পুরুষদের ধর্মত্যাগ নিয়ে হিন্দুত্ববাদী নিশ্চুপ কেন?

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের প্রেম কুমার দাস দুই বছর আগে ধর্মত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেন। তার নাম হয় মো. ইব্রাহিম। এরপর গত ৭ আগস্ট সোমবার সেই প্রেম কুমার ওরফে ইব্রাহিমের হাত ধরে তার ৭-সদস্যের পরিবারের সবাই ধর্মান্তরিত হয়েছে।
এর এক সপ্তাহ আগে গত ৩১ জুলাই মেহেরপুর সদর উপজেলার চাঁদবিল গ্রামের বুদু দাস তার পরিবারের পাঁচ সদস্যকে নিয়ে ধর্মান্তরিত হন। মিডিয়ায় প্রকাশিত বুদু দাসের বয়ান অনুযায়ী তিনি প্রায় দুই বছরের চেষ্টায় অনেক কষ্টে তার স্ত্রী-সন্তানদের ইসলাম গ্রহণে রাজি করিয়েছেন।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে এই দুটি ঘটনা মিডিয়ায় এসেছে। এরকম ঘটনা অনেক। গত চার-পাঁচ বছরে পুরুষ লোকের হাত ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক পরিবার ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু মেয়েমানুষের হাত ধরে গোটা পরিবার ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনা একটিও আছে কিনা সন্দেহ।
ইদানিং ঘটনগুলো মিডিয়ায় বেশি আসছে, আগেকার যুগে ধর্মান্তরের ঘটনা মিডিয়ায় আসত না। অতীতে দলে দলে ধর্মত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। সব ঘটেছে পুরুষলোকদের নেতৃত্বে। এর মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের নির্মম বর্ণবৈষম্যের শিকার শূদ্র, দলিত ও অচ্ছুত জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য রয়েছে।
উচ্চবর্ণীয় সুবিধাভোগী একটি শ্রেণিও এই দলে রয়েছে –যারা মুসলিম নবাব ও প্রশাসনের আনুকূল্য লাভ, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক সুবিধা, সমাজচ্যুত হওয়া ইত্যাদি নানা কারণে সে যুগে ধর্মত্যাগী হয়েছে। এভাবেই বাংলাদেশে মুসলমান ও খ্রিস্টান সম্প্রদায় তৈরি হয়েছে এবং কালক্রমে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছে।
তবে বর্তমানের বাংলাদেশ ভুখন্ডে হিন্দুদের প্রান্তিক সংখ্যালঘুতে (৯%) পরিণত হওয়ার পেছনে ধর্মান্তর একমাত্র কারণ নয়। বরং গণহারে দেশত্যাগই এর প্রধান কারণ। জন্মহারও একটি বিষয়। সাতশো বছর আগে এদেশে মুসলমান বা খ্রিস্টান ছিল না। হিন্দু+বৌদ্ধ+আদিবাসী লোকধর্ম ও লোকবিশ্বাসের অনুসারী জনজাতি ছিল ১০০%। সেকাল থেকে আজ পর্যন্ত যে ক্ষয়, এর সবটাই কিন্তু হয়েছে পুরুষদের মাধ্যমে।
নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভিকটিম। হিন্দুরা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব হারিয়ে দুর্বল হওযার ক্ষেত্রেও পুরুষদেরই অবদান। হিন্দু পুরুষতন্ত্র তথা পুরুষরা সামগ্রিক অর্থে ফেল করেছে। অথচ ধর্মান্তরের অভিযোগ দিয়ে নারীদের অধিকার হরণ করার বাণী এখনো দিয়ে যাচ্ছে একটি স্বার্থান্বেষী দুষ্টচক্র।
বাংলাদেশে মেয়েদের ধর্মান্তরিত হওয়ার যত ঘটনা আছে তার ৯৯% প্রেমঘটিত। এই ঘটনাগুলো সাধারণত ঘটে মেয়েদের ১৪ বছর থেকে ২৫ বছর বয়সের মধ্যে। আমাদের ছোটন সুশীল দাদা একটি বাস্তব কথা লিখেছেন। রেকর্ড অনুযায়ী পুরুষদের ধর্মান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা ১৪ বছর থেকে শুরু হয়ে তাদের শেষ বয়স পর্যন্ত থাকে। পুরুষদের পরকীয়া এবং দ্বিতীয় বিবাহের সম্ভাবনা ৮৫ বছর বয়সেও শেষ হয় না। পুরুষ-কর্তৃত্বের সমাজ হওয়ার কারণে পুরুষরা যে কোনো বয়সে বিবাহ এবং ধর্মান্তরের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সঙ্গে তারা তাদের পরিবরকেও ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করে। কারণ পুরো পরিবার অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্তিকভাবে পুরুষের উপর নির্ভরশীল থাকে।
মেয়েরা পৈত্রিক সম্পত্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমঅধিকার পেলে ধর্মান্তরের হার কমবে। বর্তমানে একটি হিন্দু মেয়ে ধর্মান্তরিত হলে তার হারানোর কিছু থাকে না। কিন্তু নতুন আইন হওয়ার পর ধর্মান্তরিত হলে তাকে অনেক কিছু হারাতে হবে। কারণ আইন সংশোধন করে বাবার সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে মেয়েদেরকে মালিক বানানোর বিধান হচ্ছে না।
আইন সংশোধন হলেও মেয়েরা তাদের টিনেজে পিতা-মাতার উপস্থিতিতে কোন সম্পত্তিরই মালিক হবে না। কারণ ‘উত্তরাধিকার সিস্টেমে’ মানুষ সম্পত্তির অধিকারী হয় পিতা-মাতা মারা যাওয়ার পরে। বাবা যখন বার্ধক্যে ভুগে মারা যাবেন, তখন সেই নারী নিজেও ৫০ থেকে ৬০ বছরের মানুষ। শৈশবে পিতৃহারা হওয়ার ঘটনা ব্যতিক্রম।
তাই নতুন আইনে মেয়েদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার স্বীকার করা হলেও তারা শৈশবকাল থেকেই সম্পত্তির উপর অধিকার পাবে না। সুতরাং ১৪ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে কোন মেয়ে ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনা ঘটলে তার বাবা তাকে নিজ ইচ্ছায় সম্পত্তি লিখে না দিলে অধিকার পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। বরং ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে তাকে অধিকার হারাতে হবে।
সম্পত্তি তথা অর্থনৈতিক সক্ষমতা মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে। এতে তার নিজস্ব কর্তৃত্ব, ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব, পরিচালন ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বিকশিত হয়। নির্ভরশীল মানুষরা আত্মনির্ভর, আত্মবিশ্বাসী ও বিকশিত ব্যক্তিত্বের হয় না। তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ সক্ষমতাও দুর্বল হয়; ফলে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত ও চালিত হয়। এই নির্ভরশীলতার মনস্তত্ত্ব ও আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা থেকে নারীদের বের করে আনতে হবে; মুক্তি দিতে হবে। এতে ধর্মান্তর কমবে। নারীর ক্ষমতায়ন নারীকে তথা হিন্দু জনগোষ্ঠীকে শক্তিশালী করবে।

* পুরুষদের নেতৃত্বে বাংলাদেশে কয়েকশ’ মানুষের ধর্মান্তরিত হওয়ার সংবাদের কিছু লিংক দৃষ্টান্ত হিসেবে এখানে সংযোজন করা হচ্ছে। এই তালিকাটি এক বছর আগের। নতুন যারা ধর্মত্যাগ করেছেন তাদের নাম এখনো যুক্ত করা হয়নি।  

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ