হিন্দু আইনের কোথাও গীতা অথবা বেদের বাণী নেই। এ আইনের বড় অংশ যেসব শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে, সেখান থেকে মুনি ঋষিদের কিছু মৌলিক মতামত সংক্ষেপে বলছি।
- শূদ্র, অন্তজ, চণ্ডাল ইত্যাদি পাপযোনির মানুষেরা কুকুর, শৃগালের চেয়ে বা বিভিন্ন প্রাণির বমি-বিষ্ঠার চেয়ে ঘৃণিত ও অধম।
- মরা কুকুর কিংবা বিষ্ঠার ছোঁয়ায় সহজে শুদ্ধি; কিন্তু চন্ডালে ছুঁলে শুদ্ধ হওয়া কঠিন।
- শূদ্রের বেদপাঠ ও যাগযজ্ঞে অধিকার নেই; এমন কি উন্নত জাতের গাভীর দুধ পানেরও অধিকার নেই।
- শূদ্ররা উচ্চ বর্ণের দাস, তারা নেতা হতে পারে না।
- কোনো শূদ্র এ নিয়ম ভঙ্গ করলে রাজা তাকে প্রাণদন্ড দিবেন। এ শাস্ত্রের বিধান; ধর্মীয় আইন। তাই শ্রী রাম নিজ হাতে শূদ্র তপস্বী শম্বুকের মস্তক ছেদন করেছিলেন।
যারা ধর্মীয় আইনের কথা বলে হিন্দু নারীদের অধিকার হরণ করে পুরুষের অধিনস্ত রাখতে চায় তাদের এসব বিধান অবশ্যই মানা উচিত। শূদ্রবংশজাত কয়েকজন নেতা এবং তাদের অনুসারিরা এসব শাস্ত্রবিধি না মেনে ঘোরতর অপরাধ করছেন। শাস্ত্রীয় বিধানে এর পরিণতি ভগবান শ্রী রাম নিজ হাতে প্রয়োগ করে দেখিয়ে গেছেন। তারা স্বধর্ম (নিজ বর্ণবিহিত ধর্ম) পালন করলে নারীদের ব্যাপারে বলতেই পারেন না।
এই শাস্ত্রীয় বিধানের অমর্যাদা করা মানে ধর্মের অমর্যাদা এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত। এর বিরুদ্ধে গালি দেওয়া মানে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ, শ্রী রাম, মহর্ষি বেদব্যাস, পরাশর, বৃহস্পতি, অত্রি, নারদসহ সকল শ্রেষ্ঠ মুনি ঋষিকে গালি দেওয়া। আশা করি কোনো হিন্দুর সন্তান এরকম কাজ করবেন না। তবে কেউ যদি প্রমাণ করতে পারেন আমি শাস্ত্রের বাইরে অতিরঞ্জিত একটা কথাও বলেছি –তবে শপথ করে বলছি, আমি হিন্দু আইন সংস্কার আন্দোলন ছেড়ে দেব। আমি প্রমাণ দিতে পারলে পাল-প্রামাণিক-বিশ্বাস বাবুদের নারীবিরোধী অন্যায় প্রপাগাণ্ডা বন্ধ করতে হবে। আমার সঙ্গে লাইভে এসে বিতর্ক করার চ্যালেঞ্জ নিন।
প্রিয় দাদারা,
আপনারা কি শাস্ত্রগন্থ এবং মুনি ঋষিদের মানেন? তবে উপরের চিত্রে প্রদর্শিত শাস্ত্র বাক্যটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত কি? কপিলা গাভী হল সবচেয়ে উন্নত জাতের গাভী। শুধুমাত্র শাস্ত্রপাঠ নিষিদ্ধ করা নয়, শূদ্রদের সেই পরম উপাদেয় গাভীর দুধ পান করতেও নিষেধ করা হয়েছে।
এবার আরেকটি শাস্ত্রবাণী শোনাই। এটা হয়তো আপনাদের ভাল লাগবে।
তীর্থস্নানার্থিনী নারী পতিপাদোদকং পিবেৎ।
শঙ্করস্ব্যাপিবিষ্ণো্র্ব্বা প্রয়াতি পরমং পদম।।
[শ্লোক ১৩৭, অত্রি সংহিতা]
অর্থ: নারী তীর্থস্নান-অভিলাষিণী হইলে স্বামী, শিব বা বিষ্ণুর পাদোদক পান করিবে; ইহাতে পরম স্থান লাভ করিবে।
কি দাদা, এই শ্লোকটি ভাল লাগছে? এখানে তীর্থ করার পরিবর্তে নারীকে স্বামীর পা ধোয়া জল পান করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। স্বামীকে শিব এবং বিষ্ণুর সমতুল্য করে দেখানো হয়েছে। শাস্ত্র যখন আপনাকে ব্রাহ্মণের পা ধোয়া জল খাওয়ার পরামর্শ দেয়, সেই পরামর্শ ভাল লাগে না। কিন্তু শাস্ত্র যখন আপনার স্ত্রীকে স্বামীর পা ধোয়া জল খেতে পরামর্শ দেয় সেটা আপনার ভাল লাগে। আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি ভন্ড ও কপট হবেন, নাকি অন্তরে বাইরে সত্যিকারের মানুষ হবেন।
ক্ষমাপ্রার্থী: উপরের কথাগুলি সভ্যজনের কাছে কটু লাগবে। কিন্তু এর সবটাই যে শাস্ত্রবাণী! ‘শূদ্র,’ ‘চন্ডাল’, ‘অন্তজ’, ‘পাপযোনি’ ইত্যাদি শব্দকে আমরা সভ্য দুনিয়ার মানুষ আজ রেসিস্ট ও অপরাধমূলক মনে করি। নারী এবং লিঙ্গবৈচিত্রময় জনগোষ্ঠীর প্রতি নিন্দাবাচক শব্দগুলিও সভ্য পৃথিবীতে অগ্রহণযোগ্য। অথচ এসব শব্দ শাস্ত্রে বহুল ব্যবহৃত। একাডেমিক আলোচনায় এবং জ্ঞানবিস্তারে এসব ঢেকে রাখার উপায় নেই। সত্য আড়াল করে সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। তবুও এসব বলে মানুষকে কষ্ট দেওয়ায় নিজ অন্তরের বেদনাবোধ থেকে সভ্যজনের কাছে সবিনয়ে মার্জনা চাই। কাউকে কষ্ট দিতে চাই না, মানুষকে জাগাতে চাই।
“সত্যমেব জয়তে”।
[লেখক: সাংবাদিক; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ।]