সনাতন ধর্মে বিবাহবিধি: নারীর জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধন ও পুরুষের অনন্ত মোক্ষ

পুলক ঘটক

কোনো নারী স্বামীর চিতায় আত্মাহুতি দিলে শাস্ত্র অনুযায়ী তিনি সতী; তার স্বর্গে গমন একদম সহজ। এমনকি পাপিষ্ঠ স্বামীকেও তিনি উদ্ধার করে স্বর্গে নিয়ে যাবেন। পরাশর সংহিতার চতুর্থ অধ্যায়ের ২৮ এবং ২৯ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে,

‘তিস্রঃ কোট্যোহর্দ্ধকোটি চ যানি রোমাণি মানবে।
তাবৎ কালং বসেৎ স্বর্গং ভর্ত্তারং যানুগচ্ছতি।।’ ২৮

অর্থ: স্বামীর মরণে যিনি সহমৃতা হন, সেই স্ত্রী মানবদেহে যে সার্দ্ধ ত্রিকোটি সংখ্যক রোম আছে তাবৎপরিমিত কাল স্বর্গ বাস করেন।

‘ব্যালগ্রাহী যথা ব্যালং বিলাদুদ্ধরতে বলাৎ।
এবমুদ্ধৃত্য ভর্ত্তারং তেনৈব সহ মোদতে।।’২৯

অর্থ: ব্যালগ্রাহী (সাপুড়ে) যেমন গর্ত্তমধ্য হইতে সর্পকে বলপুর্ব্বক টানিয়া আনে, তেমনি সহমৃতা নারী মৃতপতিকে উদ্ধার করিয়া, তৎসহ স্বর্গসুখ ভোগ করেন।
কম প্রলোভন নয়। মাত্র কয়েক মিনিট চিতায় পুড়ে মরলেই ওপারে স্বর্গ! সদ্য স্বামী হারানোর বেদনা, বেঁচে থাকলে অধিকারহীনতা এবং সামনে অন্ধকার ভবিষ্যৎ—এমন অবস্থায় কোনো নারীকে যদি সুখময় স্বর্গে যাওয়ার জন্য আত্মহত্যার পথ দেখানো হয়—ওই সময়ে তিনি তা স্বেচ্ছায় করতেও পারেন। তাকে একাজে উদ্বুদ্ধ করতে পুরুষদের জন্য প্রলোভনটা আরও বেশি। পুরুষকে পুড়ে মরতে হচ্ছে না। ইহকালে পাপকর্ম ও ভোগলিপ্সায় মজে থাকলেও বউকে পোড়াতে পারলেই তার জন্য স্বর্গের রাস্তা খোলা! সমজাতীয় প্রলোভনে উদ্বুদ্ধ হয়ে কিছু মানুষ সরাসরি বেহেশতে যাওয়ার জন্য আত্মঘাতী জঙ্গি হয়। সৌভাগ্য, হিন্দু সমাজ এধরনের শাস্ত্র-বিধানকে ত্যাজ্য করেছে। ভাবতে হবে, শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে নারীর প্রতি অন্যায় ও বৈষম্য করার আর যতসব বিধান আছে তা পরিত্যাজ্য কিনা? ভগবান বৃহস্পতি বলেছেন,

‘কেবলম্ শাস্ত্রমাশ্রিত্য ন কর্তব্যো বিনির্ণয়ঃ৷
যুক্তিহীন বিচারে তু ধর্মহানি প্রজায়তে৷৷’

অর্থ: কেবল শাস্ত্রের উপর নির্ভর করে কর্তব্য নির্ণয় করা ঠিক নয়। যুক্তিহীন বিচারের দ্বারা ধর্মহানী হয়।
শুধু বেদ, স্মৃতি এবং সদাচার অনুসরণ নয়; বিবেকের বাণী অনুসরণ করাও সনাতন ধর্মের অনুশাসন। হিংস্র ধারণার বিপরীতে উন্নততর ধর্মীয় ও মানবিক আদর্শের শিক্ষা কি শাস্ত্রে নেই? অবশ্যই আছে। সনাতন ধর্মের যে উন্নততর আদর্শ, তা স্বর্গের প্রলোভন দেয় না। মোক্ষ লাভ স্বর্গের চেয়ে উন্নত এবং তার চেয়ে উন্নত হল পঞ্চম পুরুষার্থ অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রেম-রাজ্যে প্রবেশ। যে মানুষ নিস্কাম হয়ে মুক্তির বাসনা করে, যে স্বর্গে যেতে চায় না, তাকে স্বর্গে পাঠানোর অগ্রহণযোগ্য বিধানগুলো থেকে মানুষ ও মানসিকতার মোক্ষ দরকার।
 
বলতে চাই বিয়ের কথা—যে বিয়েকে ‘জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন’ বলে দাবি করা হচ্ছে, মজার বিষয় হলো, বন্ধনটা শুধু নারীর জন্য। পুরুষের কোনো বন্ধন নেই। পুরুষ এক বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠেই আরেকটি পিঁড়িতে বসতে পারে; যতবার ইচ্ছে বিয়ে করতে পারে, তাতে বাধা নেই। আগের স্ত্রীদের ডিভোর্স না দিয়েই পুরুষ তার ইচ্ছা অনুযায়ী বিয়ে করতে পারে। কিন্তু নারীর সে উপায় নেই। স্বামী পরিত্যক্তা যে নারী, তাকেও বিয়ে করতে দেবে না। স্বামী নেশাগ্রস্থ, উন্মত্ত, পাগল, পিশাচ যাই হোক—স্ত্রীর মুক্তি নেই। নারীর ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে তার বিয়ে নাকি জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন। কথাটি বলা হচ্ছে শুধু ডিভোর্স আইন প্রণয়নে বাধা দেওয়ার জন্য। যেহেতু বিবাহ বিচ্ছেদের সুযোগ নেই, তাই নারীর দ্বিতীয়বার বিয়ে করার উপায় নেই। অথচ পরাশর সংহিতার চতুর্থ অধ্যায়ের ২৭ নম্বর শ্লোক বলছে,

‘নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরণ্যো বিধিয়তে।’

অর্থ: স্বামী যদি নিরুদ্দেশ হয়, মারা যায়, প্রব্রজ্যা অবলম্বন করে (অর্থাৎ সন্ন্যাসী হয়ে যায়) ক্লীব (পুরুষত্বহীন) হয় অথবা পতিত (ধর্ম বা সমাজ থেকে বিচ্যুত) হয় তবে নারীর জন্য অন্য পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া বিধেয়।
কোন কোন ক্ষেত্রে স্ত্রী পরিত্যাগ করা যাবে সে বিধান মনুসংহিতায় আছে, অন্যান্য সংহিতাতেও আছে। বিচ্ছেদের বিধান থাকা সত্ত্বেও বলা হচ্ছে, ‘হিন্দু বিয়ে জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন’।
আসলে ‘যদেতৎ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম’ কথাগুলো আপনি ছাদনাতলায় বলুন অথবা রমনাপার্কের বেঞ্চিতে বসে বলুন—এর বাস্তব প্রয়োগ কি রকম হয় তার উপরই সবটা নির্ভর করছে। দয়িতাকে বলছেন, ‘এই গাছ সাক্ষী, ফুল সাক্ষী; এই চাঁদ সাক্ষী, তারা সাক্ষী —আমি একমাত্র তোমার।’ অথচ কিছুক্ষণ পর আরেকজনের কোলে ঢলে পড়লেন–তাহলে আপনার বাক্য বা মন্ত্রের অর্থ কি দাঁড়াল?
চলুন একবার শাস্ত্র পাতায় দেখে আসি কত প্রকারে আমাদের ‘জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন’ হতে পারে।
সনাতন শাস্ত্রগ্রন্থে সুপ্রাচীনকালের প্রথা অনুযায়ী আট রকমের বিয়ে নির্দেশিত আছে। এগুলো হল ১. ব্রাহ্ম, ২. দৈব, ৩. আর্য, ৪. প্রাজাপত্য, ৫. আসুর, ৬. গান্ধর্ব, ৭. রাক্ষস ও ৮. পৈশাচ।

‘ব্রাহ্মো দৈবস্তথৈবার্যঃ প্রাজাপত্যস্তথাসুরঃ।
গান্ধর্বো রাক্ষসশ্চৈব পৈশাচশ্চাষ্টমোহধমঃ।।’
(মনু ৩/২১)

পাত্র-পাত্রী নির্বাচন বা সংযোগ ঘটানোর প্রক্রিয়াভেদে বিয়ের এই আট রকমের প্রকারভেদ। অর্থাৎ আপনি যদি নিজে উপযাচক হয়ে আপনার মেয়েকে কারও কাছে নিঃস্বার্থে দান করে দেন, তাহলে সেটা এক প্রকার বিয়ে। শাস্ত্র অনুযায়ী এটিই সর্বোৎকৃষ্ট, যার নাম ‘ব্রাহ্ম বিবাহ’। যদি পূণ্যলাভের আশায় যজ্ঞের পুরোহিতকে দক্ষিণা হিসেবে নিজের কন্যারত্ন দান করে দেন, তা হবে অরেক প্রকার বিয়ে। এর নাম ‘দৈব বিয়ে’ যা, দ্বিতীয় সর্বোত্তম। ধর্মীয় উদ্দেশ্যে এক জোড়া বা দুই জোড়া গো-মিথুন গ্রহণের বিনিময়ে যদি কন্যা দান করেন তার নাম ‘আর্য বিবাহ’।
ছেলে-মেয়ে সুখে সংসার করবে—এরকম চুক্তিতে যদি কন্যাদান করেন তাহলে হবে আরেক রকম বিয়ে। এর নাম ‘প্রাজাপত্য বিবাহ’, যা বর্তমানে আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত রয়েছে। আট প্রকার বিয়ের তালিকায় এটি চতুর্থ।
শুল্ক বা পণের বিনিময়ে আপনি যদি আপনার মেয়েকে (বিক্রি করে) দেন তবে তা আরেক রকম বিয়ে। এর নাম ‘আসুর বিয়ে’, ভাল’র ক্রমে যার অবস্থান ৫ নম্বরে।
দান করা কিংবা বিক্রি করা নয়; যদি পাত্র-পা্ত্রী নিজেরা পরস্পরকে পছন্দ করে বিয়ে করে, তাহলে সেটি আরেক প্রকারের। একে বলে ‘গান্ধর্ব্য বিয়ে’। তালিকায় এটি ৬ নম্বরে। শাস্ত্রে এর বিধান আছে।
যদি ক্ষমতার জোরে কারও মেয়েকে বলপূর্বক তুলে এনে বিয়ে করেন সেটা হবে আরেক রকম বিয়ে। একে বলে ‘রাক্ষস বিয়ে’ সিরিয়ালে যার অবস্থান ৭ নম্বরে। আর যদি কোনো মেয়েকে ঘুমন্ত, উন্মত্ত বা নেশাগ্রস্ত করে তাকে প্রতারণাপূর্বক সম্ভোগ করেন সেটি হবে সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রকারের বিয়ে–যার নাম ‘পৈশাচ বিয়ে’।
বর্ণভেদে এসব বিয়ের অধিকার ভেদ আছে। অর্থাৎ ব্রাহ্মণের জন্য যা বৈধ, শূদ্রের জন্য তা বৈধ নয়। এছাড়াও বর্ণভেদে তিন প্রকার বিয়ে আছে–সমলোম, অনুলোম ও প্রতিলোম। বিয়ের কোয়ালিটি অনুযায়ী সন্তানদের বর্ণ পরিচয় শাস্ত্রে নির্ধারণ করা আছে। সেই অনুযায়ী আবার আইনে অধিকার নির্ধারণ করা আছে।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার। নারী দানের বস্তু, বিক্রয়ের বস্তু, জোর করে ছিনিয়ে নেয়ার বস্তু এবং অন্যায় পন্থায় উপভোগের বস্তু–এ সবই শাস্ত্র নির্ধারিত। এর সঙ্গে এটিও শাস্ত্র নির্ধারিত, তারা মানুষ। তারা চাইলে কারও দান বা বিক্রয়ের বস্তু না হয়ে নিজেদের পছন্দে সঙ্গী নির্বাচন করতে পারে। এর মধ্যে কোনটি জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন, কোনটি নয় বিবেচনা করুন।
 
শাস্ত্রের এই ভাগে গান্ধর্ব্য বিবাহ থাকলেও স্বয়ংবর সভায় পাত্র বাছাই করার ব্যবস্থা দেখিনি। কিন্তু মহাভারতে তার অনেক প্রমাণ আছে। অন্যদিকে ইতিহাসে “অপরাজিতা” খ্যাত কবি রাধারাণী দেবী ১৯৩১ সালে নিজেই বিয়েতে নিজেকে সম্প্রদান করেছিলেন। সেটি ছিল বিধবা বিবাহ, যাতে বাবা-জ্যাঠারা সম্প্রদান করেননি। আপনি বলতেই পারেন, ‘কলিযুগে আরও কত কি দেখব!’ মনে রাখবেন, মানবীয় সাল/বর্ষ গণনার ইতিহাসে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর বা কলি যুগ নামক কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই। কলি যুগের এই বিয়ে অতীতের বিভিন্ন প্রকারের বিয়ের চেয়ে উত্তম না অধম সে বিচারও মনুষ্যত্বের।
বলুন দেখি, শাস্ত্রীয় ধারণা অনুযায়ী সর্বোত্তম যে ‘ব্রাহ্ম বিয়ে’ তার সঙ্গে সমাজে প্রচলিত ‘প্রাজাপত্য বিয়ের’ পার্থক্য কি? উভয় ক্ষেত্রে কন্যা দান করার বিধান আছে। কিন্তু প্রাজাপত্য বিয়েতে দানের ক্ষেত্রে শর্ত আছে। এখানে “দম্পত্তির সুখে বসবাসের চুক্তি” নিহিত। কিন্তু ব্রাহ্ম বিবাহের কন্যা দান একদম শর্ত ছাড়া দান। তাতে বেশি পুণ্য। অরেকটি প্রশ্ন ‘দৈব বিবাহ’ নিয়ে। কেউ কি যজ্ঞের পুরোহিতকে কন্যা দান করতে রাজি আছেন? এই বিয়ে কিন্তু প্রাজাপত্য বিয়ের চেয়েও বেশি পুণ্যের!
বৃহস্পতি সংহিতায় বলা হয়েছে, “সকল দানকর্মের ফল, এক জন্মমাত্র ভোগ হয়, কিন্তু সুবর্ণ, পৃথিবী এবং অষ্টম বর্ষীয়া কন্যা দানের ফল সপ্ত জন্ম পর্যন্ত ভোগ হয়।” আমরা কি ৮ বছরের বাচ্চাকে দান করে দিতে প্রস্তুত আছি? তাছাড়া আইন কি বলে? এটা কি আইনসম্মত হবে? যারা বলছেন, “হিন্দু আইনের দাড়ি, কমা, সেমিকোলন কিছুই বদলাতে দেবে না, তাদেরকে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭’ ঠেকানোর জন্য মাঠে দেখা যায়নি কেন? 
তাহলে কি বুঝলেন? বিয়ে এবং বিয়ের আচার কি শুধু এক প্রকার? কোন ধরনের বিয়েকে ‘জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন’ বলছেন?
বর্তমান যুগে আপনার-আমার জন্মও সরকারের খাতায় নিবন্ধন করতে হয়। তাহলে বিয়ে নিবন্ধন করতে আপত্তি কেন? কেন আপনি বিবাহ আইন প্রণয়ন করতে দেবেন না? কেন দাড়ি, কমা সেমিকোলন কিছুই বদলাতে দেবেন না? ‘অপরিবর্তিত হিন্দু আইন’ বলতে আদৌ কিছু আছে নাকি? ইংরেজরাই তো হিন্দু আইন বহুবার পরিবর্তন করে গেছে। ‘হিন্দু আইন’ নামক কোনো কিছুর অস্তিত্ব অতীতে ছিল না। ইংরেজরা এই আইন চালু করেছে, আবার তারাই বহুবার সংশোধন করে গেছে।
আমাদের দেশে বিয়ের পূর্বে ‘পাটিপত্র’ করার সংস্কৃতি আগে থেকে চালু আছে। এটি হিন্দু বিবাহের প্রথম আচার। এটা একধরনের নিবন্ধন কিনা? প্রচলিত বিয়েতে আমরা অগ্নি, সূর্য, দেবতা, পুরোহিত, নাপিত, বাদ্যকার, উপস্থিত দশজন সবাইকে সাক্ষী করি। তার সঙ্গে রাষ্ট্র বা রাজাকে সাক্ষী করলে আপনার জন্ম জন্মান্তরের বন্ধনের কি কোনো ক্ষতি হচ্ছে? রাজাকে সাক্ষী করার মানে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে বিবাহ নিবন্ধককে সাক্ষী হিসেবে মানা। জন্মান্তরে আপনার বন্ধন কেমন থাকবে তা কেউ দেখতে যাবে না। আপনার এই জন্মের বন্ধনটা অন্তত রাষ্ট্রের খাতায় নিবন্ধিত থাক। নিজের বন্ধনের বিষয়ে সৎ হলে, ‘যদিদং হৃদয়ং মম’ কথার সঙ্গে আপনার মনের চিন্তার কোনো ফাঁক না থাকলে, স্ত্রীকে ঠকাতে না চাইলে বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করতে ভয় পান কেন?
আমাদের বুদ্ধিমান দাদারা যখন হিন্দুদের চাইতে মুসলমানদের ডিভোর্স অনেক বেশি হয় বলে দাবি করেন, তখন আমি প্রশ্ন করি, ‘হিন্দুদের ভিভোর্স হয় নাকি?’ তারা বলেন, “হয়, কিন্তু মুসলমানদের তুলনায় অনেক কম।’ আমি আবার জিজ্ঞেস করি—ইচ্ছে করেই জিজ্ঞেস করি, ‘হিন্দুদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয় প্রমাণ দেখাতে পারবেন?’ তারা প্রমাণ দেখাতে চায়। তারা বলে অনেক মেয়েরই তো আবার বিয়ে হচ্ছে! আমি বলি, তারা কি হিন্দু মেয়ে? তারা আমাকে প্রমাণ দেয়; এক স্বামী বেঁচে থাকতেও গোপনে অনেক হিন্দু মেয়ের পুনরায় বিয়ে হচ্ছে। এখানেই প্রশ্ন, কিভাবে সম্ভব? হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদের আইন নেই। কিভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ হবে? বিচ্ছেদ ছাড়া হিন্দু মেয়েদের আবার বিয়ে হয় কিভাবে?
ভারতের হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং নারীর পুনরায় বিয়ের বিধান আছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রচলিত হিন্দু আইনে বিচ্ছেদের কোনো সুযোগ নেই। ১৯৪৬ সালের Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ (divorce) স্বীকার করে না। একজন নারী চাইলে ঘোষণা দিয়ে যৌনকর্মী হতে পারে। সে অধিকার আছে। কোনো পুরুষের রক্ষিতাও হতে পারে। কিন্তু পুনরায় বিয়ে করে স্বাভাবিক ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার হিন্দু নারীকে দেয়া হয়নি। 
আমাদের বুদ্ধিমান দাদারা মেয়েদের নতুন করে বিয়ে দেয়ার যে উদাহরণগুলো দেখান সেগুলো ঠিক। কিন্তু সেগুলো অবৈধ বিয়ে। অবৈধভাবে বা আইন-বহির্ভূতভাবে অনেকেই অনেক কিছু করতে পারে। তা আইনগত বা বৈধ কর্মের উদাহরণ হতে পারে না। অবৈধভাবে বিয়ে করলে তাদের সন্তানও বৈধ হয় না। অবৈধ সন্তানের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার থাকে না।
বিবাহ বিচ্ছেদ একটি প্রয়োজনীয়তা। প্রয়োজন আইন মানে না (Necessity knows no law.)। অনেক মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে আইনবহির্ভূত অবৈধ বিয়ের দিকে যেতে বাধ্য হচ্ছে। বিবাহ বিচ্ছেদ সবার জন্য প্রয়োজনীয় নয়। কিন্তু যার জন্য প্রয়োজন তাকে এই অধিকার না দিয়ে উপায় নেই। তবুও মৌলবাদী মুর্খরা এই আইন প্রণয়নে বাধা দিচ্ছে। তারা হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ আইন প্রণয়নের বিরোধিতা করে, অথচ অবৈধ ডিভোর্স এবং মেয়েদের অবৈধভাবে পুনরায় বিয়ের উদাহরণ দেয়। তাদের কথা হল, এভাবেই চলুক। কোনো নীতিবান মানুষ এরকম মতামত দিতে পারে না।
যদি ডিভোর্স ছাড়া পুরুষদের নতুন বউ ঘরে তুলতে আইনগত অসুবিধা থাকত, তাহলে পুরুষরাই আগে বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের জন্য দাবি তুলত। মহাভারতের অনুশাসন পর্বের ১১৩/৮ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, ‘তোমার নিজের জন্য যা খারাপ লাগে অন্যের প্রতি তা করিও না।’

‘ন তৎ পরস্য সন্দধ্যাৎ প্রতিকূলং যদাত্মনঃ।
এষ সংক্ষেপতো ধর্মঃ কামাদন্যঃ প্রবর্ততে॥’

অর্থ: নিজের যাহা প্রতিকূল বা দুঃখজনক বলিয়া বোধ কর, অন্য লোকের সহিত সেরূপ ব্যবহার করিবে না, ইহাই সমস্ত ধর্মের সার, অন্য যাহা কিছু কামনা-প্রসূত।
একথা মহাভারতে অন্তত চারবার উল্লেখ আছে। গীতায় একই কথা অন্যভাবে আছে। ঈশপোনিষদে, মনু সংহিতায় এবং বৃহস্পতি সংহিতাও এই অনুশাসন দিয়েছে। একে সকল ধর্মের সারসংক্ষেপ বলা হয়েছে। এটাই ধর্ম। যারা নিজের জন্য অধিকার চায়, কিন্তু নারীর অধিকার হরণ করতে চায় তারা ধার্মিক নয়; তারা বিধর্মী। 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ