নতুন বৌদ্ধ আইন হচ্ছে

পুলক ঘটক

হিন্দু আইন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটি অংশ। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো “বৌদ্ধ পারিবারিক আইন” প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খসড়া আইনটি ইতিমধ্যে সরকারের ওয়েবসাইটে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রায় চুড়ান্ত পর্যায়ে এসে ‘বাংলাদেশ বৌদ্ধ কল্যাণ ট্রাস্ট’ আগামীকাল এ বিষয়ে একটি সেমিনার আয়োজন করেছে; যাতে আইন মন্ত্রীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ থাকবেন বলে জেনেছি। 
বাংলাদেশের বৌদ্ধ সমাজ যদি হিন্দু আইনের আওতায় থাকতে না চায়, তবে আমাদের জোর করার কিছু নেই। তবে দেশের নাগরিক হিসেবে এর ভাল-মন্দ দুয়েকটি দিক নিয়ে মতামত দিতে চাই। 
প্রথমত, বিদ্যমান ভয়াবহ বৈষম্য ও নিগ্রহের হিন্দু আইন পরিবর্তিত বিশ্বের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারানো অতি স্বাভাবিক বিষয়। তাই সমাজের যে কোনো অংশের জন্য সমঅধিকার ভিত্তিক নতুন আইন হলে তাকে স্বাগত জানাতে হবে। 
দ্বিতীয়ত, বৌদ্ধরা যদি “হিন্দু আইন“ শিরোনামের বাইরে যেতে চায়, সে অধিকার তাদের আছে। তাছাড়া বিদ্যমান হিন্দু আইনের সবটা না হোক, অনেকাংশই হিন্দুদের বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থের রেফারেন্স দিয়ে প্রচলিত আছে, যার সঙ্গে বৌদ্ধদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আবেগ অনুভূতির সম্পর্ক নেই। তবুও তারা কেন এসব মানতে বাধ্য হবেন? সুতরাং তারা আলাদা শিরোনামে ”বৌদ্ধ আইন” চাইতেই পারে। 
কিন্তু লক্ষণীয়, ১৭৭২ সালের ২১ আগস্ট ইংরেজ শাসক ওয়ারেন হেস্টিংসের “A Plan for the Administration of Justice in Bengal” ঘোষণাপত্র জারি করা এবং এর আওতায় ‘হিন্দু আইন বিধি’ সংকলন করার পর ইতিমধ্যে ২৫১ বছর চলে গেছে। এতদিন যাবত হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈনসহ ভারতীয় ঐতিহ্যগত সকল ধর্মীয় সম্প্রদায় “হিন্দু আইনের” আওতাভুক্ত রয়ে গেছে – যদিও সে আইন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল এবং বিভিন্ন গোত্র/গোষ্ঠীভেদে বিভিন্ন রকম। একই আইনের আওতায় থাকায় আমরা হিন্দু ও বৌদ্ধরা দীর্ঘকাল একই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক হয়ে আছি। তা থেকে আমাদের একটি বাহু বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে উপকার হবে নাকি ক্ষতি হবে ভাবা দরকার। 
তৃতীয়ত, লক্ষণীয়, ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫৬ সালে “Hindu Succession Act, 1956 সহ অন্যান্য হিন্দু আইনগুলো নতুন করে প্রণয়ন করলেও ভারত সরকার বৌদ্ধদেরকে হিন্দুদের থেকে আলাদা করে দেয়নি। (শুধু মুসলমান, পার্শি এবং খ্রিষ্টানরা ছাড়া) ভারতের হিন্দু, বৌদ্ধ জৈনসহ সকল ধর্ম সম্প্রদায় এক “হিন্দু আইনের” আওতাভুক্ত রয়ে গেছে। ভারতের বর্তমান বিজেপি সরকার সকল ধর্মীয় পরিচয়ভিত্তিক আইন তুলে দিয়ে সকল সম্প্রদায়ের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। শিগগিরই ভারতে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার জন্য অভিন্ন সেক্যুলার আইন প্রবর্তন হতে চলেছে। ঠিক সেই সময়ে বাংলাদেশ সরকার এদেশের বৌদ্ধদের জন্য নতুন করে সম্প্রদায় ভিত্তিক ‘বৌদ্ধ পারিবারিক (বিবাহবন্ধন, বিবাহবিচ্ছেদ ও উত্তরাধিকার ইত্যাদ) আইন, ২০১৮’র খসড়া চুড়ান্ত করেছে। এতে হিন্দু ও বৌদ্ধ ট্রেডিশন বিভক্ত হবে। 
চতুর্থত, দেশের বৌদ্ধ সমাজ এবার আনুষ্ঠানিকভাবে অর্থাৎ আইনগতভাবেই দুইভাগে বিভক্ত হতে যাচ্ছে। কারণ নতুন আইনটি করা হচ্ছে শুধুমাত্র সমতলের “বাঙালি বৌদ্ধদের” জন্য; যাদের ক্ষেত্রে আদিবাসীদের মতো কোনো আলাদা নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নেই শুধু তাদের জন্য। দেশে এরকম বৌদ্ধ জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে ৩ লাখ। বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর ৬৫% পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীভুক্ত, যাদেরকে এই আইন থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে। নতুন আইনের ব্যাপারে তাদের আপত্তির কারণেই তাদেরকে বাদ দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। আর সমতলের ‘বাঙালি বৌদ্ধ’ নেতাদের অধিকাংশ এই নতুন আইনের বিষয়ে একমতে পৌঁছানোর কারণে “বৌদ্ধ কল্যাণ ট্রাস্ট“ এভাবে খসড়া জমা দিয়েছে। 
পঞ্চমত, এই আইনের ফলে দেশের বৌদ্ধ সমাজ দুইভাগে বিভক্ত হওয়ায় একই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হলেও আদিবাসী ও বাঙালি বৌদ্ধ নরনারীর মধ্যে বিয়েতে সম্ভাব্য আইনগত জটিলতা নিরসনের প্রয়োজন আছে। তাছাড়া, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আদিবাসী ও বাঙালি নরনারীর বিবাহের মাধ্যমে গঠিত পরিবার ও সন্তানদের উত্তরাধিকার নিয়ে সম্ভাব্য জটিলতা সৃষ্টির ক্ষেত্রেও সতর্ক উত্তরণের ব্যবস্থা থাকা দরকার। নতুন আইনের খসড়ায় এ বিষয়টি পরিস্কার নয়। 
ষষ্ঠত, প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় অনেক ধরনের বৈষম্য, স্ববিরোধ ও বিশৃঙ্খলা রয়েছে। এই আইনে “সন্তান” অর্থে শুধু পুত্র এবং কন্যা বোঝানো হয়েছে। লিঙ্গ বৈচিত্রময় জনগোষ্ঠীকে (হিজড়া) সন্তানের সংজ্ঞায় রাখা হয়নি। বর্তমান সভ্য দুনিয়ায় এধরণের বৈষম্য গ্রহণযোগ্য নয়। 
সপ্তমত, বিবাহ বহির্ভূত সন্তান হিসেবে শুধু বিয়ের আগে বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কের মাধ্যমে জাত সন্তানের অধিকার স্বীকার করা হয়েছে। বিবাহের পর বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কের ফলে কোনো সন্তান জন্ম নিলে সেই সন্তানের অধিকার স্বীকার করা হয়নি। ধর্ষণের মতো অপরাধের ফলে মানব শিশু জন্ম নিলে তার দায় বা উত্তরাধিকার নির্ধারণ করা হয়নি। আইনটিতে এরকম বেশ কিছু গোলমাল আছে, যা নিরসন করা প্রয়োজন। 
অষ্টমত, সর্বোপরি, সন্তান হিসেবে সমঅধিকার স্বীকার করা হয়নি। কন্যা সন্তানকে পুত্র সন্তানের অর্ধেক অধিকার প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই ধরণের প্রস্তাবনা একদম অগ্রহণযোগ্য। যেখানে মানবিক, আধুনিক ও প্রগতিশীল চিন্তার মুসলমানরা বিদ্যমান মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কার করে নারী-পুরুষ সকলের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছে, সেখানে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানিয় ব্যক্তিবর্গ কিভাবে ফারায়েজি আদলে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব দেয় তা ভাবা যায় না! এরফলে মুসলিম পারিবারিক আইনের উন্নয়ন এবং মানবতা প্রতিষ্ঠার যুক্তি, ন্যায় ও আবেগ প্রচণ্ডভাবে মার খাবে। 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ