বর্ণবৈষম্য চাই না; তবে লিঙ্গবৈষম্য চাই! [পর্ব ১]

পুলক ঘটক

শূদ্রের শাস্ত্র আলোচনা, বিশেষত বেদপাঠ নিষিদ্ধ। পরাশর সংহিতার প্রথম অধ্যায়ের ৬৪ নম্বর শ্লোকটি হল,

কপিলাক্ষীরপানেন ব্রাহ্মণীগমনেন চ।
বেদাক্ষরবিচারেণ শূদ্রস্য নরকং ধ্রুবম্।।

অর্থ: “কপিলা গাভীর দুগ্ধ পান, ব্রাহ্মণীগমন এবং বেদাক্ষর বিচার –এই কার্য্যে শূদ্র নিশ্চয়ই নরকগামী হইবে।”
উল্লেখ্য, কপিলা গাভী হল, সবচেয়ে উন্নত যাতের গাভী। শূদ্রদের সেই গাভীর দুধ পান করতেও নিষেধ করা হয়েছে; শুধুমাত্র শাস্ত্রপাঠ নিষিদ্ধ করা হয়নি।
বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণ এক শতাংশেরও কম হবে। পেশা হিসেবে বৈশ্যকর্মে (কৃষি ও ব্যবসা বাণিজ্য) অধিকাংশ হিন্দুকে দেখা গেলেও শাস্ত্র এবং আইনের বিচারে এখানে ব্রাহ্মণ ছাড়া বাকি প্রায় সবাই শূদ্র। দেশের উত্তরাঞ্চলে কোচ এবং রাজবংশী জনগোষ্ঠী বৃটিশ আমলে পৈতা গ্রহণ করে আইনগতভাবে ক্ষত্রিয় স্বীকারোক্তি আদায় করেছে। এছাড়া এদেশে বংশ পরম্পরায় ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণের মানুষ শূণ্যের কোঠায়।
তাই একটি সাধারণ প্রশ্ন, দেশের সম্পূর্ণ শূদ্র জনগোষ্ঠীকে যদি শাস্ত্র অনুযায়ী বেদাদী গ্রন্থ অধ্যয়ন করতে দেয়া না হয় তাহলে সনাতন ধর্মের অনুসারী বা অস্তিত্ব থাকবে? তবে বলুন, পরাশর সংহিতার পূর্বোক্ত বিধান মানতে কে কে প্রস্তুত আছেন? ধার্মিক হিসেবে ভেবে বলুন।
এবার বলুন, শাস্ত্রে এবং আইনে এরকমই বহু বিধান আছে, যেখানে নারীকে পুরুষের দাসী বানানো হয়েছে। শূদ্ররা যেমন উচ্চ বর্ণের দাস, নারীরা তেমনি পুরুষের দাসী। শূদ্রদের যেমন ব্রাহ্মণ সেবায় পুণ্য, নারীর তেমনি পুরুষের সেবা করলে পূণ্য হয়। 
তবে বলুন, নারী/স্ত্রী আপনার দাসী, এটা মানতে আপনার ভাল লাগছে কিনা? আবার, আপনি শূদ্রত্ব থেকে মুক্তি চান কিনা? নিজে শূদ্রত্ব থেকে মুক্তি নেবেন কিন্তু নারীকে শূদ্রত্ব থেকে মুক্তি দিতে রাজি নন! কেন? কারণ এক জায়গায় আপনি ভিকটিম (শিকার), আরেক জায়গায় আপনি বেনিফিসিয়ারি (সুবিধাভোগী)। আর নারী সামগ্রিকভাবে শুধুই ভিকটিম।
যারা বর্ণবৈষম্য বিলোপ চায়, কিন্তু লিঙ্গবৈষম্য বহাল চায় তাদেরকে কি বলা যায় বন্ধু? মানববোধ জাগ্রত কর হে মানুষ। আধুনিক পৃথিবীতে টিকতে হলে উন্নত হতে হবে। 

গীতায় কি আছে, পড়ুন দ্বিতীয় পর্বে

বিশ্লেষনে না গিয়ে সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে মুনি ঋষিদের অল্পকিছু বাণী এখানে সরাসরি তুলে ধরছি। হিন্দু আইনের বড় অংশ এইসব শাস্ত্রের রেফারেন্স দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। হিন্দু আইনের কোথাও গীতা অথবা বেদের বাণী নেই। আপনারা কোনটা মানতে চান, কোনটা মানতে চান না সিদ্ধান্ত নিবেন। তবে “বর্ণবৈষম্য পছন্দ করি না, কিন্তু লিঙ্গবৈষম্য পছন্দ করি” – এই যদি আপনার মত হয়, তবে আমি নিশ্চিত, আপনার জন্মের পর শয়তান সগর্বে বলেছিল, “অব ম্যায় সাহেবে আওলাদ বন গেয়া।” 

শাস্ত্রবাণী

পরাশর সংহিতা

বিকর্ম্ম কুর্ব্বতে শূদ্রা দ্বিজসেবাবিবর্জ্জিতাঃ।
ভবন্ত্যল্পায়ুষন্তে বৈ পতন্তি নরকেষু চ।
চতুর্ণামপি বর্ণানামেষ ধর্ম্মঃ সনাতনঃ।।
(পরাশর ২/১৬)

অর্থ: দ্বিজ-সেবা-বর্জ্জিত হইয়া শূদ্রগণ যদি অন্যায় করে, তবে তাহাদের আয়ু অল্পা হয় এবং তাহারা নরকে যায়। এই চারিবর্ণের ইহাই সনাতন ধর্ম্ম।

তস্মাদ্দ্বিজো মৃতং শূদ্রং ন স্পৃশেন্ন চ দাহয়েৎ।
দৃষ্টে সূর্যাবলোকেন শুদ্ধিরেষা পুরাতনী।
পরাশর ৩/৫৪

অর্থ: অতএব ব্রাহ্মণ শূদ্রের মৃতদেহ স্পর্শ করিবেন না, দাহ করিবেন না। উহা চক্ষে দেখিলে সূর্যাবলোকন দ্বারা তিনি শুদ্ধিলাভ করিবেন। ইহাই চিরাচিরত বিধি। (পরাশর ৩/৫৪)

চাণ্ডালৈঃ সহ সুপ্তন্তু ত্রিরাত্রমুপবাসয়েৎ।
চাণ্ডালৈকপথং গত্বা গায়ত্রীস্মরণাচ্ছুচিঃ।
(পরাশর ৬/২১)

অর্থ: চণ্ডালের সহিত একত্র শয়ন করিলে, তিনি ত্রিরাত্র উপবাস করিলেই শুদ্ধি লাভ করিবেন। যে ব্রাহ্মণ চণ্ডালের সহিত এক পথে গমন করেন, তিনি গায়ত্রী স্মরণ করি শুদ্ধি লাভ করিবেন।

চাণ্ডালদর্শনেনৈব আদিত্যমবলোকয়েৎ।
চাণ্ডালস্পর্শনে চৈব সচেলং স্নানমাচরেৎ।।
(পরাশর ৬/২২)

অর্থ: চণ্ডাল দর্শন করিলে সূর্য্য দর্শন করিবে। চন্ডালকে স্পর্শ করিলে জলে সবস্ত্র স্নান করিবে।

চাণ্ডালখাতবাপীষু পীত্বা সলিলমগ্রজঃ।
অজ্ঞানাচ্চৈব নক্তেন ত্বহোরাত্রেণ শুধ্যতি।।
(পরাশর ৬/২৩)

অর্থ: ব্রাহ্মণ না জানিয়া চণ্ডালখাত পুস্করিণী বা দীর্ঘিকাতে জলপান করিলে এক রাত্রি এবং দিবারাত্রি উপবাস করিয়া শুদ্ধি লাভ করিতে পারিবেন।

চাণ্ডালভাণ্ডসংস্পৃষ্টং পীত্বা কূপগতং জলম।
গোমুত্রযাবকাহারস্ত্রিরাত্রাচ্ছুদ্ধিমাপ্নুয়াৎ।।
(পরাশর ৬/২৪)

অর্থ: চণ্ডালের ভাণ্ডস্পৃষ্ট কূপস্থিত জল পান করিলে, তিন রাত্রি গোমুত্র ও যাবক আহারপূর্ব্বক থাকিয়া শুদ্ধি লাভ করিতে পারিবেন।

চাণ্ডালোদকভাণ্ডে তু অজ্ঞানাৎ পিবতে জলম্।
তৎক্ষণাৎ ক্ষিপতে যযস্তু প্রাজাপত্যং সমাচরেৎ।।
(পরাশর ৬/২৫)

অর্থ: যদি কোন ব্রাহ্মণ না জানিয়া চাণ্ডালের জলপাত্রে জল পান করেন ও যদি ঐ জল তৎক্ষণাৎ বমন করিয়া ফেলেন, তাহ হইলে প্রাজাপত্য ব্রতাচরণ করিয়া শুদ্ধি লাভ করিতে পারিবেন।

যদি ন ক্ষিপতে তোয়ং শরীরে যস্য জীর্য্যতি।
প্রাজাপত্যং ন দাতব্যং কৃচ্ছং সান্তপনং চরেৎ।। (পরাশর ৬/২৬)

অর্থ: কিন্তু যদি সেই জল বমন করিয়া না ফেলিয়া জীর্ণ করিয়া ফেলেন, তাহা হইলে প্রাজাপত্য ব্রতানুষ্ঠান করিলে হইবে না।, কৃচ্ছ পন্তপন ব্রতাচরণ করিতে হইবে।

সংস্পৃষ্টঃ শুনা শূদ্রেণ বা দ্বিজঃ।
উপোষ্য রজনীমেকাং পঞ্চগব্যেন শুধ্যতি।।
(পরাশর ৬/২১)

অর্থ: রাহ্মণ উচ্ছিষ্টযুক্ত শূদ্র ও কুক্কুর কর্ত্তিৃক স্পৃষ্ট হইলে, তিনি এক রাত্রি উপবাস করিয়া পঞ্চগব্য সেবন দ্বারা শুদ্ধি লাভ করিতে পারিবেন।

অনুচ্ছিষ্টেন শূদ্রেণ স্পর্শে স্নানং বিধীয়তে।
উচ্ছিষ্টেন চ সংস্পৃষ্টঃ প্রাজাপত্যং সমাচরেৎ।।
(পরাশর ৬/২২)

অর্থ: উচ্ছিষ্টবিরহিত শূদ্র কোন ব্রাহ্মণকে স্পর্শ করিলে ব্রাহ্মণের স্নান করা বিহিত আর শূদ্র উচ্ছিষ্টযুক্ত থাকিলে ব্রাহ্মণকে প্রাজাপত্য আচরণ করিতে হইবে। (পরাশর ৬/২২)

গায়ত্রীরহিতো বিপ্রঃ শূদ্রাদপ্যশুচির্ভবেৎ।
গায়্ত্রীব্রহ্মতত্ত্বজ্ঞাঃ সম্পূজ্যন্তে দ্বিজোত্তমাঃ।।
(পরাশর ৮/৩১)

অর্থ: বিপ্রগণ গায়ত্রীবিহীন হইলে তাঁহারা শূদ্র অপেক্ষাও অশুচি হন; আর যাহারা গায়ত্রীনিষ্ঠ ও ব্রহ্মতত্ত্বজ্ঞ, তাহারাই দ্বিজগণমধ্যে শ্রেষ্ঠ ও পূজনীয় হন।

দুঃশীলোহপি দ্বিজঃ পূজ্যো ন শূদ্রো বিজিতেন্দ্রিয়ঃ।
ক: পরিত্যজ্য দৃষ্টাং গাং দুহেচ্ছিলবতীং খরীম্।।
(পরাশর ৮/৩২)

অর্থ: দু:শীল হইলেও দ্বিজ পূজনীয় হইবে, আর শূদ্র সংযতেন্দ্রিয় হইলেও সে পূজনীয় হয় না। কে বল দেখি, দুষ্ট-দুষিত-শরীর গাভীকে পরিত্যাগ করিয়া সুশীলবোধে গর্দ্দভী দোহনে প্রবৃত্ত হয়? 

অত্রি সংহিতা

যে ত্যক্তারং: স্বধম্মস্য পরধর্ম্মে ব্যবস্থিতাঃ।
তেষাং শাস্তিকরো রাজা স্বর্গলোকে মহীয়তে।।
(অত্রি শ্লোক ১৭)

অর্থ: যাহারা পূর্বোক্ত নিজ নিজ ধর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া অন্য ধর্ম্ম আশ্রয় করে, নরপতি তাহাদিগকে শাস্তিদান করিয়া স্বর্গভাগী হন।

আত্মীয়ে সংস্থিতো ধর্ম্মে শূদ্রোহপি স্বর্গমশ্নুতে।
পরধর্ম্মো ভবেত্ত্যাজ্যঃ সুরূপপরদারবৎ।।
(অত্রি শ্লোক ১৮)

অর্থ: স্বধর্ম্মে থাকিলে শূদ্রও স্বর্গলাভ করে। পরধ্ম্ম, সুন্দরী পরস্ত্রীর ন্যায় সর্বোতভঅবে ত্যাজ্য।

বধৌা রাজ্ঞা স বৈ শুদ্রো জপহোমপরশ্চ যঃ।
ততো রাষ্ট্রস্য হন্তাসৌ যথা বহ্নেশ্চ বৈ জলম্।।
(অত্রি শ্লোক ১৯)

অর্থ: জপ হোম প্রভৃতি দ্বিজোচিত কর্ম্ম-নিরত শূদ্রকে রাজা বধ করিবেন। কারণ জলধারা যেরুপ অনলকে বিনষ্ট করে, সেইরূপ ঐ জপহোম তৎপর শূদ্র, সমস্ত রাজ্যকে বিনষ্ট করে।

প্রতিগ্রহোহধ্যাপনঞ্চ তথাবিক্রেয়বিক্রয়ঃ।
যাজ্যং চতুর্ভিরপ্যেতৈঃ ক্ষত্রবিটপতনং স্মৃতম্।।
(অত্রি শ্লোক ২০)

অর্থ: প্রতিগ্রহ, অধ্যাপন, অবিক্রেয়- বিক্রয় বা যাজন এই চারিকর্ম্ম করিলে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য পতিত হয়।

জপস্তপস্তীর্থযাত্রা প্রব্রজ্যা, মন্ত্রসাধনম্।
দেবতারাধনঞ্চৈব স্ত্রীশূদ্রপতনানি ষট।।
(অত্রি শ্লোক ১৩৫)

অর্থ: জপ, তপস্যা, তীর্থযাত্রা, সন্ন্যাস, মন্ত্রসাধন, দেবতারাধন এই ছয়টি কার্য স্ত্রী শূদ্রদিগের পাতিত্যজনক।

জীবদ্ভর্ত্তরি যা নারী উপোষ্য ব্রতচারিণী।
আয়ুষ্যং হরতে ভর্ত্তুঃ সা নারী নরকং ব্রজেৎ।।
(অত্রি শ্লোক ১৩৬)

অর্থ: যে নারী স্বামী জীবিত থাকিতে উপবাস করিয়া ব্রত করে, সে নারী স্বামীর আয়ু-হরণ করে ও নরকে গমন করে।

তীর্থস্নানার্থিনী নারী পতিপাদোদকং পিবেৎ।
শঙ্করস্ব্যাপিবিষ্ণো্র্ব্বা প্রয়াতি পরমং পদম।।
(অত্রি শ্লোক ১৩৭)

অর্থ: নারী তীর্থস্নান-অভিলাষিণী হইলে স্বামী, শিব বা বিষ্ণুর পাদোদক পান করিবে; ইহাতে পরম স্থান লাভ করিবে।

রজকঃ শৈলুষশ্চৈব বেণুকর্ম্মোপজীবনঃ।
এতেষাং যস্তু ভুঙেক্ত বৈদ্বিজশ্চান্দ্রায়ণং চরেৎ।।
(অত্রি শ্লোক ১৬৮)

অর্থ: রজক, শৈলুষ (নাটকাদিতে সাজিয়া যাহারা জীবিকা নির্ব্বাহ করে) বেণ-কর্ম্মোপজীবী (ডোম) ইহাদিগের অন্ন ভোজন করিলে ব্রাহ্মণ, চান্দ্রায়ণ ব্রত করিবে।

সর্ব্বান্ত্যজানাং গমনে ভোজনে সম্প্রবেশনে।
পরাকেণ বিশুদ্ধিঃ স্যাদ্বগবনাত্রিরব্রবীৎ।।
(অত্রি শ্লোক ১৬৯)

অর্থ: সকল অন্ত্যজা গমনে, তাহাদিগের দ্রব্য ভোজনে ও সম্প্রবেশনে (একত্র শয়নে) পরাকব্রত দ্বারা শুদ্ধ হইবে – ইহা ভগবান অত্রি বলিয়াছেন।

চাণ্ডালভাণ্ডে যত্তোয়ং পীত্বা চৈব দ্বিজোত্তমঃ।
গোমত্রযাবকাহারঃ সপ্তত্রিংশদহান্যপি।।
(অত্রি শ্লোক ১৭০)

অর্থ: ব্রাহ্মণ চাণ্ডাল-ভান্ডস্থিত জল পান করিলে ৩৭ দিন গোমুত্র সিদ্ধ যাবক আহার করিযা থাকিবে।

মনু সংহিতা

* সর্বশাস্ত্রে মনু সংহিতার বিধানকে সর্বোচ্চ হিসেবে স্থান দেয়া হয়েছে। তাহলে বর্ণবাদ বিষয়ে মনু কি বলে গেছেন পড়ুন।

‘অধীয়ীরংস্ত্রয়ো বর্ণাঃ স্বকর্মস্থা দ্বিজাতয়ঃ।
প্রব্রূয়াদ্ ব্রাহ্মণস্ত্বেষাং নেতরাবিতি নিশ্চয়ঃ।।’
(মনু সংহিতা ১০/১)

অর্থ: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই তিনবর্ণের লোকেরা দ্বিজাতি; এঁরা নিজনিজ কর্তব্য কর্মে নিরত থেকে বেদ অধ্যয়ন (পড়াশোনা) করবেন। কিন্তু এঁদের মধ্যে কেবল ব্রাহ্মণেরাই অধ্যাপনা (শিক্ষকতা) করবেন, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই দুই বর্ণের পক্ষে অধ্যাপনা করা উচিত নয়। -এটাই শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত।

এতমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম সমাদিশৎ।
এতেষামেব বর্ণানাং শুশ্রƒষামনসূয়য়া।।
(মনু ১/৯১)

অর্থ: প্রভু ব্রহ্মা শূদ্রের জন্য একটি কাজই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন,- তা হলো কোনও অসূয়া অর্থাৎ নিন্দা না করে (অর্থাৎ অকপটভাবে) এই তিন বর্ণের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের শুশ্রূষা করা।

উত্তমাঙ্গোদ্ভবাজ্জৈষ্ঠ্যাদ্ ব্রহ্মণশ্চৈব ধারণাৎ।
সর্বস্যৈবাস্য সর্গস্য ধর্মতো ব্রাহ্মণঃ প্রভুঃ।।’
(মনু ১/৯৩)

অর্থ: ব্রহ্মার পবিত্রতম মুখ থেকে উৎপন্ন বলে, সকল বর্ণের আগে ব্রাহ্মণের উৎপত্তি হওয়ায়, এবং বেদসমূহ ব্রাহ্মণকর্তৃক রক্ষিত হওয়ার জন্য ব্রাহ্মণই ধর্মের অনুশাসন অনুসারে এই সৃষ্ট জগতের একমাত্র প্রভু।

ব্রাহ্মণো জায়মানো হি পৃথিব্যামধিজায়তে।
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ধর্মকোষস্য গুপ্তয়ে।।
(মনু ১/৯৪)

অর্থ: ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করা মাত্রই পৃথিবীর সকল লোকের উপরিবর্তী হন অর্থাৎ সমস্ত লোকের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হন। কারণ, ব্রাহ্মণই সকলের ধর্মকোষ অর্থাৎ ধর্মসমূহ রক্ষার জন্য প্রভুসম্পন্ন হয়ে থাকেন।
* এখানে “জন্মগ্রহণ করা মাত্রই” কথাটি খেয়াল করুন।

সর্বং স্বং ব্রাহ্মণস্যেদং যৎ কিঞ্চিজ্জগতীগতম্।
শ্রৈষ্ঠ্যেনাভিজনেনেদং সর্বং বৈ ব্রাহ্মণোহর্হতি।।
(মনু ১/১০০)

অর্থ: জগতে যা কিছু ধনসম্পত্তি সে সমস্তই ব্রাহ্মণের নিজ ধনের তুল্য; অতএব সকল বর্ণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে ব্রাহ্মণই সমুদয় সম্পত্তিরই প্রাপ্তির যোগ্য হয়েছেন।

‘স্বমেব ব্রাহ্মণো ভুঙ্ক্তে স্বং বস্তে স্বং দদাতি চ।
আনৃশংস্যাদ্ ব্রাহ্মণস্য ভুঞ্জতে হীতরে জনাঃ।।’
(মনু ১/১০১)

অর্থ: ব্রাহ্মণ যে পরের অন্ন ভোজন করেন, পরকীয় বসন পরিধান করেন, পরের ধন গ্রহণ করে অন্যকে প্রদান করেন, সে সবকিছু ব্রাহ্মণের নিজেরই। কারণ, ব্রাহ্মণেরই আনৃশংস্য অর্থাৎ দয়া বা করুণাতেই অন্যান্য যাবতীয় লোক ভোজন-পরিধানাদি করতে পারছে।

শূদ্রং তু কারয়েদ্ দাস্যং ক্রীতমক্রীতমেব বা।
দাস্যায়ৈব হি সৃষ্টোহসৌ ব্রাহ্মণস্য স্বয়ম্ভুবা।।
(মনু ৮/৪১৩)

অর্থ: ক্রীত অর্থাৎ অন্নাদির দ্বারা প্রতিপালিত হোক্ বা অক্রীতই হোক্ শূদ্রের দ্বারা ব্রাহ্মণ দাসত্বের কাজ করিয়ে নেবেন। যেহেতু, বিধাতা শূদ্রকে ব্রাহ্মণের দাসত্বের জন্যই সৃষ্টি করেছেন।

ন স্বামিনা নিসৃষ্টোহপি শূদ্রো দাস্যাদ্বিমুচ্যতে।
নিসর্গজং হি তত্তস্য কস্তস্মাত্তদপোহতি।।

অর্থ: প্রভু শূদ্রকে দাসত্ব থেকে অব্যাহতি দিলেও শূদ্র দাসত্ব কর্ম থেকে অব্যাহতি পেতে পারে না। দাসত্বকর্ম তার স্বভাবসিদ্ধ কর্ম (অর্থাৎ জন্মের সাথে আগত)।

বৈশ্যশূদ্রৌ প্রযত্নেন স্বানি কর্মাণি কারয়েৎ।
তৌ হি চ্যুতৌ স্বকর্মভ্যঃ ক্ষোভয়েতামিদং জগৎ।।
(মনু ৮/৪১৮)

অর্থ: রাজা বিশেষ যত্ন সহকারে বৈশ্য এবং শূদ্রকে দিয়ে তাদের কাজ অর্থাৎ কৃষিবাণিজ্যাদি করিয়ে নেবেন। কারণ, তারা নিজ নিজ কাজ ত্যাগ করলে এই পৃথিবীকে বিক্ষুব্ধ করে তুলবে।

শক্তেনাপি হি শূদ্রেণ ন কার্যো ধনসঞ্চয়ঃ।
শূদ্রো হি ধনমাসাদ্য ব্রাহ্মণানেব বাধতে।।
(মনু ১০/১২৯)

অর্থ: ধন অর্জনে সমর্থ হলেও শূদ্রকে কিছুতেই ধন সঞ্চয় করতে দেওয়া চলবে না, কেননা ধন সঞ্চয় করলে ব্রাহ্মণদের কষ্ট হয়৷ শাস্ত্রজ্ঞানহীন শূদ্র ধনমদে মত্ত হয়ে ব্রাহ্মণদের পরিচর্যা না করে অবমাননা করতে পারে৷

বিস্রব্ধং ব্রাহ্মণঃ শূদ্রাদ্ দ্রব্যো দাদানমাচরেৎ।
ন হি তস্যাস্তি কিঞ্চিৎ স্বং ভর্তৃহার্যধনো হি সঃ।।
(মনু ৮/৪১৭)

অর্থ: ব্রাহ্মণ নিঃসঙ্কোচে শূদ্রের জিনিস গ্রহণ করবেন; কারণ তার অর্থাৎ শূদ্রের নিজের বলতে কোন ধনও নেই, সেও প্রভুরই জন্য দ্রব্য আহরণ করে; সে স্বয়ং ধনহীন।

অনংশৌ ক্লীবপতিতৌ জাত্যন্ধবধিরৌ তথা।
উন্মত্তজড়মূকাশ্চ যে চ কেচিন্নিরিন্দ্রিয়াঃ।।
(মনু ৯/২০১)

অর্থ: ক্লীব (পুরুষত্বহীণ), পতিত (বর্ণভ্রষ্ঠ), জন্মান্ধ, বধির, উন্মত্ত, জড়, চেতনহীন, মূক (বোবা), কালা (শ্রবণশক্তিহীন) প্রভৃতি বিকলেন্দ্রিয় ব্যক্তিরা কেউই পৈত্রিক ধনসম্পত্তির অংশিদার হবে না।
* বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রের রচয়িতারা উত্তরাধীকার প্রশ্নে নারীদের ক্ষেত্রেও প্রায় একই দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়ে গেছেন। নারীরাও হিন্দু আইনের দৃষ্টিতে পাগল, প্রতিবন্ধী, মুক, বধীর ও কুষ্ঠরোগীর সমতুল্য। নারীদের অধিকার অস্বীকার করে মনুসংহিতার মনু বলছেন,

অস্বতন্ত্রাঃ স্ত্রিয়ঃ কার্য্যাঃ পুরুষৈঃ স্বৈর্দ্দিবানিশম্
বিষয়েষু চ সজ্জন্ত্যঃ সংস্থাপ্যা আত্মনো বশে॥

অর্থ: স্ত্রীলোকদের স্বামী প্রমুখ ব্যক্তিরা দিনরাত পরাধীন রাখবেন, নিজেদের বশে রাখবেন।
নারীদের রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্ব পুরুষের উপর অর্পণ করে তিনি বলছেন,

পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে
রক্ষতি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি॥

পন্ডিতপ্রবর মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের পদ্যে এর বাংলা হল,
“জনক করিবে রক্ষণ শৈশব যখন,
যৌবনে রক্ষিবে পতি করিয়া যতন ;
বৃদ্ধকালে রক্ষা তারে করিবে তনয়,
স্বাধীনতা অবলারে দেওয়া ভাল নয়।”
* আমি এখানে হাতে গোনা কয়েকটি বাণী’র উদ্ধৃতি দিলাম। এরকম শত শত শাস্ত্রবাণী আছে। দুর্ভাগ্য যে, শূদ্রের সঙ্গে এসব শাস্ত্রবানী নিয়ে বিচার করতেও শাস্ত্রে নিষেধ আছে। এ শাস্ত্রের কথা, আমার কথা নয়। এর বিপরীতে সনাতন ধর্মে উদার মানবতাবাদও আছে এবং শুধুমাত্র শাস্ত্রের উপর নির্ভর না করে বিবেকের বাণী অনুসরণের নির্দেশও আছে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় নির্দেশ পরিহার করার পরামর্শও শাস্ত্রেই আছে। অতএব এরপর আপনার মতামত কি হবে তা আপনার বিবেচনা। 

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ