পুলক ঘটক
স্বামী ও তাঁর পরিবারের লোকজনের পাশবিক নির্যাতন সহ্য করতে পারছিলেন না যমুনা রানী বিশ্বাস। বাধ্য হয়ে বিয়ের মাত্র ৩ বছর পর মেয়েকে তাঁর বাবা নিজ বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যান। যমুনার স্বামী ধীরেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস আবার বিয়ে করেন। কিন্তু হিন্দু আইন অনুযায়ী যমুনার দ্বিতীয়বার বিয়ের সুযোগ নেই। আজ তার বয়স ৬৫। এ জীবন বেশি দীর্ঘ মনে হয়, যদি তা স্বাভাবিকভাবে কাটানোর সুযোগ না থাকে। তিনি একা কাটিয়েছেন কাটাচ্ছেন; একাকী বাঁচার যুদ্ধ। কিন্তু তার ঠিকানা কোথায়?
একটি ঠিকানা বলছি। পিতা: (প্রয়াত) পূর্ণ শিশির বিশ্বাস, গ্রামঃ রাতুরা, উপজেলাঃ কালীগঞ্জ, জেলাঃ গাজীপুর। ঐ বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন যমুনা। বাড়িটি এখনো আছে। কিন্তু তা নিজের বলে দাবি করতে পারছেন না। সেখানে পূর্ণ দখল নিয়ে সংসার করছেন তার ছোট ভাই সুবোধ বিশ্বাস। অবৈধভাবে নয়, আইনগতভাবেই তিনি ভোগ করছেন।
আরও একটি ঠিকানা বলছি। স্বামী: ধীরেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস, গ্রাম: ধনপুর, উপজেলাঃ কালীগঞ্জ, জেলাঃ গাজীপুর। বিবাহসূত্রে ১৯৭৫ সালে ঐ বাড়িতে যেতে হয়েছিল যমুনাকে। কিন্তু বিয়ের মাত্র তিন বছর পর সেখান থেকে উচ্ছেদ হন তিনি। এরপর তার ঠিকানা কোথায় তা রীতিমত গবেষণার বিষয়। কারণ গত ৫০ বছরে বহুবার তার ঠিকানা বদল হয়েছে।
বাবা পূর্ণ শিশির বিশ্বাস ছিলেন অবস্থাপন্ন কৃষক। তার অনেক জমিজমা। বাবার আদরের বড় মেয়ে যমুনা। তাঁকে স্বামীর বাড়ি থেকে ফিরিয়ে আনার সময় বলেছিলেন, “আমার মেয়ের খাওয়া পরার অভাব কোনদিন হবেনা।” যমুনার নামে তিনি ৫ বিঘা জমি লিখে দেবেন বলে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু লিখে দেয়ার আগেই ১৯৮৪ সালে তাঁর হঠাৎ মৃত্যু হয়। তখন যমুনার বয়স ২৪ বছর।
বাবার মৃত্যুর কয়েকবছর পর ছোট ভাই সুবোধ বিশ্বাস বিয়ে করে। এবার নতুন সংকট নেমে আসে যমুনার জীবনে। বাবার প্রতিশ্রুত ৫ বিঘা জমি লিখে দেয়ার বদলে যমুনাকে তাড়ানোই উত্তম মনে করলেন ভাই ও ভাইয়ের বউ। তাদের কথা হল, যমুনা কোনভাবেই বাপের বাড়িতে থাকতে পারে না। সে তাঁর স্বামীর বাড়ি চলে যাক অথবা অন্য কোথাও।
১৯৯০ সালে প্রথমে ঘোড়াশাল সার কারখানার এক কর্মকর্তার বাসায় গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করেন যমুনা। ধনাঢ্য পিতার সন্তান থেকে অন্যের বাসার গৃহকর্মী! এই তার পরিণতি! তখন তার বয়স ২৫ বছর; বিয়েসাদী করা যাবে না –আইন নেই। পরে ঢাকায় চলে আসেন। ২০০৪ সাল থেকে তিনি ঢাকায় বিভিন্ন বাসায় কাজের বুয়া হিসেবে থাকছেন। দীর্ঘ ৩৩ বছর যাবত দু’মুঠো আহারের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। এখন তিনি ভগ্নদেহ, শরীরে অনেক রোগ বাসা বেঁধেছে। ঠিক মতো কাজ করতে পারেন না। চিকিৎসার জন্যই এসেছিলেন ডা: অসীম দত্ত অনির্বাণের চেম্বারে। এক পর্যায়ে ব্যক্ত করেন জীবনের গল্প।
যমুনার মা অন্যদা বিশ্বাস এখনো বেঁচে আছেন; প্রথম সন্তানের দুরাবস্থায় আজও নিয়মিত কাঁদেন। তিনি নিজেই অসহায়ভাবে পুত্রের সংসারে আশ্রিত হয়ে আছেন। মেয়েকে এক দিনের জন্য বাড়িতে এনে রাখার তাঁর অধিকার নেই। সেই অধিকার দেখাতে গিয়ে নিজেও পুত্র ও পুত্রবধূর হাতে মার খেয়েছেন। এখন আর সাহস করেননা।
যমুনার আরও তিন বোন আছে; বাবা বেঁচে থাকতেই তাদের বিয়ে হয়েছে। তারা স্বামীর আশ্রয়ে আছেন। স্বামী ভাল হলে হিন্দু মেয়েদের নির্ভরশীল জীবন খারাপ হয় না।
সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে যমুনার জন্য একটি ঘর করে দেয়ার চেষ্টা করছেন বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের অন্যতম নেতা (সাবেক ছাত্রলীগ নেতা) ডা: অসীম দত্ত। কিন্তু আবেদনপত্রে যমুনার কোন ঠিকানা লেখা হবে? তাঁর ভোটার আইডিতে পুরান ঢাকার একটি ঠিকানা দেয়া আছে। কারণ ২০০৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র করার সময় তিনি ঐ বাসায় কাজ করতেন। সে ঠিকানা বদলিয়ে এখন গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলায় তাঁর জন্মভিটার ঠিকানাটি দেখাতে হবে – যে ঠিকানায় তাঁর অধিকার নেই। যমুনার বাকি জীবনের জন্য একটি ঠিকানা দিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ জানাই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
আপনি অঙ্গিকার করেছেন, বাংলাদেশের কাউকে ভূমিহীন রাখবেন না। বাংলাদেশে বৈষম্যমূলক হিন্দু আইনের কারণে সকল হিন্দু-বৌদ্ধ নারী বাস্তবিক অর্থে ভূমিহীন। এই অভিশপ্ত আইনের কবল থেকে আমাদের মা, বোন, কন্যাসন্তানদের মুক্তি দিন। যারা মা-বোনদের অধিকার প্রদানের বিষয়ে আপত্তি করছে তারা সবাই একেকজন সুবোধ বিশ্বাস –যমুনা বিশ্বাসের ভাই। এরা বোনদের অধিকার নিজেরা ভোগ করবে। বোনরা হয়ে থাকবে দয়ার পাত্রী। তারা যদি দয়া করে ভাল রাখে তবে ভাল থাকবে, নচেত নয়।
যারা হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ আইন প্রণয়ন করে মেয়েদের বৈধভাবে পুনরায় বিয়ের অধিকার দিতে বাধা দিচ্ছে তারা একেকজন ধীরেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস। তারা যমুনাদের স্বাভাবিকভাবে সংসার করতে দিতে চায় না। কিন্তু স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও ডিভোর্স না দিয়ে নিজেরা পুনরায় বিয়ে করার অধিকার বহাল রাখতে চায়। তারা সনাতন ধর্ম মানে না। কারণ সনাতন ধর্মে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং নারীর পুনরায় বিয়ের বিধান আছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
আপনি জানেন, কারও আপত্তিতেই মানুষের অধিকার অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এধরনের আপত্তি অবৈধ। বাধাদানকারীরা একটি স্বার্থান্বেষী অসৎ চক্র। বর্বরদের বাধায় নারীর ভাগ্যন্নয়ন আটকাতে পারে না। বিবেকবান হিন্দুরা এই দুষ্টচক্রের সঙ্গে নেই। নারী এবং বিবেকবান হিন্দু-বৌদ্ধ পুরুষদের সমন্বিত আবেদন গ্রহণ করে আইন সংশোধন করুন; সমঅধিকার বিধান করুন।
* ছবিতে যমুনা বিশ্বাসের সঙ্গে ডাঃ অসীম দত্ত অনির্বাণ; -১৩ জুলাই ২০২৩। যমুনার এই জীবন কাহিনী তিনি রেকর্ড করেছেন এবং তিনি প্রথম পোস্ট দিয়ে ঘটনাটি জনসমক্ষে এনেছেন।
[লেখক: সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ]
⇒লেখকের ফেসবুক পেজ, ফেসবুক প্রোফাইল, টুইটার অ্যাকাউন্ট
⇒বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের ফেসবুক গ্রুপ