটিম এবং সুবিধাভোগী। নারীরাও অংশত পুরুষতন্ত্রের সুবিধাভোগী হতে পারে এবং হয়। পুরুষতন্ত্রের সুবিধাভোগী সেই অল্পকিছু নারীকে বাদ দিলে পৃথিবীর প্রায় সকল নারী পুরুষতন্ত্রের শিকার; ভিকটিম।
সুদূর অতীতে পৃথিবীতে পুরুষতন্ত্র ছিল না। সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। মানুষের অর্থনৈতিক জীবন, সমাজ এবং প্রশাসন ব্যবস্থায় বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত, পরিবর্তন ও যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র, প্রশাসন, সমাজ ও পরিবার গড়ে উঠেছে। মানবতা তথা মানববোধ পরাভূত হয়েছে। সঙ্গে নারী হয়েছে বিশেষভাবে পরাভূত।
এবার দুই কথায় বলব নারীবাদের কথা। পুরুষতন্ত্র নামক অবিচারের বিরুদ্ধে মানুষ হিসেবে সকলের সমান অধিকার ও মর্যাদার দাবিতে মানুষের (নারী বা পুরুষের) যে চেতনা ও লড়াই তার নাম নারীবাদ। সোজা কথায় অন্যায় লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে ন্যায্যতার জন্য ও মানবতার জন্য যে চেতনা, লড়াই ও প্রয়োজনীয়তা তার নাম নারীবাদ। এই মতবাদ পুরুষের বিরুদ্ধে নয়, পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে; মাতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, সমতন্ত্র বা সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য; মানবতন্ত্র বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য; মানুষের মানব-মর্যাদা বা human dignity সমুন্বত রাখার জন্য।
সচেতনভাবে অথবা অবুঝ, অবচেতন ও কান্ডজ্ঞানরহিত হয়ে নারী বা পুরুষ উভয়ই এই নারীবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে এবং নেয়। নারী বা পুরুষ উভয়েই ব্যক্তিগতভাবে অথবা সমষ্টিগত পর্যায়ে পুরুষতন্ত্রের পক্ষে থাকতে পারে, সমঅধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে এবং দাঁড়ায়। স্বার্থজনিত কারণে সচেতনভাবেই একজন নারী পুরুষতান্ত্রিক অবিচারের পক্ষে তথা নারীবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে –নারীর অধিকার আদায়ের বিরুদ্ধে নারী দাঁড়াতে পারে এবং দাঁড়ায়। বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটাই স্বাভাবিক, কারণ নারীরাও এখানে পুরুষতন্ত্রী। নারীরা পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা কাঠামোর উপাদান ও অংশ। যে হিজাবী মহিলা টিশার্ট পড়া মেয়েটিকে গালি দিচ্ছেন সেই মহিলা পুরুষতন্ত্রী। দেশের অধিকাংশ নরনারীই পুরুষতন্ত্রী। এজন্যই আমরা পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাস করছি।
“নারীর অধিকার আদায়ে আমরা যদি শুধু পুরুষতন্ত্রকে দোষারোপ করি সেটা ভুল। নারীরাই নারীদের বেশি শোষণ করছে” –শিক্ষিত নারীদের মুখে এরকম কথা বেশি শোনা যায়। এখানে “পুরুষতন্ত্র” শব্দ দিয়ে তারা কি বোঝাচ্ছেন? পুুরুষদের দোষারোপ করা এবং পুরুষতন্ত্রকে দোষারোপ করা কি এক জিনিস? শিক্ষিত হলেও তারা আসলে নারীবাদ বা পুরুষতন্ত্র কি জিনিস বোঝেন না। তারা পুরুষ এবং পুরুষতন্ত্রকে গুলিয়ে ফেলেন।
নারীরা নারী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করে –এ নতুন কিছু নয়। বরং এটাই পুরুষতন্ত্র। পুরুষতন্ত্রের “আদর্শ নারী” আত্মবিস্মৃত। পুরুষতন্ত্রে একজন নারীর আদর্শই হলো আত্মবিস্মৃত হয়ে পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রের সেবায় নিয়োজিত হওয়া। পুরুষতন্ত্রে একজন নারী যত বেশি আত্মবিস্মৃত, ব্যক্তিত্বহীন, আত্মমর্যাদাবোধহীন, ম্রিয়মাণ, কমনীয়, সহজভোগ্য এবং কর্মে, মননে ও মগজে যত বড় সেবাদাসী ততই বেশি উপাদেয়। দাস সমাজে একজন মানুষ যতবেশি ব্যক্তিত্বরহিত, প্রভুভক্ত ও বিশ্বস্ত ততই ভাল দাস।
পুরুষ এবং পুরুষতন্ত্র আলাদা জিনিস –দুটো এক নয়– একথা বুঝতে হবে। নারীও পুরুষতন্ত্রী এবং পুরুষও পুরুষতন্ত্রী হয় এবং পুরুষতন্ত্রের যন্ত্র হিসেবে কাজ করে। কোনো নারী বা নারীগোষ্ঠী নারীদের অধিকারের প্রশ্নে বিরুদ্ধে অংশ নিলে বুঝতে হবে, তারা পুরুষতন্ত্রের অংশ হিসেবেই এটা করছে। নারী অধিকারের প্রশ্নে ঐ নারীর বা নারীদের যে বিরোধিতা সেটা পুরুষতান্ত্রিক বিরোধিতা। এর জন্য দায়ী পুরুষতন্ত্র। কোনো পুরুষ যদি নারীর অধিকার ও মর্যাদার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তবে বুঝতে হবে পুরুষতন্ত্রের অংশ হিসেবে সে এটা করছে। কারণ ঐ ব্যক্তি পুরুষতন্ত্রের প্রোডাক্ট এবং সুবিধাভোগী। দায়ী আসলে পুরুষতন্ত্র –সেটা পুরুষের মাধ্যমে আসুক বা নারীর মাধ্যমে আসুক। বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অধিকাংশ নারী বাস্তবে এবং মনোজগতে পুরুষতান্ত্রিক; যখন উন্নত চেতনার বহু পুরুষ নারীবাদী।
নারীবাদ স্থানভেদে এবং নানা বাস্তবতায় নানা প্রকার। আফগানিস্তান, সৌদি আরব বা বাংলাদেশের বাস্তবতায় নারীবাদ এবং নারীমুক্তি আন্দোলন যে রকম; ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে তা মিলবে না। তবে আধুনিক বিশ্বায়িত সমাজে মিথস্ক্রিয়া অনিবার্য। হিন্দু-বৌদ্ধ, মুসলিম বা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী সমাজ ও পরিবার বিবেচনায়, আদিবাসী সমাজে, জনঘনত্বের বৈশিষ্ট্য বিচারে, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র বা পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও প্রশাসনিক বাস্তবতায় নারীবাদ এবং নারীমুক্তি আন্দোলনের রূপ ভিন্ন হবে। নারীবাদ কত প্রকার ও কি কি ধরণের হতে পারে, তা নিয়ে সবার ভালভাবে পড়াশোনা করা উচিত। আধুনিক মানববাদী সভ্যতায় এটা জানা খুব জরুরি। কারণ, নারীবাদী না হলে প্রকৃত সভ্য মানুষ হওয়া যায় না। পুরুষতন্ত্র অসভ্যতা। পুরুষতন্ত্রীরা সভ্য নন।
[লেখক: সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ]
⇒লেখকের ফেসবুক পেজ, ফেসবুক প্রোফাইল, টুইটার অ্যাকাউন্ট
⇒বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের ফেসবুক গ্রুপ