বর্ণবৈষম্য চাই না, তবে লিঙ্গবৈষম্য চাই! [পর্ব-২]

পুলক ঘটক
আজ বর্ণবাদ প্রসঙ্গে সনাতন ধর্মের অতি আদরনীয় গ্রন্থ গীতার দৃষ্টিভঙ্গির উপর সামান্য আলোকপাত করতে চাই। গীতার একটি শ্লোককে বংশগত বর্ণ বা জাতপাত পরিচয়ের বিরুদ্ধে মোক্ষম যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়। চতুর্থ অধ্যায়ের ১৩ নম্বর শ্লোক, যাতে বলা হচ্ছে,

চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্।।
গীতা ৪/১৩

অর্থ: আমি গুণ ও কর্ম অনুসারে চারটি বর্ণ সৃষ্টি করেছি । আমি এর স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে। 
মুশকিল হল, সমাজে বর্ণ বিভেদ মানুষের সৃষ্টি বললে তা নিরসনের জন্য যুক্তি দেখানো সহজ হয়। কিন্তু স্বয়ং ভগবান যদি বলেন, ”এটা আমি সৃষ্টি করেছি,” তখন তা মোচন করা আরও দুরূহ হয়। এখানে ভগবানের দুইটি স্বরূপের কথা বলা হয়েছে; এক স্বরূপে তিনি এর কর্তা এবং আরেক স্বরূপে তিনি সবকিছুর অকর্তা এবং অব্যয়। শ্লোকটির ব্যাখ্যায় আসলে অনেক কিছু বলার আছে। 
এখানে যেসব “গুণ এবং কর্ম অনুসারে” বর্ণ বিভাগের কথা তিনি বলছেন সেই “গুণ এবং কর্ম” মানুষের মধ্যে কিভাবে আসে? এই গুণ ও কর্মগুলো কি ভগবান নিজে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি বা আরোপ করে দেন? নাকি এই গুণ ও কর্ম স্বয়ম্ভু এবং ঈশ্বর থেকে স্বতন্ত্র সত্তা? নাকি এই গুণ ও কর্ম ব্যক্তি মানুষের নিজেদের অর্জন। গীতার মতে এগুলো কি দৈহিক গুণ। এ কি জিনগতভাবে আসে? নাকি এসব আত্মিক গুণ? আত্মা বিভিন্ন দেহে জন্মলাভের সময় সঙ্গে করে এই গুণগুলো কি নিয়ে আসে? কি বলছে গীতা? গীতা জন্মান্তরবাদ স্বীকার করে কি-না? আত্মার উন্নতি এবং উন্নত যোনিপ্রাপ্তি এবং অধোগতি বা নিম্নযোনিতে জন্মলাভের তত্ত্ব গীতায় আছে কিনা? ভাল কর্মের ফলে উন্নত যোনিতে জন্মলাভ এবং খারাপ কর্মের ফলে পাপযোনিতে জন্মলাভের কথা গীতা বলেছে কিনা?
আসুন, বিষয়টি যাচাই করার জন্য গীতার শুরু থেকে একদফা চোখ বুলিয়ে আসি। গীতা আসলে কি? মহাভারতের ৭০০টি শ্লোকের নাম গীতা। গীতা ধর্মশাস্ত্র, কিন্তু মহাভারত কি ধর্মশাস্ত্র নয়? তাহলে মহাভারতে কি আছে? গোটা মহাভারতে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের বিচরণ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় তিনি যে কথাগুলো বলেছেন প্রায় হুবহু একই কথা অন্য জায়গাতেও বলেছেন। যে বর্ণাশ্রম ধর্মের রক্ষক হিসেবে কৃষ্ণের আবির্ভাব, সেই বর্ণাশ্রমের রূপরেখা মহাভারতের বিভিন্ন আখ্যায়িকায় আছে।
পুরো মহাভারত নয়, আপাতত শুধু ঐ ৭০০ শ্লোকের ফাঁকে ফাঁকে দৃষ্টিপাত করি। অর্জুন তখন বিষাদগ্রস্ত, যার প্রেক্ষিত বর্ণনায় পুরো একটি অধ্যায় চলে গেছে, কিন্তু কৃষ্ণ তখন পর্যন্ত একটি কথাও বলেননি। তিনি মুখ খুললেন দ্বিতীয় অধ্যায়ের দ্বিতীয় শ্লোকে। ভগবান স্বরূপে গীতায় শ্রী কৃষ্ণের প্রথম বাক্যটিই হল,

কুতস্ত্বা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম্ ।
অনার্যজুষ্টমস্বর্গ্যমকীর্তিকরমর্জুন॥
গীতা ২/২

তিনি অর্জুনকে ”অনার্য” আচরণের জন্য ভর্ৎসনা দিয়ে শুরু করলেন। ‘আর্য’ প্রশংসাবাচক, আর এখানে ‘অনার্য“ নিন্দাবাচক শব্দ। তবে এখানে ব্যক্তির বা মানুষের এই জাতিগত পরিচয়টি বর্ণগত নয়। আর্য, অনার্য, দ্রাবিড় ইত্যাদি পরিচয়ে মানুষকে মহিমান্বিত বা নিন্দিত করার পক্ষে বিপক্ষে অনেক ক্ষুরধার শানিত যুক্তি থাকতে পারে। জাতিবাদী শব্দ দিয়ে বাক্য শুরু হলেও ভগবানের উদ্দেশ্য তার চেয়ে উন্নততর আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা, সন্দেহ নেই। এ প্রসঙ্গ বিস্তারে যাই না। চলুন শুনি এর পরের বাক্যে তিনি কি বলছেন?

ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতত্ত্বয্যুপপদ্যতে।

অর্থ: ”হে পার্থ ! ক্লীব হয়ো না৷ এ তোমার সাজে না।”
দ্বিতীয় বাক্যে ভর্ৎসনাটি সরাসরি লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে। এখানে ‘ক্লীব’ নিন্দাবাচক।
এরপর ৬টি শ্লোকে ভগবানের বাণী নেই। অর্জুন কিভাবে ভীস্ম, দ্রোনাচার্যসহ গুরুজন ও আত্মীয়দের হত্যা করবেন ইত্যাদি কথা আছে। ভগবান তখন তাকে আত্মতত্ত্ব বোঝাতে শুরু করেন। তাতে বর্ণাশ্রম নির্ধারক কর্তব্যবাদী ধর্মের কথা নেই। ভগবানের মুখ থেকে বর্ণবাদসূচক প্রথম শব্দটি এসেছে দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৩১ নম্বর শ্লোকে। এখানে এসে তিনি অর্জুনকে “ক্ষত্রিয়” হিসেবে তার “স্বধর্ম” কি, তা স্মরণ করিয়ে দেন।

স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি।
ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োহন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে॥
গীতা ২/৩১॥

অর্থ: “‘স্বধর্ম’ বিবেচনা করলেও তোমার দ্বিধাগ্রস্থ হওয়া উচিত নয়। কারণ ধর্ম রক্ষার্থে যুদ্ধ করার চেয়ে ‘ক্ষত্রিয়ের’ পক্ষে মঙ্গলকর আর কিছুই নেই।”
এখানে প্রাসঙ্গিক আরেকটি বিষয় আনতে হচ্ছে। আমাদের মহা পণ্ডিতেরা মাঝে মাঝেই গীতার একটি শ্লোক আওরিয়ে “স্বধর্মের” যে মানে তৈরি করেন তাতে মনে হয়, গীতার যুগে সনাতন ধর্ম ছাড়াও ইসলাম, খ্রিস্টান, ইহুদি ইত্যাদি ধর্ম ছিল। তারা গীতার ঐ বাক্য দেখিয়ে অন্য ধর্মগুলোর স্বীকৃতি দেন। আসলে গীতায় ঐ ধর্মগুলো সম্পর্কে ইঙ্গিতেও কিছু বলা হয়নি। গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের ৩৫ নম্বর শ্লোকে ‘স্বধর্ম’ বলতে প্রত্যেকের নিজ নিজ বর্ণ ও আশ্রম ধর্মের কথা বলা হয়েছে।

শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ।।
গীতা ৩/৩৫।।

অর্থ: “স্বধর্মের অনুষ্ঠান দোষযুক্ত হলেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম থেকে উৎকৃষ্ট। স্বধর্ম সাধনে যদি মৃত্যু হয়, তাও মঙ্গলজনক, কিন্তু অন্যের ধর্মের অনুষ্ঠান করা বিপজ্জনক।
গীতায় ‘ক্ষত্রিয়’ হিসেবে অর্জুনের ‘স্বধর্ম’ বারবার মনে করে দেয়া হয়েছে। এটা বর্ণধর্ম। এই বর্ণধর্ম অর্জুন কিভাবে পেয়েছেন? বংশ পরম্পরায় অর্থাৎ জন্মসূত্রে কিনা? অর্জুন স্বভাবগত বীর বটে। কিন্তু তাকে শৈশব থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বীর হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল; কারণ তিনি ক্ষত্রিয় সন্তান।
মহাভারতেই একলব্য একজন সহজাত বীর ছিলেন। কিন্তু জন্ম পরিচয়ে অন্তজ হওয়ায় তাকে ক্ষত্রিয় হিসেবে মানা হয়নি। কর্ণ স্বভাবে এবং জন্মগতভাবেও ক্ষত্রিয়। কিন্তু ধীবরের পরিচয়ে মানুষ হওয়ায় তার ক্ষত্রিয়ত্ব নিয়ে জীবনভর সংকট! শ্রীকৃষ্ণের উপস্থিতিতেই দ্রৌপদির স্বয়ংবর সভায় তাঁকে লক্ষ্যভেদ করতে দেয়া হয়নি। 

অন্যান্য শাস্ত্রে কি আছে পড়ুন প্রথম পর্বে 

আসলে মহাভারত তথা গীতা ছাড়াও সকল শাস্ত্রে এই বর্ণবাদী ধর্মব্যবস্থা নির্ধারণ করে দেয়া আছে এবং গীতার মতোই ‘স্বধর্ম’ শব্দটি অন্যান্য শাস্ত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। অত্রি সংহিতায় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের স্বধর্ম বিস্তারিতভাবে নির্ধারণ করার পর বলা হচ্ছে,

যে ত্যক্তারং: স্বধর্ম্মস্য পরধর্ম্মে ব্যবস্থিতাঃ।
তেষাং শাস্তিকরো রাজা স্বর্গলোকে মহীয়তে।।
শ্লোক ১৭, অত্রি সংহিতা

অর্থ: “যাহারা স্বধর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া অন্য ধর্ম্ম আশ্রয় করে, নরপতি তাহাদিগকে শাস্তিদান করিয়া স্বর্গভাগী হন।”
নিজ জন্মগত বর্ণের যে ধর্ম তা ত্যাগ করে অন্য বর্ণের মানুষের ধর্ম গ্রহণ করাকে নিজের বউ কুৎসিত হওয়ায় তাকে ত্যাগ করে পরের সুন্দরী বউকে গ্রহণ করার সমতুল্য অপরাধ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

আত্মীয়ে সংস্থিতো ধর্ম্মে শূদ্রোহপি স্বর্গমশ্নুতে।
পরধর্ম্মো ভবেত্ত্যাজ্যঃ সুরূপপরদারবৎ।।
শ্লোক ১৮, অত্রি সংহিতা

অর্থ: “স্বধর্ম্মে থাকিলে শূদ্রও স্বর্গলাভ করে। পরধ্ম্ম সুন্দরী পরস্ত্রীর ন্যায় সর্বোতভাবে ত্যাজ্য।”
অত্রি সংহিতায় এর পরের শ্লোকে চরম বিধান দেওয়া হয়েছে। শূদ্র যদি জপ, হোম, দেব আরাধনা ইত্যাদি উচ্চ বর্ণের কর্ম করে তাহলে রাজা তাকে হত্যা করবে বলে নির্দেশ আছে।

বধৌ রাজ্ঞা স বৈ শুদ্রো জপহোমপরশ্চ যঃ।
ততো রাষ্ট্রস্য হন্তাসৌ যথা বহ্নেশ্চ বৈ জলম্।।
শ্লোক ১৯, অত্রি সংহিতা

অর্থ: “জপ হোম প্রভৃতি দ্বিজোচিত কর্ম্ম-নিরত শূদ্রকে রাজা বধ করিবেন। কারণ জলধারা যেরুপ অনলকে বিনষ্ট করে, সেইরূপ ঐ জপহোম তৎপর শূদ্র, সমস্ত রাজ্যকে বিনষ্ট করে।
একারণেই আমরা রামায়নে দেখতে পাই শম্বুক নামের এক ব্যক্তি শূদ্র হওয়া সত্ত্বেও তপস্যা করার “অপরাধে” রাজা শ্রী রাম নিজহাতে তাকে দন্ড দেন। তরবারির কোপে শম্বুকের ঘাড় থেকে মাথা নামিয়ে দিয়ে ভগবান শ্রীরাম বর্ণধর্ম রক্ষা করেছিলেন। 

অন্যান্য শাস্ত্রে কি আছে পড়ুন প্রথম পর্বে  

 

আবার আসছি গীতার কথায়। রাজর্ষী অর্জুন, যাকে ভগবান স্বয়ং গীতা জ্ঞান প্রদান করেছিলেন, তিনি নিশ্চয় আপনার-আমার চেয়ে অনেক বেশি প্রাজ্ঞ। শাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৩৭ থেকে ৪৩ নম্বর শ্লোক পর্যন্ত শুধু সনাতন জাতিধর্ম, বর্ণধর্ম ও কূলধর্ম রক্ষার কথাই বলেছেন। বর্ণসংকর (মিশ্র বর্ণ) উৎপাদন হলে ধর্মনাশ হয় বলেছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার সেই বক্তব্য খণ্ডন করেননি। বর্ণসংকর তত্ত্ব গ্রহণ করেই তিনি অর্জুনকে দেহের অনিত্যতা এবং আত্মতত্ত্ব বুঝিয়েছেন। 

তাহলে ভগবান আবার কেন বলছেন, “আমি গুণ ও কর্ম অনুসারে” চার বর্ণ সৃষ্টি করেছি। সংকর বর্ণের মানুষ জন্ম নিলে সেই মানুষের কি গুণ ও কর্ম থাকবে না? তবে গীতাতেই কৃষ্ণের আরেকটি আগ্রহোদ্দীপক বক্তব্যের দিকে দৃষ্টি দেই।

মাং হি পার্থ ব্যপাশ্রিতা যহপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ।
স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেহপি যান্তি পরাং গতিম্।। ৯/৩২।।

অর্থ: “হে পার্থ, স্ত্রীলোক, বৈশ্য ও শূদ্র অথবা যাঁহারা পাপযোনিসম্ভুত (পাপিষ্ঠজন্মা) অন্ত্যজ জাতি, তাঁহারাও আমার আশ্রয় লইলে নিশ্চয়ই পরমগতি প্রাপ্ত হন।
এখানে ‘পাপযোনি’ শব্দটির ব্যবহার খেয়াল করুন। পাপযোনি কি জিনিস দাদা? মানুষ কিভাবে পাপযোনি সম্ভূত হয়? আপনার জন্ম কি পাপযোনিতে? একবার ব্যাপারটা ভাবুন তো! সে না হয় থাক। লক্ষ করুন স্ত্রী, বৈশ্য ও শূদ্র এবং পাপযোনিতে জন্মারা এখানে এক শ্রেণীতে আছে। ‘তাঁহারাও”’ শব্দটির দিকে খেয়াল করুন। এখানে ‘তাঁহারা’র শেষে ‘ও’ যুক্ত আছে। অর্থাৎ তারা জন্মসূত্রে নিম্নবর্ণের ‘হলেও’ ভগবানের স্মরণ নিলে পরমগতি পেতে পারে।
কি দাদা? গীতায় জন্মসূত্রে বর্ণবিভাগের কথা বুঝতে কি কষ্ট হয়? ব্রাহ্মণের সঙ্গে এই পাপযোনির মানুষদের বিষয়টি আলাদাভাবে কেন বলতে হচ্ছে? তাহলে পরের শ্লোকটির দিকে তাকান। সেখানে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মতো উচ্চ বর্ণের সৌভাগ্যের কথা বলা আছে। ভগবান বলছেন,

কিং পুনব্রাহ্মণাঃ পুন্যা ভক্তা রাজর্ষয়স্তথা।
অনিত্যমসূখং লোকমিমং প্রাপ্য ভজস্ব মাম্।। ৯/৩৩।।

অর্থ: “পূণ্যশীল ব্রাহ্মণ ও রাজর্ষিগণ যে পরম গতি লাভ করিবেন তাহাতে আর কথা কি আছে? অতএব তুমি আমার আরাধনা কর। কারণ এই মর্ত্যলোক অনিত্য এবং সুখশূন্য।”
দাদা-দিদিরা, তফাৎ কিছু কি বোঝা যায়? এই লাইনে পূণ্যবান ব্রাহ্মণ এবং তার সাথে রাজা (ক্ষত্রিয়) আছে। কৃষ্ণ বলছেন, যেখানে শূদ্র, নারী এবং পাপযোনির লোকেরা পরমগতি পাবে; সেখানে উন্নত যোনির ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের কথা বলার অপেক্ষাই রাখে না। কারণ তারা উচ্চ! 

আসলে গীতায় জন্মান্তরবাদ এবং ভাল কর্মের কারণে উন্নত যোনিতে জন্ম হয় – এরকম বার্তা বিভিন্ন শ্লোকে বলা হয়েছে। যেমন ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের (ধ্যানযোগে) অর্জুন যখন যোগভ্রষ্ট ব্যক্তিদের পরিণতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছেন, তখন ভগবান তাকে বলছেন, পূণ্যকর্ম কখনো বিফলে যায় না। এর ফলে ব্যক্তি মৃত্যুর পর দুর্লভ কূলে জন্ম লাভের সুযোগ পায় এবং তার পূর্বজন্মের অভ্যাস যায় না।

প্রাপ্য পুণ্যকৃতাং লোকানুষিত্বা শাশ্বতীঃ সমাঃ ।
শুচীনাং শ্রীমতাং গেহে য়োগভ্রষ্টোঽভিজায়তে ॥ ৬/৪১॥
অথবা য়োগিনামেব কুলে ভবতি ধীমতাম্ ।
এতদ্ধি দুর্লভতরং লোকে জন্ম য়দীদৃশম্ ॥ ৬/৪২॥

গীতায় তথা মহাভারতে এবং অন্যান্য সকল শাস্ত্রে পূর্বজন্মের কর্মের ফলেই বিভিন্ন উচু বা নিচু বর্ণে মানুষ জন্ম নেয় বলা হয়েছে। এখন আপনি তা সত্য বলে মানবেন কি মানবেন না তা আপনার বিষয়। 

আপনারা কেউ দয়া করে ভাববেন না, আমি ব্রাহ্মণ সন্তান হওয়ার কারণে নিজের উচ্চবর্ণের গরিমা বজায় রাখার জন্য বংশগত জাত/বর্ণ পরিচয়ের পক্ষে বলছি। মোটেই তা নয়। বাল্যকালে আমি অত্যন্ত আচারনিষ্ঠ একদম “ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্রাহ্মণ” ছিলাম -একথা স্বীকার করি। সঙ্গে একথাও স্বীকার করি, সময়ের সঙ্গে আমার চিন্তাচেতনা ও দর্শন পাল্টে গেছে। আমি এখন অকুন্ঠে বলছি, হিন্দু সমাজের আজকের দুর্দশার সবচেয়ে বড় কারণ এই বর্ণবাদ তথা জাতপাত বিভেদ। সমাজের অধোগামিতার তার চেয়েও বড় কারণ লিঙ্গভেদে নারীকে পিছিয়ে রাখা। আমি লিঙ্গবৈষম্য এবং বর্ণবৈষম্য বিলোপের পক্ষে। কিন্তু ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কে মিথ্যা কথা বললেই কি এসব নিরসন করা যাবে? সত্যাশ্রয়ী হন দাদারা; সত্য ভাবতে এবং সত্য বলতে শিখুন।
শাস্ত্রবাণীর সমালোচনা করলেও দোষ; বলবেন, আমি নাস্তিক হয়ে গেছি। আবার যদি বর্ণধর্মকে সঠিক অর্থে মেনে নেই, তখন বলবেন আমি ব্রাহ্মণ্যবাদী বা বর্ণবাদী। যা ইচ্ছে বলুন, তার আগে শাস্ত্রের ভাল পাঠক হওয়ার চেষ্টা করুন। নিবিড় পাঠক হলে একটি শাস্ত্র থেকে তৎকালীন ইতিহাস, ভুগোল, প্রত্নসূত্র ইত্যাদি অনেককিছু পাবেন।
গড়ুর পুরাণ পড়েছেন? এর দ্বিতীয় পর্ব পুরোটাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী। সেখানে বিষ্ণুর বাহন গরুড় পাখি গোটা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড ঘুরে এসে বলছেন, তিনি সর্বত্র শুধু দু:খ ও হাহাকার দেখেছেন। তিনি গোটা পৃথিবী ঘুরেছেন কিন্তু সেখানে আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া বা আফ্রিকার কোনো দেশের বর্ণনা পেয়েছেন কি? বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বলতে কেবল ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গার বর্ণনা কেন?
গীতায়ও তো ভুগোল আছে। সেখানে হিমালয় পর্বতমালা আছে, কিন্তু ইউরোপের আল্পস পর্বতমালা নেই কেন? বেদ পুরাণসহ ভারতীয় সকল শাস্ত্রে তৎকালীন ভুগোল পাবেন। প্রিয় পাঠক, শাস্ত্র বুঝতে হলে দৃষ্টিশক্তি উপযুক্ত হতে হয়।
আমি আনুপূর্বিক শাস্ত্র মানি কিনা – এই তো আপনার জিজ্ঞাসা? তার আগে আপনাকে জিজ্ঞেস করি, আপনি কি ধর্ম এবং শাস্ত্র আনুপূর্বিক মানেন? গত পর্বে উল্লেখিত শাস্ত্রবাক্যটি এখানে আবার বলছি। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?

কপিলাক্ষীরপানেন ব্রাহ্মণীগমনেন চ।
বেদাক্ষরবিচারেণ শূদ্রস্য নরকং ধ্রুবম্।।
১/৬৪ পরাশর সংহিতা

অর্থ: “কপিলা গাভীর দুগ্ধ পান, ব্রাহ্মণীগমন এবং বেদাক্ষর বিচার এই কার্য্যে শূদ্র নিশ্চয়ই নরকগামী হইবে।
উল্লেখ্য, কপিলা সবচেয়ে উন্নত জাতের গাভী। শুধুমাত্র শাস্ত্রপাঠ নিষিদ্ধ করা নয়, শূদ্রদের সেই পরম উপাদেয় গাভীর দুধ পান করতেও নিষেধ করা হয়েছে। এবার আরেকটি শাস্ত্রবাণী শোনাই। এটা হয়তো আপনার ভাল লাগবে।

তীর্থস্নানার্থিনী নারী পতিপাদোদকং পিবেৎ।
শঙ্করস্ব্যাপিবিষ্ণো্র্ব্বা প্রয়াতি পরমং পদম।।
শ্লোক ১৩৭, অত্রি সংহিতা

অর্থ: “নারী তীর্থস্নান-অভিলাষিণী হইলে স্বামী, শিব বা বিষ্ণুর পাদোদক পান করিবে; ইহাতে পরম স্থান লাভ করিবে।”
কি দাদা, এই শ্লোকটি ভাল লাগছে? এখানে তীর্থ করার পরিবর্তে নারীকে স্বামীর পা ধোয়া জল পান করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। স্বামীকে শিব এবং বিষ্ণুর সমতুল্য করে দেখানো হয়েছে।
শাস্ত্র যখন আপনাকে ব্রাহ্মণের পা ধোয়া জল খাওয়ার পরামর্শ দেয়, সেই পরামর্শ ভাল লাগে না। কিন্তু শাস্ত্র যখন আপনার স্ত্রীকে স্বামীর পা ধোয়া জল খেতে পরামর্শ দেয় সেটা আপনার ভাল লাগে! আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি ভন্ড ও কপট হবেন, নাকি অন্তরে বাইরে সত্যিকারের মানুষ হবেন। যারা বর্ণবৈষম্য বিলোপ চায়, কিন্তু লিঙ্গবৈষম্য বহাল রাখতে চায় তাদের কি বলবেন?
উপরোক্ত বিভেদবাদী প্রয়োগের বাইরেও উন্নততর সাম্যবাদী ধারণা আমাদের ধর্মশাস্ত্রেই আছে। বেদ, পুরাণ, গীতা সব জায়গায় উচ্চতম মহত্তের আহ্বান আছে। ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান, “ব্রহ্ম হতে কীট পরমাণু, সর্বভূতে সেই প্রেমময়”- এ বাণী আছে। তাতে উচু-নিচুর ভেদ নেই। আমি তাতে বিশ্বাস করি। পরবর্তী আরেক পর্বে ব্যাখ্যা করব। ওঁ শুভমস্তু। 

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ